বিশ
বিধ্বস্ত বৈরুত শহরের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় এলেনার মনে হলো, ও আছে এক পরাবাস্তব জগতে। অনেকেই জানে, প্রায় তিরিশ বছর ধরে লড়াই চলেছে এই দেশে। হামলা আর প্রতিহামলার কারণে শেষ ছিল না নাগরিকদের কষ্টের। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ যা জানে না, তা হচ্ছে, একসময় এই বৈরুত ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগর, এখানে ছিল নানান জাতের মানুষের আধুনিক সংস্কৃতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শহর ছিল মুসলিম ও খ্রিস্টানদের। দু’ধর্মের মানুষের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সমান। ক্ষমতা ভাগাভাগি করে চলতে সমস্যা হয়নি। এভাবেই পেরিয়ে গেছে বিশ বছরেরও বেশি। আধুনিকভাবে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক এলাকা, বাড়ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, তার ওপর তো আছেই ঐতিহ্যবাহী পর্যটন শিল্প।
ওই অদ্ভুত আনন্দের বিশ বছর বৈরুত ছিল আরব · দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা সব দেশের যোগসূত্র। মোনাকো বা দক্ষিণ ফ্রান্সের মতই বৈরুতের ক্যাসিনোতে হাজির হতো ইউরোপিয়ানরা। এই শহর ছিল ইউরোপে ঢোকার উপায়, আবার এটাই ছিল মিডল ইস্টে যাওয়ার সহজ পথ।
কিন্তু এরপর এল দুঃসময়। খ্রিস্টানদের চেয়ে দ্রুত বাড়তে লাগল মুসলিমদের জনসংখ্যা। মুসলিম নেতারা চাইলেন, তাঁদেরকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। সন্দেহের ভেতর পড়লেন খ্রিস্টান নেতারা। মাত্র কয়েক দিনের ভেতর এই শহর ও দেশের বুকে নেমে এল দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ। এমনই এক যুদ্ধ, যেটাতে জড়িয়ে গেল সিরিয়া, ইজরায়েল ও ইউনাইটেড স্টেট্স্।
বদ্ধ উন্মাদের মত লড়াইয়ের প্রথম দশকে ভাগ করে নেয়া হলো শহর। একদিকে খ্রিস্টানরা, অন্যদিকে মুসলিমরা। মাঝে ফাঁকা জায়গা। ওটা হলো অলিখিত নো-ম্যান’স্-ল্যাণ্ড।
দু’পক্ষ থেকেই চেষ্টা হলো, যাতে নতুন করে গড়ে তোলা যায় শহর। নিজেদের দলের আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ল সাধারণ মানুষ। ফাঁকা জমির ওদিকের শত্রুদের দিকেও রাখা হলো নজর।
একসময় নিজেদের সব হতাশা, দুঃখ, হিংসা বা ঘৃণাকে কাটিয়ে আবারও একে অপরকে বুকে টেনে নিল লেবানিজরা। বারবার এসেছে তীব্র সব ভূমিকম্প, আগ্রাসী হয়েছে ভিন দেশ, দখল করেছে বৈরুত, মাটিতে মিশে গেছে শহর ভয়ানক আগুনে, কিন্তু দমে যাওয়ার মানুষ নয় ওরা।
রুপালি এসইউভিতে (স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্) চেপে শহরের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিটি ব্লকে এলেনা দেখল একের পর এক ক্রেন। রাস্তায় কাজ করছে বুলডোযার ও নানান ইকুইপমেন্ট। জ্যাম লেগে যাচ্ছে ওগুলোর জন্যে। হর্ন বাজিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে ড্রাইভাররা। কিন্তু থেমে নেই উন্নয়নের ধারা, নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক শহর।
মুসলিমদের এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় নতুন সব হোটেল ও অফিস বিল্ডিং দেখল এলেনা। ওকে নিয়ে গাড়ি চলেছে সাগর তীর ঘেঁষে। পিজিয়ন্স রক পেরিয়ে পৌছে গেল সেইণ্ট জর্জ ইয়ট ক্লাবে।
ব্যস্ত এলাকা, বন্দরের নানাদিকে নোঙর করেছে এক শত ফুটের সব ইয়ট। আরও একটু বাইরের দিকে মৃদু ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছে আশি ফুটের সব সেইলবোট ও ছোট সি-ক্রাফট।
গাড়ি পার্ক করে পিয়ারে উঠে চকচকে এক নীল মোটর ইয়টের সামনে হাজির হলো এলেনা। ইয়টের পাশে লেখা: আলিবাবা। ওটার ডেকে ওঠার আগেই গার্ডকে দেখাতে হলো ক্রেডেনশিয়াল। কাগজপত্র পরীক্ষা করে পথ ছেড়ে দিল লোকটা। এবার দ্বিতীয় এক লোক এসে এলেনাকে নিয়ে গেল ডেকের ছাউনি দেয়া এক জায়গায়। ছোট একটা টেবিলে খাবার নিয়ে ব্যস্ত নাসের আল মেহেদি।
পরনে তার বুক খোলা শার্ট। পেট-বুক ভরা কালো রোম। গলার কাছে ঝুলছে ভারী কয়েকটা সোনার চেন ও লকেট। এলো চুল উড়ছে মৃদু হাওয়ায়। মেহেদির দুই পাশে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে দু’জন বডিগার্ড।
এলেনা টেবিলের কাছে পৌঁছতেই উঠে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলল মেহেদি, ‘আপনি এলেনা রবার্টসন।
‘আর আপনি কন্ট্রাক্টর নাসের আল মেহেদি,’ বলল এলেনা, ‘মিস্টার রানার বন্ধু।
‘দুটোই হতে পেরে খুশি,’ হাসল মেহেদি। হাতের ইশারায় পাশের চেয়ার দেখাল। ‘প্লিয, বসুন।
এলেনা বসার পর নিজের চেয়ারে বসল মেহেদি। তার ইশারায় এসে সুন্দর একটা গ্লাসে এলেনার জন্যে পানি ঢেলে দিল এক ওয়েটার।
একবার মিস্টার মেহেদি, আরেকবার বডিগার্ডদেরকে দেখে নিয়ে বলল এলেনা, ‘আমরা এখানে গোপনীয় বিষয়ে আলাপ করতে পারি?’
রানার বন্ধু মাথার ইশারা করতেই দূরে গিয়ে থামল দুই বডিগার্ড। এখন আর কিছু শুনতে পাবে না।
‘মিস্টার রানা কি আপনাকে বলেছেন কেন এসেছি?’
‘আপনি নিলামে অংশ নেবেন… এমন কিছু জিনিস, যেগুলো বাজারে পাওয়া যায় না।
‘আপনি জানেন কোথায় হবে এই নিলাম?’ জানতে চাইল এলেনা।
‘জানি,’ বলল মেহেদি। ‘আপনি নিলামে অংশ নেবেন, না শুধু দেখার জন্যে?’
‘দুটোই হতে পারে,’ বলল এলেনা, ‘আবু রশিদ ও মোবারক নামের দু’জন লোক বিশেষ কিছু চেয়েছিলেন। আমি সেসব পারলে কিনে নেব।’
‘রানা বলেছে, টাকার ব্যবস্থা করে দেবে আমেরিকান সরকার, ঠিক?’
‘হ্যাঁ। আপনি কি জানেন জিনিসগুলো কী?’
‘এখনও না। অবশ্য শুনেছি, আবু রশিদ ওগুলো হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেকদিন আগে। নতুন করে ফিরে পেতে চাইছেন।’
মাথা দোলাল এলেনা। ‘আপাতত তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে খুন হয়ে গেছেন মিস্টার মোবারক। ওই নিলামে অংশ নিতে চেয়েছিলেন দু’জনই। ওখানে গেলে হয়তো জানব কী হয়েছে তাদের।’
‘তো তাদের পেছনে লেগেছে অন্য কেউ?’ আনমনে বলল মেহেদি।
‘কেউ নয়, একদল লোক,’ শুধরে দিল এলেনা।
‘তা-ই?’
‘হ্যাঁ। ওরা একটা কাল্টের লোক, ধ্বংস করতে চায় সব ধর্মের স্রষ্টাকে।
হেসে ফেলল মেহেদি। ‘মানুষকে আবার কীসের ভয় স্রষ্টার?’
‘স্রষ্টার ভয় নেই, কিন্তু সেই সাথে মানুষের ক্ষতি করবে ওরা।’
ঠোঁটের কাছে পানির গ্লাস তুলেও থেমে মাথা দোলাল ব্যবসায়ী। পড়ে গেছে চিন্তার ভেতর। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আপনি কি জানেন, আসলে কেন সঙ্গে রাখি বডিগার্ড?’
আঁচ করতে পারল এলেনা। মুখে কিছু বলল না।
‘যাতে খামোকা খুন না হয়ে যাই,’ বলল মেহেদি, ‘আমরা লেবানিজরা মিলেমিশে থাকতে পারব। কিন্তু সিরিয়া, ইজরায়েল বা ইরানের সরকারি এজেন্টরা চাইছে আমাদের ভেতর লড়াই চলতে থাকুক। কাজেই সাবধান না হয়ে উপায় নেই। রানা আমার পুরনো বন্ধু। ওর বান্ধবী আপনি। নিরাপদে ওই নিলামে আপনাকে পৌছে দেয়া বা আবার ফিরিয়ে আনা আমার দায়িত্ব। আপনার প্রশংসা শুনেছি ওর মুখে। কখনও মিথ্যা বলে না ও।’
‘আমাকে সঙ্গ দিতে হবে, এমন কথা নেই,’ বলল এলেনা। ‘আপনি শুধু ওই নিলামে পৌঁছে দিয়ে জানিয়ে দেবেন, ওখানে কীসের ওপর চোখ রাখতে হবে। বাকি কাজ আমি করব।’ মাথা নাড়ল মেহেদি। ‘তাতে সন্দেহ করবে অনেকে।’
‘আমি মহিলা বলে?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল এলেনা।
‘না,’ মৃদু হাসল কন্ট্রাক্টর। ‘কারণ আমি না গেলে ওরা সন্দেহ করবে।’
‘ও।’
‘আমরা কেউ লোভ থেকে মুক্ত নই, ভাল কিছু পেলে কিনব না কেন?’
‘বুঝলাম। নিলাম হবে কখন এবং কোথায়?
‘সন্ধ্যার আযানের পর নামাজ শেষ হলে শহরের ওদিকে একদল বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব,’ বলল মেহেদি। ‘তারপর দেখতে পাবেন আবু রশিদ কী হারিয়ে ফেলেছিল।’