মৃত্যুঘণ্টা – ১০

দশ

সিমেন্টের চাতালে উঠে এল ওরা। সামনেই ঝোপঝাপে ভরা জমি ঢালু হয়ে মিশে গেছে নদীর তীরে। কাছের মোটরবোট থেকে এল এক ঝাঁক গুলি। চট্ করে এক ঝোপের আড়াল নিল এলেনা। গুলির গতিপথ থেকে সরে সিঁড়ির পিলারের আড়াল নিয়ে রানা দেখল, শান্ত নদীর বুকে সাদা ঢেউ তুলে ঘুরে গেল মোটরবোট, ক্রমেই তুলছে গতি।

হয়তো দেখছি ডক্টর মোবারকের খুনিকে, ভাবল রানা। চারদিকে তাকাল। নিচে গেছে সিঁড়ি, শেষ পিলারে বেঁধে রেখেছে কেউ পুরনো এক ডিঙি। ওটায় চেপে পিছু নিতে পারবে না।

পিছনের রাস্তা দেখল রানা। কোনও গাড়ি না পেলে অনুসরণ করতে পারবে না ওই বোট।

প্যারিসের বুক চিরে গেছে সেইন, দু’তীরে বেশিরভাগ অংশে সিমেন্টের দেয়াল। হাজার বছর ধরে নগরীর মাঝ দিয়ে গিয়ে দু’পাশের নোংরা বুকে নিয়ে করুণ হাল নদীর। কেউ চাইলে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করতে পারবে যে-কোনও বোটকে।

বাহন পেতে রাস্তায় নেমে এল রানা।

দ্রুতগামী কোনও গাড়ি… বা…

মাঝারি গতি তুলে আসছে এক মোটরসাইকেল। আরোহীর মাথা লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল রানা।

ভীষণ ভয় পেয়েছে তরুণ। স্কিড করে থেমে গেল রানার দশ ফুট দূরে।

‘তোমার মোটরসাইকেলটা আমার দরকার,’ নরম সুরে বলল রানা।

ফ্যাকাসে মুখে রাস্তায় কাত করে মোটরবাইক শুইয়ে দিল তরুণ। পিছিয়ে গিয়ে মাথার ওপর হাত তুলেছে। এখনও চলছে ভারী ইঞ্জিন।

শোল্ডার হোলস্টারে .৩৮ ওয়ালথার রেখে সামনে বেড়ে মোটরসাইকেল সিধে করে নিল রানা, ওটার পিঠে চেপে ছুটল তীরের গতি তুলে। গোঁ-গোঁ আওয়াজ ছাড়ছে লাল ডুকাটি।

.

ঝোপ থেকে বেরিয়ে আবারও রাস্তায় নামল এলেনা, কল করতে চাইল ফ্রেঞ্চ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু ব্যস্ত ফ্রেঞ্চ ৯১১ লাইন। বুঝল, গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজে অন্তত এক ডজন লোক এখন কল করছে পুলিশে। হয়তো আরও কয়েক মিনিট লাগবে লাইন খালি হতে।

রানাকে খুঁজল এলেনার চোখ। বেশ দূরে এক লোক। মাথায় হেলমেট নেই। বাজপাখির মত উড়ছে মোটরসাইকেলটা।

‘যাহ্!’ বিড়বিড় করল এলেনা। আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি। মোবাইল ফোন রেখে দিল ও। একটু দূরেই একটা সেডান। জানালা দিয়ে গলা বের করেছে এক লোক। অবাক চোখে দেখছে ধ্বংস-স্তূপের মত বিধ্বস্ত, জ্বলন্ত বাড়িটা।

পরে বিপদে পড়বে বুঝেও সিদ্ধান্ত নিল এলেনা। পরের কথা  পরে। ঠিক রানার মতই পিস্তল বের করে তাক করল লোকটার মাথায়। আরেক হাতে ইশারা করল। গাড়ি থেকে নেমে পড়ো, বাপু!

ভীষণ ভয়ে বিকট চেহারা করে গাড়ি থেকে নামল মোটা লোকটা। বামহাতে খামচে ধরল জঙ্গলের মত দাড়ি। বুঝে গেছে, এবার মরে যেতে হবে ওকে।

‘অ্যাই! সর্ এখান থেকে!’ কড়া ধমক দিল এলেনা। ‘নইলে কিন্তু গুলি করলাম!’

বিশাল পেট নিয়ে প্রথমে হালকা দৌড় শুরু করলেও বিশ ফুট যেতে না যেতেই হাঁফিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ল ভালুকের মত লোকটা।

দেখার সময় নেই এলেনার, সেডানের ড্রাইভিং সিটে বসেই আটকে নিয়েছে দরজা। পাশের সিটে মোবাইল ফোন আর পিস্তল রেখে রাস্তায় চাকার রাবারের পোড়া দাগ রেখে রওনা হয়ে গেছে। ডানে সেইন নদী অনেক দূরে রানার মোটরসাইকেল। পেছন থেকে আসছে পুলিশের কর্কশ সাইরেন।

রাস্তার জ্যামের মাঝ দিয়ে ঝোড়ো গতি তুলে এঁকেবেঁকে চলেছে লাল ডুকাটি। এরপর কী করবে এখনও ঠিক করেনি রানা। সেইনের তীর ঘেঁষে গেছে রাস্তা, মাঝে মাঝে বাড়ির বদলে ফাঁকা জমির ওদিকে চোখে পড়ছে নদীটা।

রানার সামনেই ধীর গতি এক ট্রাক। ওটাকে এড়াতে গিয়ে বামে সরল ও, ঢুকে পড়ল পাশাপাশি চলা দুই গাড়ির মাঝের সরু অংশে। ইচ্ছে করলে ড্রাইভারদের কাঁধ স্পর্শ করতে পারবে।

দুই গাড়ি পেছনে ফেলে তুমুল বেগে ফাঁকা রাস্তায় বেরিয়ে এল রানা। মোটরবোট খুঁজতে গিয়ে চোখ বোলাল নদীর বুকে। ওই জলযান প্রায় আধ মাইল দূরে। চ্যানেলের মাঝ দিয়ে প্রচণ্ড গতি তুলেছে। পেছনে দীর্ঘ সাদা ফেনায়িত ঢেউ।

সামনে কী ধরনের সমস্যা, ভাল করেই বুঝছে রানা। ওই বোট অনুসরণ করতে পারবে, কিন্তু কখনোই জেট স্কি হয়ে উঠবে না ডুকাটি। সোজা কথায়, বোটে উঠতে পারবে না ও।

পুলিশে ফোন করে লাভ হবে না। ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নেবে ওর কণ্ঠ। কোনও মতে কথা বললেও পুলিশ ধরে নেবে, ও এক বদ্ধ উন্মাদ লোক। এইমাত্র উড়িয়ে দিয়েছে একটা বাড়ি। অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করেছে এক তরুণের মোটরসাইকেল। এখন মারাত্মক গতি তুলে পিছু নিয়েছে এক মোটরবোটের। ওই বোট ঠেকাবে না পুলিশ, আগে ধরবে ওকে। ওর পরিচয় পাওয়ার পর কখন বেরোতে দেবে পুলিশ স্টেশন থেকে, তারও ঠিক নেই। তার মানে, হাসতে হাসতে উধাও হবে বোটের লোকটা।

কিন্তু সামনে সুযোগ দেখল রানা। আন্দাজ এক মাইল দূরে নদীর ডানে জড় হয়েছে এক সারিতে বেশ কয়েকটি বার্জ। বাধ্য হয়ে বাম তীর ঘেঁষে যাবে মোটরবোট, আর তখনই সুযোগ পাবে ও।

থ্রটল মুচড়ে ধরতেই ওকে নিয়ে ক্ষিপ্র চিতার মত লাফ দিল লাল ডুকাটি।

.

জ্যামের মাঝ দিয়ে যতটা পারে দ্রুত চলেছে এলেনা। একই সঙ্গে করতে চাইছে একগাদা কাজ। প্রথম কথা, যোগাযোগ করতে হবে রানার সঙ্গে। দ্বিতীয় কাজ, কাউকে চাপা না দিয়ে চলতে হবে। তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেভাবেই হোক ফ্রেঞ্চ পুলিশের গাড়ির আগে থাকতে হবে।

রিয়ার ভিউ মিররে তাদের গাড়ির নীল বাতি দেখছে এলেনা। কানের তালা ঝনঝন করছে সাইরেনের আওয়াজে। পা দিয়ে অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখেছে ও। চোখ সামনে।

দূরে দেখল রানাকে। ডুকাটির মত দ্রুত চলবে না সেডান। এঁকেবেঁকে যাওয়াও খুব কঠিন। পলকের মধ্যে আবারও উধাও হয়েছে লাল মোটরসাইকেল। ওদিকে চেয়ে ছিল বলে সে সুযোগে ওর গাড়ির পাশে পৌঁছে গেছে পুলিশের এক গাড়ি। পাশ থেকে সেডানে ধাক্কা দিল ওটা।

সরে গেল এলেনা, গাড়ি নিয়ন্ত্রণে এনে আবারও এগোল। পেছনে পড়ল পুলিশের গাড়ি। লাউড স্পিকারে শুনল, ‘রাস্তার পাশে গাড়ি রাখুন! আইন ভাঙছেন আপনি!’

সামনে ডানে বাঁক নিয়েছে রাস্তা। ব্রেক কষে সরে যেতে শুরু করে পুলিশের গাড়িকে চেপে এল এলেনা। বাধ্য হয়ে পিছিয়ে গেল পিছনের ড্রাইভার। এ সুযোগে মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল এলেনা। গতি তুলছে আবারও। ভাল করেই বুঝতে পারছে, এখন যৌক্তিক চিন্তা করে লাভ নেই।

তুফানের মত গতি তুলে আধ মাইল পেরিয়ে গিয়ে দেখল, সামনের রাস্তা বুজে দিয়েছে দুই স্কোয়াড কার।

দুই গাড়ির মাঝ দিয়ে পথ তৈরি করে বেরিয়ে যাব, ভাবল এলেনা। কিন্তু সতর্ক হয়ে গেল লোকগুলো। বাম ঘেঁষে বেরোতে পারবে না ও। কারণ ওদিকে দেয়াল। ডানে দিয়েও নয়। ওদিকে নদী। দুই পুলিশের গাড়ির পাশে থামল তৃতীয় স্কোয়াড কার। পথ রুদ্ধ দেখে ব্রেকের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল এলেনা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

একপাক ঘুরেই পুলিশের গাড়ির পাশে গুঁতো মারল ওর গাড়ির পেছন দিক। এলেনার মুখ-নাক ঠেসে ধরল এয়ার ব্যাগ। এক সেকেণ্ড পর ও বুঝল, একদম থেমে গেছে। এয়ার ব্যাগের একগাদা ধুলো ঢুকেছে ওর নাকে। জোরালো ক’টা হাঁচি দিল এলেনা। পরক্ষণে দরজা খুলে হ্যাঁচকা টানে রাস্তায় ফেলে দেয়া হলো ওকে, বুকে চেপে বসেছে একটা মোটা হাঁটু।

.

সাঁই-সাঁই করে রকেটের মত বাতাস কেটে ছুটছে রানা। নদীতে গতি কমিয়ে চলছে মোটরবোট। মনে হলো পিছু নেয়া হয়েছে, তা জানে না ওটার ড্রাইভার। বাম তীরের কাছে সরে গেছে সে। রানা জানে, ওটাই ওর একমাত্র সুযোগ।

ঠিক জায়গায় পৌঁছতে হবে বলে গতি আরও বাড়াল রানা। ওখানে সামান্য একটা ফাঁক, তারপর আবার শুরু হয়েছে পাথুরে রেলিং। রাস্তা থেকে নেমে ঘাস মাড়িয়ে ছুটল ডুকাটি। আরেকবার ঠিক জায়গাটা দেখল রানা, তারপর শক্ত হাতে ধরল হ্যাণ্ডেল। আরও মুচড়ে ধরেছে থ্রটল।

পঞ্চাশ মাইল বেগে রেলিঙের মাঝের ফাঁকা অংশ পেরিয়ে আকাশ পথে বোট লক্ষ্য করে চলেছে রানা। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর নামতে লাগল ভারী ডুকাটি। হাত-পা সরিয়ে ডানে ঝাঁপ দিল রানা, পেছনে শুনল কিছু ভেঙে যাওয়ার জোর আওয়াজ আর তারপরই বিশাল এক ঝপ্পাস্!

বোটের পেছনের পানিতে পড়ে ডুবে গেল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠে দেখল, চার শ’ পাউণ্ডের ডুকাটির ওজন হজম করতে না পেরে ফাটল ধরেছে ফাইবার গ্লাসের বোটের পেছন দিক। একটু পর টুপ করে তলিয়ে যাবে নৌযান।

সাঁতরে ওটার পাশে পৌঁছল রানা। বোটে দু’জন লোক। তাদের একজন আহত। সম্ভবত অচেতন। অন্যজন উঠে দাঁড়াল। রানাকে দেখেই পিস্তল তুলে গুলি করল।

ভারী পাথরের মত তলিয়ে গেল রানা। ওর চারপাশে সাদা রেখা তৈরি করে ছুটছে বুলেট। সরে যেতে লাগল ও। গুলি থেমে যাওয়ার পর খুব সাবধানে আবারও ভেসে উঠল। ডুবি-ডুবি করছে বোট। পিস্তল হাতে লোকটা কোথাও নেই। হয় লুকিয়ে পড়েছে, নয়তো নিজেই নেমেছে নদীতে।

খুব সাবধানে বোটের পেছনে গেল রানা। হোলস্টার থেকে বের করে ফেলেছে ওয়ালথার। স্টার্নের কাছ থেকে উঁকি দিল বোটের ভেতরে।

কাত হলো বোট। ভেতরের সিট কুশন, লাইফ জ্যাকেট ও খালি কয়েকটা প্লাস্টিকের বোতল ভেসে গেল নদীর অলস স্রোতে। পিস্তলধারীকে কোথাও দেখা গেল না।

বোট নিমজ্জিত হওয়ার আগেই আহত লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে তীরের দিকে চলল রানা। ভেবেছিল, তলিয়ে যাবে বোট, কিন্তু নাক তুলে রাখল কিলের এক অংশ।

আশপাশে নেই পিস্তলওয়ালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *