মৃত্যুঘণ্টা – ৪

চার

চোরা কারবারী ডুক ব্রামস্ট্রির সঙ্গে মিটিং শেষ করে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর গন্তব্যে পৌঁছল রানা। সবুজ মার্সিডিজের ড্রাইভার থামল এক্সেলশিয়র হোটেলের সিঁড়ির সামনে। দেরি না করে এগিয়ে এসে পেছনের দরজা খুলে দিল ভ্যালে, ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ল রানা। যে-কেউ ভাববে, কোনও দিকে খেয়াল নেই ওর, কিন্তু বাস্তবে চারপাশ দেখে নিয়েছে; দ্রুত পায়ে ঢুকে পড়ল লকিতে। এলিভেটর ব্যবহার না করে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল তেতলার ফাইভ-স্টার রেস্টুরেন্টে। ওখান থেকে চোখে পড়বে প্রাচীন বন্দর ও নীল সাগর।

দৃশ্যটা দেখার মতই, অপূর্ব সুন্দর। সাগরের তীরে প্রায় বাঁধের ওপর তৈরি বেশ কয়েক তলা এই হোটেল। যেন বন্দরের ব্যাটলমেন্টের অংশ। দোতলার রেস্টুরেন্টের সামনে সরু, দীর্ঘ ব্যালকনি, প্রায় ঘিরে রেখেছে হোটেলটাকে। দেখা যায় বন্দর ও  লোভরিজেন্যাক দুর্গ।

সার্ভিস ও খাবারের জন্যে গোটা ইউরোপে বেশ কয়েকটি নামকরা পুরস্কার পেয়েছে এ রেস্টুরেন্ট। তবে দামি ও লোভনীয় খাবারের জন্যে এখানে আসেনি রানা। সময় কাটাতে হবে। হঠাৎ করেই ক্রোয়েশিয়া থেকে বিদায় নিলে সন্দেহ করবে ডুক ব্রামস্ট্রি। সেক্ষেত্রে হয়তো মিসাইল খুলে দেখবে, ফলে মাটি হবে ওর এত পরিশ্রম।

ব্যালকনির শেষমাথায় পাথুরে দেয়ালের দিকে পিঠ রেখে টেবিলে বসল রানা। ওখান থেকে দেখল মৃদু ঢেউ তোলা সুনীল সাগর ও রাজকীয় হোটেলের সামনের সরু রাস্তা। এরই ভেতর হাজির হয়েছে ওয়েটার, তাকে এসপ্রেসো কফির অর্ডার দিল রানা। হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে রুমের অগ্রিম টাকা দিলেও ঠিক করেছে, রাতে ওখানে থাকবে না। আরও কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে ব্যাগ নিয়ে ক্যাব ডেকে সোজা চলে যাবে এয়ারপোর্টে, রাতটা কাটাবে ওখানেই।

ডুক ব্রামস্ট্রি এরই ভেতর ওকে খুঁজতে শুরু না করলে, ধরে নেবে স্টিংগার মিসাইলের গাইডেন্স সিস্টেমের ভেতর ওর রাখা ট্র্যান্সমিটার পায়নি সে। সেক্ষেত্রে আবারও ক্রেটে মিসাইল রেখে কম খুঁতখুঁতে কাস্টমার খুঁজবে লোকটা।

সে বা তার লোকের জানার কথা নয়, ঠিক কী জিনিস খুঁজতে হবে। রানার রেখে আসা ট্র্যান্সমিটার দেখতে মিসাইলের সার্কিট বোর্ডের মতই, খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে অনেক দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও। কাজেই রানা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, নিজের কাজে কোনও খুঁত রাখেনি ও।

চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে সচেতন হলো রানা। ওর দিকে আসছে এক লোক। পরনে নীল কোট। চুলের অভাবে খুশি মনে কপাল গিয়ে উঠেছে মাথার মাঝখানে। মুখে বিশাল চওড়া হাসি। হাতের লাঠির ডগা ক্রমেই তাক হচ্ছে রানার বুকে।

রানা জানে, ওই লোকের হাতের ওই হ্যাণ্ডেলে সামান্য মোচড় দিলে লাঠির ডগা থেকে বেরোবে বন্দুকের একটা এলজি গুলি।

‘গুলি করার আগেই খুন হবে,’ সহজ সুরে বলল রানা।

‘কী করে?’ জানতে চাইল টেকো যুবক। নামিয়ে ফেলেছে লাঠি। আরও সামনে এসে উঁকি দিল রানার কোলে।

টেবিলের তলায় রানার ওয়ালথার পি.পি.কে.-র নল। কাঠ ভেদ করে সোজা বুলেট বিঁধত জন গ্রাহামের মগজে।

একবার মাথা নেড়ে হতাশ হয়ে সামনের চেয়ারে বসল ব্রিটিশ যুবক। রানার প্রতি কৃতজ্ঞ এক বন্ধু, আগে ছিল এম.আই.সিক্স-এ। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আর এম.আই.সিক্স-এর এক যৌথ মিশনে শত্রু এলাকায় ঢুকে বুকে- পেটে গুলি খায় সে। ব্রিটিশ দলের জীবিত দু’জন আগেই পিছিয়ে গিয়েছিল। তখন সোহেল আহমেদ ও মাসুদ রানা জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ করে গ্রাহামকে তুলে নিয়ে সরে আসে নিরাপদ এলাকায়। তারপর থেকে দুই বাঙালি বন্ধুকে আপন ভাইয়ের মত জানে গ্রাহাম। প্রয়োজনে নিজের জান দিতেও আপত্তি নেই ওর।

কিন্তু ওই মিশনের পর চিকিৎসকরা ওর পাকস্থলির অর্ধেকটা কেটে ফেলেছে বলে অবসর দেয়া হয়েছে ওকে এম.আই.সিক্স থেকে। হাসি-খুশি মানুষ, চাকরি হারিয়েও ভেঙে পড়েনি। টাকার অভাব হয়নি, টুকটাক ইনফর্মেশন বিক্রির কাজ করে বেশ চলছে তার জীবন।

‘হঠাৎ এখানে?’ জানতে চাইল রানা।

‘অতিথির প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ?’ আপত্তির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল গ্রাহাম। ‘আমি তো জানতাম বাঙালিরা অতিথি-বৎসল।’

‘মতলব নিয়ে আসা অতিথিদেরকে আমরা পছন্দ করি না।’

‘কোনও মতলব নেই।’ ওয়েটারকে ডাকল গ্রাহাম। ‘তবে কাজ আছে।’

‘বলে ফেলো।’

ওয়েটারকে রাজকীয় লাঞ্চের অর্ডার দিল গ্রাহাম, তারপর নির্বিকার মুখে বলল, ‘এর বিলটা দেবেন মিস্টার রানা।’

রানার দিকে তাকাল ওয়েটার।

মাথা দোলাল রানা। ওয়েটার চলে যেতেই বলল, ‘বিয়ে করছ না কেন? আধা পাকস্থলি নিয়ে এত গুরুপাক খাবার খাওয়া কি ঠিক? নিষেধ করার লোক দরকার তোমার।’

‘আমাকে বিয়ে করবে কোন্ মেয়ে, রানা?’ করুণ চেহারা করল জন গ্রাহাম।

‘শুনেছি লণ্ডনের অর্ধেক মেয়েকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছ?’

মাথা নাড়ল গ্রাহাম। ‘ফালতু লোকের কথা।’

এবার বলল রানা, ‘অবশ্য, লণ্ডনের বাকি অর্ধেক মেয়ে খুন করতে চাইছে তোমাকে, সেটাও শুনেছি।’

‘তা অবশ্য ঠিক কথাই বলেছ,’ নির্বিকার চেহারায় স্বীকার করল গ্রাহাম।

‘কী কারণে এলে, বলবে না?’

‘তোমাকে খুঁজতেই।’

‘তা বুঝতে পেরেছি,’ বলল রানা। ‘কিন্তু কী কারণে? জানলে কী করে যে আমি এখানে?’

‘এদিকে ভাল কানেকশন আছে,’ বলল গ্রাহাম, ‘তা-ই শুনলাম এখানে এসে পূর্ণিমার চাঁদের মত জ্বলজ্বলে আলো বিলাচ্ছ। অবশ্য, জানি না…’ মাথা নাড়ল। ‘জরুরি কোনও ইনফর্মেশন লাগবে?’

‘না।’

‘তা হলে বলে ফেলি, এখানে এসেছি আমাদেরই চেনা এক লোকের কারণে।’ নড়েচড়ে বসল গ্রাহাম। ‘তাকে তুমি সাহায্য করেছিলে। তিন বছর আগে আফ্রিকা থেকে বের করে আনো।’

চট্ করে বাঙালি জেনেটিক বিজ্ঞানী আহসান মোবারকের কথা মনে পড়ল রানার। ভদ্রলোকের মেয়েও ছিল তখন ওদের সঙ্গে। মস্ত ঝুঁকি নিয়ে পেরোতে হয়েছিল কঙ্গো সীমান্ত।

‘তুমি কি এখনও বন্ধুদের সাহায্য করো?’ জানতে চাইল গ্রাহাম।

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘করো।’

‘তোমার সাহায্য দরকার?’

‘না, আহসান মোবারকের দরকার।’

মোনা মোবারকের বয়স তখন ছিল মাত্র বিশ। দেখতে গ্রিক দেবীর মতই সুন্দরী, প্রখর বুদ্ধিমতী, নিজেও যোগ্য বাবার যোগ্য মেয়ের মতই হয়ে উঠছিল আর এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কঙ্গো সরকারের হয়ে বিপজ্জনক জেনেটিক মডিফায়েড ফসল নিয়ে গবেষণা করছিলেন আহসান মোবারক, সঙ্গে মোনা। চোখ রাখছিল আর্মির কয়েকজন জেনারেল। তারা মিস্টার মোবারককে বাধ্য করতে চাইল বায়ো ওয়েপন তৈরি করতে।

তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে এক সুযোগে ই-মেইল করেছিলেন আহসান মোবারক। ফলে বিসিআই থেকে রানাকে পাঠানো হয় রিপাবলিক অভ কঙ্গোয়। মোনার ফুপাতো ভাইয়ের পরিচয়ে ওঠে ও ওদের বাড়িতে। কয়েকটা দিন চারপাশের অবস্থা বুঝে নিয়ে ওই দেশ থেকে কীভাবে বেরোবে স্থির করেছে রানা, এরই মধ্যে ওকে ভালবেসে ফেলল মেয়েটা। একেবারে হাবুডুবু কিশোরী প্রেম।

নানাভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে রানা। কিন্তু পরে বর্ষণভরা একরাতে মস্ত বিপদের মধ্যে মিলিত হয়েছিল ওরা। অবশ্য, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর সোজা আলাদা দুটো পথে রওনা হয় ওরা। বিসিআই-এর বিশেষ একটা মিশনে যোগ দিতে ইউরোপে চলে আসে রানা। আর সোহেলের সঙ্গে বিমানে চেপে বাংলাদেশে ফেরে মোনা ও তার বাবা। এরপর মোনা বা মিস্টার মোবারকের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি রানার।

‘সোহেলের কাছে শুনেছি, মিস্টার মোবারকের মেয়ে মোনা তোমাকে ভালবাসে,’ বলল গ্রাহাম। ‘ওখান থেকে চলে আসার পর আর কখনও দেখা বা কথা হয়নি ওর সঙ্গে?’

‘না।’

‘ওকে বিয়ে করলে এত দিনে গোটা দুয়েক বাচ্চা থাকত তোমার,’ মুচকি হাসল গ্রাহাম।

ছেলে না মেয়ে?’ ঠাট্টা করল রানা। তারপর বলল, ‘উচিত হতো না। শুনেছি ভাল ক্যারিয়ার পেয়েছে।

‘হয়তো।

‘তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মোনা?’

‘না, তার বাবা। অ্যাথেন্সে দেখা হতেই এক পর্যায়ে জানাল, খুব উপকৃত হবে আমি তোমাকে খুঁজে বের করলে। সে নাকি মস্ত বিপদে আছে। কে বা কারা নাকি খুন করতে চাইছে তাকে।’

‘তুমি নিজেই ওঁকে সাহায্য করতে পারতে।’

লালচে হয়ে গেল গ্রাহামের মুখ। ‘বলেছিলাম। এমন কী বলেছি, দরকার হলে নগদ টাকার ব্যবস্থা করে দেব। তখনই বলল, টাকা দিয়ে বিপদ এড়াতে পারবে না। আসলে তোমার মত করে আমাকে বিশ্বাস করেনি সে।’

রানার মনে পড়ল, মোবারক সাহেবের ওপর বিসিআই-এর ফাইলের তথ্য। সবসময়ে বিপজ্জনক মানুষের সঙ্গে মিশতেন। বা বলা যায়, তাঁকে খুঁজে নিত তারা। অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, কিন্তু অন্য কারও সঙ্গে কাজ করতে রাজি নন। আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকারের হয়ে জেনেটিক ফসলের ওপর গবেষণা করতেও আপত্তি ছিল তাঁর।

পাগলাটে, প্রৌঢ় বিজ্ঞানী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন কঙ্গোয়। বাংলাদেশে ফেরার কিছু দিন পর আবার উড়াল দেন ইউরোপে। রানা বুঝতে পারছে, আবারও একদল বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছেন তিনি।

‘কী ধরনের বিপদে আছেন, সে সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘না। তবে বাস্তবতা থেকে অনেক সরে গেছে ভদ্রলোক। দেখে মনে হয়েছিল আধমরা। বলেছিল, সাক্ষাৎ ইবলিশ লেগেছে তার পেছনে।’ কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে বলল গ্রাহাম, ‘কথা বলতে গিয়ে ‘তারা আনফরগিভিং’ শব্দ দুটো ব্যবহার করেছিল।’

‘কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে বলেছেন?’

‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে দেখা করবে প্যারিসে। চেক ইন করতে বলেছে ট্রিয়ানন প্যালেস হোটেলে। তোমাকে খুঁজে নেবে।’

মস্ত এক ট্রে নিয়ে এসে টেবিলে লাঞ্চ নামাল ওয়েটার। সে বিদায় নেয়ার পর কোটের পকেট থেকে একটা মোবাইল হার্ড ডিস্ক বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল গ্রাহাম। ‘বলেছে, এটার ভেতরের জিনিস দেখলেই অনেক কিছু বুঝবে।’

এক সঙ্গে এক শ’ একটা চিন্তা চেপে বসল রানার মনে। জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার মোবারকের সঙ্গে আছে মোনা?’

‘নো, মেইট। ওই পাগলের ধারেকাছে থাকবে কে? খোঁজ নিয়েছি, প্রথম সুযোগেই ওর বাবার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল।’ 

বাপ-মেয়ের সম্পর্ক ভাল ছিল না, মনে পড়ল রানার। হয়তো ভালই হয়েছে যে বাবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে মোনা। অবশ্য, মিস্টার মোবারক ঝামেলায় থাকলে, হয়তো মেয়েটা নিজেও আছে মস্ত বিপদে। ওর বাবার ওপর চাপ তৈরি করতে ওকে বন্দি করে নির্যাতন চালাতে পারে যে-কেউ।

‘মোনা কোথায় আছে, তা জানো?’

মাথা নাড়ল গ্রাহাম।

‘হয়তো ওর মাথার ওপরও ঘনিয়ে এসেছে বিপদ। লুকিয়ে পড়তে হয়েছে।’ গোগ্রাসে মুখে খাবার তুলছে গ্রাহাম, সাগরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওকে দেখল রানা। ‘খুঁজে বের করতে পারবে মেয়েটাকে?

ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছল গ্রাহাম। ‘পারব না কেন? ওকে পেলে দেরি না করে ফোন দেব।’

চেয়ার ছেড়ে রওনা হয়ে গেল রানা।

‘হায় হায়! এই হাজার ডলারের খাবারের বিলটা দেবে কোন শালা?’ পেছন থেকে কাতরে উঠল গ্রাহাম!

ঘুরে তাকাল রানা। ‘বিল দেবে তোমার এই দুলাভাই! কারণ তোমার বোনকে কাছে পেয়ে আমি খুব খুশি।

‘শালা! আসল কথা কী?’ নাক কুঁচকে ফেলল গ্রাহাম।

গলা নামাল রানা।

‘আমেরিকার এনআরআই-এর হয়ে কাজ করছি, সব বিল তারাই দেবে,’ বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল রানা। সোজা ফিরল নিজের রুমে। ওখান থেকে ব্যাগ নিয়ে নেমে এল লবিতে। কাউন্টারে বলতেই রেস্টুরেন্টে যোগাযোগ করল ক্লার্ক, জেনে নিল ওখানে কত বকেয়া হয়েছে।

বিল পরিশোধ করে হোটেল থেকে বেরোল রানা। ভ্যালে ডেকে দিল ক্যাব। ওটা চেপে শহরের মাঝে চলে এল ও। বার কয়েক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে নানান দিকে গেল, তারপর নেমে পড়ল মস্ত এক অফিস দালানের সামনে। প্রকাণ্ড বাড়ির ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে এল পেছনের এক গলিতে। ওখান থেকে আরেকটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা গেল স্ট্র্যাডান-এ। ওটাই ডুবরোভ্নিকের সবচেয়ে ব্যস্ত সড়ক।

কিছুক্ষণ ওখানে হাঁটাহাঁটি করে নিশ্চিত হলো, পেছনে ফেউ নেই। ছোট এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে পেছনের টেবিলে বসে সেল ফোন বের করে কল দিল। শুনল টিট-টিট আওয়াজ। ওকে দেয়া সেল ফোনের স্ক্র্যাম্বল্ড সিগনাল পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট স্যাটালাইটে, ফলে কৃত্রিম চাঁদ সরাসরি ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দিল কল।

এক সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে মিষ্টি এক নারী কণ্ঠ শুনল রানা: ‘এলেনা রবার্টসন।’

মেয়েটা কাজ করে এনআরআই অর্থাৎ ন্যাশনাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। ওই সংগঠন আমেরিকান সরকারের অদ্ভুত এক মিশ্র এজেন্সি। নানান দেশের ইউনিভার্সিটি এবং কর্পোরেশনের কাটিং এজ রিসার্চ নিয়ে কাজ করে ওটার বৈদেশিক ডিপার্টমেন্ট। ছোট ডিপার্টমেণ্ট, কিন্তু তাদের কর্মপদ্ধতি অনেকটা সিআইএ-র মতই। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল গোপন তথ্য সংগ্রহ করে।

দু’দেশের যৌথ একটি মিশনে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল রানা ও এলেনার, দেরিও হয়নি ঘনিষ্ঠতা বাড়তে। প্রথম দু’দিনের ভেতর রানার সঙ্গে আন্তরিক একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিল মেয়েটা। অবশ্য, তার আগে ভাল করেই কমপিউটার ঘেঁটে জেনে নিয়েছিল রানার অতীত। সত্যি যখন স্বপ্নের নায়কের খুব কাছে গেল মেয়েটা, সহজেই মেনে নিতে পেরেছে, কখনও সংসারে বাঁধতে পারবে না রানাকে। আসলে ওদের দু’জনের সম্পর্ক একই সঙ্গে প্রেমিক-প্রেমিকা ও বন্ধু-বান্ধবীর মাঝের কিছু। আমেরিকায় এলে কখনও কয়েক দিন রানা কাটায়  এলেনার বাড়িতে। এতেই খুশি মেয়েটা, কাছে তো পেয়েছে প্রিয় মানুষটাকে!

সুযোগ পেলে একে অপরকে সাহায্য করে ওরা। যেমন, এবার নিজের কাজে সাহায্য চেয়েছে এলেনা রানার কাছে।

‘কাজ শেষ,’ সংক্ষেপে বলল রানা।

‘বলেছিলে আরও তিন দিন লাগবে, এখনই বেরিয়ে আসতে চাও?’ বলল এলেনা।

‘এখানে আর কোনও কাজ নেই।’

ডুক ব্রামস্ট্রির ওয়্যারহাউসের কথা আর ভাবছে না রানা, মনে ঘুরছে আহসান মোবারকের চিন্তা। জানতে হবে কী ধরনের বিপদে পড়েছেন মানুষটা। বাঙালি বিজ্ঞানী। মস্তবড় গোলমালে না পড়লে ভুলেও যোগাযোগ করতেন না। তাঁর সঙ্গে প্যারিসে দেখা করবে, ঠিক করেছে রানা। তবে আগে আলাপ সেরে নেবে ওর বস্ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সঙ্গে।

‘কোনও সমস্যা হয়নি তো?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘না। তবে জড়িয়ে গেছি অন্য কাজে।’ পকেট থেকে ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বের করল রানা। ওটার দিকে চেয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে বড় ধরনের ঝামেলা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *