মৃত্যুঘণ্টা – ৮

আট

মাঝ আকাশে সোনার থালার মত ঝকঝক করছে সূর্য। দুপুরের একটু আগে প্যারিসের চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে নামল রানা ও এলেনার সাইটেশন এক্স বিযনেস জেট বিমান। আধঘণ্টা পর এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এক পিউযো গাড়ি ভাড়া নিয়ে ব্যস্ত মোটরওয়ে ধরে প্যারিসের মূল অংশ লক্ষ্য করে চলল ওরা।

এরই ভেতর স্যাটালাইট ফোনে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে কথা বলেছে এলেনা।

ভদ্রলোক জানিয়ে দিয়েছেন, ডক্টর মোবারকের বিষয়ে নতুন কিছুই জানতে পারেনি কেউ। একই কথা খাটে ইউএন অফিসে ভাইরাস হামলার ব্যাপারেও। কোথাও কোনও সূত্র নেই। চারপাশে কান পেতেও প্যারিসের পরিচিত টেরোরিস্ট সব দলের ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি।

ব্রায়ান আরও বলেছেন, বোধহয় একেবারেই নতুন কোনও দলের কাজ। খুবই সতর্ক ওটার নেতা, গোপন করছে সব। অথবা এতই ভয়ঙ্কর কাজে লিপ্ত, অন্য সব টেরোরিস্ট দলের মত গলা ফাটাবার উপায় নেই তাদের। আসলে তারা কারা বুঝলেই পাল্টা হামলা হবে নানান দেশের সিক্রেট সার্ভিস থেকে।

এদিকে চার পুলিশ হত্যায় ভীষণ খেপে গিয়ে চারপাশে তল্লাসী করছে ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শত শত সন্দেহজনক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও জোগাড় করা যায়নি নতুন কোনও তথ্য। কেউ যেন কিছুই জানে না।

তবে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছে সিআইএ। ইরানের আবু রশিদ গ্রিন রেভ্যুলেশনের সদস্য। তার ওপর চোখ রাখছিল সিআইএ। সুযোগ পেলে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করত। কাজটা যদিও খুবই বিপজ্জনক। সিআইএ ইনভল্ভড্ একথা জানা গেলে, ভোট পাওয়ার বদলে ভোট বেশি হারাবে বিপক্ষ দল, বা খুন হবে তাদের প্রার্থী। এসব ভেবেই আড়াল থেকে আবু রশিদের ওপর চোখ রেখেছিল সিআইএ। যে দিন তুলে নেয়া হলো আবু রশিদ আর বিজ্ঞানী আহসান মোবারককে, তার আগের রাতে রশিদের কাছে ফোন এসেছিল মধ্য প্যারিস থেকে। কমপিউটারের মাধ্যমে গলা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ফোনটা করেছিলেন মোবারক।

—সেইন-এর তীরে এক বাড়ি থেকে ফোন করা হয়,’ ফোনের জিপিএস ম্যাপে চোখ রেখেছে এলেনা। ‘ওই বাড়ি সার্চ করলে হয়তো নতুন কিছু জানব।’

হাইওয়ের তীক্ষ্ণ এক মোড় পেরিয়ে গেল রানা।

গুগল ম্যাপ দেখছে এলেনা। ‘ওদিকে কিছু বারোক বাড়ি। এ ছাড়া, নামকরা এক খাবারের দোকান। সূত্র বলতে এ-ই।’

রানা ধারণা করেছিল, পরিত্যক্ত ইণ্ডাস্ট্রিয়াল বা কমার্শিয়াল এলাকায় ছোট কোনও আস্তানা খুঁজে নিয়েছেন মোবারক। বাস্তবে তা নয়, প্যারিসের বুকে অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেন। টাকার অভাব ছিল না।

‘জান হাতে নিয়ে লুকিয়ে পড়া পাগল বিজ্ঞানীর স্টাইল এটা,’ বলল এলেনা। ‘শান্ত নদীর তীরে বিলাসবহুল বাড়ি, আর কী চাই?’ মৃদু হাসল। ‘ডক্টর মোবারক সম্পর্কে পড়ছিলাম। তোমার কী ধারণা, আসলে কতটা ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন তিনি?’

‘দুর্দান্ত ছিল তাঁর মগজ,’ বলল রানা। ‘দেশের জন্যে বহু কিছুই করেছেন। বিদেশে নিজে রয়ে গেলেও বড় কোনও জেনেটিক আবিষ্কার করলে প্রথমেই তার সব তথ্য পৌঁছে দিতেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে। এমন সব কাজ করেছেন, যার কারণে ওসব ইঞ্জিনিয়ার্ড ফসল বা মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে গেছে, উপকৃত হয়েছে গোটা দেশ।’

‘খুবই ব্রিলিয়ান্ট, কিন্তু বেমক্কা মরে গেলেন।’

আসলে ছিলেন একাকী, অদ্ভুত এক মানুষ, ভাবল রানা। বিপদে পড়ে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ে কিছুই করার ছিল না ওর। পরে মনে হয়েছে, মস্ত বিপদে পড়তে পারে ডক্টরের মেয়ে মোনা। তাই তাকে নিরাপদ রাখার জন্যে দায়িত্ব বোধ করছে ও। প্রতিভাবান বাঙালি ছিলেন মোবারক, যার খুশি খুন করে ফেলবে তাঁকে, সেটা মেনে নেয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে। বিসিআই চিফের সঙ্গে মোবারক প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলাপও করেছে। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান বলেন, ‘তোমার উচিত চারপাশে খোঁজ নেয়া। হয়তো কোনও আদালতে বিচার হবে না, কিন্তু শাস্তি হওয়া উচিত খুনির। ওই লোক বা তার দল এরপর আরও কত মানুষকে খুন করবে বা কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে, কেউ বলতে পারে না। আগেই উচিত এদেরকে ঠেকিয়ে দেয়া।’ আলাপের শেষ পর্যায়ে আরও বলেন, ‘বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত নতুন কিছু পাওয়া গেলে সেটা হয়তো কাজে আসবে বাংলাদেশের।’

এলেনার নরম স্বরের কথা শুনল রানা।

‘ডক্টর মোবারক প্রথম জেনেটিক বিজ্ঞানী, যিনি আবিষ্কার করেন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার হামলার সময় যেভাবে আক্রান্ত হয় হোস্টের মিলেনিয়া, তার চেয়ে অনেক দুর্বলভাবে ল্যাবে জেনেটিক স্লাইসিং করে মানুষ।’

‘বিস্তারিত পড়িনি,’ স্বীকার করল রানা।

‘তার মানে, আমাদের ডিএনএর অর্ধেক জেনোম এসেছে হাজার কোটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকে। ইনফেকশন আসলে প্রাচীন আমল থেকে জমেছে আমাদের দেহে। সোজা কথায়, আমরা যে মানব ডিএনএ নিয়ে গর্বিত, তার অর্ধেকের বেশি এসেছে সূক্ষ্ম ওসব প্রাণী থেকে।’

‘তা হলে আমরা ভাইরাসেরই অংশ,’ মৃদু হাসল রানা। ‘এক অর্থে তা-ই।’

‘ভাইরাল হওয়ার নতুন অর্থ পেলাম,’ বলল রানা।

হাসল এলেনা। ‘বোধহয় জানো, ডক্টর মোবারক হিউম্যান ডিএনএর স্ট্র্যাণ্ডের তিনটে জিন সিকিউয়েন্স টেকনিক আবিষ্কার করেন। তাই একলাফে অনেকটা এগিয়ে যায় আর সব জেনেটিক বিজ্ঞানীরা। ‘

এসব ভাল করেই জানে রানা।

‘অবাক লাগছে অন্য কারণে,’ বলল এলেনা। ‘দারুণ সম্মান ও অকল্পনীয় পরিমাণের টাকা ছেড়ে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে আসেন তিনি। এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারবে না কেউ।’

মিস্টার মোবারক খুনের রহস্য উন্মোচিত হলে এসবের ব্যাখ্যা পাব, ভাবল রানা। মনে পড়ল, তাঁর পাঠিয়ে দেয়া ফ্ল্যাশ ড্রাইভের তথ্য: ‘আশা করি আপনি পড়ছেন এই লেখা। আপনার কি মনে পড়ে আমার অন্তরের সেই প্রশ্ন? সত্যিই কি আছে স্রষ্টা? এবার ওই জবাবের খুব কাছে পৌঁছে গেছি। আর সেজন্যে যখন-তখন খুন হব। ওই মৃত্যু স্রষ্টা দেবে না, মানুষই দেবে। আশা করতে গিয়ে করে বসেছি মস্ত এক অন্যায়। কিন্তু ওরা বুঝে গেছে সব। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। একবার ধরতে পারলে মেরে ফেলবে আমাকে। এরই ভেতর পেয়ে গেছে প্লেগ ছড়িয়ে দেয়ার উপযুক্ত বাহন। এবার চাই সত্যিকারের ভাইরাসটা। ওরা আমাকে মেরে ফেলার আগেই যেভাবে হোক সাহায্য করুন, রানা। ওরা আসার আগেই সরিয়ে নিন আমাকে। জীবন-মৃত্যু রহস্য ভেদ করার খুব কাছে আছি। কিন্তু পুরো সফল হওয়ার আগেই ওরা খুন করতে চাইবে।

যদি পারেন, চলে আসুন প্যারিসে। আপনি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না। এমন কাউকে চাই, যে ওদের হাত থেকে রক্ষা, করবে আমাকে। ওরা আছে চারপাশে, আবার আড়াল করে রেখেছে নিজেদেরকে। বুলডগের মত ধাওয়া করছে। এখানে রয়ে গেলেও মরব, আবার পালাতে গেলেও বাঁচব না। ওদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারছি না। ধরে ফেলবে। কোনওভাবেই আপনি আমার কাছে কৃতজ্ঞ নন, বরং আমিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। তবুও অনুরোধ করছি আপনার কাছে, বলুন, আর কার কাছেই বা সাহায্য চাইব? আপনি ছাড়া কেউ নেই যে সাহায্য করবে আমাকে…

লিখিত বক্তব্য থেকে কিছুই স্পষ্ট নয়। চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ই-মেইল ঠিকানা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই খুন হয়ে গেছেন বিজ্ঞানী।

মানুষটা মরার সময় ভেবেছেন, কেউ নেই যে সাহায্য করবে— এটা বারবার বিব্রত করছে রানাকে। বড় একা ছিলেন ডক্টর মোবারক। আশা করেছিলেন পাশে গিয়ে দাঁড়াবে ও। কিন্তু অপেক্ষা করে বুঝে গিয়েছিলেন, চারপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে শত্রু, অথচ কিছুই করেনি রানা।

মেসেজে এমন কোনও তথ্য নেই যা থেকে বুঝবে, কাদের ‘কাছ থেকে পালাতে চেয়েছেন মোবারক। কী ধরনের গবেষণা করছিলেন, তা-ও লেখেননি।

অবশ্য, এটা স্বাভাবিক। রানা পৌঁছুতে পারলে মুখ খুলতেন। যেহেতু সাহায্য পাননি, গোপন রেখেছেন সব তথ্য।

‘সামনে ডান দিকের রাস্তা,’ ম্যাপ দেখে বলল এলেনা। 

নির্দেশ মত রানা ঢুকল আঁকাবাঁকা এক সড়কে। ওটা দেখে ওর মনে হলো, এমনই প্যাচালো ছিল বিজ্ঞানীর জীবন। প্রতিটা পদে বেছে নেন ভুল পথ। চলে গেছেন আরও কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির ভেতর। দোষ থাকুক বা না থাকুক, শেষ পর্যন্ত খুন হয়েছেন। আর কাজটা যারা করেছে, সম্ভব হলে তাদেরকে খুঁজে বের করবে রানা। বিচারের মুখে দাঁড় করাবে। এসব করতে গিয়ে হয়তো পড়বে মস্ত বিপদে, খুন হতে পারে নিজেই। কিন্তু জীবন তো সবসময় এমনই। প্রতিটি মোড় পেরোলেই তো আসবে নতুন সব গন্তব্য।

গম্ভীর হয়ে এলেনাকে দেখল রানা। বড় ধরনের বিপদে জড়িয়ে পড়ছে। উচিত হচ্ছে মেয়েটাকে সঙ্গে জড়িয়ে নেয়া?

এনআরআই চিফের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী নির্দিষ্ট রাস্তায় ঢুকে পড়ল রানা। মাঝারি চওড়া পথ এঁকেবেঁকে গেছে বহু দূরে।

দু’পাশে বারোক স্থাপত্যের সব বাড়ি, একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা কঠিন।

মোবারকের বাড়ির সামনে পৌঁছে রাস্তার ওদিকে গাড়ি রাখল রানা। এবার হয়তো জানবে বাড়িতে কী রেখেছিলেন বিজ্ঞানী। কিন্তু কেমন খচ খচ করছে ওর মন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *