মৃত্যুঘণ্টা – ৩৭

সাঁইত্রিশ

আল কুয়ারনা শহরের একটি পরিত্যক্ত এলাকায় এনআরআই-এর ছোট এক বাড়ির কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। বালি দূর করছে গা থেকে। কাজটা শেষ হলে শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল হাত-মুখ।

ঝোড়ো বালির কারণে এখনও জ্বলছে দু’চোখ। রাগ হচ্ছে, ব্যর্থ হয়েছে মিশন। মোনাকে হারিয়ে বসেছে ওরা।

পাশের ঘরে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করছে এলেনা।

কিচেনে ঢুকে রানার কাঁধে হাত রাখল গ্রাহাম। ‘বিশ্রাম নাও, ওই ছোকরাকে পাহারা দিচ্ছি। পালাতে পারবে না। এমনিতেই হাত-পা বেঁধে মুখে গুঁজে রেখেছ রুমাল। তুমি বললে ওর মাথাও ফাটিয়ে দিতে পারি।’

কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, ঠিক করেছে রানা। শুকনো গলায় বলল, ‘দরকার হলে ঠিক তা-ই করব।

মৃদু নড করে কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে গেল গ্রাহাম

কয়েক সেকেণ্ড পর ঘরে ঢুকল এলেনা। ‘সরি, দেখো, ঠিকই মোনাকে খুঁজে বের করব আমরা।’

‘বলেছ, সেজন্যে ধন্যবাদ,’ বলল রানা, ‘ওকে পেতেই হবে, নইলে সর্বনাশ হবে।’ চুলোর পাশের কাউন্টারে চোখ গেল ওর। ওখানে দুটো হোলস্টার ও পিস্তল। একটা ওর। অন্যটা এলেনার ৯ এমএম বেরেটা নয়। অনেক ছোট। ‘ওই পিস্তলটা আমাকে দিয়েছিলে। কোথা থেকে পেলে?’

‘মোনার,’ বলল এলেনা, ‘গুলির সময় হাত বদল হয়েছে।’

‘তুমিই দিয়েছিলে ওকে?’

‘না। ওর কাছে আগেই ছিল।’

অস্ত্রটা পরীক্ষা করল রানা।

.২৫ ক্যালিবারের অটোমেটিক।

হঠাৎ একটা চিন্তা আসতেই গম্ভীর হয়ে গেল ও।

না, এমন হওয়ার কথা নয়!

এলেনার হাতে তোয়ালে দিয়ে মোবাইল ফোন তুলে নিল রানা, টেক্সট মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিল ফ্রান্সের এক ফোন নম্বরে।

জবাবের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

কিছুক্ষণ পর ভিডিয়ো-কনফারেন্সের জন্যে যোগাযোগ করলেন এনআরআই চিফ। মনিটরে দেখা দিয়ে সরাসরি জরুরি কথায় এলেন, ‘ইনফেকশন রেট ও ভিরুলেন্স কনফার্ম করেছে সিডিসি। সর্বোচ্চ সতর্ক হতে বলেছে।’

‘একটু খুলে বলুন,’ বলল এলেনা।

‘নানান অ্যান্টিভাইরাস জড় করছি আমরা। জোরেশোরে তদন্তে নেমেছে ইন্টারপোল। ঠিক হয়েছে, আগামী ভোরে ন্যাটো দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে ওই ভাইরাস নিয়ে আলাপ করবেন  আমাদের প্রেসিডেন্ট।’

ওসব তো রাজনৈতিক বোলচাল,’ বলল রানা। ‘এখন এমন কিছু দরকার, যেটা দিয়ে ঠেকানো যাবে জীবন-বৃক্ষের বীজ।’

‘জানি, কিন্তু কী করব?’ কাঁধ ঝাঁকালেন ব্রায়ান। ‘জরুরি কিছু ভেবে থাকলে পরামর্শ দিতে পারেন।’

‘প্রথম সুযোগে হামলা করতে হবে ওই কাল্টের ওপর,’ বলল রানা। ‘ইরাকে আপনাদের সৈনিক আছে। বা সৌদি আরব থেকেও সরিয়ে আনতে পারবেন। চোখ খোলা রাখুক তারা। আশা করি, স্ট্রাইক টিম পাঠানো হচ্ছে? উপকূল পাহারা দেবে হেলিকপ্টার প্যাট্রল, গোপনে চোখ রাখবে পারস্য সাগরে। বোটে করে ওদিকে যেতে পারে ওই কাল্টের লোক। তাদের কাছে রয়ে গেছে ভাইরাস আর ওই বীজ। যদিও মনে করি না ইরানে থাকবে তারা।’

‘যা বলেছেন, সবই ঠিক, কিন্তু আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারছেন?’ বললেন ব্রায়ান, ‘গোপনে ইরানে ঢুকলে মস্ত বিপদে পড়ব আমরা আমেরিকানরা। ‘

‘সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে এলেনা আর আমি যেতে পারি,’ বলল রানা। ‘এরা মোনাকে তুলে নেয়ার পর ভাইরাস ছড়াতে বাধা থাকল না। কোনও ধরনের চালাকি করেছিলেন ডক্টর মোবারক, তাদের হাতে তুলে দেননি সঠিক জিনিস। কিন্তু মেয়েটা ভাইরাস তৈরি করবে। এ ছাড়া উপায় থাকবে না ওর। বাবার রেখে যাওয়া কাজ শেষ করবে।

‘আমরাও তা বুঝতে পারছি,’ ভুরু কুঁচকে গেছে ব্রায়ানের।

মোনা বলেছে কাজটা করতে লাগবে বড়জোর চব্বিশ ঘণ্টা।’

‘লাউ আনও বলেছে, ওটা সহজ কাজ।’

‘কতক্ষণ নির্যাতন সহ্য করতে পারবে মোনা?’ রানার দিকে তাকাল এলেনা।

‘বেশিক্ষণ নয়, বড়জোর এক বা দু’দিন,’ বলল রানা। ‘এরা কী করবে তার ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া, নিজে থেকেই কাজে নামতে পারে। ওর বোন অসুস্থ।

কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেলেন ব্রায়ান, কপাল চুলকাতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ‘এদিকে বাজে দুটো ঘটনা ঘটেছে। মার্ভেল ড্রাগ্‌স্‌ কর্পোরেশনের ল্যাবের নানান কমপিউটার রেকর্ড চুরি হয়ে গেছে। আমরা ধারণা করছি, সেসবের ভেতর ছিল টেস্ট রেযাল্টের ভাইরাস ৯৫২।’

কথা শুনে একটা কথাও বলল না রানা বা এলেনা।

আবারও শুরু করলেন ব্রায়ান, ‘এদিকে আমাদের আল কুয়ারনার সেফ হাউসে হামলা করেছিল কারা যেন। তিনজন গার্ডকে খুন করে নিয়ে গেছে ডক্টর মোবারকের বোন ও মেয়েকে।’

আরও তিক্ত হলো রানার মন। অসুস্থ, ছোট্ট একটা মেয়েকে জিম্মি করেছে একদল পশু। যা খুশি করবে, অথচ কিছুই করতে পারবে না ও নিজে!

‘সতর্ক ছিল না আমাদের লোক?’ বিস্ময় প্রকাশ করল এলেনা।

‘ছিল। কিন্তু আগে থেকেই চোখ রেখেছিল ওরা ওখানে।’

এই মিশনের প্রথম থেকেই ওর প্রতিটা পদক্ষেপের আগেই কয়েক পা সামনে থেকেছে ওই কাল্টের নেতা, ভাবল রানা। এরপর ও নিজে কী করবে সবই যেন জানা ছিল। এটা সম্ভব কী করে?

সম্ভব, যদি….

অস্বস্তির ভেতর পড়ল রানা।

কারা জানত ওরা ইরাক বা ইরানে যাচ্ছে?

বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান, এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান, এলেনা ও মোনা।

এলেনা আর ও ছাড়া কে জানত কোন্ এলাকায় থাকবে এনআরআই-এর সেফ হাউস?

আবারও মাত্র কয়েকজন।

বিসিআই চিফ মেজর

চিফ মেজর জেনারেল (অব.

জেনারেল (অব.) রাহাত খান, এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান, এলেনা আর মোনা।

ওর মনে হয়েছে, এটিভি থেকে ইচ্ছে করেই পড়ে গেছে মোনা। এরপর প্রায় ঘোরের ভেতর এগিয়ে গেছে শত্রুদের দিকে। সেক্ষেত্রে কি সম্ভব, কোনওভাবে ওই কাল্টের সঙ্গে জড়িত মোনা? ডক্টর মোবারকের কথা মনে পড়ল ওর। তিনি বলেছিলেন, ভুলেও কাউকে বিশ্বাস করবেন না। তাই বলে তাঁর নিজের মেয়েকেও বিশ্বাস করতে পারেননি? আরও জটিল কোনও কারণে বাবার কাছ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল মোনা? এতটাই, বাবা খুন হয়ে গেলেও কিছুই যায় আসেনি?

এসব ভাবতে গিয়ে আরও তিক্ত হলো রানার মন। চাপা স্বরে বলল, ‘কাল্টের হাতে মোনার বোন। কাজেই কোনও বাধা দেবে না ও। তা ছাড়া, ৯৫২ রেয়াল্ট পেয়ে গিয়ে থাকলে, হয়তো ওকে লাগবেই না তাদের। ধরে নিতে পারেন, আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর তৈরি হয়ে যাবে প্রাচীন আমলের অমৃত। ছড়িয়ে দেয়া হবে দুনিয়া জুড়ে। লুকিয়ে পড়েছে তারা। এখানে আসতে আমাদের লেগেছে একঘণ্টা। তার মানে, উপকূলে পৌঁছুতে তাদের লাগবে বড়জোর দু’ঘণ্টা। কাজেই আপনাদের দেখতে হবে, উপকূল দিয়ে যেন বেরিয়ে যেতে না পারে তারা।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রায়ান। ‘এত জলদি কিছুই করতে পারব না। প্রথমে রাজি করাতে হবে প্রেসিডেন্টকে। তিনি নির্দেশ দেবেন। সঠিক জায়গায় অবস্থান নেবে ফোর্স। তাতেও লাগবে অনেক সময়। আপনি যা বলেছেন, তা করতে গেলেও চাই বেশ কয়েক ঘণ্টা। আমরা হয়তো আপনাকে হেলিকপ্টার জোগাড় করে দিতে পারতাম। কিন্তু ওটাতে করে খুঁজতে গেলে ইরানিয়ান মিসাইলের আঘাতে খুন হবেন। তাই বলছি, আপাতত অপেক্ষা করুন। নতুন কিছু জানলে যোগাযোগ করব আমি।’

‘এদিকে আমরা কিছুই করতে পারব না?’ বিরক্ত হয়ে চিফকে বলল এলেনা।

‘আপাতত কিছুই করার নেই,’ বললেন গম্ভীর ব্রায়ান।

‘আমরা যে তরুণ ছেলেটাকে সঙ্গে এনেছি, তার কাছ থেকে জরুরি তথ্য পেতে পারি,’ বলল রানা।

‘নির্যাতন করতে চাও?’ আপত্তির সুরে বলল এলেনা।

‘কী করব তা পরে ভেবে বের করব,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

‘কিন্তু ওর পেট থেকে কী বেরোবে? আরব তরুণ। স্থানীয়।’

‘স্থানীয় নয়।’ বলল রানা, ফ্রান্স থেকে এসেছে। ওর বুকে ডক্টর মোবারকের মতই পুড়িয়ে লেখা ভার্স। কাল্টের লোক।’

‘হয়তো অনেক নির্যাতন করলে, কিন্তু কিছুই জানলে না- হতে পারে না? হয়তো জানেই না তেমন কিছু।’

‘যা জানে, সেটা হয়তো কাজে আসবে,’ বলল রানা। ‘এক পর্যায়ে সবাই মুখ খোলে, নির্যাতনের মাত্রা সবার আলাদা।’

‘আমি নির্যাতনের পক্ষে নই,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল এলেনা। ‘ডক্টর মোবারকের কথাই ভাব। কম অত্যাচার করেনি তারা ওঁকে। জরুরি কিছু বের করতে পারেনি মুখ থেকে।’

নিষ্ঠুর শোনাল রানার কণ্ঠ: ‘কিন্তু এই ছেলে ডক্টর মোবারক নয়, তাঁর যোগ্যতার সঙ্গে একে তুলনা করলে ভুল করবে।

চুপ করে এলেনা ও রানাকে দেখছেন ব্রায়ান।

‘কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হবে, সেটা হতে দেব না, ‘ বলল রানা।

‘আমি একমত।’ নড করল এলেনা। ‘কিন্তু কাউকে নির্যাতন করে সত্যিকার তথ্য কখনও পাওয়া যায় না।’

‘যা করার ভেবেচিন্তে করুন দু’জন, পরে যোগাযোগ করব, আমেরিকার সব অ্যাসেট কাজে লাগাব আমরা।’ বিসিআই এজেণ্ট ও এনআরআই এজেন্টের তর্ক বা বিরোধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন ব্রায়ান। কালো হয়ে গেল মনিটরের পর্দা।

এলেনার দিকে তাকাল রানা। ‘আমার দেশ বা আমার নিজের অত অ্যাসেট নেই। একা মানুষ আমি, অ্যাসেট বলতে শুধু মাথা আর এই শরীর, আর ওই একই জিনিস আছে ছোকরার। এসো, ইন্টারোগেশনের জন্যে তৈরি হই। ওর পেট থেকে বের করতে হবে সব। নইলে আগামী চব্বিশ ঘণ্টা পেরোবার আগেই হয়তো পৃথিবী হয়ে উঠবে নরক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *