মৃত্যুঘণ্টা – ২২

বাইশ

সন্ধ্যার একঘণ্টা পর বৈরুত শহরের মাঝামাঝি রুপালি মার্সিডিজ এসইউভি থেকে নামল এলেনা রবার্টসন। সামনেই বোমা হামলায় বিধ্বস্ত এক প্রকাণ্ড বাড়ি। দেয়াল ঝাঁঝরা হয়েছে বুলেটের আঘাতে। গত কয়েক বছর ধরে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল একপাল বুনো জন্তু। কিন্তু নতুন করে আবারও এই বাড়ি দখল করে নিয়েছে মানুষ। পুরোদমে চলছে মেরামত কার্যক্রম। মস্তবড় এই দালান লেবাননের জাতীয় জাদুঘর।

জাদুঘরের পাশেই নতুন করে চালু হয়েছে ব্যস্ত হাসপাতাল।  আরেক দিকে সরকারি পাঠাগার, নতুন করে আবারও গড়ে তোলা হয়েছে ওটা। পুরনো পাথরের দেয়ালের মাঝে আধুনিক সব টিণ্টেড কাঁচ। রাতের আঁধারে উজ্জ্বল আলোয় বলরুমের মত ঝকমক করছে তিন দালান।

এলাকা কঠোরভাবে পাহারা দিচ্ছে সিকিউরিটির লোক। এখানে ওখানে ক্যামেরা। বোমা শুঁকে বের করতে চাইছে কয়েক পাল প্রশিক্ষিত কুকুর। নানান দিকে অবস্থান নিয়েছে লেবানিজ আর্মির লোক।

এসইউভি নিয়ে ভ্যালে সরে যেতেই লাল গালিচা মাড়িয়ে চলল এলেনা। চারপাশে উজ্জ্বল সব বাতি, বাজছে মিষ্টি মিউযিক। খয়েরি মসৃণ, ঝিলমিলে গাউন পরেছে ও, সচ্ছন্দে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। ওকে পেছন থেকে পাহারা দিচ্ছে নাসের আল মেহেদি ও তার দুই বডিগার্ড। সবার পরনে দামি টাক্সিডো।

জাদুঘরের উঁচু মেঝেতে পৌঁছে ভাবল এলেনা, এখন কী করছে রানা? নিশ্চয়ই দুবাইয়ের দামি কোনও হোটেলে? ডিনার সারছে? নাকি হোটেলের বয় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে? নাকি ওই মেয়েটার সঙ্গে…

বুকে ঈর্ষার ছোবল টের পেল এলেনা।

ওই মেয়েটা… মোনা… সে এখন আছে রানার খুবই কাছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ পাচ্ছে ওর।

নিজেকে ধমক দিল এলেনা। তোর এখন ভাবতে হবে না রানার কথা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মেহেদিকে বলল, ‘আপনারা নতুন করে সব গড়ে নিচ্ছেন। চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।’

‘চিরকাল ধরেই এ শহর বা দেশ গড়ছি আমরা,’ বলল নাসের আল মেহেদি। ‘এবার আমাদের শেখা উচিত কীভাবে বন্ধ করা যায় ধ্বংসের খেলা।’

এলেনা খেয়াল করেছে, শহরের বেশ কিছু জায়গায় ভারী সব মেশিন নিয়ে কাজ করছে মেহেদির মজুর ও কর্মচারীরা। প্রত্যেকের পরনে মালিকের কোম্পানির ইউনিফর্ম। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড। ‘নতুন করে শহর গড়ে তোলা ভাল ব্যবসা,’ মন্তব্য করল ও।

‘জাদুঘর ঠিক করতে মুনাফা করিনি,’ জোর দিয়ে বলল মেহেদি। ‘লাভ করেছি বড়লোকদের জন্যে তৈরি হাসপাতালে। এই তিন ভবন চালু হবে বলে দেশের সেরা সবাই এসেছে আজ। ওপরের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে, কিন্তু বড়লোকদের বেশ কয়েকজন ওখানে না থেকে হাজির হবে জাদুঘরের নিচের নিলামে। চোরাই আর্ট কিনে হালকা করবে নিজেদের সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট।’

‘ও। জানতে পেরেছেন কীসের ওপর নিলামে ডাক দেব?’

‘কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে,’ বলল কন্ট্রাক্টর, ‘আবু রশিদের হারিয়ে যাওয়া জিনিস মেসোপটেমিয়ান আর্ট।

‘ওসব দিয়ে কী হবে?’

কাঁধ ঝাঁকাল মেহেদি। ‘জানি না। তার নিজেরও কিছু জিনিস নিলামে উঠবে। ওগুলো বিক্রি করেই নাকি কিনে নিতে চেয়েছিল মেসোপটেমিয়ান আর্ট।’

‘জিনিসটা কী?’

‘দ্বিতীয় লটের সেরা জিনিস। লেবেল অনুযায়ী: ওটা একটা তাম্রলিপি। প্রোটো-এলামাইট। ধারণা করা হচ্ছে, এ ছাড়াও আছে বিখ্যাত রাজা গিলগামেশের সময়ের একটা খোদাই করা আর্ট। তবে লট থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে ওটাকে।’

আগ্রহ বোধ করল না এলেনা। মেহেদিকে দেখে ওর মনে হলো না এসবের জন্যে টাকা খরচ করবে লোকটা। হঠাৎ করেই ভাবল, সঙ্গে কোনও এক্সপার্ট এলে ভাল হতো। রানা মানিয়ে  যেত ওই কাজে।

‘আমি যদি কিছু কিনতে চাই?’ জানতে চাইল এলেনা।

চট্ করে ওকে দেখল মেহেদি। ‘আপনি বললেন ডক্টর মোবারক মারা গেছেন, ঠিক না?’

মাথা দোলাল এলেনা। ‘হ্যাঁ।’ বুঝল না, হঠাৎ এ কথা কেন। ‘আপনি তো বলেছিলেন তাঁকে চিনতেন না?’

‘হ্যাঁ, চিনি তো না-ই। কিন্তু নতুন কেউ নিলামে যোগ দিতে চাইলে কখনও কখনও আমার সাহায্য নেয়।’

এলেনা বলল, ‘আপনি ব্রোকার হিসেবে কাজ করেন?’

‘সবাই বিশ্বাস করে আমাকে,’ বলল মেহেদি, ‘সব পক্ষ। সেজন্যে নানান সুবিধা পাই।’

‘নিলামে ওঠা আর্টের টাকার একটা অংশ আপনি পাবেন।’

‘হ্যাঁ। আপনি নিলামে ডাক দিলে পাঁচ পার্সেন্ট মুনাফা আসবে আমার পকেটে। আমেরিকান সরকারের টাকা বলে নেব, নইলে রানার কাছ থেকে আপনি এলে চার আনা পয়সাও নিতাম না। আবু রশিদের তরফ থেকে ডাক দেবেন, বলে দিয়েছি নিলামদারকে।’

‘এর ফলে বিপদে পড়তে পারি,’ বলল এলেনা।

‘আসলে পুরো নিরাপদ নয় কেউ,’ বলল মেহেদি। ‘আমার ধারণা, সঙ্গে অস্ত্র এনেছেন। আমি কি মিথ্যা বললাম?’

‘না, ঠিকই বলেছেন।’ এলেনার পার্সে ঘুমিয়ে আছে কা পি ৩৮০ পিস্তল, জুতোর হিলে ছোট কার্বন-ফাইবারের ছোরা।

‘আপনি নিজেও বিপজ্জনক মানুষ,’ হাসল কন্ট্রাক্টর মেহেদি। ‘আশা করি বিপদে পড়বেন না। আমার কাজ হবে আপনাকে নিরাপদে রাখা।’

মাথা দোলাল এলেনা।

জাদুঘরের রিসেপশনে একঘণ্টারও বেশি সময় কাটাল ওরা, তারপর একহারা এক লম্বা লোক এসে টোকা দিল মেহেদির কাঁধে। কানের কাছে ফিসফিস করে কী যেন বলল। ঘুরে হনহন করে রওনা হয়ে গেল।

এলেনার বাহু স্পর্শ করে বলল কন্ট্রাক্টর, ‘ওই লোকের পিছু নিতে হবে।’

প্রকাণ্ড হলরুম ছেড়ে বেরিয়ে এল ওরা। এলেনার মনে হলো না আশপাশে নিলাম ডাকার মত জায়গা আছে। জাদুঘরের পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে পুরনো এক মালটানা এলিভেটরের সামনে থামল ওরা।

গভীর সন্দেহ নিয়ে মেকানিকাল খাঁচা দেখল এলেনা।

‘পাতালে হবে নিলাম,’ আশ্বস্ত করার সুরে বলল মেহেদি। ‘জাদুঘরে নয়। আরও নিচে।’

এনআরআই চিফের কথা মনে পড়ল এলেনার। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে নিলাম। ওর ধারণা ছিল, জাদুঘরের কোনও ঘরে বা লাইব্রেরিতে হবে। একবার মনে হলো, মস্ত ভুল করে ফেলেছে। আগেই লোকটার কাছে জানতে চাওয়া উচিত ছিল, এই এলিভেটর ছাড়া অন্য উপায়ে নামতে পারবে কি না। ভয়টাকে বাড়তে না দিয়ে নিজেকে বলল, জরুরি কাজে এসেছি, দরকার হলে ঝুঁকি নেব। অত ভয় পাওয়ার কী আছে? সঙ্গে রয়েছে অস্ত্র, প্রয়োজনে নিজেও বিপজ্জনক হয়ে উঠব।

বাহুর ওপর থেকে মেহেদির হাত সরিয়ে দিল এলেনা। ‘আপনি আগে উঠুন।’

কন্ট্রাক্টর এলিভেটরে চাপতে উঠল এলেনা। সব শেষে একহারা লোকটা। টেনে আটকে দিল দরজা, বাটন টিপতেই নামতে লাগল এলিভেটর। টিমটিম করে জ্বলছে দশ ওয়াটের বাতি। করুণ সব ক্যাচকোচ শব্দ তুলে ঝাঁকি খাচ্ছে ভাঙাচোরা খাঁচা। 

কিন্তু এটা দুলতে দুলতে নামছে কোন্ নরকে? গলা শুকিয়ে গেল এলেনার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *