মৃত্যুঘণ্টা – ২৯

ঊনত্রিশ

মোনার কথা শুনে চমকে গেছে রানা। মনে পড়ল, ডক্টর মোবারকের বুকে পুড়িয়ে লেখা হয়েছিল জেনেসিসের স্তবক। প্রাচীন সব আর্টিফ্যাক্টের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন বিজ্ঞানী। সুযোগ পেলে চোরাই আর্টিফ্যাক্ট বিক্রি করতেন আবু রশিদ। শোনা যায় নিজের জন্যে খরচ না করে ওই টাকায় বিপ্লবীদের জন্যে অস্ত্র কিনে দেশে পাঠাতেন। বৈরুতের

বৈরুতের এক নিলামে যেতে চেয়েছিলেন। সেটা জেনেই ওই শহরে গেছে এলেনা। কিন্তু এসবের সঙ্গে অমৃতের কী সম্পর্ক?

একটু বেসুরো হয়ে গেল ওর কণ্ঠ, ‘জীবন-বৃক্ষ?’

‘হ্যাঁ, স্বর্গের জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়ে পতন হয়েছিল অ্যাডাম ও ইভের, আর সব ছিল জীবন-বৃক্ষ। অনেকটা তেমনই ছিল পৃথিবীর বুকেও বিভিন্ন জায়গায় বেশকিছু বাগানে জীবন-বৃক্ষ। যারা খেত ওটার ফল, হতো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কখনও মরত না তারা।’

‘তোমার বাবা বিশ্বাস করতেন সত্যিই পৃথিবীর বুকে তেমন গাছ ছিল বা আছে?’

‘হ্যাঁ, বিশ্বাস করতেন। ‘

‘ডক্টর মোবারক আর আবু রশিদ ভেবেছিলেন খুঁজে পাবেন সেই বাগান, যেখানে আছে অমৃতের গাছ?’

‘হ্যাঁ, পাগল ভেবে বোসো না।’ একটু থেমে তারপর জানতে চাইল মোনা, ‘বলো তো কতটুকু জানো জেনেটিকস সম্পর্কে?’

বহু কিছুই জানে রানা। কয়েক দিন আগেও কিছুই জানত না। তারপর এলেনার অনুরোধে এনআরআই-এর এক গবেষকের হাতে তুলে দিয়েছিল নিজেকে। নাম তার লাউ আন। লাউ না এনে পুরো দুইঘণ্টা ওর ওপর বক্তৃতা দিল চিনে ব্যাটা। শেষ দিকে কেমন ধরে গেল ওর মাথাটা, মনে হচ্ছিল লাউটাউ দিয়ে হবে না, এর মাথায় ভাঙা দরকার কাঁচা কাঁঠাল।

‘যতটুকু জানি, সেসব ভাইরাসের সঙ্গে জড়িত।’

‘ঠিক আছে। শুধু এটুকু জানলেই হবে, বহু দিন বেশি বাঁচে অনেক প্রাণী, নানান কায়দায়। আসল কথা বেশি দিন বাঁচা। যেসব প্রাণীর আয়ু কম, তারা বংশ রক্ষা করতে গিয়ে চট্ করে বাচ্চা নেয়। এই সুবিধা করে দিয়েছে প্রকৃতি। আবার এমন সব গাছ আছে, যেগুলো বেঁচে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। এসব গাছ অমৃত তৈরি করে না। ওরা কীভাবে যেন জেনে গেছে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার কৌশল। যেমন আছে এক ধরনের জেলি ফিশ। ওটার নাম টারিটোপ নিউট্রিকিউলা— প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর মরে যাওয়ার বদলে নিজেকে আবারও তরুণ করে তোলে। একবার বুড়ো হয়, আবার হয়ে ওঠে তরুণ। এভাবে মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখিয়ে পার করে দেয় বহু বছর। কেউ ওদেরকে খেয়ে না ফেললে মরে না এরা।’

‘এসব জেলি ফিশ নিয়ে গবেষণা করছিলেন ডক্টর মোবারক?’ জানতে চাইল রানা।

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলাল মোনা, ‘কিন্তু ওরা অন্য নিয়ম মেনে চলে। ওদের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই মিনতির। জেলি ফিশের চেয়ে অনেক জটিল মানবদেহের যন্ত্রপাতি। মিনতির যেসব সেল মরে যাচ্ছে, তার বদলে যেসব জন্ম নিচ্ছে, সেগুলোর ভেতর থাকছে একই জেনেটিক কোড। রয়েই যাচ্ছে ত্রুটি। কোনওভাবেই ওর দ্রুত বয়স বেড়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারছি না আমরা। জন্ম নিচ্ছে না ভাল সেল। ওকে বাঁচাতে হলে নতুন করে লিখতে হবে জেনেটিক কোড। সেক্ষেত্রে হয়তো নতুন সেল হারিয়ে দেবে ত্রুটিযুক্ত প্রোজেরিয়ার সেলকে। বয়স কমে আবারও কিশোরী হবে ও, স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠবে।’

‘সেটা কী করে সম্ভব?’

‘মিনতির টেলোমার চেনের সেল থেকে জিন নিয়ে সুস্থ করে দিতে হবে ওটাকে, তারপর চাই ইমপ্লান্ট। এভাবে সারাতে হবে সারাশরীরের সেল।’

বিজ্ঞানীর বাড়ি থেকে এলেনার আনা তথ্য মনে পড়ল রানার। পরক্ষণে ভাবল ইউএন ভাইরাসের কথা। ওই ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে মানবদেহে সংক্রমিত হতে। ওটার সেলিউলার ইনফেকশন রেট নব্বুই পার্সেন্ট। ডক্টর তৈরি করেছিলেন মেয়ের অসুখ দূর করতে।

‘জিন ইমপ্লান্ট করতে একটা ভাইরাসকে ব্যবহার করবে তুমি?’

মাথা দোলাল মোনা। ‘এমন ভাইরাস, যেটা মানুষের সেল নষ্ট করবে না। তা হলেই মানুষের ডিএনএ-তে যোগ করে দেয়া  যাবে যে-কোনও নতুন গুণ।’

এলেনার আনা ডেটার একটা ট্রায়ালে দেখা গেছে, নব্বুই ভাগ সফলভাবে ইনফেক্ট করা সম্ভব। কিন্তু তা করতে গেলে মৃত্যুর ঝুঁকি খুব বেশি। কাজেই ডক্টর মোবারক ওই ট্রায়াল বাতিল করেন। ভাইরাস দিয়ে ভয়ঙ্কর বায়োলজিকাল অস্ত্র তৈরির ইচ্ছে ছিল না তাঁর।

‘প্রথম কাজ শেষ করেছেন ডক্টর,’ বলল রানা।

মাথা দোলাল মোনা। ‘হ্যাঁ, এক মাস আগে পাঠিয়ে দেন সব ডেটা। অনেক দিন কথা নেই, তারপর হঠাৎ করেই যোগাযোগ করলেন।’

সাহায্য চেয়েছিলেন ওর কাছে, বাধ্য হয়ে যোগাযোগের ঝুঁকি নেন, ভাবল রানা। বুঝে গিয়েছিলেন কী আসছে।

‘ট্রায়াল ৯৫২।’

অবাক চোখে রানাকে দেখল মোনা। হ্যাঁ, ঠিক! জানলে কী করে?’

‘হোটেলে তোমার প্রেয়েন্টেশনে দেখেছি।’

‘হ্যাঁ, ডেলিভারি ভেহিকেল আমাদের কাছে আছে, এবার চাই মেরামত করা ডিএনএ। ভরে দিতে হবে ভাইরাসের ভেতর।’

‘তোমার বাবার ট্রায়াল ৯৫২ অনুযায়ী কমে যায় আয়ু,’ বলল রানা।

‘কমতে হবে না.’ বলল মোনা। ‘আমরা ইঞ্জিনিয়ার করে তার ঠিক উল্টো কাজ করব। এখন দরকার শুধু সঠিক সুস্থ ডিএনএ।

‘পাওয়া যাবে ওই বাগানে?’ জানতে চাইল রানা।

‘সব ভাইরাসের হোস্ট লাগে।’ বলল মোনা, ‘এমন এক আস্তানা, যেখানে ক্ষতি হবে না তার, বিশ্রাম নিতে পারবে ওটা। ইবোলা, মারবার্গ… সবাই টিকে থাকে কোথাও না কোথাও। সুপ্ত বা আধাসুপ্ত হয়ে। তারপর সুযোগ পেলে মানুষের দেহে ঢুকে হয়ে ওঠে পুরো সজাগ। বুঝতেই পারছ, কেন নাম দেয়া হয়েছে এসব ভাইরাসের? সোয়াইন ফ্লু বা বার্ড ফ্লু? ওসব প্রাণীর শরীরে আরামে বাস করে ওরা।’

‘এ ক্ষেত্রে আধার হবে কোন্ জিনিস?’

‘প্রাচীন আমলে ছিল এক ধরনের গাছ,’ বলল মোনা। ‘ওটার ফলের ভেতর থাকত এক ধরনের ভাইরাস। ওটার কারণে বদলে যেত মানুষের ডিএনএ। ওই ফল যে খেত, হয়ে উঠত দীর্ঘায়ু। আসলে টেলোমারগুলো দীর্ঘ হতো বলেই সহজে আসত না মৃত্যু। প্রাচীন মানুষ বুঝত না কেন এমন হচ্ছে। কিন্তু এটা বুঝত, ওই গাছের ফল খেলে চিরকালের জন্যে বেঁচে থাকে মানুষ। তারা বলত, ওই ফল পাঠানো হয়েছে স্রষ্টার তরফ থেকে। স্বর্গের উদ্যান নাম দিত তারা ওই গাছের বাগানের। ওই গাছই আসলে জীবন-বৃক্ষ।’

মোনা থেমে যাওয়ায় রানা ভাবল, তা হলে আমাদের পরের কাজ হবে ওই উদ্যান খুঁজে বের করা।

‘মিথ্যা নয়, কিংবদন্তী,’ বলল মোনা। ‘অদ্ভুত কিছুও নয়। বলতে পারো সায়েন্স। আমরা হয়তো খুঁজে পাব ওই জীবন-বৃক্ষ। তা যদি পারি, বাঁচবে মিনতি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *