মৃত্যুঘণ্টা – ৫০

পঞ্চাশ

এইমাত্র গাড়ি থেকে নামল রানা, এলেনা ও মিনতি।

ওদের সঙ্গে আসার কথা ছিল রানার বন্ধু জন গ্রাহামের, কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে কাজ পড়ে যেতে ছুটেছে সে প্যারিসে।

মাত্র একঘণ্টা আগে রানা, এলেনা ও মিনতি নেমেছে হযরত শাহ্জালাল (রাঃ) এয়ারপোর্টে। কাস্টম্‌স্ বা ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়িয়ে সহজেই বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল সাদা, নতুন এক ল্যাণ্ড ক্রুযার। ড্রাইভার হাতে চাবি দিয়ে বিদায় নিতেই এলেনা ও মিনতিকে নিয়ে রওনা হয়েছে রানা।

শুক্রবার বিকেল, বেশিক্ষণ লাগেনি ঝড়ের গতি তুলে মাওয়ার কাছে পৌঁছে যেতে। দু’মাইল দূরে ফেরি ঘাট, ওখানেই তৈরি হচ্ছে পৃথিবীবিখ্যাত পদ্মা

পদ্মা সেতু। কিন্তু ডানের সরু, উঁচু-নিচু, কাঁচা এক রাস্তায় নেমে এসেছে রানা। মাত্র পাঁচ মিনিট পর হাজির হয়েছে ছোট একটা একতলা হলদে বাড়ির সামনে।

কিছুদিন হলো এদিকে দেয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ। কাঠের দরজার পাশে কলিং বেল দেখে টিপল রানা। ভেতরে মিষ্টি সুরে ডাকল কোকিল।

রানার পাশেই ক্লান্ত সুরে বলল মিনতি, ‘এটাই দাদাভাইয়ার বাড়ি?’ 

‘হ্যাঁ, এখানে থেকেই লেখাপড়া করবে,’ বলল রানা, ‘তোমার দাদীর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে আমার।’

দরজা খুলে যেতেই এক মহিলাকে দেখল রানা। তাঁর পরনে সাদা শাড়ি। যেন মিনতিই, তবে বয়স অনেক বেশি।

‘কাকে চাই?’ ভারী চশমার ওদিকে ঘোলা চোখ।

‘আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল,’ বলল রানা, ‘মিনতিকে নিয়ে এসেছি।’

সামান্য ঝুঁকে মিনতিকে দেখলেন বৃদ্ধা। ‘দাদাভাইয়া, কেমন আছ? প্লেনে করে আসতে গিয়ে কষ্ট হয়নি তো?’

‘না, দাদাভাই,’ বলল মিনতি। ‘কষ্ট হয়নি।’

‘মিনতি দাদাভাইয়া, এসো তো তোমাকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরি!’ বললেন ডক্টর মোবারকের মা। কয়েক সেকেণ্ড পর সরে দাঁড়ালেন। ‘এই দেখো, বুড়ো হয়ে গেছি তো, বসতে বলব তোমাদেরকে, সে-কথাও ভুলে গেছি! এসো, ভাই; এসো, আপু!’

মৃদু হাসল রানা ও এলেনা।

‘আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না,’ বলল রানা, ‘অন্য এক দিন এসে চা খেয়ে যাব।’

‘সে কী কথা! এত কষ্ট করে আমার দাদাভাইয়াকে পৌঁছে দিলে, আর আমি…’

‘আজ বাদ থাক,’ নরম সুরে বলল রানা। আগেই ফোনে ডক্টর মোবারকের মাকে সব খুলে বলেছে। শক্ত মানুষ তিনি, সামলে নিতে পেরেছেন ছেলে, মেয়ে ও নাতনী মোনার মর্মান্তিক মৃত্যু। কিন্তু এই মুহূর্তে রানার মনে হয়নি যে তাঁকে বিরক্ত করা উচিত।

পিচ্চি মেয়েটার পাশে বসে পড়ল রানা। ‘মিনতি, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে, ওটা সেরে ফেলতে হবে।’ শার্টের বুক পকেট থেকে ছোট একটা সিরিঞ্জ বের করেছে। ওটার তিন ভাগের এক ভাগ তরলে ভরা। খেয়াল করল, অবাক হয়ে ওকে দেখছে এলেনা। বুঝতে পেরেছে, ওই সিরিঞ্জের ভেতর কী আছে। রানা একটিবারও এটার কথা বলেনি ওকে।

প্যান্টের পকেট থেকে ডিযইনফেক্ট্যান্ট লোশন নিয়ে মিনতির ডানহাতে লাগাল রানা। সিরিঞ্জ দেখিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, ‘তুমি না অনেক সাহসী? তা ছাড়া, এটা দিতে ব্যথা লাগবে না।’

‘হ্যাঁ, আমার অনেক সাহস,’ কাঁদো-কাঁদো সুরে বলল মিনতি।

‘জানি তো,’ বলল রানা। সাবধানে ইনজেক্ট করল সিরিঞ্জের সাদা তরল। ‘ব্যস, কাজ শেষ! কয়েক দিন পর দেখবে তুমি পুরো সুস্থ হয়ে গেছ!’

ছলছলে চোখে রানাকে দেখল মিনতি। ‘মোনা আপু এই ওষুধ তৈরি করেছিল, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ,’ বাধ্য হয়ে স্বীকার করল রানা, ‘তোমার আপু চেয়েছিল তুমি ভাল থাকো।’

মুখ নিচু করে নিয়েছে মিনতি। যেন মিনা ফুফু, মোনা বা ডক্টর মোবারকের মৃত্যুর সব দায় ওর নিজের।

রানা বা এলেনা কিছু করা বা বলার আগেই মিনতিকে জড়িয়ে ধরলেন ওর দাদী। ‘একদিন আমার ছেলে, মেয়ে আর মোনার চেয়েও অনেক নাম করবে আমার দাদাভাইয়া, তাই না রে?’

বিড়বিড় করল মিনতি, ‘দেখো, তাই করব, দাদাভাই!’

‘আমরা এবার আসি, যোগাযোগ রাখব,’ বলল রানা।

এলেনার পাশে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই রানা শুনল বৃদ্ধার কণ্ঠ: ‘তোমাদের মঙ্গল হোক!’ দরজায় নাতনির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষটা, চোখ থেকে টপটপ করে ঝরল ক’ফোঁটা অশ্রু।

এক মিনিট পর গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকার দিকে চলল রানা। চুপ করে আছে এলেনা। হয়তো ভাবছে, এত কষ্ট করেও লাভ হলো না। দীর্ঘায়ু হওয়ার ওষুধ পেল না এনআরআই।

গাড়ি চালাতে চালাতে মৃদু হাসছে রানা।

‘কী হলো, হাসছ কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল এলেনা।

‘ভাবছি।’

‘কী ভাবছ?’

‘মন খারাপ হয়ে গেছে তোমার,’ বলল রানা। শার্টের পকেট থেকে বের করল দ্বিতীয় সিরিঞ্জ। ওটারও তিন ভাগের এক ভাগ তরলে ভরা। ‘তোমাদের ভাগ বুঝে নাও। ‘

সিরিঞ্জ পার্সে রেখে জানতে চাইল এলেনা, ‘তৃতীয় ভাগ পাবে বিসিআই, তা-ই না?’

‘না, আর পাবে না,’ বলল রানা, ‘ওটা আগেই পেয়ে গেছে।’

‘কখন পেল?’ জানতে চাইল বিস্মিত এলেনা।

‘যখন গাড়ি পৌছে দিয়ে গেল ড্রাইভার। ওই বদমাসটাই বিসিআই-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সোহেল আহমেদ।’

‘মানে, মাঝে মাঝেই যার গল্প করো, সেই…’

‘এখন ওর বাড়ির দিকেই চলেছি। আগামী কয়েক দিন আমার বাড়িতে থাকবে ও। আর তুমি থাকবে আমার সঙ্গে ওর বাড়িতে। নইলে যখন-তখন তলব করবেন বিসিআই-এর সিংহ বুড়ো।

‘তার মানে কড়া অভিভাবকদের রক্তচোখ এড়াতে প্রেমিক- প্রেমিকার মত পালাব আমরা?’ ভাবতে গিয়ে মজা পেল এলেনা। ‘আর খালি বাড়িতে দু’জন মিলে…’

‘জরুরি কাজ নেই, ক্ষতি কী?’ দুষ্টু হাসল রানা।

ঝড়ের গতি তুলে ছুটছে ল্যাণ্ড ক্রুযার।

রানার কাঁধে মাথা রেখে ভাবল এলেনা, চিরদিনের জন্যে যদি কাছে পেতাম মানুষটাকে!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *