মৃত্যুঘণ্টা – ৫

পাঁচ

অপরূপা প্যারিস।

আকাশের বুক ভেদ করে সোজা পুরো এক হাজার ফুট ওপরে উঠেছে ফ্রান্সের লৌহমানবী, চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতই গঠন, তেমনি তার মনোরম গড়ন। প্রকাণ্ড আইফেল টাওয়ারের সামনে পৌঁছে ওপরে চোখ তুললেন জেনেটিক বিজ্ঞানী ডক্টর আহসান মোবারক। অবযার্ভেশন ডেক-এ থাকার কথা এক ইরানিয়ান লোকের, সঙ্গে করে এনেছে সে আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে খোদাই করা অমূল্য এক ট্যাবলেট। শুধু যে প্রাচীন তা-ই নয়, ওটা বলে দেবে এমন সব তথ্য, যার তুলনা নেই। ওটা যেমন আসবে ভাল কাজে, তেমনি একটু এদিক- ওদিক হলেই সর্বনাশ হবে মানব-সভ্যতার।

চারপাশে হাজার মানুষের ভিড়েও নিজেকে বড় একা লাগল ডক্টর মোবারকের। সাহায্য চেয়ে খবর দিয়েছিলেন, কিন্তু কই, এল না মাসুদ রানা। এরই ভেতর অনেক দেরি করে ফেলেছেন। শেষে উপায় না দেখে বেরিয়ে এসেছেন গোপন আস্তানা ছেড়ে। যে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছেন, যখন তখন খুন হয়ে যেতে পারেন এখন।

অত ওপরে চেয়ে এখন মাথা ঘুরছে মোবারকের, চোখ নিচু করে দেখলেন চারপাশে শত শত টুরিস্ট। সবার সঙ্গে মিশে চললেন এলিভেটর লক্ষ্য করে। ভুলেও তাড়াহুড়ো করছেন না। চাইছেন না বাড়তি মনোযোগ দিক কেউ।

চট্ করে কেউ বুঝবে না, তিনি চিন্তিত। বয়স কম-বেশি ষাট, মাঝারি আকারের মানুষ। কালো চুল খাটো। পৃথিবীতে এমন বহু লোক আছে, যাদের দিকে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখবে না কেউ, তিনিও তেমনই একজন।

জেনেটিক বিজ্ঞানী হিসেবে একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল নাম। বিখ্যাত জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। পরে কিছু দিন ছাত্র পড়ান ওখানেই, ছিলেন নোবেল ক্যাণ্ডিডেট। পরে ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে যোগ দেন নামকরা এক জেনেটিক  প্রতিষ্ঠানে। অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে, তাই সেখানেও ভাল লাগেনি। এরপর কাজ করেছেন বহু দেশের নানান প্রতিষ্ঠানের হয়ে।

আর এ কারণেই বিপজ্জনক লোক বলে চিহ্নিত করেছে তাঁকে ইন্টারপোল, প্রথম সুযোগে বন্দি করা হবে। খারাপ কিছু করেছেন তা নয়, কিন্তু যখন-তখন মারাত্মক কিছু করবেন, সেজন্যে হাই-প্রায়োরিটি লিস্টে তোলা হয়েছে তাঁর নাম।

পৃথিবীর সেরা সব ল্যাবোরেটরিতে কাজ করেছেন। বাদ পড়েনি ইউএস সরকারি গবেষণাগার। জাদু দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মত করে ভাঙতে পারেনি কেউ জেনেটিক কোড। খুব ভাল করেই জানেন, কীভাবে তৈরি হতে পারে বায়োলজিকাল ওয়েপন।

কয়েক বছর আগে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছিল একটা খবর: জেনেটিক বিজ্ঞানী আহসান মোবারকের অনেক টাকা দরকার। কেন চাই, সে রহস্য ভেদ করা যায়নি। তবে ভয় পেতে শুরু করেছিল সিআইএ ও অন্যান্য পশ্চিমা সিকিউরিটি সার্ভিস।

এখনও কোনও অন্যায় করিনি, মনে মনে বললেন মোবারক।

এটা অর্ধ সত্য। বাকিটা মিথ্যা।

যখন-তখন ভাল বা খারাপ যে-কোনও কিছু করবেন তিনি হাঁটতে হাঁটতে মাথা নাড়লেন মোবারক। সামনের মিটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভেবে ঠিক করেছেন, আবু রশিদের সঙ্গে আলাপ করবেন ফ্রান্সের পাবলিক স্পেসে। আশা করছেন, আগে যাদের হয়ে কাজ করতেন, তারা এখানে এসে ধরতে পারবে না তাঁকে। খুব চাপ তৈরি করেছিল তারা। পালিয়ে না এসে উপায় ছিল না। আরেকটু হলে কেড়ে নিত তাঁর গবেষণালব্ধ সবকিছু। সেক্ষেত্রে সর্বনাশ হতো পৃথিবীর।

ভয় লাগতেই একবার শিউরে উঠলেন তিনি। কপাল ভাল, ঠিক সময়ে সরে যেতে পেরেছিলেন ওদের কাছ থেকে। এবার বাকি কাজ শেষ করবেন আড়ালে বসে। যদি দেখেন গবেষণার কারণে তৈরি হয়েছে ভয়ঙ্কর কোনও প্রতিক্রিয়া, দেরি না করে নষ্ট করে দেবেন তাঁর রিসার্চের সব ফলাফল।

কিন্তু আপাতত ওই রিসার্চ না করে উপায়ও নেই তাঁর।

‘এক্সকিউয মি,’ একদল জাপানিজ টুরিস্টের মাঝ দিয়ে গেলেন মোবারক। ‘মার্সি, মার্সি!’ আরও কয়েক পা গিয়ে উঠে পড়লেন ভিড় ভরা এলিভেটরে। ঊরুর পাশে শক্ত হাতে ধরেছেন কমপিউটার ব্যাগ। দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এলিভেটরে উঠল আরও কয়েকজন যাত্রী।

ভিড়ের প্লাযায় চোখ গেল মোবারকের। এইমাত্র ঘুরে ওকে দেখল এক যণ্ডার্ম। একবার কার উদ্দেশে সামান্য মাথা দোলাল লোকটা, চোখে কীসের যেন দ্বিধা।

ধক করে উঠল মোবারকের হৃৎপিণ্ড। এলিভেটরের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে যণ্ডার্ম। তাড়া নেই তার। আসলে এদিকে যে আসবে, তা-ও ঠিকভাবে বোঝা গেল না।

এইমাত্র বুজে গেল এলিভেটরের দরজা। মৃদু আওয়াজ তুলে উঠতে লাগল লোহার মস্ত বাক্স।

বড় করে দম নিলেন মোবারক। মনে মনে আশা করলেন, বিপদ হবে না। একবার অবযার্ভেশন ডেক-এ উঠে ভাববেন পরের কথা। বড় ভারী লাগছে কমপিউটার কেস, ভেতরে রেখেছেন তাঁর অর্জন করা প্রায় সব টাকা। তবুও হয়তো হবে না তাতে, গবেষণা শেষ করতে চাইলে লাগবে কমপক্ষে আরও বিশ হাজার ইউরো।

তাঁর দেয়া টাকা পেয়েও যদি সন্তুষ্ট না হয় ইরানিয়ান লোকটা, সেক্ষেত্রে অন্য ব্যবস্থা নেবেন। সেজন্যে  মানসিকভাবেও তৈরি। কোটের পকেটে আছে সিরামিকের সেল ফোনের মত দেখতে পিস্তল। পুরে নিতে পারবেন হাতের মুঠোয়। ম্যাগাযিনে চারটে বুলেট।

কাউকে কখনও গুলি করেননি মোবারক, কিন্তু দরকার পড়লে আজ তা-ই করবেন। খালি হাতে ফিরবেন না প্রাণ থাকতে।

এলিভেটর থেমে যেতেই ষাঁড়ের মত গুঁতোগুঁতি করে বদ্ধ জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল সবাই। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছেন মোবারক, ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। ডেক- এর দক্ষিণ-পশ্চিমে একজনের ওপর চোখ পড়ল তাঁর।

লোকটার এক চোখে কালো পট্টি। পায়ের সামনে নামিয়ে রেখেছে কাপড়ের একটা ব্যাগ। মনে হলো ভেতরে ভারী কিছু। প্রফেসর আবু রশিদের সামনে থেমে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বললেন মোবারক, ‘ভাল আছেন?’

মাথা দোলালেন ভদ্রলোক। কঠোর পরিশ্রমে রোদে পোড়া মুখ। গাল চিরে কানা চোখ পর্যন্ত গেছে গভীর ক্ষতচিহ্ন। নিচু স্বরে বললেন আবু রশিদ, ‘ফ্রেঞ্চ ভাষায় আমি ঠিক অভ্যস্ত নই।’

‘কিন্তু বাস করেন এই দেশে,’ বললেন মোবারক।

‘আপনার কাছ থেকে টাকা বুঝে পেলে এ দেশে আর থাকব না,’ বললেন ইরানিয়ান। ‘মানুষের চামড়া সাদা না কালো, তা নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করছে এরা।’

ইরানে দ্বিতীয়বার যাওয়ার পর আবু রশিদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ডক্টর মোবারকের। ভদ্রলোক ছিলেন আর্কিওলজিস্ট এবং একটি ব্যক্তিগত জাদুঘরের কিউরেটর। সবুজ বিপ্লবের পক্ষে কাজ করেছেন বলে তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে খুন করেছিল সরকারি দলের লোক। রশিদ নিজে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসেন ফ্রান্সে। কেউ ভাবতেও পারেনি, তাঁর কাছে রয়ে গেছে অতি প্রাচীন ও দুর্লভ এক সম্পদ। এখন ভাবছেন, ওই ট্যাবলেট বিক্রি হলে যে টাকা পাবেন, তা নিয়ে যোগ দেবেন প্রতিরোধ যুদ্ধে।

‘এবার খোদা চাইলে ঠিকই ফিরব দেশে,’ বললেন পদচ্যুত প্রফেসর ও কিউরেটর।

বিষণ্ণ হাসলেন মোবারক। আগেও আবু রশিদের সঙ্গে তাঁর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করেছেন। তাঁর সবসময় মনে হয়েছে, সফল হবে না সবুজ বিপ্লব। মাথা নাড়লেন তিনি। ‘বন্ধু, আসল কথা, স্রষ্টা বলে কেউ নেই। আমাদেরকে দেখভাল করছে না কেউ। নইলে মানুষে মানুষে এত হানাহানি থাকত না।’

জবাবে তিক্ত হাসলেন আবু রশিদ। তাঁর হাসি মোবারকের হাসির মতই ম্লান। নিচু স্বরে বললেন, ‘পশ্চিমারা আপনার মাথা খেয়ে নিয়েছে, ভাই!’

‘অনেক বিষ ঢেলেছে মনে, কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে ওই ধারণা আমার নিজের।’ চুপ হয়ে গেলেন মোবারক। মনে পড়েছে, কিছু দিন আগে পশ্চিমা একটা দলের লোক কীভাবে অত্যাচার করেছে তাঁর ওপর।

‘আপনি যা বললেন, তার ভেতর সন্দেহের সুর, ভাই,’ বললেন আবু রশিদ। ‘যাক সেসব, বলবেন, কেন আপনার দরকার ওই ট্যাবলেট? কী করবেন ওটার ভেতরের সত্য জেনে?’

জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন মোবারক, ‘আপনার জিনিসটা হাতে পাওয়ার জন্যে আরও অপেক্ষা করতে হবে?’

‘আমি নিজে পুরো পঁয়ত্রিশ বছর ওগুলো হাতে পেতে চেয়েছি,’ বললেন রশিদ। ‘জানি না আপনার কতটা দরকার, কিন্তু আমার ভুল না হয়ে থাকলে ওই ট্যাবলেট বা তাম্রলিপি তৈরি করেছিল সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষিত মানব। আপনি কি বুঝতে পারছেন এর মানে? এই খবর ছড়িয়ে পড়লে হামলে পড়বে কোটি কোটি ডলারের মালিক সব বড়লোক।’

কথা শুনে বুক শুকিয়ে গেল মোবারকের। ঠিকই বলেছেন আবু রশিদ। কিন্তু সেজন্যে ব্যস্ত হওয়া উচিত হবে না। আগেও পেয়েছেন নকল জিনিস। জানতে চাইলেন, ‘আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে যে এসব আসল?’

‘বোঝার উপায় নেই,’ বললেন রশিদ, ‘কিন্তু যেসব ট্যাবলেট পড়ে ওই কবরের খোঁজ পেয়েছি, ওখানে লেখা ছিল এক বাগানের কথা। ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ে মানুষটা। আরও লিখেছে…’

‘এখানে খোলা জায়গায় কিছু বলবেন না,’ সতর্ক করলেন মোবারক।

বিরক্ত হলেন রশিদ। ‘কিন্তু আপনার জানা থাকা দরকার। যা ভাবছেন, তা ঠিক নয়। মাটির ট্যাবলেটে লেখা আছে পানি, তলোয়ার, আগুন আর মৃত্যুর কথা।’

‘এ ছাড়া নিশ্চয়ই থাকবে জীবনের কথা,’ জোর দিয়ে বললেন মোবারক। তিনি জানেন না, যা চাইছেন তা পাবেন কি না।

‘হ্যাঁ, জীবনের কথা’ সায় দিলেন রশিদ।

‘আর মুড়িয়ে রাখা তামার জিনিসটা?’

‘আগেই বলেছি, ওটা তোলা হবে বৈরুতের এক নিলামে, ‘ হতাশ সুরে বললেন রশিদ।

একই সঙ্গে ভয় ও হতাশা বোধ করলেন ডক্টর মোবারক। ভেবেছিলেন মুড়িয়ে রাখা তাম্রলিপি হাতে পাবেন আবু রশিদ। কিন্তু তা হয়নি। ওটা নিয়ে ভেবে এখন লাভ হবে না। মাটির ট্যাবলেট পেলেও চলবে তাঁর।

‘কখনও ভেবেছেন, অন্তর থেকে একটা জিনিস চাইছেন, কিন্তু সবসময় ওটা রয়ে গেছে আপনার নাগালের বাইরে?’ বললেন রশিদ।

‘হুঁ, কখনও কখনও তা-ই হয়,’ স্বীকার করলেন মোবারক।

‘ওই তাম্রলিপি আমার জীবনে ঠিক তেমনই এক জিনিস। যতবার ওটার খুব কাছে গেছি, হারিয়ে গেছে বহু দূরে।’ মাথা দোলালেন আবু রশিদ। ‘আপনি যে টাকা দেবেন, হয়তো তার একটা অংশ ব্যয় করেই একদিন কিনে নেব ওই তাম্রলিপি। একবার ওটা পেলে আবার যোগাযোগ করব আপনার সঙ্গে। দু’জন মিলে জেনে নেব কী আছে ওটার ভেতর।’

তার মানে টাকা পেলে বৈরুতে যাবেন আবু রশিদ। নিলামে অংশ নেবেন। সেক্ষেত্রে তাম্রলিপি পেলে হয়তো একমত হবেন রশিদ ও তিনি। জানবেন, সত্যিই পৃথিবীর বুকে অদ্ভুত এক বাগান ছিল কি না। অবশ্য, আগে দরকার মাটির ট্যাবলেট।

‘জিনিসটা দেখতে দিন,’ বললেন মোবারক।

মেঝে থেকে ব্যাগ তুলে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন আবু রশিদ।

থলির মত কাপড়ের ব্যাগের চেন খুলে ভেতরে চোখ রাখলেন মোবারক, আটকে ফেলেছেন শ্বাস। বুঝে গেলেন, সত্যিই হয়তো মাটির ট্যাবলেট জানাবে জীবন-মরণের জটিল রহস্য।

জিনিসটা বাদামি পাথরের মত, সেখানে খোদাই করা কী যেন। আরেকবার শ্বাস নিলেন মোবারক। এটা পাওয়ার জন্যে প্রায় পাগল হতে বাকি ছিল তাঁর।

রশিদের চোখ অনুসরণ করে টাওয়ারের একপাশে চোখ গেল তাঁর। ইরানিয়ানের মুখে ফুটে উঠেছে সত্যিকারের আতঙ্ক।

‘আপনি সতর্ক ছিলেন না,’ প্রায় ফিসফিস করলেন রশিদ। ঘুরে দেখতে যাচ্ছিলেন মোবারক, কিন্তু নিচু স্বরে বললেন প্রফেসর, ‘ভুলেও ঘুরবেন না।’

সোজা হয়ে মেঝেতে কমপিউটার কেস রাখলেন মোবারক। আড়চোখে দেখেছেন, ছড়িয়ে পড়ে ভিড়ের মাঝ দিয়ে আসছে  চারজন যণ্ডার্ম। রিফ্লেকটিভ ভেস্টের জন্যে পরিষ্কার বোঝা গেল তারা কারা। কোমরের হোলস্টারের পাশে হাত। যেন বুঝে গেছে ঝামেলা হবে।

‘পুলিশ!’ ফিসফিস করলেন রশিদ।

চারজনের একজনকে চিনে ফেললেন মোবারক। বুকে বিঁধল ভয়ের তীক্ষ্ণ তীর। চাপা স্বরে বললেন, ‘পুলিশ না ওরা! আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে!’

‘কিন্তু এত লোকের ভেতর…’

‘কেউ কিছু করতে পারবে না,’ বললেন মোবারক।

পা দিয়ে রশিদের দিকে ঠেললেন কমপিউটার ব্যাগ। শক্ত করে ধরলেন মাটির ট্যাবলেটের ব্যাগ। ভাবছেন, একবার ভিড়ের ভেতর দিয়ে এলিভেটর পর্যন্ত যেতে পারলেই…

এক পা যেতেই কাঁধে ভারী হাত রাখল কে যেন। হ্যাঁচকা টানে ঘুরিয়ে নেয়া হলো তাঁকে। খুব সতর্ক বলে চট্ করে ব্যাগ মেঝেতে রাখলেন তিনি, এক হাত মাথার ওপর তুলেছেন আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে। অন্য হাত ঢুকল কোটের পকেটে। পেয়ে গেলেন ছোট্ট অস্ত্র, বের করার সময় নেই, তাক করেই টিপে দিলেন ট্রিগার।

গুলির জোরালো ‘বুম!’ শব্দে কাঁপল অবযার্ভেশন ডেক। এক লাফে সরে গেল আশপাশের দর্শক। পেট খামচে ধরে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল পুলিশের ভেস্ট পরা লোকটা। হাতের ফাঁক গলে ঝর্নার মত পড়ছে লাল রক্ত।

ওই দৃশ্য দেখে চিৎকার জুড়ল নারী দর্শকরা। ঘুরে দৌড় দিল সবাই এলিভেটর ও সিঁড়ি লক্ষ্য করে।

গুলির কমলা আগুনে একটু পুড়ে গেছে মোবারকের হাত ও কোমর। বোকার মত চেহারা করে দেখলেন আহত লোকটাকে। যেন বুঝছেন না কী করেছেন। তাঁর চারপাশে নানান দিকে ছুটছে ভীত দর্শক। নিজেও তাদের সঙ্গে মিশে যেতে চাইলেন তিনি। কিন্তু কয়েক দিক থেকে এল গুলি

বাধ্য হয়ে ডাইভ দিয়ে একপাশে পড়লেন মোবারক। পকেট থেকে বের করেছেন পিস্তল। আইফেল টাওয়ারের লোহার কারুকাজের আশ্রয় পেয়ে পাল্টা গুলি পাঠালেন শত্রুদের লক্ষ্য করে। আপাতত তিনি নিরাপদ। কিন্তু হালকা হয়ে উঠছে ছুটন্ত ভিড়। একটু পর পরিষ্কার তাঁকে দেখবে শত্রুপক্ষ।

পাশ থেকে বললেন আবু রশিদ, ‘লড়াই করে জিতবেন না! যা চায় দিয়ে দিন! তাম্রলিপি ছাড়া ওই মাটির ট্যাবলেটের কোনও মূল্য নেই!’

‘ভুল,’ বললেন মোবারক, ‘ট্যাবলেটই আসল জিনিস!’

অন্য মত পোষণ করেন বলেই খপ করে কাপড়ের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে ঘুরে এলিভেটর লক্ষ্য করে ছুটতে চাইলেন রশিদ। কিন্তু পা বাড়িয়ে দিয়েছেন মোবারক, ল্যাং খেয়ে মেঝেতে আছাড় খেলেন রশিদ। হাত থেকে ডেকে পড়ে ভাঙল ট্যাবলেটের একটা কোনা।

আমেরিকান সুরে প্ল্যাটফর্মের একপাশ থেকে চিৎকার করল একজন, ‘আহসান মোবারক! আপনি সরে গেছেন বিশ্বাস থেকে! তাই প্রভু বলেছেন আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে!’

ওই গলা চিনলেন মোবারক।

থিয়োডর এন. মাউক!

ভয়ঙ্কর খুনি!

হাসতে হাসতে মানুষের রক্তে স্নান করে!

মাটির ট্যাবলেট তুলে নিয়েই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন মোবারক, খুঁজছেন আরও ভাল কোনও আশ্রয়। যথেষ্ট দ্রুত সরতে পারেননি। উরুতে বিঁধল বুলেট। মেঝে থেকে পা সরে যেতেই পিছলে পড়লেন মোবারক। ব্যথায় মনে হলো পাগল হয়ে যাবেন। কয়েক গড়ান দেয়ার পর শুরু করলেন ক্রল। তখনই দ্বিতীয় বুলেট গাঁথল তাঁর কাঁধে।

কোনও দিকে না চেয়ে সামনে বাড়লেন মোবারক। লোহার কারুকাজ করা একটু ভাল আড়াল পেয়ে থামলেন ওখানে। শক্ত হাতে ধরেছেন ট্যাবলেট। আইফেল টাওয়ারের ইস্পাতের সব পাতের মাঝ দিয়ে বাইরে গেল চোখ। আবার দেখলেন চারপাশ।

তিনদিক থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে শত্রুরা। কোনওভাবেই এলিভেটর বা সিঁড়ির দিকে যেতে পারবেন না।

না, পালাবার উপায় নেই!

ছোট্ট পিস্তলে বড়জোর আছে আর দুটো বুলেট।

লড়াই করেও কোনও লাভ নেই।

অসহায় চোখে আবারও চারপাশ দেখলেন মোবারক।

পাশ থেকে বললেন রশিদ, ‘দিয়ে দিন! নইলে বাঁচতে দেবে না!’

‘আপনাকে বা আমাকে ছাড়বে না ওরা,’ জবাবে বললেন মোবারক। বহু নিচের রাস্তায় পুলিশের গাড়ির সাইরেন। বুঝে গেলেন, দেরি করবে না খুনির দল, এবার প্রথম সুযোগে খুন করবে ওদের দু’জনকে।

প্ল্যাটফর্মের কোনা দেখলেন মোবারক। ওখান থেকেই শুরু খোলা আকাশ। ভাল করেই জানেন, এখন আর কোনওভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না। যাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, তার জন্যে কিছুই করতে পারলেন না। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একদল লোক কেড়ে নেবে ট্যাবলেট। মানব-সভ্যতাকে শেষ করে দিতে ব্যবহার করবে ওটার ভেতরের তথ্য।

তা হতে দিতে পারেন না তিনি।

মসৃণ, খোদাই করা মাটির ট্যাবলেটে হাত বোলালেন মোবারক, একবার দেখলেন ওটার মাঝের সিম্বল। ওটা বৃত্তাকার, তার চারপাশে চারটে পেরেকের মত দাগ। ওই চার চিহ্নের মাঝে একটা বর্গক্ষেত্র, তার ভেতর ছোট একটা আয়তক্ষেত্র।

আবু রশিদ বলেছিলেন, ওটাই প্রাচীন আমলের বিশেষ এক উদ্যানের চিহ্ন। ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু রশিদ বা তাঁর কোনও কাজে এল না ওটা। যেহেতু স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, এখানেই শেষ হচ্ছে তাঁর কষ্টকর জীবন। সত্যিই যদি দেখভাল করার কেউ থাকেন, তাতেই বা কী, সারাজীবন ধরে যা করেছেন, সেজন্যে প্রচণ্ড নির্যাতনের কোনও নরকে পাঠানো হবে তাঁকে।

ইঞ্চি ইঞ্চি করে প্ল্যাটফর্মের কিনারার দিকে চললেন মোবারক।

একটু দূর থেকে এল খুনি মার্ডকের নির্দেশ: ‘হাল ছেড়ে দিন, মোবারক!’

‘যাতে আমাকে ব্যবহার করে ধ্বংস করতে পারো পৃথিবীটা?’

‘নইলে আপনার সঙ্গেই শেষ হবে আপনার সৃষ্টি, ধমকের সুরে বলল মার্ডক। ‘আপনি কি তা-ই চান?

পিছলে আরও কয়েক ইঞ্চি এগোলেন মোবারক। ‘নিজের চোখে এই পৃথিবীকে নরক হতে দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।’

‘খুব জরুরি না হলে খারাপ কোনও কাজ করি না আমরা,’ বলল মার্ডক। ‘আপনি নিজেও আগে বলেছেন, আসলে কী করা উচিত।’

মুখ থেকে যেসব কথা বেরিয়ে গেছে, সেজন্যে এখন লজ্জিত হলেন মোবারক। উচিত ছিল না চরম কোনও মন্তব্য করা। তাঁর  পেশা আসলে এমনই! জেনেটিসিস্টরা সবসময়েই জন্ম-রহস্য নিয়ে কাজ করছে স্রষ্টার মতই। কিন্তু এখন…

দুঃখে ভারী হয়ে গেল তাঁর বুক। কী করে বসেছেন তিনি!

গত কয়েক দশকের আপ্রাণ চেষ্টার দৃশ্য ভেসে এল চোখে। এক পলকে বুঝলেন কোটা আসলে সত্য। হ্যাঁ, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে শেষ করে দিতে হবে এত কষ্টের সব গবেষণা।

তিলতিল করে প্ল্যাটফর্মের আরও কাছে গেলেন মোবারক। ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি দুঃখিত, মিনতি! চেষ্টা করেছিলাম রে! পারলাম না!’

ঘাড় ফিরিয়ে শেষ দুটো গুলি অন্ধের মত ছুঁড়লেন, পরক্ষণে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই লাফিয়ে উঠে দৌড়াতে চাইলেন। ঝাঁপ দেবেন উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে শূন্যে।

কিন্তু এক পা যেতে না যেতেই পেছন থেকে এল গুলির গর্জন। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন মোবারক, ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেল পিঠ। ঠক করে বাড়ি খেল দুই হাঁটু। এক হাতে ধরে ফেললেন প্ল্যাটফর্মের রেলিং। অন্য হাত থেকে মেঝেতে পড়ল ট্যাবলেট। ওটার বুকের জীবন-চিহ্ন চেয়ে আছে তাঁর দিকে।

গায়ে কোনও শক্তি পেলেন না, ধপ করে বসে পড়লেন মোবারক। হাত বাড়িয়ে দিলেন ট্যাবলেটের দিকে। স্পর্শ করলেন মাটির মসৃণ জিনিসটা। তুলে নিয়েই ছুঁড়ে দিলেন প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরের শূন্যে।

বার কয়েক পাক খেল ট্যাবলেট, যেন চিরকালের জন্যে ঝুলছে বাতাসে।

কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝলেন মোবারক, ছোট হয়ে আসছে মাটির ট্যাবলেট। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর পড়ল অনেক নিচের কংক্রিটের রাস্তায়। হাজার টুকরো হলো ওটা।

মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়লেন মোবারক। কালো কী যেন ঝেঁপে আসছে দু’চোখে। ভাবলেন, এবার মগজে ঢুকবে বুলেট। কিন্তু কর্কশ হাতে হ্যাঁচকা টানে তুলে নেয়া হলো তাঁকে।

‘আমাদের সঙ্গে নেব, ‘ শুনলেন মার্ডকের কণ্ঠ।

‘দু’জনকেই।’

‘ট্যাবলেটের কী হবে?’ দ্বিতীয়জনের কণ্ঠে ভয়।

পরিষ্কার বুঝলেন মোবারক, ভয়ঙ্কর খেপে যাবে ওদের প্রভু!

অপেক্ষাকৃত কম ভয় পেয়েছে থিয়োডর মার্ডক। ‘আগে দরকার ওই তাম্রলিপি। পরে ওটা দেখে খুঁজে বের করব ওই জিনিস।’

সচেতন করতে গিয়ে মাথার চুল ধরে বার কয়েক মোবারককে ঝাঁকি দিল মার্ডক। ‘খুন করার আগে তোর মুখ থেকে বের করব সব! বিশ্বাস কর্, বারবার প্রার্থনা করবি, যাতে মরে যেতে পারিস!’

ঘন এক ধূসর কুয়াশার ভেতর শুনলেন সব মোবারক। আবছা দেখলেন, মার্ডকের নিষ্ঠুর হলদে চোখ। জন্মের ঘৃণা করে লোকটা তাঁকে। ঠিক কথাই বলেছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিয়ে খুন করবে সে।

মরতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে খুব আফসোস হলো মোবারকের।

কে বলেছে পৃথিবীতে নরক নেই?

সত্যিকারের নরক দেখাবে তাঁকে থিয়োডর এন. মার্ডক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *