মৃত্যুঘণ্টা – ২৪

চব্বিশ

কাঁপতে কাঁপতে কোথায় যেন নেমে চলেছে প্রাচীন এলিভেটর। কাঠের দরজার সরু এক চিলতে ফাঁক দিয়ে বাইরে স্বল্প ওয়াটের মিটমিটে হলদে আলো দেখছে এলেনা। তাতেই বুঝতে পারছে, পেরিয়ে এসেছে দুই তলা। কিন্তু একেক তলা অনেক উঁচু। আরও কয়েক সেকেণ্ড পর তৃতীয়তলায় ঝাঁকি খেয়ে থামল এলিভেটর। দরজা খুলে দিল একহারা লোকটা। বেরিয়ে এসে চারপাশে স্যাণ্ডস্টোনের দেয়াল দেখল এলেনা। একপাশে বাড়ি মেরামতের ইকুইপমেন্ট, আরেক পাশে নিচু করে বাঁধা দড়ি। সাইনবোর্ডে লেখা: দয়া করে দড়ি পেরিয়ে যাবেন না।

‘আমরা এখন কোথায়?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘নতুন করে শহর গড়তে গিয়ে অতীত জানছি আমরা,’ বলল মেহেদি। এক্সকেভেশন দিক দেখাল। ‘একসময় ওদিকে ছিল রোমান বাথ।’

ওখানে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক, দু’জনের শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল আছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে।

‘এই পথে আসুন,’ ডানের করিডোর ধরে এগোল একহারা লোকটা।

করিডোর শেষ হলো এক স্টেয়ারওয়েলে। সিঁড়ির অনেক ওপরে কারুকাজ করা আর্চওয়ে। প্রাচীন শহর গড়ে তোলা হয়েছিল স্যাণ্ডস্টোন ব্যবহার করে।

‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ আবারও জানতে চাইল এলেনা।

থমকে গিয়ে ঘুরে ওকে দেখল একহারা লোকটা। পরক্ষণে মেহেদিকে বলল, ‘নিলাম নিচে হবে। নামতে হবে চল্লিশ ধাপ সিঁড়ি। মাদাম নামতে রাজি না হলে, বা কোনও অসুবিধে থাকলে, তাঁর হয়ে নিলামদাতাকে বলে দেব, তিনি আসছেন না। কিন্তু অংশ নিতে গিয়ে যে টাকা জমা দেয়া হয়েছে, সেটা ফেরতযোগ্য নয়।’

মেহেদিকে বলল এলেনা, ‘মাদামের কোনও অসুবিধে নেই। সে শুধু জানতে চেয়েছে, কীসের ভেতর গিয়ে পড়ছে।’

‘নিজেই দেখবেন।’ পাশের দরজা খুলে দিল লম্বু।

প্রথমে দরজা পেরিয়ে গেল এলেনা, তারপর মেহেদি। প্ৰায় অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলল ওরা। মূল শহরের অনেক নিচে পৌঁছে গেছি, ভাবল এলেনা। উচিত ছিল না গাউন পরা। বিপদ হলে দৌড়াতে পারবে না।

‘আমরা চলেছি ছয় হাজার বছর আগের ইতিহাসের মাঝখান দিয়ে,’ বলল রানার বন্ধু, ‘নিচে পাবেন বৈরুতের সবচেয়ে আগের ভূগর্ভের সমাধিক্ষেত্র। মৃতদেরকে ওখানে রাখত ফনেশিয়ানরা। অনেক পরে ওই একই কাজ করেছে রোমানরা। কিছু লিপি থেকে জানা গেছে, এখানে আছে ইউরোপ থেকে আসা ক্রুসেডারদের লাশও।’

‘তাতে আমার সমস্যা নেই, আপত্তি তুলব এখানে চিরকালের জন্যে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হলে,’ বলল এলেনা।

শেষ হলো সিঁড়ির ধাপ, পৌঁছে গেছে ওরা নিচের মেঝেতে। সামনেই লোহার গেট। হয়তো ক্রুসেডের সময়ের জিনিস। দুই কবাটের পাশে দুই লোক, হাতে অস্ত্র। ডানের লোকটা খুলে দিল একদিকের কবাট। তাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল মেহেদি।

পিছু নিয়ে জানতে চাইল এলেনা, ‘বিপদ হবে না তো?’

‘না,’ মাথা নাড়ল মেহেদি। ‘আমরা এখানে নিরাপদ।’ এনআরআই এজেন্ট হওয়ার আগে এলেনাকে কঠোর সব ট্রেনিং নিতে হয়েছে, সেগুলোর ভেতর একটি: চট করে মানিয়ে নেবে পরিবেশের সঙ্গে। এখন প্রশিক্ষকের কথা মনে পড়ল ওর। ওই একই কথা শুনেছে রানার মুখে: ‘যে-কোনও ঝামেলা থেকে বেরোতে পারে ভাল অপারেটর, কিন্তু সেরা অপারেটর এড়িয়ে যায় ঝামেলা।’

একবার পেছনের গেট, তারপর চেপে আসা দু’দিকের দেয়াল ও স্টেয়ারওয়েল দেখল এলেনা। ফাঁদে পড়ে গেছে বলে মনে হলো ওর। অবশ্য বুঝল, খুবই আত্মবিশ্বাসী নাসের আল মেহেদি।

মাথার ইশারা করে সরু করিডোর ধরে পা বাড়াল ঠিকাদার। সামনেই চার করিডোরের মোড়। মেঝে ও দেয়াল এখানে ভেজা। জায়গায় জায়গায় মেঝেতে পানির অগভীর ডোবা।

যথেষ্ট কারণ আছে বলেই প্রাচীন ফনেশিয়ানরা এ শহরের নাম দিয়েছিল: বৈরুত, অর্থাৎ কূপ। ভুল ছিল না কথায়। এই শহরের মাটি সামান্য খুঁড়লেই পাওয়া যায় প্রচুর পানি। প্রাচীন শহরের ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র থেকে খুব দূরে নয় ওঅটার টেবিল।

চারপাশে আর কেউ নেই। অবশ্য, বিশ গজ দূরেই নীরবে ডাকছে পুরু কাঠের এক দরজা। ওদিক থেকে এল মানুষের গলার আওয়াজ।

দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে টোকা দিল নাসের আল মেহেদি।

ওদিক থেকে খটাং শব্দে সরানো হলো ভারী বোল্ট। দরজা খুলে যেতেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় ওরা দেখল বিশাল এক ঘর। জড় হয়েছে কমপক্ষে বিশজন লোক। সবার পরনেই ওপরের ওই পার্টিতে ব্যবহার করা পোশাক।

সমাধিক্ষেত্রের মতই মস্ত এ ঘরও স্যাণ্ডস্টোনের তৈরি, তবে ঝেড়েমুছে রাখা। ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ জায়গায় উজ্জ্বল আধুনিক বাতি। এখানে ওখানে কমপিউটার টার্মিনাল। ঘরের এক কোণে ছোট বার। একদিকের দেয়ালে রয়েছে একের পর এক অ্যালকোভ। ঘরের শেষ মাথায় আরেকটা দরজা, হুড়কো দিয়ে আটকে রাখা।

এলেনার মনে হলো, কারও ব্যক্তিগত লাউঞ্জে ঢুকে পড়েছে।

কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও হাজির হলো একহারা লোকটা। চোখে এখন অন্য ধরনের দৃষ্টি। বিনীত চাকর নয়, হাঁটার ভঙ্গিতে মালিকের গর্ব। অন্য কোনওভাবে পৌঁছেছে ঘরে।

‘সবাই যখন পৌঁছে গেছেন, দয়া করে সময় নিয়ে দেখুন কী  ধরনের জিনিস কিনতে চান,’ বলল লম্বু। প্রাচীন একটা চাবি বের করে ঘরের শেষমাথার দরজা খুলল। তার পিছু নিয়ে ভেড়ার পালের মত ওদিকের ঘরে গিয়ে ঢুকল সবাই। নানান জিনিস দেখে স্থির করবে কী কিনবে।

অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে এলেনা। সাবধানে দেখতে লাগল সব আর্টিফ্যাক্ট। প্রথম দুটো মনে হলো গ্রিক বা মিনোয়ান মাস্ক। এরপর তৃতীয় জিনিস গিলগামেশের ছোট এক মূর্তি। চতুর্থ তাম্রলিপি। পাশেই সুমেরিয়ান লেখা ভরা কাদার এক ট্যাবলেট। তার ওদিকে পারস্যের প্রথম সাম্রাজ্যকালীন পাথরের এক দেবী মূর্তির মুখ

এসব আর্টিফ্যাক্ট থেকে একটু দূরে চার ফুটি এক বর্শা, এক দিকে লোহার তীক্ষ্ণ ফলা, অন্যদিকে রুপার কাঁটাতার। এসব বর্ণাকে বলে ডোরি, গ্রিক স্বর্ণযুগে ব্যবহার করত স্পার্টার হোপলাইট সৈনিক।

শেষ আর্টিফ্যাক্ট একটা প্যাপিরাস। তার বুকে গিজগিজ করে কালো কালিতে লেখা। পড়তে চাইলে আগে ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু সবার হাতে ধরিয়ে দেয়া কাগজ অনুযায়ী: ডেড সি-র স্ক্রলের মতই ওই প্যাপিরাসে আছে অ্যারামাইক ভাষা। কার বাপের সাধ্যি বুঝবে ওসব!

তিক্ত হয়ে গেল এলেনার মন। এসব জিনিস সত্যিকারের, নকল নয়। নিউয পেপার ও ইনশ্যরেন্স ক্লেইম অনুযায়ী চুরি হয়েছে নানান দেশের জাদুঘর বা সংগ্রাহকদের কাছ থেকে। অবশ্য, কোথাও থেকে চুরি করা হয়নি তাম্রলিপিটা,।

‘কিছু পছন্দ হলো?’ এলেনার কানের কাছে বলল মেহেদি।

‘এখনও না,’ বলল এলেনা, ‘কিন্তু আবু রশিদ আগ্রহী ছিল ওই তাম্রলিপি কেনার জন্যে।’

‘কয়েকজনের কাছে শুনেছি, লোকটা বলেছিল ওই লিপি খুঁজে পাওয়া যে কারও সারাজীবনের সেরা কাজ হতে পারে।’

‘প্রমাণীকরণ নেই কেন?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘হয়তো সরাসরি এসেছে এক্সকেভেশন এলাকা থেকে, বা কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছ থেকে, অথবা এতই বিরল যে ওটার কথা কেউ কিছু জানাতে পারেনি,’ বলল মেহেদি।

নকল জিনিস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, ভাবল এলেনা। তাম্রলিপির বিষয়ে লেখা কাগজে চোখ বোলাল। জিনিসটা দৈর্ঘ্যে চল্লিশ ইঞ্চি। বাটালির মত কিছু দিয়ে পেছন থেকে টোকা দিয়ে ওপরদিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লেখা। পোস্টার বা দানবীয় ধাতব সুইস রোলের মত। লিপি খুলে ছবি তোলা হয়েছে অদক্ষ হাতে। আলো এতই কম, লেখা বোঝা কঠিন। কোনওখানে বলা হয়নি কোথা থেকে পাওয়া গেছে তাম্রলিপি। কেউ চেষ্টাও করেনি অনুবাদ করতে।

‘সত্যি যদি আর্কিওলজিস্টদের কারও চোখে না পড়ে থাকে, আমরা বুঝব কী করে, কোনও গ্যারাজে বসে কেউ এই কাজ করেছে কি না?’

কাঁধ ঝাঁকাল মেহেদি। ‘ক্যাভিয়্যাট এস্পটর।’

‘বুঝেশুনে সাবধানে কিনতে হবে, এই তো?’

মাথা দোলাল কন্ট্রাক্টর। ‘যা করার করবেন, কিন্তু একটা কথা বলে রাখি, এই তাম্রলিপির জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল আবু রশিদ। কেন, তা আমরা জানি না।’

তার খুব দরকার ছিল, ভাবল এলেনা। কিন্তু এই জিনিস দিয়ে কী করবে কোনও জেনেটিসিস্ট কিংবা কাল্ট? এটা দিয়ে তো দুনিয়া জুড়ে প্লেগ তৈরি করতে পারবে না কেউ। বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।

‘এক গ্লাস পানি পেলে ভাল হতো,’ বলল এলেনা।

‘বার থেকে আনছি,’ বলল নাসের আল মেহেদি। ‘ভুলেও বেশি নজর দেবেন না জিনিসটার ওপর, দাম বেড়ে যাবে। আপনার দেখাদেখি অন্তত এক ডজন লোক ওটা কিনতে চাইবে।’

মৃদু হাসল এলেনা, মনোযোগ দিল চারপাশের লোকগুলোর ওপর। সব মিলে তারা আট দল। তিন দম্পতি। আলাদা দুই লোক। এদের দেখলেই মনে হয়, এসেছে মেডিটারিয়ান এলাকার বড় পরিবার থেকে। এখনও উড়িয়ে দিতে পারেনি সব টাকা। এ ছাড়াও আছে তিনটে দল। তাদের ভেতর দু’জন আরব, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। একটু দূরে এক ইউরোপিয়ান যুবক, আঙুলে দামি হীরার আংটি। পরনের সুট রাজকীয়। চেহারা দেখে মনে হলো সত্যিকারের সমঝদার লোক।

সে বার থেকে এক গ্লাস ওয়াইন নিতেই তার দিকে মনোযোগ দিল এলেনা। লোকটার হাতের তালু ভরা কড়া। আঙুল পরিশ্রম করা মানুষের। নিজ পয়সা খরচ করতে এখানে আসেনি। যারা এসেছে, তাদের বেশিরভাগই হয়তো এমন।

দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরল নাসের আল মেহেদি। নিজের জন্যে শ্যাম্পেন, এলেনার জন্যে পানি। তাকে মনে হলো বেশ হতাশ।

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘এদের বেশ কয়েকজনকে চিনি,’ বলল কন্ট্রাক্টর। ‘আজ রাতে বেরিয়ে যাবে আপনাদের সরকারের অনেক টাকা।

মৃদু হাসল এলেনা। ‘চাপ দিয়ে পাবলিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে যা খুশি করা সব দেশের সরকারের জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে!’

কয়েক মুহূর্ত পর সবাইকে নিয়ে প্রকাণ্ড ঘরে ফিরল একহারা লোকটা। এলেনা ও মেহেদিকে নিয়ে ঢুকল সে এক অ্যালকোভে। পেতে রাখা হয়েছে দামি কয়েকটি চেয়ার ও ছোট এক টেবিল। একইভাবে সাজানো অন্যান্য অ্যালকোভ। প্রতিটিতে থাকবে নিলামে ডাক দেয়া একেকটি করে দল।

এলেনার হাতে একটা আইপ্যাড ধরিয়ে দিল লম্বু। ‘এটার মাধ্যমে বুঝবেন কখন কী জিনিস তোলা হবে নিলামে। এ ছাড়া, কেউ ডাক দিলে সেটাও দেখতে পাবেন।

‘কিন্তু কে আসলে ডাক দিল, তা জানব না,’ আন্দাজ করল এলেনা।

‘হ্যাঁ, মাদাম, এসব জিনিসের ক্রেতারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হন।

‘আমার মতই আর কী।’

তাড়া খাওয়া তেলাপোকার মত ছেঁচড়ে বেরিয়ে গেল লম্বু। ঢুকল গিয়ে পাশের অ্যালকোভে। এলেনার উল্টো দিকের চেয়ারে বসল কন্ট্রাক্টর মেহেদি। সামনে ঝুঁকে নিচু স্বরে জানতে চাইল, ‘আপনি তো বোধহয় আসলে নিলামে ডাক দেবেন না?’

‘বলা যায় না,’ বলল এলেনা, ‘অন্তত সবকিছু কিনতে চাইব না।

আরেক চুমুক শ্যাম্পেন নিল রানার বন্ধু। মনে হলো এলেনার কথা শুনে একটু চমকে গেছে।

টিং আওয়াজে বাজল ঘণ্টি। বড় ঘর থেকে এল একহারা লোকটার গলা, ‘আমরা এবার নিলামে তুলছি প্রথম আইটেম।’

আইপ্যাডে মন দিল এলেনা। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল স্ক্রিনে চারটে ডাক। প্রথম ডাকের পর ক্রমেই বেড়েছে টাকার অঙ্ক। সবুজ একটা বার দেখিয়ে দিচ্ছে কত পর্যন্ত খরচ করলে জিনিসটা হাতে পাওয়া যাবে। বর্তমান ডাক অনুযায়ী সুমেরিয়ান ট্যাবলেটের জন্যে একজন দিতে রাজি এক লাখ বিশ হাজার ডলার।

‘প্রশংসনীয় অত্যাধুনিক সেটআপ,’ বলল এলেনা, ‘এটা চালাচ্ছে কারা?’

‘সেটা জানা কঠিন, তবে চিকন লোকটাকে এসব চালাবার  দায়িত্ব দেয়া হয়েছে,’ বলল মেহেদি, ‘দুনিয়ার চারপাশ থেকে আসছে আর্টিফ্যাক্ট। তবে আপাতত বেশি আসছে ইরাক থেকে। ওদের একের পর এক সাইট লুঠ হচ্ছে। এমনও হয়েছে, চোরাই জিনিস বিক্রির পর ক্রেতার কাছ থেকে চুরি হয়ে গেছে। আবারও বিক্রি হয়েছে এই নিলামে।’

আইপ্যাডের দিকে তাকাল এলেনা। ডাক গিয়ে উঠেছে দু’ লাখ ডলারে। স্পর্শ করেছে সবুজ রিযার্ভ বার। পরের কয়েক সেকেণ্ডে সবুজ লাইন পেরিয়ে গেল টাকার অঙ্ক।

এলেনা খেয়াল করল, অন্য সব নিলামের মতই এখানে প্রতিযোগিতায় নেমেছে মাত্র কয়েকজন। মালিক পক্ষের দিক থেকে এটাই ভাল কৌশল। একজন জানবে না, আসলে কে বা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ফলে জেদ ও গর্ব বাধ্য করবে বেশি টাকা দিয়ে জিনিসটা কিনতে।

প্রথম আইটেম বিক্রি হলো দু’ লাখ আশি হাজার ডলারে।

মস্ত ঘরের মাঝে দুই গার্ড মখমল দিয়ে মুড়িয়ে দিল কারও অমূল্য আর্টিফ্যাক্ট। ওটা চলে গেল কাঠের বাক্সের ভেতর। মোম সিল মেরে সরিয়ে রাখা হলো।

এবার এল একহারা লোকটার কণ্ঠ: ‘এবার নিলামে উঠছে পারস্যের দেবী।’

এবার ডাক দিল এলেনা। এক লাখ ডলার।

‘সাবধান,’ বলল কন্ট্রাক্টর মেহেদি। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দ্বিগুণ হলো ডাকের অঙ্ক। স্বস্তির শ্বাস ফেলল মেহেদি।

এলেনার কারণে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে দু’দল লোক। কয়েক দফা দাম বাড়ল জিনিসটার। তারপর হার মেনে নিল এক পক্ষ।

‘চার লাখ সত্তর হাজার ডলার,’ বিড়বিড় করল এলেনা। ‘দেবীর পুরো শরীর পেলে কত গুণ খরচ করত?’

‘এতই, যে কখনও কিনতে পারতাম না,’ জোর দিয়ে বলল মেহেদি।

ঘরের মাঝে দেবীর মূর্তির মাথা মখমল দিয়ে মুড়িয়ে কাঠের বাক্সে রেখে দিল দুই গার্ড। বুকে মোমের সিল নিয়ে বাক্স চলে গেল একপাশে।

‘ওই সিল দিয়ে প্রমাণীকরণ করা হলো,’ বলল এলেনা। ‘আনুষ্ঠানিকতা,’ বলল মেহেদি, ‘এরা যে ধরনের লোক, কিছু চুরি করলে খুন হয়ে যাবেন ওদের হাতে।’

তৃতীয়বারের মত বেজে উঠল ঘণ্টি।

এবার নিলামে তোলা হলো গিলগামেশের মূর্তি।

পাঁচ লাখ ডলারে চট করে শেষ হলো ওটার জন্যে ডাক।

এবার চতুর্থ আইটেম: তাম্রলিপি।

স্ক্রিনের সবুজ বার জানিয়ে দিল, কমপক্ষে এক লাখ ডলার পেলে বিক্রি হবে।

চতুর্থ দলের তরফ থেকে এল ডাক: দেড় লাখ ডলার।

এলেনা ডাকল দু’ লাখ ডলার।

আট নম্বর প্রতিযোগী ডাকল আড়াই লাখ ডলার।

কিন্তু ওটাকে বাড়িয়ে তিন লাখ করল চার নম্বর দল।

তাদেরকে টপকে গেল এলেনা।

টাকার অঙ্কটা দেখে নিয়ে চুপ থাকল কন্ট্রাক্টর মেহেদি।

আবারও ডাকল চতুর্থ নম্বর। পাঁচ লাখ ডলার।

সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার ডাক দিল এলেনা। কিন্তু ওকে পেরিয়ে

গেল চার নম্বর। সে দেবে ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার।

‘খুব সাবধান,’ নিচু স্বরে বলল মেহেদি, ‘ওরা আপনাকে বড়শিতে বাজিয়ে নিয়েছে।’

একমত নয় এলেনা। ওর ধারণা, বরং কয়েকজনকে গেঁথে নিতে পেরেছে। এই জিনিস যদি এতই দরকার ছিল আবু রশিদের, সেক্ষেত্রে কাউকে নিলামে আকাশ পর্যন্ত তুলে দিলে, হয়তো বেরোবে কে বা কারা গুম করেছে আর্কিওলজিস্টকে বা খুন করেছে বিজ্ঞানীকে।

আট নম্বর দল থেকে ডাক দেয়া হলো সাত লাখ ডলার। তিন সেকেণ্ড পর বিরাট এক লাফে টপকে গেল চার নম্বর। আট লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার। এর কোনও দরকার ছিল না। বোধহয় নার্ভাস কোনও বিডার, খেলা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে প্রতিযোগীকে। ফলে খরচ করে বসছে অনেক বেশি টাকা।

এলেনা আট লাখ পঁচাত্তর হাজার ডলার ডাক দিতে চোখ কুঁচকে ফেলল কন্ট্রাক্টর। তখনই ওই অঙ্কের টাকাকে পিছনে ফেলল চার নম্বর— নয় লাখ পঁচিশ হাজার ডলার!

‘জানা দরকার এ কোন হারামজাদা,’ বিড়বিড় করল এলেনা। অ্যালকোভ সব আলাদা, কেউ কারও মুখ বা হাত দেখবে না।

ডাক দিতে চেয়েছে এলেনা, নয় লাখ পঁচাত্তর হাজার ডলার। কিন্তু লাল একটা লাইন ফুটে উঠল আইপ্যাডের স্ক্রিনে। আবারও ডাক দিতে গেল ও, কিন্তু দেখা দিল সেই লাল লাইন।

ওর অ্যালকোভে হাজির হলো একহারা লোকটা, ফিসফিস করে বলল, ‘মাদাম কি জমা টাকার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করতে চান?’

তাকে দেখল এলেনা, তারপর মেহেদির দিকে। ‘মাদাম কি বাড়তি টাকা পেতে পারে?’

চোয়াল ফুলে গেল কন্ট্রাক্টর মেহেদির। কয়েক সেকেণ্ড পর চোখে-মুখে নিদারুণ কষ্ট নিয়ে মাথা দোলাল।

‘সীমা কত?’ আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল লম্বু।

‘সব,’ কর্কশ স্বরে বলল মেহেদি, ‘পুরো তিন মিলিয়ন ডলার!’

খুব খুশি লম্বু, যেন এইমাত্র বড়শিতে গেঁথে নেটে তুলেছে মস্ত কাতলা মাছ।

‘পুরো খরচ করতে হবে, এমন নয়, কড়া চোখে এলেনাকে দেখল মেহেদি।

নিজের আইপ্যাডে কয়েকবার টোকা দিল লম্বু। আবারও সবুজ হলো এলেনার স্ক্রিনের লাইন।

এলেনা লক্ষ করল, কিছুক্ষণ ধরে কম টাকা বাড়িয়ে খেলছে চার নম্বর সদস্য। এর কারণ বোধহয়, টান পড়েছে তার পুঁজিতে।

বড় করে দম নিয়ে নতুন অঙ্ক টাইপ করল এলেনা। ডলারের অঙ্ক দেখে প্রায় অসুস্থকর সবুজ হলো কন্ট্রাক্টর মেহেদির চেহারা।

এন্টার বাটন টিপল এলেনা।

বিড করা হয়েছে পুরো দেড় মিলিয়ন ডলার!

প্রকাণ্ড ঘর ও সব অ্যালকোভ থেকে এল ফিসফিস কণ্ঠের আলাপ। টেবিলে মাথা রাখল মেহেদি। বুঝতে পারছে, কী সর্বনাশ হয়েছে!

তার দিকে ঘুরে আইপ্যাডের স্ক্রিন দেখাতে চাইল এলেনা। কিন্তু হাত সামনে বাড়িয়ে মাথা নাড়ল মেহেদি। ‘না রে, সিস্, আমি জানতেও চাই না।’

আবারও স্ক্রিনের দিকে তাকাল এলেনা। অপেক্ষা করছে, যে- কোনও সময়ে ওকে পেছনে ফেলবে চার নম্বর সদস্য। কিন্তু ঠিক তখনই ধূসর হলো স্ক্রিন। তার মানে, ওই আর্টিফ্যাক্টটা পেয়ে গেছে এলেনা। তাম্রলিপি এখন ওর। ভেরিফিকেশনের জন্যে ওর কাছে চাওয়া হলো একটা কোড। ওটা ইলেকট্রনিক সিগনেচার।

দেরি না করে নাসের আল মেহেদির হাতে আইপ্যাড ধরিয়ে দিয়ে খুশি খুশি সুরে বলল এলেনা, ‘আপনি অন্তত পাঁচ পার্সেন্ট পাবেন।’

‘নিজের সব টাকা খরচ করে তার পাঁচ পার্সেন্ট ফিরে পেলে চলবে আমার ব্যবসা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহেদি। করুণ চেহারায়  টাইপ করল কোড।

কাজ শেষ। আবু রশিদের ওই তাম্রলিপি এখন সত্যি এলেনার। জানে না, আসলে পুরো দেড় মিলিয়ন ডলার পানিতে ফেলল কি না। এবার কী করবে ভাবছে, এমন সময় বাইরের ঘর থেকে এল কর্কশ চিৎকার। রেগে গেছে কেউ। সন্দেহ কী, সে চার নম্বর সদস্য। নিচু স্বরে কী যেন তর্ক করছে কারও সঙ্গে।

ঝনঝন করে ভাঙল একটা কাঁচ। ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল কে যেন। খুলে গেল ভারী দরজা, আবারও বন্ধ হলো দড়াম করে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল তার প্রতিধ্বনি।

প্রকাণ্ড ঘরের মাঝে থামল একহারা লোকটা, ওখান থেকে প্রতিটি অ্যালকোভ দেখছে। নরম সুরে বলল, ‘চার নম্বর বিডার বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু চলবে আমাদের নিলাম।

ওই লোক আসলে কে জানলে ভাল হতো, ভাবল এলেনা। ঠিক করল, পরে চেষ্টা করবে লম্বুর পেট থেকে খবর বের করতে। তবে, নকল কোনও নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে চার নম্বর। স্মৃতি হাতড়াল ও। ওই লোক ছিল ছয় ফুট লম্বা। চওড়া কাঁধ। কালো চুল। বাদামি চোখ। এবড়োখেবড়ো দাঁত! ভাঙা দু’একটা। এসব তথ্য এনআরআই চিফকে দিলে কমপিউটারে খুঁজে দেখা হবে প্রোফাইল। পাওয়া যেতে পারে তাকে কোথাও।

পরের আইটেমের জন্যে শুরু হয়েছে বিড।

এলেনার হাতে আইপ্যাড ধরিয়ে দিল মেহেদি। ‘নিন, খতম করে দিন আমাকে।’

মিষ্টি হাসল এলেনা। খামোকা তিক্ত চেহারা করে বসে আছে কন্ট্রাক্টর। আগামীকাল সকালেই ইউএস সরকারের কাছ থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা ফিরে পাবে সে। ‘আমার কাজ শেষ, ‘ বলল ও। ‘যা চেয়েছি, পেয়ে গেছি।’

গার্ডরা যেদিকে তাম্রলিপি বাক্সে ভরছে, সেদিকে তাকাল এলেনা। একটা কেসে জিনিসটা রাখল লোকদু’জন। মোম গেলে সিল করে দিল। তখনই সামান্য কেঁপে উঠল চারপাশ।

মৃদু ভূমিকম্প?

একবার প্রায় নিভেই আবার জ্বলতে লাগল সব বাতি। টিং- টিং শব্দে নড়ে উঠেছে কয়েকটা কাঁচের গ্লাস।

মস্তবড় ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল এলেনা। ওদিকের দেয়ালের কাছে জ্বলছে এক সারি মোমবাতি। একটু কেঁপে গেল লাল-হলদে শিখা। যেন ঘর থেকে ভুস করে টেনে নেয়া হয়েছে অনেক বাতাস।

এলেনার মনে হলো না পরিবর্তনটা খেয়াল করেছে কেউ। ওর নিলামের ডাক নিয়ে এখনও ফিসফিস করে আলাপ করছে অন্যরা। বিপদের আশঙ্কায় খাড়া হয়ে গেল ওর ঘাড়ের ছোট ছোট রোম। নিচু স্বরে বলল, ‘কোথাও গোলমাল আছে।’

মাথা দোলাল নাসের আল মেহেদি। ‘চলুন, বেরিয়ে যাই।’

টেবিলে আইপ্যাড রেখে উঠে দাঁড়াল এলেনা, কিন্তু তখনই শুনল জোরালো ভারী আওয়াজ।

ওটা হয়েছে দূরে, কিন্তু থরথর করে কাঁপল গোটা ঘর। কড়িবরগা থেকে ঝরঝর করে ঝরল ধুলো। বার-এ টুং-টাং শব্দে দুলল বোতল। ঠুস্ শব্দে মেঝেতে পড়ে ভাঙল একটা গ্লাস।

এবার খেয়াল করেছে সবাই।

অ্যালকোভ থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে চলল এলেনা ও মেহেদি। কিন্তু বিস্ফোরণের কারণে থরথর করে কাঁপছে পুরো দালান। ছিটকে খুলে গেল ভারী দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল ঘন ধুলোর ঝড়। চারপাশ হলো প্রায় রাতের মত আঁধার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *