ছাব্বিশ
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ঝলমলে উষ্ণ রোদ। যে কারও মন চাইবে সৈকতে গিয়ে শুয়ে-বসে রোদ পোহাতে। হাতে থাকবে শীতল বিয়ার। কিন্তু ছেলের বাড়ির পেছনের বাগানে বন্দি হয়েছেন প্রফেসর পিট বার্ডম্যান। পাঁচ বছরের নাতিকে দেখে রাখার দায়িত্ব পড়েছে তাঁর ওপর। বিরাট এক প্লাস্টিকের ক্লাব দিয়ে প্লাস্টিকের বড় এক গলফ বল-এ বাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে টম। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি, কিন্তু ইতিমধ্যেই আশপাশের ঘাস ও গাছের বারোটা বেজে গেছে। এরই ভেতর দুই হাঁটুর বাটিতে চারটে বাড়ি খেয়েছেন প্রফেসর। কিন্তু নাতির উৎসাহের অভাব নেই। তার গায়ে তো লাগছে না।
বাড়ির ভেতর টেলিফোন বেজে উঠতেই ওদিকে মনোযোগ গেল প্রফেসর বার্ডম্যানের। ‘তুমি চালিয়ে যাও,’ কণ্ঠে আদর ঢেলে বললেন। ‘গ্র্যাণ্ডপা ফোন ধরতে গেল।
চওড়া হাসল টম। এসব দারুণ সুন্দর হাসি দেখা যায় শুধু পাঁচ বছরের ছেলে-মেয়েদের মুখে। পরক্ষণে টমের ক্লাবের মারাত্মক এক হামলায় গাছ থেকে ছিটকে গেল অপরূপ সুন্দর মস্ত এক গোলাপ।
বাড়িতে পা রেখে বিড়বিড় করলেন প্রফেসর, ‘এবার বলব সিনডারেলার গল্প… তা হলে যদি ব্যাটা ব্যাট ছাড়ে!’
পেছনে বন্ধ করে দিলেন স্ক্রিন ডোর। তুলে নিলেন ফোনের রিসিভার। ‘হ্যালো।’
‘প্রফেসর,’ ওদিক থেকে এল নরম নারী কণ্ঠ।
চিনে ফেললেন প্রফেসর বার্ডম্যান। ওদিকের মেয়েটাকে খুব স্নেহ করেন তিনি। কিন্তু একই সঙ্গে মনে এল: টেলিমার্কেটার ফোন করলেই বুঝি ভাল ছিল। মৃদু হেসে বললেন, ‘কবে আমাকে বলবে যে রিটায়ার করছ? ভাল করে খুঁজে দারুণ কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।’
‘না, প্রফেসর, আছি আরামে,’ বলল মেয়েটা, ‘একটা সাহায্য চাইতে ফোন করলাম। আসলে দরকার জ্ঞান। সময় দিতে পারবেন?’
একটু গম্ভীর হলেন প্রফেসর বার্ডম্যান। গত দু’বছর ধরে কাজ করেছেন এনআরআই-এর হয়ে। বার কয়েক মস্তসব বিপদেও পড়তে হয়েছে। ‘আমার গুলি খাওয়া হাঁটুর ব্যথা কিন্তু সারেনি এখনও। এসব মারাত্মক মিশন বাদ দিয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে, এবার বিয়ে করে ফেলো বাঙালি হ্যাণ্ডসাম ছেলেটাকে। নইলে…’
‘আপনাকে কোনও ঝুঁকি নিতে হবে না, প্রফেসর,’ বলল মেয়েটা, ‘একটা জিনিস একটু শুধু দেখে দিলেই হবে।’
স্বস্তি পেলেন বার্ডম্যান। ‘তোমার সঙ্গে রানাও আছে?’
‘না, প্রফেসর, ও আপাতত অন্য কাজে ব্যস্ত,’ বলল এলেনা।
‘তুমি নিজে কী নিয়ে ব্যস্ত?’ জানতে চাইলেন প্রফেসর।
‘এখন সব খুলে বলতে পারব না, স্যর, কিন্তু আপাতত দেখছি প্রাচীন একটা লিপির ছবি। স্বাভাবিক জিনিস না। তামা দিয়ে তৈরি। জানা দরকার ওটার সব লেখা অনুবাদ করা যায় কি না।’
‘তার মানে ডেড সি-র ওই তাম্রলিপির মত?’
‘অনেকটা তা-ই, কিন্তু শুনেছি আরও অনেক পুরনো।’
‘কোত্থেকে এল?’
‘ইরাকের কাছে, বা ইরানে। ওটার লেখা সুমেরিয়ান মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ক্লিংঅনও হতে পারে।’
হাসলেন প্রফেসর। ‘সুমেরিয়ান অনুবাদ করতে পারব। আর কয়েকজনকে চিনি, ওরা ক্লিংঅনও অনুবাদ করতে পারবে।’
‘তা-ই?’ হাসল এলেনা, ‘এনক্রিপটেড ই-মেইলে পাঠাচ্ছি।’
‘পাসওঅর্ড কী?’
‘শেষ অভিযানে যাওয়ার তারিখ মনে আছে, প্রফেসর?’
‘ভুলি কী করে? পঞ্চম দিনে ফুটো হয়ে গেল আমার হাঁটু।’
‘ঠিক আছে, প্রফেসর, রওনা হয়ে গেছে ই-মেইল। কিছু পেলে মিস্টার ব্রায়ানকে জানাবেন, তিনি জানেন কোথায় থাকব।’
ছেলে ও তার স্ত্রীর সাজানো, ছিমছাম, সুন্দর ঘরটা দেখলেন প্রফেসর। তাঁর পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও হাওয়াইয়ান টি-শার্ট। নিরাপদ, শান্ত এক পরিবেশে বাস করছেন। মন চাইল না আবারও ঝাঁপ দিতে ভয়ঙ্কর বিপদে। কিন্তু একই সঙ্গে হয়ে উঠেছেন চিন্তিত। জটিল কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এলেনা। নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে আছে ওই বাঙালি দুর্ধর্ষ ছেলেটা? মারাত্মক সব বিপদে জড়িয়ে যায় ওরা।
‘আমার কি সতর্ক হওয়া উচিত?’ জানতে চাইলেন বার্ডম্যান। ‘আপাতত নয়,’ বলল এলেনা। ‘যে কাজে আছি, সেজন্যে একটুও বিপদে পড়বেন না আপনি।’
‘কিন্তু…’
‘খারাপ একটা কিছু ঠেকাতে চাইছি, নইলে মস্ত বিপদ হবে,’ বলল এলেনা।
ঝুঁকি না নিয়ে উপায় থাকে না ওদের, ভাবলেন প্রফেসর। ‘এসবের সঙ্গে তামার লিপির সম্পর্ক নেই, এমন হতে পারে, ‘ বলল এলেনা, ‘আবার থাকতেও পারে। জরুরি একটা সূত্র পেয়ে এগোতে হচ্ছে। দেরি করা ঠিক হবে না।
প্রফেসর একবার ভাবলেন বিষয়টি কী জানতে চাইবেন, কিন্তু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন চিন্তাটা। এমনিতেই ওই বাঙালি ছেলেটা বা এই মেয়েটির কাছে কৃতজ্ঞ তিনি। না, এলেনার পেট থেকে জোর করে তথ্য বের করার চেষ্টা অনুচিত হবে। এসব হয়তো জটিল কোনও কিছুর অংশ। সব জানতে গিয়ে নিজের ছেলে, ছেলে-বউ আর নাতিকে বিপদে ফেলবেন কেন! তবুও জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের অবস্থা কেমন?’
‘ভাল না। নইলে আপনার সাহায্য চাইতাম না।
বড় করে দম নিলেন প্রফেসর। ‘ঠিক আছে। ই-মেইল পেয়ে গেলেই কাজে নামব।’