মৃত্যুঘণ্টা – ৪২

বিয়াল্লিশ

এনআরআই সেফ হাউস থেকে পুরো দু’মাইল দূরে পরিত্যক্ত এক দালানে জুবায়ের পাশাকে নিয়ে এসেছে এলেনা রবার্টসন। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, একসময় মিলিটারির বড় গাড়ির জন্যে ডিপো ছিল এই দালান। কিন্তু ওপর থেকে গোলার আঘাতে ধসে গেছে ছাত। বালিতে জন্ম নিয়েছে মরুর কাঁটাগাছ।

সবচেয়ে নীরব জায়গা বেছে গাড়ি রেখেছে এলেনা। তার নির্দেশ শুনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল আরব তরুণ। তাকে ভাঙা এক অফিসে নিয়ে এল এনআরআই এজেন্ট। দেয়ালের পাশে পুড়ে যাওয়া এক কেবিনেট। বোঝার উপায় নেই, ওটা বোমার কারণে এমন হয়েছে, না আগুনের তাপে। বালিভরা মেঝেতে জুবায়েরকে বসতে ইশারা করল এলেনা।

রানা এক হাতের তালু ফুটো করে দিয়েছে বলে খুব সাবধানে মেঝেতে বসল জুবায়ের। প্রথমবারের মত মুখ খুলল, ‘আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, ধন্যবাদ।’

‘চুপ করো!’ ধমক দিল এলেনা। তরুণের বুকে তাক করল ওয়ালথার। ‘যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাজে কাজ করছ, তারা সবাই খুনি। ডক্টর মোবারক বা ফ্রেঞ্চ পুলিশদেরকে খুন না করে থাকলেও, যারা এসব করেছে, তাদের সঙ্গে ছিলে তুমি।’

‘তা হলে আমাকে বাঁচালেন কেন?’ মৃদু বিস্ময় নিয়ে বলল জুবায়ের।

‘রানা তোমাকে খুন করলে নতুন কোনও তথ্য পেতাম না, ‘ সরাসরি বলল এলেনা।

চুপ করে থাকল জুবায়ের।

ওদেরকে আড়াল করছ কেন?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে,’ বলল তরুণ, ‘আমি এখন তাদের একজন। ‘

ভালভাবেই ইংরেজি বলতে পারে সে, তবে ফ্রেঞ্চ টানে।

‘তুমি ওদের একজন হলে তোমাকে নিয়ে যেত,’ মন্তব্য করল এলেনা।

‘নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছে।’

‘তেমন কিছু দেখিনি,’ বলল এনআরআই এজেন্ট। ‘সত্যি তারা এলে, তোমার মগজে একটা বুলেট গেঁথেই দায়িত্ব শেষ করবে। ওই একই কাজ করেছে তোমার বন্ধুদের বেলায়। ফ্রান্সে।’

যেন ঝাঁকি খেল তরুণ। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘ওদেরকে গুলি করেছেন আপনি!’

মাথা নাড়ল এলেনা। ‘কথা ঠিক নয়। সুযোগ পেলেও তোমাকে খুন করিনি। বন্দি করে এনে ইন্টারোগেট করেছি। আমরা ওই খুনে কাল্টের লোকদের মত খুনি নই।’

কড়া চোখে এলেনাকে দেখল জুবায়ের। অবিশ্বাস করেছে প্রতিটা কথা।

‘যারা তথ্য দিতে পারে, তাদেরকে কেন খুন করব?’ মাথা নাড়ল এলেনা। ‘তোমার বন্ধুদেরকে খুন করিনি। তবে সুযোগ পেলে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। ওই একই কাজ করত ফ্রেঞ্চ পুলিশ। কিন্তু কাল্টের কেউ তাদেরকে মেরে ফেলেছে, যাতে মুখ খুলতে না পারে তারা।’

এলেনার চোখে চোখ রেখে রেগে উঠল তরুণ। বুঝতে  পারছে না মেয়েটা সত্যি না মিথ্যা বলছে। তবে ওর মন বলল, বোধহয় সত্য। চোখ সরিয়ে নিল সে।

‘উদ্ধার করতে কেউ আসবে না,’ বলল এলেনা, ‘পরিত্যাগ করেছে ওরা তোমাকে। তুমি বাঁচলে না মরলে, তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। তোমাকে খরচের খাতায় তুলে দিয়েছে। …নাম কী তোমার?’

‘মামবা।’

মাথা নাড়ল এলেনা।

‘নিশ্চয়ই ওরা ভেবেছিল আমি মরে গেছি,’ বলল জুবায়ের।

‘হাতে সময় ছিল, তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ, দেখতে পারত,’ বলল এলেনা, ‘চাইলে রানা, গ্রাহাম বা আমাকে খুনও করতে পারত, তারপর তোমাকে খুঁজে নিয়ে সরে যেতে পারত— তা করেনি। কোনও খোঁজ রাখেনি। বিশ্বাস করতে পারো আমার কথা: ওরা ভুলে গেছে তোমাকে। সত্যিকার অর্থে আবারও একা হয়ে গেছ তুমি।

আরও বেশি দ্বিধায় পড়ল জুবায়ের। ‘আপনি নিজের বন্ধুকে গুলি করেছেন, আপনি নিজেও তো একা হয়ে গেলেন।’

ম্লান হাসল এলেনা। কখনও খুব কঠিন হয় পৃথিবী। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘যা করা উচিত ভেবেছি, তা-ই করেছি। তুমি জরুরি তথ্য না দিলে ওর বন্ধু গ্রাহামের হাতে তুলে দেব। তার মানেই, খুন হবে তুমি।’

কোনও জবাব দিল না জুবায়ের, দেখছে এলেনাকে। বুঝতে চাইছে, মেয়েটা কেমন ধরনের। আর যাই হোক, আবারও ওই অ্যাপার্টমেন্টে যেতে চায় না ও। মাসুদ রানার ইংরেজ বন্ধু লাশটা পাওয়ার পর, ওকে পেলে জানে বাঁচতে দেবে না।

‘আমি যদি মুখ খুলি, আমাকে কী করবেন আপনি?’

‘ছেড়ে দেব। চলে যেতে পারবে নিজের পথে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানতে চাইল এলেনা, ‘পুলিশের লোকগুলোকে খুন করেছিলে?’

‘না,’ গর্বিত চেহারায় মাথা নাড়ল জুবায়ের, ‘খুনি নই।’

‘অথচ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষকে খুন করতে চাইছে, এমন একটা দলের সঙ্গে ভিড়ে গেছ— এর কী ব্যাখ্যা?’

চিন্তায় ডুবে গেল জুবায়ের। মনে হলো এলেনার কথাটা স্পর্শ করেছে ওর হৃদয়। একটু পর বলল, ‘আমার ধারণা, আপনি চালাকি করে আমার কাছ থেকে সব জেনে নিতে চাইছেন।’

কথাটা পাত্তা না দিয়ে সহজ সুরে বলল এলেনা, ‘ওরা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে চাইছে ভয়ঙ্কর একটা ভাইরাস। কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে মরবে। দেশে দেশে হবে যুদ্ধ। ঘৃণা ও হিংসা থাকবে চারপাশে। ইচ্ছে করলে তুমি এসব ঠেকাতে পারো।’

‘আমি? কী করে? সামান্য মানুষ। আজ আছি তো কাল নেই।

‘তুমি বলতে পারো, ওরা কোথায় নিয়েছে ওই মেয়েকে।’ চুপ করে থাকল জুবায়ের।

‘ওই মেয়ে জানে কীভাবে তৈরি করতে হয় সেই ভয়ঙ্কর ভাইরাস।’

দূরে চেয়ে রইল জুবায়ের।

‘তোমার আসল নাম কী?’ জানতে চাইল এলেনা। ‘আসল নাম কারও মামবা হতে পারে না। তুমি আরব।’

‘কী যায় আসে নাম দিয়ে?’ বলল জুবায়ের। ‘ফ্রান্সের লোক আমাদের বলে নোংরা আরব। থুতু ফেলে মুখে। নাগরিক হিসেবে আমি ফ্রেঞ্চ, কিন্তু ওরা দেখতে পারে না দু’চোখে। মাজা সোজা করে দাঁড়াতে গেলে দল বেঁধে বুক-পিঠ ভেঙে দেয়। মানুষ বলেই মনে করে না, আমরা মরে গেলেই যেন খুশি হবে।’

‘আমরা বলতে কারা?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘যারা আমার মত,’ তিক্ত সুরে বলল জুবায়ের।

‘তোমার বন্ধুদের কথা বলছ, যাদেরকে মেরে ফেলেছে কাল্টের লোক?’

‘আমি আসলে… জানি না…’ হ্যাণ্ডকাফ ধরে নাড়তে লাগল জুবায়ের। ফুলে গেছে নাকের পাটা। রাগ হচ্ছে ওর। ‘ওরা খুন করবে কেন?’

‘জানি না, কিন্তু তা-ই করেছে,’ নরম সুরে বলল এলেনা। ‘বলো, তুমি কোথা থেকে এসেছ? বললে তো ক্ষতি নেই।’ এর আগে অন্তত এক শ’বার এই প্রশ্ন করেছে। জবাবও ওর জানা, কিন্তু তরুণের মুখ থেকে শুনতে চাইছে। একবার সত্য বললে সেই সুযোগ নিয়ে আরও তথ্য আদায় করবে। ব্যাপারটা নদীর বাঁধের মত। একবার ফাটল ধরলে হুড়মুড় করে ভাঙবে সব।

‘লে কুখনেইভ,’ একটু পর বলল মামবা ওরফে জুবায়ের।

‘তোমার নাম?’ নরম সুরে বলল এলেনা, ‘সত্যিকারের?’

চোখ সরিয়ে দূরে তাকাল তরুণ।

‘সত্যি বললে ভাল কোনও দেশে তোমাকে পাঠিয়ে দেব, ‘ বলল এলেনা। ‘নামটা কী তোমার?

‘জানতে চাইছেন কেন?’

‘কারণ, আমার লোক আসার আগেই তোমার লোক এলে খুন হবে, তখন আর কাউকে কিছু জানাতে পারবে না।’

‘প্রভু আমার নাম দিয়েছেন মামবা।’

‘মা আমার নাম রেখেছে এলেনা। তোমার নাম কে রেখেছিল— বাবা না মা?’

বিষণ্ন হয়ে চুপ করে আছে তরুণ। কী যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ পর আবারও মেঝে দেখল। ‘আমার নাম বাবা-মা রেখেছিলেন জুবায়ের পাশা। আমার নানার নামে।’

‘তোমার বাবা-মা আদর করতেন না?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘নিশ্চয়ই,’ গলা সামান্য চড়ে গেল জুবায়েরের। ‘আমিও ভালবাসি তাঁদেরকে। আমার বাবা আর নেই, মা আছেন। আমি আমার পরিবারের সবাইকে ভালবাসি।’

এবার আলাপের সুযোগ হয়েছে, বুঝল এলেনা। ‘তুমি কি জানো না কাল্টের লোক কী করছে? কীভাবে সর্বনাশ করবে পৃথিবীর? আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। যাদেরকে ভালবাসো, সবার সর্বনাশ হবে। সবাই মিলে কষ্টের ভেতর পড়ব।’

‘আমাদের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার জবাব দেব আমরা,’ আত্মপক্ষ সমর্থন করল জুবায়ের।

‘অন্যায় ঠেকানো, আর নিজেরা অন্যায় করা সম্পূর্ণ আলাদা কথা,’ বলল এলেনা, ‘আসলে বিশ্বে সত্যি বিচার নেই। বরাবরের মতই, ধনী হবে আরও বড়লোক, সাধারণ মানুষ হবে আরও গরীব। অনেক বেশি কষ্টে পড়বে তারা। পেট পুরে খেতে পাবে না। থাকবে না মাথার ওপর ছাত। চারপাশে শুরু হবে যুদ্ধ ও ধ্বংসের মাতম। সেসবই ডেকে আনছে তোমার ওই কাল্ট।’

মাথা নাড়ল জুবায়ের। ‘না, আমাদেরকে ভয় পাবে ধনীরা।’

‘হ্যাঁ, ভয় পাবে,’ সায় দিল এলেনা, ‘তাই হামলার জন্যে আর্মিকে টাকা দেবে ওরা। তোমার পরিবার পড়বে কঠিন কষ্টের ভেতর। পৃথিবী জুড়ে মানুষ দেখবে সত্যিকারের দুঃস্বপ্ন। চাকরি হারাবে পরিবারের সবাই। লাঞ্ছনার শেষ থাকবে না। এসবই হবে তোমার কারণে। তাদের কপাল পুড়িয়ে দিচ্ছ তুমি।’

‘এসব কিছুই হবে না,’ রেগে গিয়ে বলল জুবায়ের।

‘তা-ই হবে,’ নরম সুরে বলল এলেনা, ‘তুমিও জানো।’

‘আর আপনাকে সাহায্য করলে ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন হবে এই দুনিয়ার?’ জুবায়েরের কথা থেকে ঝরল তিক্ত বিষ।

ছেলেটা মিথ্যা বলছে না, ভাবল এলেনা। সত্যিই তো, কী  পাবে গরীব মানুষ! ‘অন্তত কোটি কোটি মানুষ খুন হবে না,’ বলল ও।

‘ভালভাবে বাঁচার অধিকার পাবে আমার পরিবার?’

‘সে-কথা দিতে পারব না,’ বলল এলেনা, ‘কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে না, এটা জানি। নিজের ছেলেকে ফিরে পাবে তোমার মা।’

‘আপনাকে কিছুই বলব না,’ বলল জুবায়ের।

‘অন্যায় গোপন করে কিছুই লাভ হবে না তোমার,’ বলল এলেনা। বিরক্ত হয়ে গেছে। ‘বড়লোক বা অমর হবে না, পাবে না খ্যাতি। আসলে পাবে চরম শাস্তি।’

‘স্রষ্টা নেই যে শাস্তি দেবে,’ বলল জুবায়ের।

‘তুমি না মানলেও অনেকে বিশ্বাস করে তিনি আছেন,’ বলল এলেনা, ‘তাঁর ওপর রাগতে গেলেও অলৌকিক অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে হবে। তুমি স্রষ্টাকে ঘৃণা করো, কারণ তোমাকে তেমন কিছুই দেননি। তার মানেই মেনে নিয়েছ, তিনি আছেন।’

‘আমার রাগ নেই তার ওপর, কারণ সে তো নেই,’ বলল জুবায়ের। চোখ সরিয়ে নিল।

এলেনা বুঝল, নীরব থাকলে আবারও শামুকের খোলসের ভেতর ঢুকে পড়বে তরুণ। মামবা নামের আড়াল নিয়ে রক্ষা করবে নিজেকে। হাতে সময় নেই, অথচ এর মুখ থেকে জরুরি তথ্য জোগাড় করা খুবই জরুরি।

‘স্রষ্টা থাকুক বা না থাকুক, তুমি পৌঁছে গেছ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে,’ বলল এলেনা। ‘আমাদেরকে খুঁজে নেবে আমার বন্ধুরা। তখন শেকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলবে গভীর অন্ধকার কূপে। ওখানে থাকবে মৃত্যু পর্যন্ত। ওটাই হয়তো সত্যিকারের নরক। মিথ্যা বলব না, সে সময়ে যে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হবে, তার তুলনা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। এক এক করে পেট থেকে বের করে নেয়া হবে সব তথ্য। শেষে মেরে ফেলা হবে।’

‘কিন্তু একটা কথাও বেরোবে না আমার মুখ থেকে।’

‘ভুল বললে,’ বলল এলেনা। ‘আমাকে না বললেও ওদেরকে সবই বলবে। একটা একটা করে হাত-পায়ের হাড় ভাঙবে ওরা। শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠবে চিরকালের জন্যে পঙ্গু। হয়তো তখন খুন করবে না তোমাকে। মরে যেতে চাইলেও মরতে পারবে না। ওটাই হবে সত্যিকারের কষ্টের জীবন।’

মুখ তুলে এলেনাকে দেখল জুবায়ের। বিষণ্ন সুরে বলল, ‘আর কিছু বলবেন?’

‘মিথ্যা বলছি না, আমি চাই তুমি রক্ষা পাও,’ বলল এলেনা। মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নিল জুবায়ের। ঘুমের অভাবে ও মারধর খেয়ে খুব দুর্বল বোধ করছে সে।

এবার বুঝি মুখ খুলবে ছেলেটা, ভাবল এলেনা। আস্তে করে বলল, ‘প্লিয, জুবায়ের।’

মেঝে থেকে চোখ তুলল না তরুণ।

‘প্লিয, জুবায়ের।’

জুবায়েরের চোখ মেঝেতে। মনে হলো একটা ঘোরের ভেতর আছে। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘ওখানে একটা দ্বীপ আছে।

‘কোথায় সেই দ্বীপ?’

‘ইরান উপসাগরে,’ মেঝে দেখছে জুবায়ের। মাথা কাত করে দেখিয়ে দিল পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ দিক। ‘কয়েকটা দালানে বোমা পড়েছিল। তীরের কাছে মালটানা জাহাজও আছে। পাথরে আটকা পড়েছে। ওই মেয়েকে ওখানে নিয়ে গেছে ওরা।’ মুখ না তুলে দুলছে জুবায়ের। ‘ওখানে নিয়েছে আপনাদের বান্ধবীকে।’

‘ওই দ্বীপের নাম বলতে পারো?’

‘নাম জানি না।’

‘নামটা মনে করার চেষ্টা করো, জুবায়ের,’ বলল এলেনা।  ‘আমরা হয়তো তাদেরকে ঠেকিয়ে দিতে পারব।’

‘হয়তো পারবেন,’ বিড়বিড় করল জুবায়ের, ‘বোটে গেলে ওখানে যেতে লাগে বড়জোর এক ঘণ্টা। কিন্তু কোনও নাম শুনিনি ওই দ্বীপের। অনেক পাখি আছে ওখানে। ‘

বড় করে শ্বাস নিল এলেনা, ওর অন্তর বলল, সত্যি কথাই বলেছে জুবায়ের। বোমা পড়া এক দ্বীপ। পারস্য উপসাগরে। ওখানে পাথরে আটকা পড়েছে ফ্রেইটার। স্যাটালাইট ওদিক দিয়ে গেলেই চোখে পড়বে ওই দ্বীপ। জায়গাটা খুঁজে পেলেই হামলা করবে ওরা, ঠেকিয়ে দেবে ওই কাল্টকে!

‘ওদের কাছে মিসাইল আছে,’ বলল জুবায়ের, ‘নিজ চোখে দেখেছি। ওগুলো দিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে দেবে।’

শীতল স্রোত নামল এলেনার মেরুদণ্ড বেয়ে। মিসাইল পেলে আর কী চাই কাল্টের! এরই ভেতর পেরিয়ে গেছে সতেরো ঘণ্টা। এখনও হয়তো ঠেকিয়ে দেয়ার সামান্য সুযোগ আছে। ‘অনেক ধন্যবাদ, জুবায়ের,’ বলল এলেনা।

জবাব দিল না তরুণ। চুপ করে দেখছে মেঝে। গাল বেয়ে টপটপ করে পড়ছে অশ্রু। ‘অনেক খারাপ কাজ করে ফেলেছি, ‘ ভাঙা গলায় বলল।

‘আমরা তো মানুষ, ভুল তো করিই,’ বলল এলেনা।

মুখ তুলে তাকাল জুবায়ের। ‘আমি তাদের ভেতর সবচেয়ে খারাপ শ্রেণীর— গাদ্দার। দয়া করে আমাকে খুন করে রেখে যান।’

বিশ বছর বয়স হয়নি জুবায়েরের, যত খারাপ কাজই করুক, ওর জন্যে বুকে কষ্ট লাগছে এলেনার। যারা ধর্মের নামে মানুষকে খুন করছে বা যা খুশি করে বেড়াচ্ছে, তাদের মতই ওই কাল্টের নেতারা, তাদের শিকার হয়েছে বেচারা জুবায়ের।

‘মৃত্যু চাওয়া উচিত নয় তোমার,’ বলল এলেনা।

‘খুন করার আগে টিটকারি দেবে, অনেক অত্যাচার করবে, ‘ দুর্বল স্বরে বলল জুবায়ের।

হাত বাড়িয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিল. এলেনা।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল তরুণ। ভেঙে গেছে বুক। মুখ তুলে দেখল এলেনাকে। গাল ভেসে যাচ্ছে অশ্রুর স্রোতে। বিড়বিড় করে বলল, ‘ওরা বলবে, আমি গাদ্দার। সত্যিই তা-ই। সর্বশক্তিমানের কথা ভুলে ওদের সঙ্গে মিশতে গিয়েছিলাম, আবার ওদের সঙ্গেও গাদ্দারি করেছি।’

‘এসব ভুল কথা,’ বলল এলেনা।

‘তা-ই বলবে ওরা,’ জোর দিয়ে বলল জুবায়ের।

‘না,’ মাথা নাড়ল এলেনা, ‘ভালরা বলবে, ওই যে দেখো জুবায়ের পাশাকে। সে সবচেয়ে কালো আঁধারে ইবলিশকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, নইলে আজ ধ্বংস হতো পৃথিবী। নইলে আমরা কেউ বাঁচতে পারতাম না।’

বিস্ফারিত চোখে এলেনাকে দেখল জুবায়ের, চোখে সামান্য আশার আলো। এখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কিন্তু থেমে গেছে প্রলাপ।

পেরিয়ে গেল মিনিট দশেক। বন্ধ হলো কান্না। জুবায়েরের হাতে এখনও হ্যাণ্ডকাফ, কিন্তু ওকে আস্তে করে মেঝেতে শুইয়ে দিল এলেনা। হাত বুলিয়ে দিল ওর কপালে। একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত তরুণ।

ছোট্ট ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল এলেনা। পরে এনআরআই-এর এজেন্টরা এসে সরিয়ে নেবে জুবায়েরকে। বসের সঙ্গে আলাপ করবে ও, যেন ছেলেটাকে ছোটখাটো কোনও চাকরি দেয়া হয় আমেরিকায়।

নিজের গাড়ির কাছে পৌছে গেল এলেনা।

গাড়ির পাশে আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। 

‘বলল কিছু?’ জানতে চাইল রানা।

আস্তে করে মাথা দোলাল এলেনা, খুব ক্লান্ত। ‘তোমাকে গুলি করতে হয়েছে ভাবতে গেলে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।’

‘কাজ তো হলো?’ হাসল রানা। ‘কিন্তু কখনও রায়ট পুলিশ বলতে এলে যে রাবারের বুলেটে তেমন ব্যথা লাগে না, দেরি না করে ছিঁড়ে নেব তার কান!’

‘লাল রঙের কমবিনেশন দারুণ ছিল।’

‘ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারীর রোল করতে গিয়ে আরেকটু হলে বুক থেকে ব্যাগটাই পড়ে যেত,’ বলল রানা।

‘যার শেষ ভাল, তার সবই ঠিক,’ মৃদু হাসল এলেনা। ‘এবার এনআরআই এজেন্ট সরিয়ে নেবে জুবায়েরকে। পরে পাঠিয়ে দেবে ওকে আমেরিকায়। ওর মাকেও। যার ভেতর দিয়ে গেল, চাই না এরপর ওদের কষ্ট আরও বাড়ুক

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘আমারও মনে হয়েছে, ছেলে হিসেবে খারাপ নয় ও। সবারই ভুল হয়। কম আর বেশি।

রানার চোখে চোখ রাখল এলেনা। বাঙালি গুপ্তচরের অদ্ভুত গুণ, কাউকে ছোট করে দেখে না। প্রয়োজনে যেমন কঠোর হতে জানে, তেমনি মানুষের উপকারে লাগতেও দেরি করে না। ফিসফিস করে বলল এলেনা, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, রানা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *