মৃত্যুঘণ্টা – ১৬

ষোলো

প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ঘরে দাঁড়িয়ে আছে জুবায়ের। আলো আসছে ছাতের, শেড লাগানো সাদা বাতি থেকে। ওর পরনে সোয়েট প্যান্ট। দু’দিকের দেয়ালের আংটায় বন্দি হ্যাণ্ডকাফ পরা দু’হাত।

চারপাশে লোহার দেয়াল। বাইরে গুঞ্জন তুলছে কোনও মেশিনারি। মৃদু কাঁপছে মেঝে। কমে আসছে কম্পন, তারপর আবারও বাড়ছে। সাগরের স্রোতের মত।

জুবায়ের দেখছে ছায়ায় কারা যেন। একটু এগিয়ে আসছে তারা, আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সবার পরনে কালো পোশাক। মুখ ঢেকে রেখেছে হুড দিয়ে। এক এক করে ওকে পেরিয়ে যাচ্ছে তারা। তার আগে ওর বাহু চিরে দিচ্ছে ধারালো ছোরা দিয়ে। প্রতিবার রক্ত বেরোচ্ছে ক্ষত থেকে।

ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলছে জুবায়ের। অন্ধকার থেকে ছোরা বেরিয়ে এলে ঝিলিক দেখছে। ওর বাহু থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত, জমা হচ্ছে পায়ের কাছে রাখা ধাতব ট্রেতে।

জুবায়েরের সামনে ক্রুশ, বাঁকা চাঁদের আকৃতির সোনালি কর্ণকুণ্ডল ও ডেভিডের নক্ষত্র। অন্যান্য জিনিস চিনল না ও।

শেষবারের মত বাহু কেটে দেয়ার পর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল জুবায়ের।

ওর সামনে এসে দাঁড়াল একদল লোক। কিন্তু অন্ধকারে  তাদেরকে ভাল করে দেখা গেল না।

কে যেন এসে থেমেছে পেছনে। কিন্তু আগেই মানা করে দেয়ায় ঘুরে তাকাল না ও।

‘প্রথম থেকেই কি মিথ্যা বলা হয়েছে আমাদেরকে?’ পেছনের লোকটা জানতে চাইল।

ধাতব ঘরে প্রতিধ্বনি তৈরি করেছে ওই কণ্ঠ। মার্ডকের গলা চিনল জুবায়ের।

‘আমরা মিথ্যা শুনে বিশ্বাস করে শাস্তি পাচ্ছি, তাই পতিত হয়েছি,’ জবাবে এক সঙ্গে বলল কালো পোশাক পরা লোকগুলো। ‘আমরা অসম্পূর্ণ।’

জানতে চাইল কর্কশ কণ্ঠ: ‘আমরা কি ত্যাগ করেছি সব মিথ্যা?’

‘আমরা মিথ্যা ত্যাগ করেছি,’ জবাবে বলল অন্যরা। ‘বুকে রেখেছি শুধু সত্য।’

‘আসল সত্য কী?’

ঝিমঝিম করছে জুবায়েরের মাথা। মন দিয়ে শুনতে চাইল কথাগুলো। ভাবল, আগে কী যেন বলেছে? হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে সব!

‘বলা হয়েছে, আমরা সবাই মিলে সম্পূর্ণ হয়েছি!’

‘আর কোথা থেকে আসে সত্য?’ পেছন থেকে এল কণ্ঠ!

জুবায়েরের মনে হলো ড্রাগ দেয়া হয়েছে ওকে। আসলে তা নয়। ভাবল, বাতাসের অভাবে আর রক্তশূন্যতায় দুর্বল লাগছে। খুব ঘুরছে মাথা।

‘প্রভু সবসময় ঠিক কথা বলেন,’ একই সঙ্গে বলল অন্যরা। ‘রক্ত সবসময় সত্যি বলে।’

‘আর প্রভুর সঙ্গে কথা বলেন কে?’

‘পৃথিবীর আসল মালিক যিনি।’

পেছন থেকে চেপে ধরা হলো জুবায়েরের ঘাড়। যখন-তখন ওটা ভাঙবে মার্ডক। নরম হাড়ে শুরু হয়েছে তীব্র ব্যথা।

‘তুমি কি মিথ্যা ত্যাগ করেছ?’

জুবায়েরের মনে আছে কী বলতে হবে। ‘আমি মিথ্যা ত্যাগ করেছি! সত্যিই নেই স্রষ্টা! আছে শুধু মানুষ! পরে কোনও বিচার হবে না! আছে অনন্ত জীবন! আমাদের ক্ষেত্রে মৃত্যু নেই! কিন্তু যারা মিথ্যার ভেতর পড়ে আছে, তাদের মৃত্যু হবে!’

মেঝেতে রাখা ধাতব ট্রের দিকে তাকাল জুবায়ের। ওখানে অন্তত সিকি ইঞ্চি গভীর রক্ত। লাল তরলে ভাসছে কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ।

আগুনের গন্ধ পেল জুবায়ের, লাল উত্তপ্ত কিছু এল অন্ধকারের মাঝে। ওটার ডগায় কয়েকটা অক্ষর ও সংখ্যা। ব্রাদারহুডের ব্র্যান্ডিং আয়ার্ন। কেউ ঈশ্বরকে অস্বীকার করলে প্রথমেই দলে নেয়ার সময় ওটা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ব্রাদারহুডে যোগ দিতে চাইলে বুকে থাকতে হবে এসব সংখ্যা ও অক্ষর।

এবার মার্ডকের কণ্ঠের চেয়েও ভারী এক কণ্ঠ বলল: ‘এই চিহ্নের জন্যে তুমি তৈরি?’

গনগনে লোহার দিকে তাকাল জুবায়ের। অন্ধকারে লাল আভা ছড়াচ্ছে ওটা। যে-কোনও সময়ে পুড়বে ত্বক ও মাংস।

আবারও জিজ্ঞেস করা হলো: ‘এই চিহ্নের জন্যে তুমি তৈরি?’

স্রষ্টা আমার জন্যে কী করেছে? ভাবল জুবায়ের।

স্রষ্টা থাকলেও তো ওকে ফেলে দিয়েছে বস্তির ভেতর!

যখন-তখন এসে নির্যাতন করেছে পুলিশ ও ড্রাগ ডিলাররা।

বাঁচার জন্যে কী-ই বা পেয়েছে?

তা হলে ঈশ্বরকে ভেজে খাবে ও?

‘আমি এই চিহ্ন নেব,’ ব্যথার জন্যে তৈরি হলো জুবায়ের।

‘তা হলে তুমি সত্যিই হবে মামবা,’ বলল কাউন্টের ডানহাত।

জুবায়েরের বুকে চেপে ধরা হলো তপ্ত ব্র্যাণ্ডিং আয়ার্ন।

পুড়ে গেল ত্বক-মাংস, ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জুবায়ের। ছিটকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু হাতদুটো আটকানো হ্যাণ্ডকাফে। বুক থেকে উঠছে পোড়া চামড়া-মাংসের বাজে গন্ধ। মাথা ঝুঁকে গেল ওর। হড়হড় করে বমি করল। ছুঁড়ে দেয়া হলো বালতি ভরা শীতল একরাশ পানি।

হাঁটুর ওপর ভর করে বসতে চাইল জুবায়ের। কিন্তু দু’হাত ওকে বসতে দিল না। কয়েক দফায় বমি করল। বুকের পোড়া ত্বক-মাংস খসে পড়ল মেঝেতে। ওদিকে চেয়ে দেখল জুবায়ের, বুকে গভীর পোড়া চিহ্ন। ওটার মাধ্যমেই বোঝা যাবে, ও আসলে ব্রাদারহুডের একজন।

শীতার্ত, রক্তাক্ত, হাঁটুর ওপর ভর করে টলমল করছে জুবায়ের। শুনল মার্ডকের কণ্ঠ। তাতে যোগ দিল অন্যরা।

‘মামবা,’ ফিসফিস করে বলল সবাই, ‘উঠে দাঁড়াও, মামবা। উঠে দাঁড়াও।’

দু’দিকের দেয়ালের আঙটায় দু’হাত, কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল জুবায়ের। বুঝতে পারছে, যে-কোনও সময়ে জ্ঞান হারাবে।

বাড়তে লাগল বেশ কয়েকজনের কণ্ঠের মন্ত্র। একটু পর মনে হলো, থরথর করে কাঁপছে ধাতব ঘর। তবুও বুকের ভেতর হঠাৎ করেই সাহস ফিরে পেল জুবায়ের। হ্যাঁ, মারা গেছে জুবায়ের, সে এখন থেকে মামবা!

এমন এক দলের সদস্য, যাদের কখনও মৃত্যু নেই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *