মৃত্যুঘণ্টা – ৭

সাত

তার নাম থিয়োডর এন. মার্ডক। গায়ের রং কালচে, দৈহিক গড়ন বিশাল। চওড়া চোয়াল। ভারী ভুরুর নিচে ডাকাতের মত চোখ। মনে হয় যেন সত্যিকার দানব। দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট, চওড়ায় তেমনই বিশাল। হাতের পাঞ্জা ভালুকের। প্রভুর পর দলের দ্বিতীয় লোক সে। তার দায়িত্বেই আছে একদল খুনি। তাদেরকে বলা হয় ব্লাড ফোর্স। প্রভুর জন্যে মানুষ খুন করতে দেরি করে না তারা। থিয়োডর এন. মার্ডকই প্রভুর হুকুমে পিটিয়ে খুন করেছে চার ফ্রেঞ্চ পুলিশকে।

অন্তর থেকে ভালবাসে প্রভুকে, তার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রভুর নির্দেশ পালন করা।

লে কুখনেইভ, ফ্রান্স।

নির্জন এক বুলেভার্ডে পরিত্যক্ত এক বাসস্টপেজের ছাউনিতে বসে আছে মার্ডক। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে পুরনো জিন্স পরা এক তরুণকে। তার পরনে অপেক্ষাকৃত বড় এক হুডি। হেঁটে আসতে আসতে আবর্জনা ভরা ট্র্যাশ ক্যানে লাথি দিল তরুণ। জং ধরা পুরনো সব গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেল। শেষ রায়টের সময় এসব গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল একদল ক্ষিপ্ত তরুণ।

লে কুখনেইভ হলো প্যারিসের শহরতলী। পশ্চিম ইউরোপের অন্যতম খারাপ বস্তি এলাকা। এখানে জুটেছে গরীব ফ্রেঞ্চ ও আলজিরিয়ানরা। কূপের ভেতরের ব্যাঙের মত গাদাগাদি করে বাস করছে সবাই মিলে। দুর্গন্ধের ভেতর কেটে যাচ্ছে জীবন। কারও কোনও আয়রোজগার নেই বললেই চলে, তাই কোনও আশাও নেই মনে। মরে যেতে পারলে বাঁচবে।

দু’ হাজার পাঁচ সালে এই বস্তি এলাকায় পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মরেছিল দুই তরুণ। মিডিয়া প্রচার করেছিল, রায়ট আরম্ভ হয় জাতিগত লড়াইয়ের কারণে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছিল ভাল করেই জানে মাউক। এই বস্তিতে রয়েছে অনেক জাতের মানুষ, নানান রং তাদের চামড়ার, সবাই থাকে মিলেমিশে। সবার বুকে রাগ ও হতাশা। বড়লোকরা ভুলে গেছে তাদেরকে। সরকারও ঘৃণা করে, মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না ওদের।

বস্তিবাসীরা বলে, নিয়মিত এসে তাদের ওপর নির্যাতন চালায় পুলিশ। ওদিকে পুলিশ বলে, যখন-তখন তাদের ওপর হামলা করে নেশাগ্রস্ত তরুণ ও যুবকরা। এই এলাকাকে ধরে নেয়া হয়েছে রেড যোন হিসেবে। দলেবলে সশস্ত্র হয়ে না এলে কেউ নিরাপদ নয় এখানে।

অবশ্য আপাতত কারও ওপর হামলা করবে না কেউ। দলে দলে এই এলাকায় ঘুরছে পুলিশ বাহিনী। রাস্তার দূরে মার্ডক দেখল, খুব ধীর গতি তুলে আসছে পুলিশের দুটো গাড়ি আর এক আর্মার্ড এসইউভি। এদিকেই পাওয়া গেছে চার পুলিশের লাশ। ভয়ঙ্কর খেপে গেছে পুলিশ বাহিনী। কেউ সামান্য তেড়িবেড়ি করলেই পিটিয়ে আধমরা করে গ্রেফতার করা হবে তাকে।

হেঁটে আসা তরুণকে পাশ কাটিয়ে গেল পুলিশের কনভয়। ওদিকে ভুলেও তাকাল না ছেলেটা। ভাল করেই জানে, চোখ তুলে দেখতে হয় না পুলিশের চোখে। মার্ডকের পাশে এসে থামল সে, বসে পড়ল দাগভরা বেঞ্চিতে।

‘যা করতে বলেছি, করেছ,’ বলল মার্ডক, ‘আমি সেজন্যে খুশি। খুশি হয়েছেন প্রভুও।’

‘লাশগুলো পেয়ে গেছে পুলিশ।’

‘হ্যাঁ,’ বলল মার্ডক। ‘আমরা তা-ই চেয়েছি।’

কথাটা শুনে অসুস্থ বোধ করে শিউরে উঠল তরুণ জুবায়ের। ‘লাশ পেয়ে যাক কেন চাইলেন?’.

প্রশ্নের জবাব দিল না মার্ডক। ‘ওদের জন্যে দুঃখ লাগছে?’

‘ওরা যা করে, সেজন্যে ঘৃণা করি ওদেরকে,’ বলল জুবায়ের।

‘সেক্ষেত্রে বলতে পারো, উচিত শাস্তি পেয়ে গেছে ওরা।’

চেহারা দেখে মনে হলো সায় দেবে জুবায়ের। কিন্তু চোখে এখনও দ্বিধা। জানতে চাইল, ‘এবার কি আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারব?’

‘সব ছেড়ে সরে যেতে পারবে? তুমি কি তৈরি?’

‘আমার আছেই বা কী?’

‘কিছুই নেই?’ জানতে চাইল মাৰ্ডক।

মাথা নাড়ল জুবায়ের। ‘আমার বাবা নেই। ভাই নেই। আমি ফ্রেঞ্চ নাগরিক, কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ফ্রেঞ্চরা বলে নোংরা কুকুরের বাচ্চা আরব। ভাল করেই জানি, আমি ওদের কেউ নই।’

‘তুমি মুসলিম,’ বলল মার্ডক।

‘ছিলাম। এখন আর কারও কাছে প্রার্থনা করি না।’

‘কেন করো না?’

দ্বিধা নিয়ে চুপ করে থাকল জুবায়ের।

কেন প্রার্থনা করো না, জুবায়ের?’

মাটির দিকে চেয়ে চাপা স্বরে বলল তরুণ, ‘খোদা কখনও প্রার্থনার জবাব দেন না।’

‘তুমি তা হলে ঠিক পথেই আছ,’ ভরসার সুরে বলল মাউক।

চুপ করে কী যেন ভাবছে তরুণ। কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল, ‘অন্যদের কী হবে?’

হামলার সময় কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়েছিল জুবায়ের। তারাও ওর মতই এই জীবনে চরম হতাশ। কিন্তু জুবায়েরের মত দক্ষ এবং সাহসী নয়। মার্ডক মাথা নাড়ল। ‘অন্যরা তোমার মত মূল্যবান নয়। কাজের জন্যে পয়সা দিয়ে দেয়া হবে। ওদেরকে পেছনে ফেলে অনেক দূরে সরে যাবে তুমি। অথবা, চাইলে থেকেও যেতে পারো এখানে।’

ঠিকভাবেই তরুণের ওজন বুঝে নিয়েছে মার্ডক।

বন্ধুদের ফেলে যেতে খুবই খারাপ লাগবে জুবায়েরের। যে- দেশ মোটেও চায় না ওকে, সেটা ত্যাগ করতে আপত্তি থাকবে না ওর, বা যে স্রষ্টা ঘুরেও দেখে না বিপদের সময়, তাকে ভালবাসার কোনও কারণ নেই; কিন্তু জুবায়েরের পরিবার বলতে ছিল শুধু রাস্তার ওই হদ্দ নোংরা ছেলেগুলো। তাদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে সে। যা পেয়েছে ভাগ করে নিয়েছে। তাদের ত্যাগ করা খুব কঠিন কাজ।

কয়েক বছর আগে ওই একই সমস্যায় পড়েছিল মার্ডক। কিন্তু জুবায়েরের বন্ধুদের মত নয়, ওর বন্ধুরা বুঝত না কোথা থেকে আসছে সরকারের এই স্বৈরশাসন। তাদের বিরুদ্ধে লড়তে চাইত, বড়লোক বা শক্তিশালীদের ঘৃণা করত— জানত না কীভাবে বদলে দিতে হবে নিজের জীবন।

মার্ডকের চোখ খুলে দিয়েছিলেন প্রভু। দেখিয়ে দিয়েছিলেন সত্য! হাজার মিথ্যা থেকে সরিয়ে নেন ওকে। আর এখন ঠিক তেমন করেই জীবন পাল্টে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে মার্ডক জুবায়েরকে।

‘তা হলে ওদেরকে ফেলে যাব,’ বলল জুবায়ের। তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। ‘আমাকে ছাড়া ভালই থাকবে ওরা।’

‘কথাটা ঠিক হলো না, আপত্তির সুরে বলল মার্ডক। ‘নিজের জীবন গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে তুমি। কিন্তু তার আগে আরেকটা কাজ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।’

মুখ তুলে মার্ডককে দেখল তরুণ।

‘রুই ডে জাখদান্স সেইণ্ট পলে একটা বাড়ি আছে। ওটা এক বিজ্ঞানীর ল্যাবোরেটরি। ওখানে যাবে। যা পাবে, সব সরিয়ে নেবে। জিনিসগুলো আমাদের কাজে আসবে। কেউ বাধা দিলে, দেরি করবে না খুন করতে।

তরুণের হাতে ভাঁজ করা একটা কার্ড দিল মার্ডক।

ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল ঠিকানা। ওটা পড়ে নিয়ে পকেটে কার্ড রেখে দিল জুবায়ের।

তার দ্বিধা টের পেয়েছে মার্ডক। নিজেও চিন্তিত হয়ে উঠল সে, শেষ পর্যন্ত কাজটা করবে তো এই ছেলে!

উঠে মার্ডকের চোখে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল জুবায়ের। আবর্জনা ভরা রাস্তার দূরে দেখল। দাঁড়িয়ে আছে  পাথরের মূর্তির মত।

‘তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে,’ আঁচ করল মার্ডক। ‘জিজ্ঞেস করো।’

কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল জুবায়ের, ‘কী নাম দেবেন আপনি আমার?’

‘তোমার নাম দেবেন প্ৰভু।’

‘আপনিই তো বোধহয় প্রভু?’ ভুল ধারণা করেছে জুবায়ের।

‘না,’ মাথা নাড়ল মার্ডক। ‘আমাকে খুঁজে নিয়েছেন প্রভু। এক দিন ঠিকই দেখবে তাঁকে।’

মাথা দোলাল জুবায়ের। ‘কী নাম দেবেন তিনি আমাকে?’

মৃদু হাসল মার্ডক। অতীত পেছনে ফেলে এগোবার জন্যে তৈরি জুবায়ের। জানতে চাইছে ওর নতুন নাম। বুঝতে চাইছে কীভাবে চলবে ওর জীবন।

‘তিনি তোমার নাম দেবেন মামবা,’ বলল মার্ডক, ‘শত্রুর জন্যে খুব বিপজ্জনক সাপ তুমি, তোমার বিষ ভয়ঙ্কর।’

মার্ডকের চোখে তাকাল না জুবায়ের। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বড় করে দম নিল। বিষাক্ত সাপ সে! ভীষণ ভয় পাবে তাকে শত্রুরা!

‘এবার যাও, গিয়ে শেষ করো নিজের কাজ,’ নরম সুরে বলল মার্ডক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *