মৃত্যুঘণ্টা – ৪৭

সাতচল্লিশ

লাউ আনের বক্তব্য শুনতে শুনতে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের মনে হলো, যদি যুবকের কথা মিথ্যা হতো! চায়নিজ-আমেরিকান বিজ্ঞানীর মুখে তিক্ততা আর ভয়।

‘সংক্ষেপে সারো,’ বললেন ব্রায়ান।

‘আপনার কথা মতই ওই ভাইরাস নিয়ে রিসার্চ করছিলাম, ‘ বলল আন, ‘ওই ডেটা মিস রবার্টসনের সংগ্রহ করা নয়, ইউএন-এর ওই জাদুর ভাইরাস।’

‘তাতে কী দেখলে? আমাদের পরিকল্পনা বদল করতে হবে বলে মনে করছ?’

‘তা নয়, কিন্তু কৌতূহল জাগিয়ে দেয়া একটা দিক আছে।’

‘এখন আর কৌতূহল দেখিয়ে কী হবে, আন?’

‘তা ঠিক,’ বলল যুবক বিজ্ঞানী, ‘বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছেন। কিন্তু…’

‘তুমি জানো না কী হয়েছে,’ তাকে থামিয়ে দিলেন ব্রায়ান। ‘পৃথিবীর সেরা দু’জন এজেন্ট এখন ওই জাহাজে। হামলা হবে তাদের ওপর। যদি বেঁচেও যায়, ওই দ্বীপই তো মিসাইল মেরে উড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। রক্ষা নেই ওদের। কাজেই, আন, তুমি বুঝবে না কেমন লাগছে আমার।’

তাঁর দুঃখিত চেহারা দেখে লাউ আনের মনে হলো, এ মুহূর্তে এই অফিসে না এলেই ভাল করত সে। কিন্তু নিজের দায়িত্ব  এড়াতে পারবে না। কাজেই নিচু স্বরে বলল, ‘আপনি বুঝছেন না, স্যর। আপনার কথা মত ওই ভাইরাসের ঘুমন্ত অবস্থা পরখ করে দেখছিলাম।

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়লেন ব্রায়ান। ‘তুমি না বলেছিলে ওটার ভেতর অংশ ফাঁকা? ওখানে রাখা যাবে ডিএনএ। এর বেশি কী?’

‘আপনার কথাই ঠিক, ওটার ভেতর ফাঁকা অংশ আছে,’ বলল আন, ‘কিন্তু তখনই আরেকটা দিক দেখলাম। ওটার ভেতর রয়েছে একটা মেসেজ।

মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামল ব্রায়ানের। ‘মেসেজ? কীসের?

আস্তে করে মাথা দোলাল আন।

‘কী বোঝাতে চাইছ?’ সামনে ঝুঁকলেন এনআরআই চিফ। ‘আপনি তো জানেন না ডিএনএ মলিকিউল দেখতে কেমন?’ জানতে চাইল আন।

‘খুব ভাল করে দেখিনি।’

‘ওটার পাশের ওপরের দিককে বলে নিউক্লিওটাইড্‌স্। মাঝের অংশ মলিকিউল— বলতে পারেন মইয়ের ধাপের মত, ওগুলোকে বলে বেসেস বা বেস জোড়া।’

‘বুঝলাম। তো?’

‘সাধারণ ডিএনএতে আছে বড়জোর চার ধরনের বেস। অ্যাডেনিন, সাইটোসিন, গুয়ানিন আর থাইয়ামিন। আমরা ওদের বলি: এ, সি, জি আর টি।’

‘বলতে চাইছ এসব বেস জোড়ায় রেখে দিয়েছে কোডেড মেসেজ,’ আন্দাজ করলেন ব্রায়ান। দ্রুত জানতে চাইছেন।

মাথা দোলাল আন। ‘ভাইরাসের প্রাইমারি অংশ স্বাভাবিক ডিযাইনের। মইয়ের একের পর এক ধাপ। কিন্তু একেবারে ভেতরে অন্যরকম। একই রকম ধাপ পাবেন। ডিএনএর নির্দিষ্ট সেকশন এমনই হবে। একই রকম হবে টেলোমারদের সেকশন: টিটিএজিজিজি। কিন্তু ওই ভাইরাসে দেখলাম অন্য কিছু। নতুন করে শুরু হয়ে থেমে গেল সব, তারপর আবারও শুরু হলো নতুন করে।’

‘কী ধরনের মেসেজ?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান। চট্ করে দেখলেন হাতঘড়ি। মাত্র কয়েক মিনিট পর ওই জাহাজ উড়িয়ে দেয়া হবে।

‘কারণ প্যাটার্ন যথেষ্ট উপর্যুপরি নয়, বা যথেষ্ট এলোমেলো নয়। তার মানে জরুরি কোনও কারণে এভাবে তৈরি করেছে ওই ভাইরাস। একটি বেস জোড়ায় পর পর তিনটে ধাপ পেয়েছি আমি। দ্বিতীয় বেস জোড়ায় নয়টা ধাপ। তৃতীয় জোড়ায় একটি ধাপ। তারপর আবারও প্রথম থেকে শুরু হয়েছে সব। তিন, নয় আবার এক। তিন, নয় আবার এক। এটা খুবই অস্বাভাবিক।’

একজন জেনেটিসিস্ট বিস্মিত হয়েছে বলেই অবাক লাগছে ব্রায়ানের। ‘এসবের মানে কী?’

‘জেনেটিকালি কিছুই নয়,’ বলল আন। ‘কিন্তু তখনই মনে পড়ল আপনার কথা। বলেছিলেন এনআরআই-এ যোগ দেয়ার অনেক পরে সিআইএ থেকে ডাক পড়েছিল ডেবি ম্যাকেঞ্জির। ওখান থেকে সে যায় ইউএন অফিসে। এখন অ্যালফাবেটিকালি ‘তিন’ নম্বর অক্ষর সি। ‘নয়’ আসলে আই। আর ‘এক’ হচ্ছে এ। অর্থাৎ পেলেন সিআইএ। পর পর তিনবার ওই ভাইরাসের ভেতর লেখা হয়েছে সিআইএ। আবার পাঠানো হয়েছে ভাইরাস প্রাক্তন এক সিআইএ কর্মকর্ত্রীর কাছে।’

সোজা হয়ে বসলেন ব্রায়ান। ‘এর কোনও কারণ জানতে পেরেছ? এই ধরনের প্যাটার্ন কেন?’

‘সিআইএর এক বন্ধুর কাছে খোঁজ নিয়েছি। যে সময়ে ডেবি ম্যাকেঞ্জি গেল ইউএন অফিসে, সে সময় আলাস্কায় ভয়ঙ্কর এক দানব তৈরি নিয়ে কী যেন গণ্ডগোল হচ্ছিল সিআইএর ভেতর। সে কারণে সিআইএ ডেপুটি চিফকে বরখাস্ত করা হলে পালিয়ে যায় লোকটা। নইলে এত দিনে জেল বা মৃত্যুদণ্ড হতো।’

‘তুমি শিয়োর এসব ব্যাপারে?’

‘মোটামুটি, হ্যাঁ। আমার ধারণা ওই লোকই ভাইরাস পাঠিয়ে দিয়েছে ডেবি ম্যাকেঞ্জির কাছে। হয়তো তার বিরোধিতা করেছিল মহিলা। এরপর পেলাম সাতাত্তর বেস জোড়া। এরপর আবারও এল ‘আঠারো’, এক জোড়া ‘পাঁচ’, এরপর,’বাইশ’, ‘পাঁচ’, চোদ্দ’ ‘সাত’, তারপর আবার ‘পাঁচ’। এসব সংখ্যাকে অক্ষর ধরে নিলে আপনি পাবেন একটা শব্দ— রিভেঞ্জ।’

গলা শুকিয়ে গেল জেমস ব্রায়ানের। আমেরিকান সরকারের শক্তিশালী সব সংস্থার একটি সিআইএ, ওটা থেকে বের করে দেয়া বিশেষ ওই লোকটা রনি এমসন ছাড়া কেউ নয়। এলেনা বা মাসুদ রানার প্রতিটি পদক্ষেপের থেকে এক পা এগিয়ে ছিল সে। তার জানা ছিল এনআরআই কোথায় রাখবে ডক্টর আহসান মোবারকের বোন বা মেয়েকে।

নতুন কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করলেন না ব্রায়ান, ফোন তুলে নিয়ে অটো ডায়াল করলেন এলেনার স্যাটালাইট ফোনে। বিড়বিড় করে বললেন, ‘বোকা মেয়ে, ফোনটা ধরো!’

ওদিক থেকে রিসিভ করল ব্রিটিশ উচ্চারণে এক লোক। ‘গ্রাহাম বলছি।’

‘গ্রাহাম, দয়া করে এলেনাকে ফোন দিন,’ বললেন ব্রায়ান।

পেরিয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর এল জবাব, ‘সরি, দেরি করে ফেলেছেন। ওরা উঠে গেছে দ্বীপে।’

সত্যিই, দেরি হয়ে গেছে, মনে মনে আফসোস করলেন ব্রায়ান। নিশ্চিত মৃত্যু-ফাঁদের দিকে চলেছে মাসুদ রানা ও এলেনা রবার্টসন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *