দুই
বর্তমান সময়।
নিউ ইয়র্কে ইউএন জেনারেল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিঙের সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে আইডি দেখালেন মিয ডেবি ম্যাকেঞ্জি। আসলে দরকার নেই, কারণ প্রতি দিন ভোরে তাঁকে দেখে গার্ডরা। ইস্ট কোস্টের হিসাব অনুযায়ী সকাল ঠিক ছয়টায় আসেন ডেবি। অন্য ডিপ্লোম্যাটরা কেউই এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন না।
গার্ডদের হাতের ইশারা পেয়ে গেট পেরোলেন কাঠির মত সরু, লম্বা ডেবি; হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে ‘মোকা ল্যাটে। হনহন করে হেঁটে থামলেন সিকিয়োর এলিভেটরের সামনে। মাত্র এক মিনিটে উঠে এলেন বারোতলা দালানে নিজ অফিসে।
আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নেয়ার পর গড়ে নিয়েছিলেন ভাল একটা অভ্যেস— সবসময় অফিসে পৌঁছান অধস্তনদের আগে। তাতে যেমন নিজেকে তুলে ধরতে পারেন উদাহরণ হিসেবে, তেমনি অন্যদেরকে রাখতে পারেন চাপের মুখে। বস্ কঠোর পরিশ্রম করছেন, কাজেই অন্যরা আয়েস করবে, তা একেবারেই অসম্ভব।
এত চট জলদি অফিসে আসার আরেকটা কারণ আছে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে ভাল পোকা পায় না অলস পাখি। তা ছাড়া, একটু তাড়া কম থাকে ভোরের এ সময়ে। চটপট দেখে নেয়া যায় নিজের কাজ।
মাত্র একঘণ্টা যেতে না যেতেই শুরু হবে একের পর এক টেলিফোন কল। নানান অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো আছেই, তারপর বিকেলে টেলিকনফারেন্স, প্রেস ব্রিফিং ও পাবলিক হিয়ারিং। মনে হবে চোখের পলকে পেরিয়ে যাবে দিনটা। তখনও ডেস্কে থাকবে ফাইলের স্তূপ। ডেবি ম্যাকেঞ্জির মাঝে মাঝে মনে হয়, একই জায়গায় বসে সারাটাদিন আসলে কোনও কাজই করেননি তিনি।
নিজ অফিসে ঢুকে ডেস্কে মোকা ল্যাটে রেখে কমপিউটার চালু করলেন ডেবি। পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন অ্যাসিস্ট্যান্টের ডেস্কে ফাইল ও চিঠি। রাতে আসা সব জমা করে রেখেছে মেয়েটা।
একটার পর একটা চিঠি দেখছেন ডেবি। এগুলো রিপোর্ট। আবারও ব্লকেড দিয়েছে গাজায়। ভয়াবহ খারাপ হয়ে উঠেছে ইস্ট টিমোরে আইন শৃঙ্খলা। সিরিয়া, মিশর, লিবিয়ার ওপর পুরু সব ফাইল। এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার আগেই অন্য দিকে মনোযোগ গেল ডেবির। একপাশে ইণ্টারনাল-ইউয এনভেলপ।
ওটা খোলা হয়নি।
খামের ওপর লেখা: ‘ডিপ্লোম্যাটিক মেটারিয়াল, প্রাইভেট অ্যাণ্ড কনফিডেনশিয়াল।
এই খাম সরাসরি এসেছে সেক্রেটারি জেনারেলের অফিস থেকে। রিসিপিয়েন্ট-এর স্লটে লেখা ডেবি ম্যাকেঞ্জির নাম। একই সঙ্গে চারটে ফাইল ও ওই খামটা নিয়ে নিজ অফিসে ফিরলেন ডেবি।
চারটে ফাইলে এমন কোনও দুঃসংবাদ থাকবে না যে কেঁপে উঠবে পৃথিবী। কাজেই ওগুলো ইনবক্সে রেখে বড় ম্যানিলা প্যাকেজটা খুললেন ডেবি।
ভেতরে লিগার সাইযের এনভেলপ। এসব খাম ব্যবহার করেন সেক্রেটারি জেনারেল। এক চুমুকে বেশ কিছুটা দামি কফি গিলে নিয়ে পেপার-মগ নামিয়ে রাখলেন ডেবি। লেটার ওপেনার দিয়ে খুললেন এনভেলপের একদিক। কেমন যেন চটচটে এনভেলপটা, যেন ওয়াটারপ্রুফ। ভুরু কুঁচকে ডেবি ভাবলেন, অফিস সাপ্লাই হিসেবে অনেক দামি জিনিসপত্র ব্যবহার করেন সেক্রেটারি জেনারেল।
এনভেলপ থেকে চিঠি বের করে চোখ রাখলেন তিনি।
শাস্তি দেয়া হবে তোমাকে। শাস্তি দেয়া হবে তোমাদের সবাইকে। অনেক অপেক্ষা করেছি, সহ্য করেছি অনেক কষ্ট।
গম্ভীর হয়ে গেলেন ডেবি। প্রতি দিন ইউএনও সদর দপ্তরে হুমকি দিয়ে পাঠানো হচ্ছে শত শত চিঠি, আসছে ফোনকল। এসব করে উন্মাদ বা মানসিকভাবে অসুস্থরা। বেশিরভাগই ফাঁকা বুলি। এদের ধারণা, কালো হেলিকপ্টার থেকে নেমে গোটা পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে ইউএনওর লোকেরা। এসব কেন ভাবে পাগলরা, তা ভাবতে গিয়ে নিজেই বিরক্ত হলেন ডেবি। আবার মনোযোগ দিলেন চিঠিতে।
তোমাদের কারণে উপকৃত হইনি, প্রতি দিন আরও গভীর বিপদে ঠেলে দিয়েছ আমাদেরকে। উন্নতির নামে আমাদেরকে বানিয়েছ ক্রীতদাস। দয়ার নামে করেছ আমাদের অভুক্ত। শান্তির কথা বলে আমাদের খুন করেছ নির্বিচারে।
তোমাদের সাহায্য পাওয়ার জন্যে আর বসে থাকব না আমরা। নিজেরাই বদলে দেব এই পৃথিবী।
সাধারণত এসব হুমকি একেবারেই পাত্তা দেন না ডেবি, কিন্তু কেন যেন এই চিঠিটা কাঁপিয়ে দিল ওঁকে। যে লিখেছে, সে ভাল করেই জানে কীভাবে ঢুকে পড়া যায় এই সংগঠনের ভেতর। নইলে ওর অফিস পর্যন্ত এই এনভেলপ আসত না। ভয় লাগছে সেই কারণেই। ঘামতে শুরু করেছে মুখ ও হাত।
প্রচণ্ড কষ্টের ভেতর দিয়ে বড় হয়ে উঠেছি আমরা। আমাদের শ্রমের ফসল তোমরা গিলেছ। তোমরা ভাবছ, হারিয়ে দিয়েছ আমাদেরকে। কিন্তু যারা আবারও উঠে আসে গায়ের শক্তি খাটিয়ে, তারা এরই ভেতর অর্ধেক জয় করে ফেলেছে শত্রুকে।
তোমরা যে অত্যাচার করেছ, চাইলেও তা ঠেকাতে পারিনি আমরা। কিন্তু এরপর থেকে নিজেদের সঙ্গে তোমাদেরকেও টেনে নামিয়ে নেব। আর তুমি, ডেবি ম্যাকেঞ্জি, আমাদের হয়ে বার্তা পৌঁছে দেবে পৃথিবীর ক্ষমতাশালী সব দেশের লম্পট, লোভী, নিষ্ঠুর নেতাদের কাছে। হ্যাঁ, ঠিক, অ্যাম্বাসেডর ম্যাকেঞ্জি, তুমিই আমাদের প্রতিশোধের বার্তাবাহক। সত্যি যদি এত দূর পর্যন্ত পড়ে থাকো চিঠি, এরই ভেতর তুমি বহন করছ ভয়ঙ্কর এক সংক্রামক মহামারীর বীজ।
ভয়ে আঁকড়ে আসতে চাইল ডেবির হৃৎপিণ্ড। তবুও পড়তে লাগলেন বদ্ধ উন্মাদটার চিঠি। তিরতির করে কাঁপছে ওঁর হাত, টিপে দিলেন ফোনের ইন্টারকম বাটন।
‘সিকিউরিটি,’ ওদিক থেকে বলল এক পুরুষ কণ্ঠ।
‘আমি…’ বলেই থেমে গেলেন ডেবি, দেখতে পেয়েছেন ফোনের বাটনের ওপর চট-চট করছে লাল তরল। দেখলেন হাতের তালু। আঙুলের ডগায় লালচে খয়েরি আঠালো কী যেন!
হাতে কেমন এক গন্ধ, যেন ভাজি করা হচ্ছে কী যেন।
বামহাতে এখনও ধরে আছেন চিঠি, মনে হচ্ছে পুড়ছে আঙুল। চিৎকার করে উঠে কাগজটা ফেলে দিলেন ডেবি, ঝটকা দিয়ে চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। ফলে ডেস্ক থেকে পড়ে গেল কফির মগ।
আতঙ্কিত ডেবি দেখলেন, রক্তের মত লাল হয়ে গেছে হাতের তালু ও আঙুল, বুদ্বুদ উঠছে চামড়ার ওপর। ছুটন্ত ঘোড়ার মত লাফ দিচ্ছে ওঁর হৃৎপিণ্ড।
‘ম্যাডাম অ্যাম্বাসেডর?’ ফোনে বলছে লোকটা, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? …ম্যাডাম অ্যাম্বাসেডর?’
কথা বলতে পারলেন না ডেবি। হতবাক হয়ে দেখছেন মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজ। ওটার বুকে দেখা দিয়েছে রক্ত বা লাল রঙের আঠার মত কিছু। কাগজ লাল হয়ে গেলেও বড় ফন্টে বোল্ড অক্ষরে লেখা শেষ বাক্য পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে:
নরকে স্বাগতম!