মৃত্যুঘণ্টা – ১৭

সতেরো

দুবাইয়ের চকচকে মোনোরেলে বসে পারস্য উপসাগরের দিকে চলেছে রানা। দূরে ঢলে পড়েছে সূর্য। সব ছায়া এখন দীর্ঘ। পশ্চিম আরবের আকাশে উজ্জ্বল সাদা রোদের বদলে মেঘে লাল- হলদে আভা।

দুবাইবাসীর আরও আধুনিক হওয়ার আগ্রহে কিছু দিন আগে চালু করা হয়েছে মোনোরেল, দেখার মতই সুন্দর। গোটা শহর ভেদ করেছে, কিন্তু বিশেষ এই লাইন গেছে উপকূলে।

বহু দূরে গন্তব্য দেখছে রানা।

ওই যে আকাশে নাক তুলেছে অদ্ভুত রূপসী বুর্জ আল আরব। উঠে গেছে পুরো এক হাজার বায়ান্ন ফুট ওপরে। ওটা বসে আছে মানুষের তৈরি এক দ্বীপে। কীলক আকৃতির হোটেল দেখলে মনে হবে, ওটা আসলে মস্ত এক ফুলে ওঠা পাল। পশ্চিমে খাড়া উঠে গেছে মাস্তুলের মত। পুবে মোটা পেটের মত নেমেছে মাটির দিকে, যেন স্পিন্যাকারের পাল। দালানের ওপরে মস্ত জাহাজের ব্রিজের মত অংশ প্রকাণ্ড পাখির দু’ডানার মত। এদিকের ছাতে হেলিপ্যাড ঝুলছে সাগর থেকে কমপক্ষে আট শ’ ফুট ওপরে।

মুগ্ধকর যত আর্কিটেকচারাল ডিযাইন দেখেছে রানা, এই হোটেল তার অন্যতম। একটু আগে পেছনে রেখেছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দালান বুর্জ খালিফা, মস্ত কোনও পেরেক যেন। ওটা আর বুর্জ আল আরব হোটেলের মধ্যে তুলনা করে একটাকে ভোট দিতে বললে, উঁচু পেরেকের মত ওই দালানের বদলে এই হোটেলকেই বেছে নেবে ও।

চুপ করে ওটার দিকে চেয়ে আছে রানা।

কিন্তু চুপ থাকার অভ্যেস নেই ওর পাশের লোকটার। ‘প্লেন থেকে নামার পর স্রেফ নরকে পড়েছি।’ সিল্কের টাই নাড়ল সে। ‘এত গরম কেন? ভাবতে পারিনি এমন হবে!’

‘আমরা আছি মরুভূমির ভেতর,’ বলল রানা। ‘আর এখন জুলাই মাস।’

‘গুড,’ রানাকে দেখল ব্যবসায়ী। ‘সবসময় চারপাশে চোখ রাখো তুমি! সিকিউরিটি বিযনেসে এটা দরকার।’ কর্কশ হাসল লোকটা।

এসব কথার ভেতর কৌতুকটা কী, বুঝল না রানা। একবার ভাবল, দেব নাকি মাতাল শালার পিঠ চাপড়ে! না, বোধহয় উচিত হবে না। গম্ভীর চেহারায় বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, স্যর।’

আন্তর্জাতিক ড্রাগ বিযনেসে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ক্যালিফোর্নিয়ার মস্তবড় ব্যবসায়ী জন এফ. হার্বার্ট চলেছে মোনার মিটিঙে যোগ দিতে। এনআরআই চিফের সঙ্গে আলাপে ঠিক হয়েছে, এই লোকের সিকিউরিটি দেখার দায়িত্ব নেবে রানা। ওই কাজ যেন করতে পারে, সেজন্যে লোকটার সিকিউরিটি গার্ডকে ভালমন্দ খাইয়ে খারাপ করে দেয়া হয়েছে তার পেট। আপাতত সে হাসপাতালে।

আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্যে রানা এজেন্সি থেকে রানাকে ভাড়া করেছে জন এফ. হার্বার্ট। তারপর থেকে আফসোস করছে রানা। আটচল্লিশ ঘণ্টা টিকবে কি না, ঠিক নেই। যখন-তখন নোংরা সব কৌতুক শুনে মনে হচ্ছে, এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেবে ব্যাটার।

ঘুরে মার্ভেল ড্রাগস্ কর্পোরেশনের হোস্টের দিকে তাকাল হার্বার্ট। আরবকে পছন্দ হয়নি। পোশাকের নাম কাণ্ডুরা, আসলে দীর্ঘ আলখেল্লা। ওই একই জিনিস গায়ে চাপিয়ে শয়তান জাদুকরের মত ঘুরছে সবাই! আবার পট্টি বেঁধেছে মাথা পেঁচিয়ে।

‘এদিকে রিয়াল এস্টেটের দাম কেমন?’ জানতে চাইল হার্বার্ট। ‘আমাদের সিলিকন ভ্যালির আশপাশে মোতার মত জায়গা চাইলে, লাগবে কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার।’

করুণ হাসল আরব, অসহায় চোখে দেখল রানাকে।

জবাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ থাকল রানা। কিছুই করার নেই, লাথি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিতে পারবে না আপদটাকে।

‘আপনি চাইলে ভাল কোনও ব্রোকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি,’ খুব বিনীত স্বরে বলল আবু আল নাসের।

‘তা-ই করুন,’ খুশি হলো হার্বার্ট। ‘শুনেছি পাম গাছের মত দেখতে এক দ্বীপ তৈরি করেছেন আপনারা? ওখানে হয়তো জমি কিনে নেব।’

মাথা দোলাল আরব।

রানার দিকে ফিরল হার্বার্ট। ‘জমি কিনব ভাবতে গিয়ে ভালই লাগছে।’

চুপ থাকল রানা। ভাবছে, ডক্টর মোবারক ও মোনার কথা। কঙ্গোতে গোপন কী এক গবেষণা করছিল বাপ-বেটি। ওটার জন্যেই এক সঙ্গে ছিল তারা। আবার ওটার কারণেই আলাদা হয়ে গেছে। ওর বাবার মতই ল্যাবে বেশিরভাগ সময় কাটাত মোনা। ওকে নিজ হাতে সব শিখিয়ে দিতেন মোবারক।

কঙ্গোর জেনারেলরা আরও চাপ তৈরি করলে বাধ্য হয়ে একা ল্যাবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। সেটা কি মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে? নাকি কিছু গোপন করতে চেয়েছিলেন মেয়ের  কাছ থেকে?

কঙ্গোয় কিছু জিজ্ঞেস করার পরিবেশ ছিল না। এখন কয়েক বছর পর ডক্টর মোবারকের ডিভিডি দেখার পর খচ খচ করছে রানার মন। অনেক আগে থেকেই হয়তো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন মোবারক।

বাবার ছায়া থেকে সরে গিয়ে নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়ে নিয়েছে মোনা। যে-কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে, সেটার পুরনো এক উদ্যোক্তা ওরই বাবা। পরিচিত অনেকেই ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, এটা খুব স্বাভাবিক।

ক্রোয়েশিয়ার হোটেলে ভেবেছিল রানা, কো-ইনসিডেন্স বিশ্বাস করে না। ডক্টর মোবারক, মোনা বা মার্ভেল ড্রাগ্‌স্ কর্পোরেশন সবই যেন একই সুতোয় বাঁধা। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।

দশ মিনিট পর ওরা পা রাখল রূপসী হোটেল বুর্জ আল আরবের লবিতে। ওখানেই বিদায় নিল আরব হোস্ট। ড্রাগ্‌স্‌ কর্পোরেশনের স্টাফ সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে হোটেলের প্রকাণ্ড এক হলরুমে নেয়া হলো হার্বার্টকে! তার সঙ্গে থাকল রানা। গোপন তথ্য দেয়া হবে বলে ওখানে আইনী কাগজে সই দিতে হলো ব্যবসায়ীকে। সঙ্গে রেকর্ডিং ডিভাইস বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ইকুইপমেণ্ট নেই, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করা হলো ওদেরকে। হার্বার্টের সামনে ধরা হলো প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ। ওটার ভেতর ব্ল্যাক বেরি মোবাইল ফোন ও আই ফোন রাখল ব্যবসায়ী।

এরপর রানা ও হার্বার্টকে তোলা হলো একটা এলিভেটরে। ওটা সরাসরি উঠে এল হোটেলের টপ ফ্লোরের বলরুমে। দরজা খুলে যেতেই সামনে পড়ল হলুদ টাইলস বসানো হলরুম। মেঝে থেকে শুরু করে সিলিং পর্যন্ত জানালা দিয়ে আসছে শীতল নীল আলো। জানালার ওদিকে বহু নিচে পারস্য উপসাগর। চারপাশে ফিসফিস করে আলাপ করছেন একদল মিলিয়নেয়ার। কারও কারও হাতে বেলুগা ক্যাভিয়ার, বা শ্যাম্পেনের গ্লাস।

বডিগার্ডের পাশে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল হার্বার্ট। রানা বলল, ‘এরা যথেষ্ট সতর্ক, স্যর। এখন যাচ্ছি চারপাশ দেখে আসতে। আপনার সিকিউরিটির জন্যে কোনও হুমকি বা হোটেলের দুর্বলতা দেখলে দেরি না করে এসে জানাব।

কর্কশ হাসল হার্বার্ট। ‘গুড! তবে মনে করি না কোনও বিপদ হবে। সিকিউরিটি ঠিক রাখার জন্যে নাম আছে এদের। তোমাকে কেন এনেছি জানো? নিজের কাজের লোক থাকলে দাম বাড়ে মালিকের। …যাও, কয়েকটা ড্রিঙ্ক নিয়ে কোথাও গিয়ে বসে পড়ো। সত্যি কোনও মেয়েকে বাগিয়ে ফেলতে পারলে তোমাকে বাড়তি বোনাস দেব।’

তিক্ত মন নিয়ে সরে এল রানা। পরীক্ষা করে দেখল কয়েকটা দরজা ও হলওয়ে। দালানের পুরের কাঁচের দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেল। নিচে দুবাইয়ের উপকূল। দূরে শহরের ঝিকমিক করা নানান রঙা বাতি। হোটেলের ওপরে ছাত থেকে বেরিয়ে এসেছে বৃত্তাকার হেলিপ্যাড, ওখানে জ্বলছে অনেকগুলো ফ্লাডলাইট।

রানার সামনে থামল এক ওয়েটার। তার ট্রে থেকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন নিল ও। দ্বিতীয় ওয়েটার এসে বাড়িয়ে ধরল আরেক ট্রে। ওটার ওপর চোখ বোলাল রানা। পাতলা ক্র্যাকার ও কোই গ্রাস দেয়া ক্যাভিয়ার। মাথা নাড়ল ও, লাগবে না।

ওয়েটার আরেক দিকে যেতে হলরুমে চোখ বোলাল রানা। প্রকাণ্ড ঘরে জড় হয়েছে একদল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও মেডিকেল প্রফেশনাল। মার্ভেল ড্রাগস্‌ কর্পোরেশন যা-ই বিক্রি  করতে আগ্রহী হোক, তা কেনার জন্যে হাজির হয়েছে নামকরা সব ব্যবসায়ীরা।

অন্তত দশটা দেশের সেরা বড়লোক এই হলরুমে উপস্থিত। হার্বার্ট ও কয়েকজন আমেরিকান ব্যবসায়ী ছাড়াও রয়েছে মিডল ইস্টের ক’জন। তাদের পোশাক আলাদা। আরও রয়েছে চাইনিজ, জাপানিজ ও রাশান ব্যবসায়ীরা।

একবার নিজের পোশাক দেখে নিল রানা। ওয়েটারদেরকে বাদ দিলে এখানে সবচেয়ে গরীব মানুষ ও।

চারপাশে চোখ বোলাতে গিয়ে পোডিয়ামের কাছে মোনাকে দেখল রানা। মেয়েটার পরনে সাদা ককটেইল ড্রেস। হালকা হয়ে আসা ধূসর চুলের এক মধ্যবয়স্ক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে নিচু স্বরে। বার কয়েক মাথা দোলাল। একজন এসে হ্যাণ্ডশেক করতেই তাকে উপহার দিল মিষ্টি হাসি।

মাত্র কয়েক বছরেই সত্যিকারের মহিলা হয়ে উঠেছে মোনা। আরও আকর্ষণীয় হয়েছে চেহারা। সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী। সবার মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু।

পাশের ভদ্রলোককে কিছু বলল। আরও কয়েকজন এগিয়ে যেতেই তাদের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল। কাজটা শেষ হতেই ওর চোখ পড়ল রানার চোখে। স্থির হয়ে গেল মেয়েটা, বড় করে একবার শ্বাস নিল। কেমন যেন অসহায় হয়ে উঠল চেহারা।

রানা বুঝল, ওকে এখানে আশা করেনি মোনা।

মোনার কাঁধে টোকা দিল ধূসর চুলের ভদ্রলোক। দু’ সেকেণ্ডে নিজেকে সামলে নিল মেয়েটা। আবার শান্ত হলো চোখ। ভাল করেই জানে, এই মিটিঙের একমাত্র আকর্ষণ ও নিজে।

তখনই নিভু নিভু হলো হলরুমের সব বাতি। ধূসর চুলের ভদ্রলোকের পাশে নেমে পড়ল মোনা প্ল্যাটফর্ম থেকে। একদল লোকের ভেতর তাদেরকে হারিয়ে ফেলল রানা। হলরুমের শেষ মাথায় চালু হলো প্রকাণ্ড দুই প্লাযমা স্ক্রিন মনিটর। সিলিং থেকে নেমে আসছে নিঃশব্দে। স্পিকারে শোনা গেল জলতরঙ্গের মত বাজনা।

শুরু হচ্ছে অনুষ্ঠান।

গত কয়েক বছরে জরুরি কিছু আবিষ্কার করেছে মোনা।

সেটাই বিক্রি করতে চাইছে মার্ভেল ড্রাগ্‌স্ কর্পোরেশন।

অন্যদের সঙ্গে মিশে প্লাযমা স্ক্রিন মনিটরের দিকে পা বাড়াল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *