মৃত্যুঘণ্টা – ৩

তিন

ডেবি ম্যাকেঞ্জির ওপর ভীতিকর ভাইরাস হামলার বারো ঘণ্টা পর।

বিশাল, বিস্তৃত ওয়্যারহাউসের প্রকাণ্ড দরজা বন্ধ। আশপাশে কোথাও কারও পদচারণা নেই। বিশাল দালানের সামনের সরু, নির্জন রাস্তায় চলছে না কোনও গাড়ি। দালানের অভ্যন্তর থেকেও কোনও আওয়াজ নেই। এমন কী পেছনের সারি সারি লোডিং ডক খালি। নিচে টেনে তালা মেরে দেয়া হয়েছে গ্যারাজের দরজার মত সব গেট।

গাঢ় কালো সানগ্লাস পরা এক লোক লাফিয়ে উঠল লোডিং ডকে। পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট। সে ভাল করেই জানে, এই ওয়্যারহাউস বন্ধ বলে মনে হলেও আসলে ভেতরে আছে লোক। তারা জরুরি মাল নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

জায়গাটা ডুবরোভ্নিক, ক্রোয়েশিয়া।

দরজার দিকে পা বাড়াল যুবক। এক হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে একবার স্পর্শ করল শোল্ডার হোলস্টারে রাখা ৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার পি.পি.কে.। ছোট এক জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে।

প্রথমে দেখল নিজ প্রতিবিম্ব। ক্রু-কাট কালো চুল, কপালের নিচে কালো সানগ্লাস। মুখে দু’দিনের না কামানো খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।

বিরক্ত হয়েছে সে। সূর্যের আলো এড়াতে কপালে হাত রাখল, নতুন উদ্যমে উঁকি দিল জানালায়। হারিয়ে গেছে বাঁকা কাঁচে ওর বিদঘুটে চেহারা। এবার পরিষ্কার দেখল ওয়্যারহাউসের মাঝে চারজন লোক। তাদেরকে খুব বিরক্ত মনে হচ্ছে। আঙুলের গিঁঠ ব্যবহার করে জানালার কাঁচে বার কয়েক জোরে টোকা দিয়ে পিছিয়ে এল যুবক।

যার কাছে এসেছে, সে চিনবে ওকে। হঠাৎ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত এসেই বেশ কয়েকটা গ্রাঁ প্রি রেস জিতে নিয়েছিল মরিস রেইনার। তারপর উধাও হয় ওই আঙিনা থেকে। হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাবান সেই ড্রাইভারের কথা আজও আফসোস করে বলে দর্শকরা। অবশ্য এখন যার কাছে এসেছে সে, ওই লোক জানে ওর আরও দুটো পরিচয়। মরিস রেইনার আসলে দুর্ধর্ষ এক মার্সেনারি। কখনও কখনও কাজ করে আর্মস ডিলার হিসেবেও। তার মত ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ও কঠোর লোক নাকি হয় না।

বেশিরভাগ মানুষের জানার কথা নয়, বেপরোয়া এই বাঙালি যুবক বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেরা এজেন্টদের একজন, দেশের বিরুদ্ধে কোথাও ষড়যন্ত্র হলেই তার কাজ তা নস্যাৎ করে দেয়া। প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুর মুখে। অমোঘ আকর্ষণে কাছে টানে যে-কাউকে, অথচ অদ্ভুত একাকী জীবন ওর। এক ঘনিষ্ঠ আমেরিকান বান্ধবীর অনুরোধে এই কাজ করবে বলে আপাতত এখানে এসেছে।

খটাং শব্দে ভেতর থেকে খুলে গেল ওয়্যারহাউসের দরজার বল্টু। সরসর করে দু’ফুট সরল স্লাইডিং ডোর। ফাঁকা জায়গায় দেখা দিল এক লোক। আকার দেখে তাকে বলা যেতে পারে বাচ্চা হাতি। একবার মাথা দুলিয়ে পিছিয়ে গেল।

বড় করে দম নিয়ে ওয়্যারহাউসে পা রাখল মাসুদ রানা।

এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওই চার সশস্ত্র লোক। রানার বামে এখন পঞ্চম লোকটা, টেনে ধুম্ করে বন্ধ করল দরজা। ঘুরে হাতের ইশারা করল। ‘আমার সঙ্গে আসুন।’

বাচ্চা হাতি দুলে দুলে রওনা হতেই পেছনে চলল রানা। মস্ত ওয়্যারহাউসের গভীরে ঢুকছে ওরা। দালানের ভেতর দামি সব মালামাল। এক দিকের দেয়ালে ক্রেট ভরা সব ইলেকট্রনিক ইকুইপমেণ্ট। পাশে ঠাঁই নিয়েছে সারি সারি হ্যাঙার থেকে ঝুলন্ত ফার কোট; সেগুলোর ভেতর দুটো আসল মুক্তা দিয়ে কারুকাজ করা। একটু দূরে বারো সিলিণ্ডারের কয়েকটা টার্বোচার্জড় জাগুয়ার। ওগুলোকে একেবারে নতুন বলে মনে হলো রানার।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করছে বাচ্চা হাতি। ‘ওগুলো সরাসরি এসেছে ফ্যাক্টরি থেকে।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

চোরাই গাড়ি পেরিয়ে দালানের মাঝে থামল ওরা। এখানে মেঝেতে দু’ধরনের দীর্ঘ আয়তাকার ক্রেট। প্রতিটির ওপর ছিল ন্যাটোর সামরিক চিহ্ন। চেষ্টা করা হয়েছে সব চিহ্ন মুছে দেয়ার। তবুও আবছাভাবে দেখা গেল লেখা ও প্রতীক। পরিষ্কার চিনল রানা আলফানিউমেরিক কোড: এফআইএম-৯২।

স্টিংগার সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল দেখতেই এখানে এসেছে রানা। রং স্প্রে করার সময় ঢেকে দেয়া হয়নি মিসাইলের ক্রেটের ওপরের দুটো অক্ষর। ওগুলোর কারণে বুঝল রানা, ভেতরের মাল এক্সটেণ্ডেড-রেঞ্জ ভ্যারিয়েন্ট— কমপক্ষে পাঁচ  মাইল একেবারে নিখুঁতভাবে গিয়ে আঘাত হানবে লক্ষ্যে।

কয়েক বছর আগে ন্যাটোর এক কনভয় থেকে হারিয়ে গেছে এসব অস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল সিআইএ। কিন্তু নানান দিকে খোঁজ নিয়েও মিসাইলের ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। যে চুরি করেছে, সে বুঝে গিয়েছিল, হাতের মাল অনেক বেশি গরম। বিক্রির কোনও চেষ্টা হয়নি চোরাই মার্কেটে, নইলে ঠিকই ফাঁস হতো সব।

বামে অপেক্ষাকৃত চওড়া ও দীর্ঘ সব ক্রেট দেখল রানা।

‘ওগুলো নগদ টাকায় কিনেছে আরেক কাস্টমার,’ ছায়ার ভেতর থেকে এল ভারী কণ্ঠ

ঘুরে তাকাল রানা। মোটা গলার মালিক বেরিয়ে এসেছে ছায়া থেকে। ছাতের হলদে বাতির কারণে চকচক করছে তার টাক, যেন পালিশ করা হয়েছে। ঝিলিক মারছে নাকের ডগা, ভোঁতা চোয়াল ও গণ্ডারের মত ঘাড়।

মনে মনে ‘বাপরে’ বলে উঠল রানা। ওর পাশের মোটকু এর কাছে রীতিমত শিশু। ছায়া থেকে যেটা বেরিয়ে এসেছে, সেটা পূর্ণবয়স্ক মদ্দা হাতি। দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি হলে কী হবে, ওজন কমপক্ষে তিন শ’ পঞ্চাশ পাউণ্ড। রানা বুঝল, দরকার হলে ট্যাঙ্কের মত ছুটবে এই হাতি।

নাম তার ডুক ব্রামস্ট্রি।

যেভাবে ছায়ায় লুকিয়ে ছিল, তা সত্যিকারের আর্ট। মস্ত এই ওয়্যারহাউস আস্ত গোলকধাঁধা, এটার প্রতিটি কোনা মটকুর চেনা। জানে, কোথায় রাখতে হবে নিজের লোক। প্রত্যেকের সঙ্গে অস্ত্র। নিজেকে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত লাগল রানার। বুঝে গেল, যতই প্রশিক্ষিত বা দক্ষ হোক, এদের বিরুদ্ধে একটা মাত্ৰ পিস্তলের জোরে রক্ষা করতে পারবে না নিজেকে।

মন দিয়ে রানাকে দেখছে ব্রামস্ট্রি। ‘বহু কিছু শুনেছি আপনার নামে। ওরা বলে, আপনি মরুভূমির ঝড়। কারও ওপর রাগলে তার রক্ষা নেই। নিজেকে বাঁচাতে পারবে না কেউ।

‘সব কথা বিশ্বাস করবেন না,’ শুকনো গলায় বলল রানা।

‘যা শুনেছি, তার অর্ধেক মেনে নিলে আগেই মেরে ফেলতাম আপনাকে, যাতে আমার ধারেকাছে আসতে না পারেন,’ বলল ডুক ব্রামস্ট্রি।

খুশি বা অখুশি হলো না রানা। এক সেকেণ্ড পর ওর মনে হলো, অন্তর থেকেই কথাটা বলেছে পূর্ণবয়স্ক হাতি। ও কার হয়ে এসেছে, তা জানে না আর্মস্ ডিলার। তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। সব ঠিক করা হয়েছে খুব দ্রুত। সেজন্যে সাহায্য নিতে হয়েছে তৃতীয় এক পক্ষের। সে-ই যোগাযোগ রেখেছে রানা ও ব্রামস্ট্রির মাঝে। সেজন্যে পেয়েছে উপযুক্ত ফি।

চুপ করে থাকল রানা।

‘তবে এ-ও ঠিক, আপনার ব্যাপারে যা বলেছে, তার এক শ’ভাগের একভাগও সত্যি বলে মনে করি না,’ মোটা গলায় হাসল আর্মস্ ডিলার। প্রায় গড়িয়ে এসে রানার সামনে থেমে হাত বাড়িয়ে দিল।

হাতির পায়ের মত মোটা হাতটা সামান্য ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিল রানা। টের পেল, যথেষ্ট শক্তি খরচ হয়েছে কাঁধের পেশির।

এদিকে ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে একটা ক্রেট খুলছে ষষ্ঠ এক লোক।

অপেক্ষাকৃত বড় ক্রেট দেখল রানা। ভেতরে রয়েছে বড় সব মিসাইল। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কী ধরনের জিনিস। লংগার-রেঞ্জ স্যাম, নাকি সার্ফেস-টু-সার্ফেস মিসাইল? যাক, এলেনা ওকে দরদাম করতে বলেছে স্টিংগারের জন্যে। অবশ্য, অন্যগুলো সম্পর্কে তথ্য পেলে পরে কাজে আসবে।

‘অন্যান্য মালপত্র?’ সংক্ষেপে জানতে চাইল রানা। 

মাথা দোলাল ব্রামস্ট্রি। ‘অনেক কিছু বিক্রি করি।’

‘আপনার মিসাইলের দাম?’

‘নিজে থেকে কিছুই বলব না,’ মাথা নাড়ল মদ্দা হাতি।

‘নিলামের ডাক দেবেন না?’

‘না।’

‘যার হয়ে দর করতে এসেছি, সে কিন্তু অন্য মিসাইলের ব্যাপারেও আগ্রহী।’

‘অন্যগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। অবশ্য, আপনার লোক নিজে থেকে দাম বললে পরে হয়তো ওই জিনিস আরও জোগাড় করতে পারব।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। নিজে থেকে কোনও প্রশ্ন করল না। মনে গেঁথে নিল ক্রেটের আকার ও রং। তিন সেকেণ্ড পর সামনের টেবিলে ব্রিফকেস রেখে খুলে ফেলল ডালা।

‘খুব ছোট ব্রিফকেস,’ মন্তব্য করল ব্রামস্ট্রি। ‘আমি ভেবেছি, আপনি যথেষ্ট টাকা নিয়ে এসেছেন।’

এইমাত্র ব্রিফকেস থেকে ছোট এক সেট যন্ত্র বের করেছে রানা। পাশেই রাখল একজোড়া ইলেকট্রনিক ডিভাইস— টেস্টিং ইকুইপমেণ্ট।

‘ডাউন পেমেন্টের ব্যবস্থা করেছি,’ সহজ সুরে বলল রানা। ‘তবে ওই টাকা পাওয়ার আগে আমাকে পরীক্ষা করতে দেবেন মিসাইলের গাইডেন্স, ওয়ারহেড আর প্রপালশন।’

মাথা দোলাল ব্রামস্ট্রি, মেনে নিয়েছে প্রস্তাব। ‘অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখবেন।’

পনেরো মিনিট পর ক্রেডলে খোলা অবস্থায় পড়ে থাকল একটা মিসাইল। হাঁ করেছে তিন এগযামিনেশন পোর্ট। ওপরের দু’ পোর্টে গাইডেন্স সিস্টেম ও শক্তি দেয়ার ব্যাটারি প্যাক। মিসাইলের নিচে লেজের পোর্ট থেকে বোঝা যাবে, কী অবস্থায় আছে প্রপেল্যান্ট স্টেজ।

কিছুক্ষণ মিসাইলের ওপরের পোর্ট ঘাটল রানা। মনে হলো, বুঝে নিয়েছে সার্কিট বোর্ড ও চার্জেবল ব্যাটারি প্যাকের স্ট্যাটাস। এবার মন দিল রকেটের লেজের পোর্টে। এখন ওর হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস। কাদার মত হলদে সলিড ফিউয়েলই উড়িয়ে নেবে মিসাইল। ইউভি লাইট জ্বেলে খুব সতর্ক হয়ে জ্বালানির ওপর ঝুঁকল রানা।

ম্যাগনিফাইং গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছে সব।

পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। পরীক্ষা শেষ হচ্ছে না রানার। এদিকে ওর প্রায় ঘাড়ে চেপে এল ব্রামস্ট্রি আর ষষ্ঠ লোকটা।

আরও কিছুক্ষণ পর পিছিয়ে এল রানা, একবার মাথা নাড়ল।

‘সমস্যা কী?’ জানতে চাইল ব্রামস্ট্রি।

‘মাল কত দিন আগের?’

‘কেন?’ প্রায় ফুঁসে উঠল চোরাই অস্ত্রের কারবারী।

‘কারণ, এসব বাতিল মাল,’ এককথায় জানিয়ে দিল রানা। ‘আপনি নিজেও নিশ্চয়ই তা জানেন।

‘এগুলো আমেরিকার সেরা মিসাইল,’ আপত্তির সুরে বলল ব্রামস্ট্রি। ‘জিজ্ঞেস করে জেনে নেন ইরাকি, সিরিয়ান আর রাশানদের কাছ থেকে। ভয়ঙ্কর অস্ত্র।’

মদ্দা হাতির চোখে চোখ রাখল রানা। ‘ভয়ঙ্কর ছিল। অতীতের কথা।’

‘কী বলতে চান?’ জানতে চাইল ছোট হাতি। রানার জন্যে দরজা খুলে দিয়েছিল সে।

একবার রানার মনে হলো, আসল লোক এই ছোট হাতি। নকল লোক বড় হাতি। ‘কেউ আপনাদেরকে ঠকিয়ে দিয়েছে,’ সহজ সুরে বলল রানা।

‘মিথ্যা কথা!’ রাগে থরথর করে কাঁপছে বাচ্চা হাতি, পিস্তল তুলেই তাক করল রানার বুকে।

প্রতিপক্ষের চোখে সরাসরি তাকাল রানা। যে-কোনও সময়ে আরও খেপে গিয়ে গুলি করবে ছোট হাতি। আরও ঝুঁকি নেবে কি না, ভাবছে রানা। ডুক ব্রামস্ট্রির দিকে তাকাল। ‘তুমি কি তোমার কাস্টমারদেরকে খুন করে বড়লোক হয়েছ?’

সঙ্গীর দিকে ফিরল ব্রামস্ট্রি। ‘অস্ত্র নামাও।’ আবারও রানার দিকে ফিরল সে। ‘বন্ধু, আপনি যা বলেছেন, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে হবে আপনার।’

আবারও ইউভি বাতি জ্বালল রানা। ‘নিজ চোখেই দেখুন।’

ওর হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে ঝুঁকল ব্রামস্ট্রি। চোখ প্রপেল্যান্টের ওপর। কাত করে বাতি ফেলেছে রানা।

‘চুরি হওয়ার পর কয়েক বছর বাঙ্কারে ছিল,’ বলল রানা। ‘আর আপনি বা আমি ভাল করেই জানি, ফলে কী হয়েছে।’

চোরা কারবারীর স্যাঙাতের হাতে বাতি দিল রানা, আঙুল তাক করে দেখিয়ে দিল প্রপেল্যান্টের একটা অংশ। একটু আগে ওই জায়গাটা মনোযোগ দিয়ে দেখেছে।

‘চুলের মত সরু ওই সব রেখা দেখছেন? ওগুলো হচ্ছে আপনাদের বা অন্যদের সমস্যা। ঠিকভাবে জ্বলবে না জ্বালানি। আর জ্বলে উঠলেই হয়তো বিস্ফোরিত হবে।

সলিড ফিউয়েলে প্রায় নাক ঠেকিয়ে দিল ডুক ব্রামস্ট্রি। কয়েক সেকেণ্ড পর মনে হলো, মেনে নিয়েছে রানার কথা।

‘সরি, কিন্তু এই জিনিস ব্যবহার করতে গেলে নিজেকেই মরতে হবে,’ বলল রানা।

প্রপেল্যান্টের দিকে চেয়ে আছে ব্রামস্ট্রি ও তার স্যাঙাত। গাইডেন্স সেকশনের দিকে ফিরল রানা। হাত ভরে দিল পোর্টের ভেতর। ব্যবহার করছে ইলেকট্রিকাল ডিটেক্টর। মেপে দেখছে পাওয়ার সাপ্লাই। কয়েক সেকেণ্ড পর হাত বের করে এনে দেখল মিটারের রিডিং।

‘গাইডেন্স ঠিক আছে, তার ওপর নতুন ব্যাটারি দিয়েছেন, ‘ বলল রানা। ‘কিন্তু এসব ব্যাটারি পাওয়া সহজ কাজ। কঠিন হচ্ছে মিলিটারি গ্রেড সলিড রকেট ফিউয়েল পাওয়া।’

ঘুরে ওকে দেখল ডুক ব্রামস্ট্রি। হাত সহ ম্যাগনিফাইং গ্লাস নামিয়ে নিয়েছে ঊরুর পাশে। খট শব্দে ঠিক জায়গায় পাওয়ার বাস রেখে মিসাইলের গাইডেন্স সেকশন বন্ধ করল রানা।

‘আমি যদি আপনার কথা বিশ্বাস না করি?’ তেড়া সুরে জানতে চাইল চোরা কারবারী।

‘সেক্ষেত্রে আমাদের ভেতর মত বিরোধ হবে,’ বলল রানা। আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘অবশ্য, তার মানে এমন নয় যে আমরা পরে আর ব্যবসা করব না।’

‘অন্য কিছু চাই আপনার?’

বড় ক্রেটের দিকে মাথার ইশারা করল রানা।

বার কয়েক মাথা নাড়ল ব্রামস্ট্রি।

ইজরায়েলি মিসাইলের কথা জানতে চাইল রানা, ‘স্পাইডার হলেও চলবে, আপনার কাছে আছে?’

‘চারপাশে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি।’

‘তা হলে কাজে নেমে পড়ুন,’ বলল রানা। ‘যে আমাকে পাঠিয়েছে, সে ওই ধরনের জিনিস পেলে আগ্রহ নিয়ে কিনবে। ব্রিটিশ, ইজরায়েলি, ফ্রেঞ্চ, রাশান বা চাইনিজ, কিন্তু জিনিসটাকে হতে হবে নিখুঁত।’

খুব উৎসাহী হলো না ব্রামস্ট্রি। অবশ্য, বার কয়েক মাথা দোলাল। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, ভবিষ্যতে ওর বন্ধুর কাছ থেকে কত টাকা পাবে, সে হিসাব কষছে লোকটা।

কয়েক সেকেণ্ড পর স্টিংগার মিসাইলের দিকে মাথা তাক  করে বলল হাতি, ‘এই খবর বাইরে যেন প্রকাশ না পায়।’ বলার মধ্যে হুমকির সুর পেল রানা।

‘যার কাছ থেকে এসেছি, তাকে অন্য কারণ বুঝিয়ে বলব,’ কথা দিল রানা। একটু বিরতি নিয়ে জানাল, ‘কিন্তু আপনার বদলে আমি হলে এমন কারও কাছে ওই জিনিস বিক্রি করতাম, যাকে আর কখনও দেখতে চাই না।’

ভেতরে যন্ত্রপাতি সব রেখে ধুপ শব্দে ব্রিফকেস বন্ধ করল রানা। বুঝতে পারছে, সত্যিকারের বিপদ এখন। এবার এখান থেকে ওকে বেরোতে দেবে তো ব্যাটারা?

‘আশা করি পরেরবার ব্যবসা হবে,’ নরম সুরে বলল রানা। ঠিক করে ফেলেছে, ভুলেও বলবে না বিদায় নেবে। ব্রিফকেস হাতে ঘুরে দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল ও।.

পেছনে কী নিয়ে যেন আলাপ করছে মদ্দা ও বাচ্চা হাতি। কয়েক সেকেণ্ড পর বদলে গেল সুর। চলছে তর্ক I

ক্রোয়েশিয়ার ভাষা বুঝবে না, কাজেই ওদিকে মনোযোগ না দিয়ে হনহন করে হাঁটছে রানা। মনে মনে বলল, আমার হাতের ভেলকি বুঝে ফেলল না তো? মুশকিল! সামনের দরজাটা মনে হচ্ছে হাজার মাইল দূরে!

পেছনে চড়া গলায় বলে উঠল ব্রামস্ট্রি, ‘একমিনিট, মোসিউ রেইনার! ফ্রেণ্ড! আমার কথা শেষ হয়নি!’

জায়গায় থমকে ঘুরে দাঁড়াল রানা, আটকে ফেলেছে শ্বাস।

চওড়া হাসি দিল চোরা কারবারী। দু’হাত কচলাচ্ছে। প্রায় ফুটবলের মত গড়িয়ে এল রানার দিকে। ‘মস্ত বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, সেজন্যে ধন্যবাদ। আপনি শিয়োর তো অন্য কিছু লাগবে না?’

‘না, আপাতত নয়। তবে অন্য মিসাইলের…’

‘ছিহ্, ওগুলোর কথা ভুলে যান। …আর কিছু?’

ক’ সেকেণ্ড পর বলল রানা, ‘শহরে পৌঁছে দিতে পারবেন? সঙ্গে গাড়ি নেই।’

কৃতার্থ ব্যবসায়ীর তেলতেলে হাসি দিল চোরা কারবারী। ‘এ তো ব্যাপারই নয়! যেখানে যাবেন, সেখানেই আপনাকে পৌঁছে দেবে আমার মার্সিডিজ। চলুন, ড্রাইভারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসি আপনাকে।’

‘বেশ, চলুন।’ ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *