মৃত্যুঘণ্টা – ২৮

আটাশ

যে লোহার আঁধার ঘরে পাল্টে দেয়া হয়েছে জুবায়ের পাশার নাম, সেখানেই কাল্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা মার্ডকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মামবা। জরুরি কাজের জন্যে ডাকা হয়েছে ওকে।

ওদের সামনে উপস্থিত লোকটি বয়স্ক। মাথার চুল সব ধূসর। গায়ের ত্বক বাদামি।

তাকে আবু রশিদ বলে ডাকছে কাল্টের দ্বিতীয় নেতা। ‘তোমার জন্যে একটা জিনিস আছে,’ বলল মাৰ্ডক।

‘আপনার কিছুই আমার চাই না,’ বললেন রশিদ।

অসুস্থকর খলখল হাসি হাসল নেতা। ‘আমি যা দেব, ওটা আগে তোমারই ছিল। অন্তত তা-ই বলতে।’

আবু রশিদের কথার সুরে মামবা বুঝেছে, সে মিডল ইস্টের লোক। তবে আরব নয়, ইরানিয়ান। কেন ধরে আনা হয়েছে, জানে না ও। প্রচণ্ড পেটানো হয়েছে বয়স্ক লোকটাকে। ফেটে গেছে গাল-চিবুক। দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে টলছে। এক চোখ নেই, কিন্তু ওটা অনেক পুরনো ক্ষত।

‘আহসান মোবারকের বন্ধু ছিলে,’ বন্দিকে বলল মার্ডক, ‘সে বলে গেছে কী বিশ্বাস করো তুমি।’

‘নির্যাতন করে তাঁর মুখ থেকে এসব বের করেছেন।’

‘মোবারক গাদ্দারি করার অনেক আগেই এসব বলেছে।’

‘আপনাদেরকে ত্যাগ করেছিলেন বলে তাঁকে খুন করেছেন,’ বললেন রশিদ।

‘না, তা করেছি গাদ্দারি করেছে বলে।’

‘কোন্ অধিকারে মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন?’ রাগী সুরে বললেন প্রাক্তন আর্কিওলজিস্ট।

‘স্রষ্টা যেমন প্রথম থেকেই যা খুশি করছে, আমরাও তার মতই একই কাজ করছি,’ বলল মার্ডক, ‘মোবারক এটা ভাল করেই বুঝত। জানত, দলের বিরুদ্ধে গেলে শাস্তি পেতে হবে। দলের সবাই এটা জানে।’

দীর্ঘ এক কার্ডবোর্ডের টিউব তার হাতে। ওটা নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। টিউবের ভেতরে কী, জানে না মামবা।

‘আমি কোনও কাজে আসব না,’ বললেন রশিদ। ‘আগেও সহ্য করেছি অনেক নির্যাতন। যা খুশি করুন, আমি তৈরি।’

খপ করে রশিদের কান খামচে ধরে নিজের মুখের কাছে টেনে আনল মার্ডক। মনোযোগ দিয়ে দেখছে পুরনো ক্ষত। কয়েক  সেকেণ্ড পর বলল, ‘আমরা অনেক বেশি কিছু করতে পারি।’

কান ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে রশিদকে একটা চেয়ারে ফেলে দিল সে। তুলে নিল লম্বাটে কার্ডবোর্ডের টিউব। খুলল।

কোনও অস্ত্র দেখবে ভেবেছিল মামবা। বর্শা, তলোয়ার বা ধারালো ফলার কোনও অস্ত্র। না, জিনিসটা ধাতু দিয়ে তৈরি হালকা পাত। খোদাই করা।

মুড়িয়ে রাখা জিনিসটা টেবিলে রেখে খুলছে কাল্টের নেতা। উত্তেজনার বশে উঠে দাঁড়ালেন আবু রশিদ। একটু ঝুঁকে গেলেন টেবিলের দিকে।

চুপচাপ দেখছে মামবা। খুব সাবধানে পাতলা ধাতুর পাত খুলল মার্ডক। তার নির্দেশে দলের একজন আঙুল দিয়ে টিপে ধরল ধাতুর পাতের দু’দিক, যাতে আবারও মুড়িয়ে না যায়।

পাতের ওপর চোখ রেখে অবাক হলো মামবা। তামার লিপি। তার ভেতর কয়েক রকমের সিম্বল।

‘জীবনের অর্ধেক সময় পার করেছ এটা আবারও দেখবে সে আশায়,’ বলল মার্ডক। ‘এবার সুযোগ পাচ্ছ পড়ে দেখার।’

মুখ তুলে তাকালেন আবু রশিদ।

‘ভুলেও মিথ্যা বলবে না। অন্যদের কাছ থেকেও পরীক্ষা করিয়ে নেব, তুমি ঠিক বলেছ কি না।’

‘এসব জেনে কী লাভ আপনার?’ জানতে চাইলেন রশিদ। ‘এটা অনেক প্রাচীন জিনিস।’

‘এটা প্রমাণ করবে ভয়ঙ্কর এক মিথ্যা ছড়ানো হয়েছিল,’ বলল মার্ডক।

‘কীসের মিথ্যা?’

‘যে আসলে স্রষ্টা আছে,’ বলল মার্ডক।

দ্বিধান্বিত হয়ে গেছেন রশিদ।

‘ছোট্ট একটা ভুল করেছিল বলে স্বর্গ থেকে বের করে দিল স্রষ্টা, মানুষ এসে পড়ল কঠিন এই জীবনে,’ বলল মার্ডক। ‘ওই ভুলের জন্যে মরতে হবে তাকে পৃথিবীতে। কেউ যাবে স্বর্গে, আবার কেউ নরকে। এসবই বলা হয়েছে। কিন্তু সত্যি যদি চিরকাল বেঁচে থাকে মানুষ, তো কীসের দরকার তার স্বর্গ বা নরকের? কেন মানুষ বিশ্বাস করবে একদল মানুষের তৈরি ভ্রান্ত স্রষ্টাকে!’

এর জবাব দিতে চাইলেন রশিদ, কিন্তু বুঝে গেলেন কিছু বলে লাভ হবে না। ওই লোক নিজেকে মনে করছে স্রষ্টার সমকক্ষ।

‘ওটাই পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় মিথ্যা,’ ধমকের সুরে বলল মার্ডক, ‘আর ওটা থেকেই এসেছে আরও একগাদা মিথ্যা। দুনিয়ার চার কোনায় যেখানে যাও, অনেক মানুষকে পাবে যে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে ক্ষমা চেয়ে। কিন্তু কোথাও নেই মুক্তি। স্রষ্টাই তো নেই! আর তাই কখনও ক্ষমা চাই না আমরা। যা করি, বুঝে শুনে করি। কারও ক্ষমার তোয়াক্কাও করি না।’

এক পা পিছিয়ে গেলেন রশিদ। কিন্তু তাঁর কাঁধ খামচে ধরল মার্ডক। কর্কশ সুরে বলল, ‘ভাল করে দেখো তামার লিপি!’

‘আপনি বদ্ধ-উন্মাদ!’ আতঙ্ক ভরা কণ্ঠে বললেন রশিদ, ‘আপনারা সবাই তা-ই! যারা আল্লার নাম ভাঙিয়ে অন্য মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, বা যারা সম্পদের লোভে যা খুশি তাই করে, আপনারা তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট!’

‘ওই তামার লিপিতে লেখা আছে সত্য,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল মার্ডক। ‘তুমি নিজে তা আগেই জেনেছ।’

‘না, প্রাণ থাকতে এই লিপি অনুবাদ করব না,’ কাঁপা গলায় বললেন রশিদ। ‘মারবেন? মেরে ফেলেন!’

ঘাঢ় ধরে তাঁকে তাম্রলিপির দিকে ঝুঁকিয়ে দিল মার্ডক, পরক্ষণে ওটার ওপর আছড়ে ফেলল তাঁর মুখ। ‘পথ দেখাবে তুমি!’ 

‘নরকে যান!’ ফুঁপিয়ে উঠলেন রশিদ।

হ্যাঁচকা টানে তাঁর মাথা ওপরে তুলল মার্ডক। প্রচণ্ড দুটো চড় খেয়ে পাশের দেয়ালে গিয়ে পড়লেন রশিদ। ওখান থেকে পিছলে মেঝেতে। রক্তপিশাচের কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে চাইলেন রশিদ।

কাল্টের এক লোককে ইশারা করল মার্ডক। ওই লোক রশিদকে তুলে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল নেতার দিকে। কয়েক পা সামনে বেড়ে নাগালের ভেতর অসহায় আর্কিওলজিস্টকে পেয়ে গেল মার্ডক। কোমর থেকে ছোরা বের করে ওটার কোপে কেটে দিল বন্দির হাতের দড়ি। এক এক করে দু’হাতের কবজিতে আটকে দিল দেয়ালের আঙটার হ্যাণ্ডকাফ। কয়েক দিন আগে ওখানেই বন্দি ছিল মামবা।

‘মামবা!’ রশিদের পা দেখাল মার্ডক।

বসে পড়ে আর্কিওলজিস্টের দু’পায়ে শেকল জড়াল মামবা। এমনভাবে টেনে দিল স্ট্র্যাপ, চাইলেও হাত-পা নাড়তে পারবেন না রশিদ।

‘আপনারা এসব কী করছেন?’ ভীত কণ্ঠে জানতে চাইলেন রশিদ।

জবাব দিল না কেউ।

দরজার দিকে চলল মার্ডক।

পাশের দেয়াল থেকে অ্যাসেটিলিন টর্চ নিয়ে জ্বেলে নিল কাল্টের এক সদস্য। নীল-সাদা আগুনের শিখা ছিটকে বেরোচ্ছে লকলক করে।

‘আমি পড়ব,’ বললেন রশিদ। ‘সবই খুলে বলব।’

মামবা বুঝে গেছে, যা করা হবে, তা ঠেকাতে পারবে না কেউ। অসুস্থ বোধ করল। মার্ডকের দিকে তাকাল। নেতা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।

ব্লো টর্চ হাতে রশিদের পাশে পৌঁছে গেল কাল্ট সদস্য।

‘এক মিনিট,’ বলল মার্ডক।

বুকের ভেতর ধকধক করছে মামবার হৃৎপিণ্ড। মনের ভেতর দুলে উঠল স্বস্তির মস্ত এক ঢেউ। যাক, মাথা কাজ করছে ইরানিয়ানের। হয়তো তাকে বাঁচতে দেবেন দ্বিতীয় প্রভু।

ব্লো টর্চওয়ালা সদস্যের দিকে চেয়ে হাসল মার্ডক। ‘কাজটা মামবাকে করতে দাও। অনেক কিছু শেখার আছে ওর। নইলে কী করে উন্নতি হবে?’ দরজা পেরিয়ে গেল সে, পেছনে ভিড়িয়ে দিল ধাতব দরজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *