মৃত্যুঘণ্টা – ৩৮

আটত্রিশ

অনেকক্ষণ হলো দু’হাতে কপাল টিপে ধরে নিজের অফিসে বিলাসবহুল চেয়ারে বসে আছেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। ওই কাল্ট বা ভয়ঙ্কর ভাইরাসের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট কখন সিদ্ধান্ত নেবেন, সেজন্যে বসে থাকলে সর্বনাশ হবে। কিন্তু নিজে তিনি কিছু করবেন এনআরআই চিফ হিসেবে, সেই ক্ষমতাও তাঁর নেই। জানেনই তো না কী করা উচিত। জরুরি নতুন কোনও তথ্য পেলে তা জানাবেন প্রেসিডেন্টকে, কিন্তু তেমন কোনও রিপোর্ট জমা দেয়নি কেউ।

ব্রা-ব্রা আওয়াজ তুলে ইন্টারকম বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন ব্রায়ান। ‘বলছি।’

‘স্যর, লাউ আন,’ ওদিক থেকে বলল বিজ্ঞানী, ‘ওই ভাইরাসের কোড সম্পর্কে অদ্ভুত একটা দিক জেনেছি। আরও কিছু কথা জানতে চাই ফিল্ড অপারেটিভদের কাছ থেকে।’

লাউ আনকে কথা দিয়েছিলেন ব্রায়ান, মোনার কর্পোরেশন থেকে জোগাড় করে দেবেন তথ্য। নতুন সব রিপোর্টও আসছিল, কিন্তু ওখানে চুরি বা ডাকাতি হয়ে যেতে এখন আর কোনও তথ্য পাচার করতে পারছে না এনআরআই-এর লোকটা।

‘আপাতত তা সম্ভব নয়,’ বললেন ব্রায়ান, ‘নতুন কিছু?’

‘ওই ভাইরাসের ভেতরের অংশ খুব অদ্ভুত।’

‘বিপজ্জনক?’

‘না, কিন্তু জড়।’ একবার কেশে নিল আন। ‘এলোমেলো নয়। আমার অন্তত তা-ই ধারণা।’

‘এসব থেকে কী বুঝছ?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান। তাঁর এখনও ধারণা, ওই কোডের ভেতর জরুরি কিছু থাকবে।

‘তেমন কিছুই বুঝতে পারিনি।’

‘এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে।

ব্রায়ানের বামদিকের ইন্টারকম বাজল। তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট বললেন, ‘প্রেসিডেন্টের চিফ অভ স্টাফ, স্যর। দু’ নম্বর লাইনে।’

‘এমন কিছু বের করো, যা দেখাতে পারি প্রেসিডেণ্টকে,’ লাউ আনকে বললেন ব্রায়ান।

‘সাধ্যমত করব, স্যর।’

ইন্টারকম রেখে দিলেন ব্রায়ান। বড় করে দম নিলেন, তারপর টিপে দিলেন দু’ নম্বর লাইনের বাটন।

.

কঙ্গোয় মোনা আর ওর সম্পর্ক নিয়ে অতীত রোমন্থন করছে রানা। আপাতত কোনও কাজ নেই ওর।

সেই বর্ষার রাতে গুড়-গুড় শব্দে মেঘ ডাকছিল। হারিয়ে গিয়েছিল ঝিঁঝি ও হাজারো পোকার ডাক।

পুরনো, রং-চটা সবুজ স্ক্রিন-ডোর ঠিকভাবে বন্ধ হতো না, যদিও ঠেকিয়ে দিত বেশিরভাগ পোকাকে। দূর থেকে দরজার সরু ফাঁক দিয়ে কালো, ঘন জঙ্গল দেখছিল উদাস রানা।

আঁধার রাতে আরম্ভ হলো ঝমঝম বৃষ্টি। করাগেটেড ছাতে এত জোরে পড়ছে, যেন হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে দিচ্ছে অসংখ্য পেরেক। একটু পর দক্ষিণ-পশ্চিমে নামতে লাগল একের পর এক বাজ! ঝলসে উঠছে উজ্জ্বল সাদা-নীলচে আলো, প্রতিটা ঝিলিকের কয়েক সেকেণ্ড পর প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠছে ছোট্ট বাড়ি।

তখনই হঠাৎ বেডরুম থেকে ছিটকে এল মোনা মোবারক, ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল উঠানে। বিদ্যুতের ঝিলিকে রানা দেখল, মেয়েটার চোখ বিস্ফারিত। থমকে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। যে-কোনও সময়ে দৌড়ে ঢুকবে গহীন জঙ্গলে।

যখন-তখন মস্ত বিপদে পড়বে মেয়েটা। আঁধার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রানা। দ্রুত পায়ে গিয়ে থামল মোনার সামনে।

‘স্বপ্নে দেখলাম তুমি চলে গেছ,’ কাঁপা গলায় বলল মোনা। দু’হাত তুলে খোঁপা করছে, মুখে স্বস্তি।

‘তোমাদের না নিয়ে কোথাও যাব না,’ বলল রানা। ‘আগেও তোমাকে বলেছি।’

‘জানি। বলেছ। কিন্তু ওরা আটকে রাখছে বাবাকে।’

রানা কিছু বলার আগেই বাড়ির ভেতর ঝনঝন শব্দে বাজল পুরনো টেলিফোন। মোনার হাত ধরে ঘরে ফিরল ও, তুলে নিল তারযন্ত্রের রিসিভার। ওদিকের কথা শুনে মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি।

হতাশ হয়ে ছাত দেখল মোনা। বুঝে গেছে, কী হয়েছে। আজকেও বাবাকে ল্যাব থেকে বেরোতে দেবে না কঙ্গো আর্মির জেনারেলরা।

রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা।

‘বাবা আজও আসবেন না, তা-ই না?’ বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল মোনা।

‘আপাতত তা-ই,’ বলল গম্ভীর রানা।

‘বাবা বুঝতেও পারছেন না এরা কী করছে,’ নালিশ করল মোনা। আবারও দেখল কালো আঁধার জঙ্গল। ওদিকে আছে ভয়ঙ্কর সব বিপদ। আবার ওদিক দিয়ে হয়তো পালাতে পারবে ওরা, পাবে মুক্তি।

ওই মুক্তি মোনার চাই-ই চাই। যে কারণেই হোক, বাবার সঙ্গে আফ্রিকায় এসেছিল মেয়েটা, কিন্তু দিনের পর দিন বন্দিনীর মত সময় কাটিয়ে হয়ে উঠেছে প্রায় উন্মাদিনী। পরিষ্কার বুঝে গেছে, দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে মুক্তির স্বপ্ন। কয়েক মাস ধরেই মনোমালিন্য হচ্ছে তিন জেনারেলের ভেতর, কে আগে নিজের বিছানায় তুলবে মোনাকে। আপাতত একজন করে লোক রেখে পাহারার ব্যবস্থা করেছে তিন জেনারেল।

লোভী হবে না কেন তারা? অপূর্ব সুন্দরী মোনা, ম্যাডোনার রূপ তো পেয়েইছে, বাঙালি মেয়েদের সহজ-সুন্দর কমনীয়তাও। তরুণী, স্বাস্থ্যবতী। পুরো আফ্রিকা ছুঁড়েও তো ওর মত কাউকে পাবে না জেনারেলরা! কাজেই ওকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করবে না কেন? তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করবে কে, কার এত সাহস!

এখানে এসে গত কয়েক দিনে রানা বুঝেছে, যে-কোনও সময়ে সশস্ত্র লোক এসে কিডন্যাপ করবে মোনাকে। প্রথমে পালা করে ধর্ষণ করবে, এরপর একসময় মেরে ফেলবে। একা কিছুই করতে পারবে না রানা, শত্রুদের ঠেকাতে গিয়ে মরতে হবে ওকে।

চুপ করে মোনাকে দেখছে রানা।

বড় করে দম নিচ্ছে বলে ফুলে উঠছে মেয়েটার সুডৌল বুক। বেচারি দমাতে চাইছে আতঙ্ক।

ছোট্ট কিচেনের সিঙ্কের সামনে থেমে কল খুলল মোনা। ‘চারপাশে বন্যা, কাদাটে হয়ে গেছে খাবার পানি। সেদ্ধ করে বোতলে জমিয়ে রাখা উচিত। পালাবার সময় কাজে লাগবে। রানা, কালকে পালাতে পারব না আমরা?’

ওর পাশে থেমে কল বন্ধ করল রানা। নরম সুরে বলল, ‘পরেও যথেষ্ট পানি পাব।’ মোনার হাত ধরে সরিয়ে নিল ও।

অশ্রুভরা চোখে ওকে দেখল মোনা। গলা ভেঙে গেল, ‘পালাতে পারব না, রানা। মেরে ফেলবে ওরা। তার আগে…’

ওর কণ্ঠে ভীষণ ভয় টের পাচ্ছে রানা। গত বেশ কয়েক দিন ধরে সুযোগ খুঁজছে ও, ডক্টর মোবারক আর মোনাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে কঙ্গো ছেড়ে। কিন্তু কাজটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নানান কাজে ডক্টরকে আটকে রাখছে জেনারেলরা। একটু দূরের জঙ্গল থেকে চোখ রাখছে তাদের সশস্ত্র লোক।

মোনা ও ডক্টর মোবারক ভয় পেতে শুরু করেছেন, জেনারেলরা বুঝে যাবে, ওরা পালাতে চাইছে। তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে অনেক বেশি খাটছেন বিজ্ঞানী। কোনও কাজ নেই বলে ছোট্ট এই বাড়িতে অলস সময় কাটাচ্ছে রানা ও মোনা। বেশ কয়েকবার দেখেছে, ওদেরকে লক্ষ করছে একাধিক গার্ড।

গত কয়েক দিন বৃষ্টি ভেতর বাইরে বেরিয়ে রানা দেখেছে, জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে মিলিটারি জিপ। নিয়মিত নজর রাখা হচ্ছে ওদের ওপর। কিন্তু যে-কোনও দিন ধৈর্য হারিয়ে বসবে জেনারেলরা। তখন আর বাঁচার উপায় থাকবে না ওদের।

আজ বিকেলে কাউকে দেখেনি রানা, হতে পারে পাহারা দিচ্ছে না কেউ। ল্যাবে কাজ করছেন ডক্টর। জেনারেলরা জানে, আজ রাতেও তুমুল বৃষ্টি হবে। পালাতে পারবে না কেউ।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ধুলোর পথ ভিজে হয়েছে পিচ্ছিল কাদার নালা। বাড়ি থেকে পানি সরাতে গভীর ড্রেন কেটেছে রানা, নইলে এতক্ষণে তলিয়ে যেত মেঝে।

‘আজ কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।’ বলল রানা।

‘কবে চলে যাব আমরা?’

‘এখনও জানি না। বেশি দিন নেই। তবে আজ নয়।’

চোখ সরিয়ে একবার শিউরে উঠল মোনা। গাল বেয়ে দরদর করে পড়তে লাগল অশ্রু। আবারও হাঁপিয়ে উঠছে। ফুলে গেল বুক। ভীষণ ভয় লাগছে ওর। যে-কোনও সময়ে কেঁদে ফেলবে হু-হু করে। চেহারা দেখে মনে হলো কিছু বলবে, কিন্তু তা না করে কাউন্টার থেকে খপ করে তুলে নিল ওদের ফোর-হুইল- ড্রাইভের চাবি। ঘুরেই এক দৌড়ে স্ক্রিন-ডোর খুলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ঝমবাম বৃষ্টির ভেতর নতুন করে ভিজে গেল মেয়েটা। ছুটে গিয়ে থামল জিপের ড্রাইভিং দরজার পাশে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির আওয়াজের ওপর দিয়ে বলল রানা, ‘রাস্তা কর্দমাক্ত, মোনা। কোথাও যেতে পারব না আমরা।’

‘ওরাও পারবে না!’ পাল্টা চেঁচাল মোনা।

‘বন্যার নদী পেরোতে পারব না’ বোঝাতে চাইল রানা। বড়জোর যেতে পারব অ্যাডজান্টার সেতু পর্যন্ত। ওরা ওখানে রেখেছে অন্তত এক শ’জন সৈনিক। পাগলামি কোরো না। অপেক্ষা করো। এই দফার বৃষ্টি থামলে তখন এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাব।

‘নিশ্চয়ই অন্য কোনও পথ থাকবে?’

মাথা নাড়ল রানা।

‘বলো, অন্য কোনও পথ থাকবে, রানা!’ আবারও কেঁদে ফেলল মোনা। যেন রানা চাইলেই তৈরি হবে পথ।

মোনা জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে শুরু করার আগেই ওর কবজি ধরে ফেলল রানা। ঝটকা দিয়ে কবজি ছুটিয়ে নিল মোনা, ধুপ্ করে বসে পড়ল কাদার ভেতর। পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে জিপের গায়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ক্লান্ত, পুরোপুরি অসহায়।

‘এভাবে বাঁচতে চাই না, রানা! দয়া করে মেরে ফেল! দয়া করো!’

‘আর কয়েকটা দিন সহ্য করো,’ মোনার পাশে বসল রানা। ‘পারছি না, আর পারছি না।’ বাচ্চা মেয়ের মত পিঠ দুলিয়ে কাঁদছে মোনা। ‘বাবাকে ছাড়বে না ওরা। শেষে মেরেই ফেলবে আমাদের তিনজনকে। বাঁচব না কেউ।’ দু’হাত কোলে রেখেছে মোনা। কাদার ভেতর পড়ে গেল জিপের চাবি।

মেয়েটার কথা খুব মিথ্যা নয়, ভাবল রানা। গত চারবার গোপনে চলে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ফিরতে হয়েছে ঝড়- বৃষ্টির ভেতর। দু’বার ল্যাবে আটকা পড়েন ডক্টর মোবারক। তাঁকে বাড়ি ফিরতে দেয়া হয়নি।

হাত ধরে মোনাকে দাঁড় করাল রানা, বুকে তুলে নিয়ে ফিরল বাড়ির ভেতর। ছেঁড়া পুতুলের মত নেতিয়ে গেছে মেয়েটা। একেবারেই জীবনী-শক্তিহীন। হারিয়ে ফেলেছে বাঁচার অর্থ।

‘আমার চোখে তাকাও,’ বলল রানা। বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে মোনাকে।

চোখ তুলে ওকে দেখল মেয়েটা।

‘প্রমিয করছি,’ নরম সুরে বলল রানা। ‘তোমার কোনও ক্ষতি হতে দেব না। বৃষ্টি থামলে ডক্টরকে ল্যাব থেকে তুলে নিয়ে চলে যাব বহু দূরে।’

রানার বুকে মাথা রেখে দুর্বল হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল মোনা। শীত ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে বেচারি। নীরবে কাঁদতে লাগল।

কিচেনের কাউন্টারে ওকে নামাল রানা। সুন্দর মুখ থেকে সরিয়ে দিল ভেজা, কালো চুল। কয়েক ফুট দূরের দেয়ালের পেরেকে ঝুলছে তোয়ালে, ওটা আনতে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। মৃদু হাসল। ‘শুকনো তোয়ালে চাইলে আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।’

‘আমি ছেড়ে দিতে চাই না,’ সরাসরি রানার চোখে তাকাল মোনা, চোখে এখন ভয় নেই। রানাকে খুব কাছে পেয়ে নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করছে।

একটু থমকে গেল রানা।

ঝুঁকে এসে ওর ঠোঁটে চুমু দিল মোনা। রানা পিছিয়ে গেল না বলে দু’হাতে ওকে আরও কাছে টানল মেয়েটা। এবারের চুমু অনেক গাঢ় ও গভীর। কয়েক সেকেণ্ড পর সাড়া দিল রানাও। ভেজা পোশাকে তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল ওদের দেহ।

মোনা সুন্দরী তরুণী, মানসিকভাবে পরিণত। ওর আগ্রহ দেখে কেটে গেল রানার সব দ্বিধা। মেয়েটাকে কাউন্টার থেকে মেঝেতে নামাল রানা। পরস্পরকে নিয়ে মগ্ন হয়ে উঠল ওরা। কোথায় উড়ে গেল সব ভয় ও দুশ্চিন্তা। ব্যস্ত হয়ে একে অপরের পোশাক খুলছে ওরা। রানার কানে ছোট্ট কামড় দিয়ে ফিসফিস করল মোনা, ‘বাকি জীবন পাশে চাই তোমাকে।’

একটু চমকে গিয়ে বলল রানা, ‘সম্ভব নয়। তাতে ক্ষতি হবে তোমার।’

‘কীসের ক্ষতি?’

‘আমি ভবঘুরে মানুষ।’

‘আমিও তা-ই হব, অসুবিধে কী? ‘

‘এখন যে আবেগ নিয়ে ভাবছ, পরে সেটা কষ্ট দেবে।’ .

‘আমার মনে হয় না যে…’ চুপ হয়ে গেল মোনা।

রানার নিষ্ঠুর ঠোঁট নামল তরুণীর লোভনীয় ঠোঁটে।

অনেকক্ষণের জন্যে থেমে গেল সময়। তারপর স্থির হয়ে গেল ওরা। তৃপ্তি নিয়ে রানার বুকে শুয়ে থাকল মোনা। তখনই ছড়াৎ শব্দে খুলল পুরনো স্ক্রিন-ডোর।

ঝট্ করে ঘুরে তাকাল রানা।

ঘরে এসে ঢুকেছে দু’জন লোক। একজন শ্বেতাঙ্গ, অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গ। তাদের পরনে ফ্যাটিগ। সাদা লোকটার হাতে জিপের চাবি। খ্যাঁক-খ্যাক করে হেসে উঠে বলল সে, ‘কিছু হারিয়ে ফেলেছ নাকি?’

উঠে কাউন্টারে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল রানা। একবার উলঙ্গ রানাকে আরেকবার মোনাকে কুঁতকুঁতে চোখে দেখছে দু’সৈনিক।

সামনে মস্ত বড় বিপদ, টের পেল রানা। মোনার দিকে পিঠ ফিরিয়ে কাউন্টারে হাত রাখল। ওর আঙুল স্পর্শ করল ধারালো ছুরির বাঁট।

‘অপরূপা, তোমার ওই ফর্সা পাছা সত্যিই দারুণ।’ বলল শ্বেতাঙ্গ। কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকের দিকে ঘুরল। ‘তুমিও ভাগ চাও?’

‘তা আর বলতে? বল-খল করে হাসল কালো লোকটা।

ওই একই সময়ে ছোরা হাতে লাফিয়ে সামনে বাড়ল রানা। রাইফেল হাতে ওর দিকে ঘুরছে শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু তখনই পাঁজরের হাড়ের মাঝ দিয়ে গিয়ে তার হৃৎপিণ্ড ফুটো করল ছুরির ফলা। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই মেঝেতে বিধল বুলেট।

শ্বেতাঙ্গকে ঠেলে নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকের ওপর ফেলল রানা। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ওরা তিনজন। মারাত্মক আহত লোকটার বুক থেকে ছুরি খুলেই কালো সৈনিকের ঘাড়ে কোপ বসাল রানা। কেটে গেছে মোটা শিরা, ছিটকে বেরোল রক্ত। কাত হয়ে গেছে কৃষ্ণাঙ্গের ঘাড়, উল্টে গেল চোখের মণি।

মারাত্মক আহত দু’শত্রুর ঘাড় মেঝেতে চেপে ধরেছে রানা। মাত্র দু’মিনিটে লাশ হয়ে গেল তারা। তখনই গর্জে উঠল পিস্তল।

ঘুরে দেখল রানা, এইমাত্র স্ক্রিন-ডোর পেরিয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এক লোক, মৃত!

উঠে দাঁড়িয়ে কিচেনের দিকে তাকাল রানা। ওর পিস্তল এখন মোনার হাতে। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটি। কয়েক দিন আগে ডক্টর মোবারক আর মোনার সঙ্গে আলাপের সময় ওরা বলেছিল, মরে গেলেও কখনও কাউকে খুন করতে পারবে না। কিন্তু আজ উল্টো কাজই করেছে মোনা। প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে রানাকে।

শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের রাইফেল তুলে নিয়ে বাইরে উঁকি দিল উলঙ্গ রানা। উঠানের ওদিকে একটা হার্ডটপ জিপ। মনে হলো খালি।

আবারও কিচেনে এসে রানা দেখল, খুব কাঁপছে মোনা। হাতের পিস্তল এখনও তাক করে রেখেছে মৃত লোকটার দিকে।

‘ঠিক আছে, আর ভয় নেই,’ আস্তে করে মোনার হাত থেকে পিস্তল নিল রানা।

বার কয়েক চোখ পিটপিট করে রানাকে দেখল মোনা। তখনই গুড়-গুড়-কড়াৎ শব্দে খুব কাছেই পড়ল বাজ।

‘পোশাক পরে নাও,’ মেঝে থেকে তুলে মোনার হাতে ব্লাউয ও স্কার্ট ধরিয়ে দিল রানা।

নীরবে পোশাক পরতে লাগল মেয়েটা।

দ্রুত হাতে শার্ট ও প্যান্ট পরছে রানা। ‘এবার আমাদেরকে চলে যেতেই হবে।’

বোকার মত জিজ্ঞেস করল মোনা, ‘কেন? কোথায় যাব?’

‘এই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে,’ বলল রানা।

ভয়ের বদলে মোনার চোখে স্বস্তি। খুশি, ভয়ঙ্কর এ কারাগার থেকে মুক্তি পাবে। জীবনে আর কখনও ফিরবে না এখানে। 

‘যাওয়ার পথে ল্যাব থেকে তুলে নেব তোমার বাবাকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *