মৃত্যুঘণ্টা – ১১

এগারো

নিজ অফিসে মস্তবড় ডেস্কের পেছনে বসে আছেন ন্যাশনাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা এনআরআই-এর চিফ জেমস ব্রায়ান। দু’পাশে স্তূপ করেছে একগাদা ফাইল। তারই ভেতর কষ্টেসৃষ্টে জায়গা করে নিয়েছে অত্যাধুনিক অ্যাপেল ম্যাকিনটশ পিসি, ছোট এক প্রিন্টার ও স্ক্যানার। ভিডিয়ো কনফারেন্স করতে স্ট্যাণ্ডবাই মোডে আছে মনিটর। ভেন্যু: ভার্জিনিয়ার ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স।

ডেস্কের ওদিকে ওদিকে উপস্থিত এনআরআই-এর অন্যতম ব্রিলিয়ান্ট বিজ্ঞানী লাউ আন। জেনেটিসিস্ট হিসেবে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। ডক্টরেটও ওখান থেকেই। ল্যাবে ব্যস্ত না থাকলে প্রায় সবসময় ব্যয় করে কমপিউটার গেম্‌স্‌ খেলে। এ মুহূর্তে মনে মনে তারিফ করছে বসের। নতুন করে এনআরআই অফিস সাজিয়ে নিয়েছেন ব্রায়ান। এতই নিখুঁত নিরাপত্তার ব্যবস্থা, এখানে হামলা করার সাধ্য হবে না জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের।

‘ইউএন ভাইরাসের ব্যাপারে নতুন কিছু জানলে?’ বললেন ব্রায়ান।

গলা পরিষ্কার করে নোটবুকে চোখ নামাল লাউ আন।

গত তিন দিন আগে ভোরে যাঁরা ঢুকেছিলেন ইউএন অফিসে, তাঁদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। তারপর থেকে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছেন সেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কপাল ভাল, দুনিয়ার নানান দেশের অফিশিয়াল বা কর্মচারীরা তখনও অফিসেই পা রাখেননি। আগে থেকেই তাঁদেরকে ফোনে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল: আপাতত ইউএন ভবনে আসা চলবে না। যে যার মত ছুটি কাটাচ্ছেন তাঁরা

‘সরি, নতুন কোনও তথ্য নেই,’ বলল লাউ আন।

‘তার মানে ভাল খবর নেই?’ ভুরু কুঁচকে ফেললেন ব্রায়ান। ‘একেবারেই নেই তা বলব না,’ বলল চিনা–আমেরিকান যুবক, ‘ওই ভাইরাসের স্যাম্পল পরীক্ষা করেছে সিডিসি। তাদের ডেটাবেসে ওই ধরনের কিছুই নেই।’

‘তার মানে নতুন ভাইরাস?’

মাথা দোলাল লাউ আন।

‘আসলে কি এটা ভাল খবর?’ জিজ্ঞেস করলেন ব্রায়ান।

‘ওটার প্যাথোজেন তীব্র ধরনের,’ বলল আন।

চোখ সরু করে তার চোখে তাকিয়ে আছেন ব্রায়ান।

‘ভাইরাসের ক্ষেত্রে তিনটে জিনিস দেখি আমরা,’ বলল আন। ‘কতটা দ্রুত সেলকে ইনফেক্ট করছে প্যাথোজেন, বা কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, বা কোন্ পথে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওটাকে আমরা বলি ভেকটর্স। আর তৃতীয় বিষয়, ইনফেক্টেড সেলের কী ধরনের ক্ষতি করছে।’

‘বুঝলাম,’ বললেন ব্রায়ান। ‘তো এই লড়াইয়ে জিতে যাচ্ছি আমরা?’

‘তা বলা যায়। কিন্তু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। হামলা করে সারাদেহের সেল-এ। পরীক্ষায় দেখেছি, রওনা হয় সব পথেই।’

‘সহজ করে বলো।’

‘সাধারণত নির্দিষ্ট সেল-এ হামলা করে নির্দিষ্ট সব ভাইরাস, ‘ বলল আন, ‘রেসপিরেটরি ভাইরাস হামলা করবে ফুসফুসকে। হার্পির্য ভাইরাস হামলা করবে ত্বকের কোষগুলোকে। কিন্তু ইউএন ভাইরাস নানান দিকে আক্রমণ করে ওই অণু শুধু যে দেহের এক ধরনের কোষের ওপর হামলা করবে তা নয়, যে কারও দেহের প্রায় সব কোষকে আক্রান্ত করবে। এটা খুব কম দেখা যায়।’

‘ডেবি ম্যাকেঞ্জির ক্ষেত্রে এমন হয়েছে?’ জানতে চাইলেন এনআরআই চিফ।

মাথা দোলাল লাউ আন। ‘তাঁর দেহের নানান অঙ্গে আক্রমণ করেছে। ভাইরাস বাদ দেয়নি ব্রংকিয়াল সেল, মাসল সেল, লিভার, কিডনি আর লিমফ্যাটিক সেল। আসলে পুরো দেহেই পাওয়া গেছে ইনফেকশনের ট্রেস।

বিরক্ত হয়ে বড় করে দম নিলেন ব্রায়ান। ‘বাপু, তুমি তো মহিলার ইনশ্যরেন্সের বেনিফিশিয়ারি নও, মহিলা মরে গিয়ে যে তোমাকে বড়লোক করে দেবেন, তা-ও নয়। তা হলে কোন্ আক্কেলে তোমার মনে হচ্ছে এসব ভাল সংবাদ?’

‘না, ইয়ে, চিফ, আসলে আমরা অন্যভাবে ভাবছি। নানান দিক দিয়ে তাঁর দেহকে আক্রান্ত করেছে…

তাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন ব্রায়ান, ‘কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে?’

মন খারাপ করে জবাব দিল লাউ আন, ‘পরীক্ষায় দেখলাম, ওই জিনিস অ্যারোসলের মত ছিটিয়ে পড়ে। সর্দির ভাইরাসের মত। মশা, ছারপোকার কারণে ছড়িয়ে পড়বে। বা ম্যালেরিয়া, পশ্চিম-নাইল ভাইরাসের মত। পাখির মাধ্যমে বা HINI বা SARS…’ বসের গম্ভীর চেহারা দেখে চুপ হয়ে গেল এজেন্ট।

‘কীভাবে ওই মহিলার দেহে ঢুকল?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

‘ওই এনভেলপে পাতলা প্লাস্টিকের আবরণ ছিল,’ বলল লাউ, ‘ভেতরে ছিল ফাঁকা জায়গা। এনভেলপ খুলতেই… তা ছাড়া, বিশেষ কাগজও ব্যবহার করেছে। ওটা পরিবর্তিত হয় অক্সিজেন, তাপ বা আঙুলের স্পর্শে। আর তাপ পেলেই লাল হয়ে ওঠে ওই কাগজ। ওখানেই জেল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল ভাইরাস। কাজটা করেছে অ্যারোসলের মাধ্যমে। চিঠি পড়তে পড়তে নাক দিয়ে ভাইরাস টেনে নিয়েছেন তিনি।’

‘লাল রং হওয়ার ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান। ‘চিঠিতে মেখে গিয়েছিল ডেবি ম্যাকেঞ্জির রক্ত?’

‘সস্তা কৌশল,’ বলল আন, ‘ত্বকের গরমের কারণে অমন হয়েছে। কাগজে মাখা ছিল অদৃশ্য কালির মত ওই জিনিস।’

‘নাটকীয়তার জন্যে,’ বললেন ব্রায়ান। তাঁর মনে পড়ল, ওই ঘটনার দায় নেয়নি কোনও সংগঠন। বিষয়টা রহস্যময়।

‘নানান কারণে সিডিসি থেকে ওই ভাইরাসকে জাদুর ভাইরাস বলা হচ্ছে,’ বলল আন।

‘নাম তো দেয়া হলো, এখন অপেক্ষা করছি ভাল খবরটা কী জানার জন্যে,’ বিরস সুরে বললেন ব্রায়ান।

‘ওটাই তো ইন্টারেস্টিং দিক,’ হাসল আন। ‘খুব সংক্রামক, কিন্তু সামান্য জ্বর আর ভয়ানক মাথাব্যথা ছাড়া আর কোনও ক্ষতি করবে না। কয়েক দিনের ভেতর সুস্থ হয়ে যাবেন ডেবি ম্যাকেঞ্জি। অদ্ভুত ভাইরাস। সহজেই কোষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে, যা খুশি করতে পারে, কিন্তু করবে না কিছুই। জাদু আর কাকে বলে!’

সিটে নড়ে বসলেন ব্রায়ান। ভাবছেন: সত্যি, অবাক কাণ্ড! ‘এসব থেকে কী বুঝব, লাউ?’

‘কোষ দখল করলে নিজ ডিএনএ ইনজেক্ট করে বেশিরভাগ ভাইরাস, তৈরি করে নিজের মত কোটি কোটি ভাইরাস। কাজটা হয়ে গেলেই ওরা কোষ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে মৃত্যু হয় ওই কোষের। এভাবেই সারাদেহে মরতে থাকে কোষ। শরীরের নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে রোগ। ইউএন ভাইরাসও কোষের ভেতর ঢুকে ওটাকে বাধ্য করেছে নিজের মতই ভাইরাস তৈরি করতে। কিন্তু কেন যেন ক্ষতি করে না কোষের। কোষ ঠিকই রয়ে যায়, পরে ভাইরাসের ডিএনএর সামান্য অবশিষ্ট অংশ ছাড়া কিছুই থাকে না। যেমন ছিল তেমনই ভাল থাকে কোষ।’

‘অবশিষ্ট?’ সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইলেন ব্রায়ান। ‘কী ধরনের অবশিষ্ট? পরে আর কোনও ক্ষতি করবে না তো?’

‘আমরা এখনও ওটা স্টাডি করছি,’ বলল আন। ‘মৃদু জ্বর বাধিয়ে দেয়া আর রাক্ষুসী মাথাব্যথা তৈরি করা ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই করেনি।’

ভুরু কুঁচকে জাদুর ভাইরাসের কথা ভাবছেন ব্রায়ান। অবাক লাগছে তাঁর। কী কারণে ওই জিনিস তৈরি করেছিল ডক্টর মোবারক? দেহে ওই ভাইরাসের অবশিষ্ট ডিএনএ রেখে তার কী লাভ? কোষের ভেতর তৈরি করেছে একটা জায়গা। কিন্তু কেন?

‘আপাতত আমাদের কপাল ভাল, কিন্তু পরে ভাগ্য এত ভাল না-ও থাকতে পারে,’ বললেন ব্রায়ান, ‘আরও ভাল করে স্টাডি করো। সিডিসিকে বলো মূল ভাইরাস নিয়ে কাজ করুক। মানুষের স্পর্শে যেন না আসে ওটা। তুমি নিজে দেখবে ডিএনএর কোডিং। খুঁজে বের করবে এসবের মানেটা কী।’

উঠে দাঁড়াল আন। ‘আর কোয়ারেন্টাইন করা মানুষগুলোর কী হবে, চিফ?’

মাথা নিচু করে নিজ নোট দেখছেন ব্রায়ান। চোখ না তুলেই বললেন, ‘ওদের আবার কী?’

‘অ্যাম্বাসেডর ডেবি ম্যাকেঞ্জি আর অন্যদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চাইছে সিডিসি।’

ঝট্ করে মুখ তুললেন ব্রায়ান। ‘পাগল নাকি! কী নিয়ে বাড়ি ফিরবে তার ঠিক আছে? ওরা কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। কেউ বেরিয়ে যেতে চাইলে দরকার হলে গুলি করে থামাবে তুমি। কথা বুঝতে পেরেছ?’

‘স্যর, আমাকে তো অফিস থেকে আগ্নেয়াস্ত্রই দেয়া হয়নি।’

জোগাড় করে নাও একটা।’

অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেল লাউ আন।

‘মন দিয়ে শোনো, বেশ কিছু কারণে আমরা এসবের ভেতর জড়িয়ে গেছি,’ বললেন ব্রায়ান। ‘সেসব তোমাকে বা সিডিসিকে ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না। কিন্তু একটা কথা মাথায় গেঁথে নাও, আগে এনআরআই-এ কাজ করত ডেবি ম্যাকেঞ্জি। তখন আমাদের এজেন্ট ছিল। এটা সামান্য কাকতালীয় ঘটনা না-ও হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, সরাসরি আমার কাছে এসেছে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার: রহস্যময় ওই ভাইরাস মস্ত কোনও সর্বনাশ করবে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কাজেই  কোয়ারেন্টাইন থেকে কাউকে বেরোতে দেয়া যাবে না। কেউ না! কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

মাথা দোলাল লাউ আন। গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ। দেয়া হয়েছে জরুরি কাজ। এখন বুঝতে পারছে এসবের গুরুত্ব।

‘দুঃখিত, আগেই বলা উচিত ছিল, কতটা চিন্তিত প্রেসিডেন্ট,’ বললেন ব্রায়ান।

‘বুঝেছি,’ বলল লাউ আন।

‘ঠিক আছে, দেরি না করে মাটি খুঁড়তে শুরু করো। হয়তো এর ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই।’

মাথা দুলিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল লাউ আন।

বড় করে দম নিলেন ব্রায়ান। আর তখনই বেজে উঠল তাঁর ইন্টারকম। বাটন টিপে দিতেই এল সেক্রেটরি মিসেস উডরোর কণ্ঠ: ‘স্যর, এক মিনিট দিতে পারবেন?’

‘এক মিনিট কেন. দশ মিনিট দিতে পারব,’ বললেন ব্রায়ান।

এনআরআই-এর প্রায় কেউ জানে না, অত্যন্ত জরুরি এক মিশনে গেছে এলেনা রবার্টসন। সাহায্য নিয়েছে বিসিআইরত্ন মাসুদ রানার। এ খবর জানেন শুধু ব্রায়ান ও তাঁর সেক্রেটারি মিসেস উডরো। দু’দেশের দুই এজেন্টের বিষয়ে খোঁজখবর রাখার দায়িত্ব ছিল বিধবা মহিলার ওপর। খুক খুক করে কেশে নিয়ে বলল মিসেস উড়রো, ‘এলেনা রবার্টসন আর মাসুদ রানার ব্যাপারে আলাপ করতে চাই, স্যর।

‘কী হয়েছে ওদের?’ চিন্তিত হয়ে গেলেন ব্রায়ান।

ওদের জন্যে এবার ব্যস্ত হয়ে উঠতে হবে আপনাকে, স্যর।’

‘মিসেস উডরো, আমি এমনিতেই ব্যস্ত।

‘ফ্রেঞ্চ পুলিশের ব্যাণ্ডে কিছু কথা শুনেছি আমরা, স্যর,‘ বলল মিসেস উডরো। ‘এলেনা আর মাসুদ রানা মিলে নাকি প্যারিসের বুকে উড়িয়ে দিয়েছে এক বাড়ি। গোলাগুলিও করেছে। ওদের কাছ থেকে পুলিশ জেনেছে, এলেনা আমেরিকান নাগরিক। আর মাসুদ রানা বাংলাদেশি। আপাতত ওদের দু’জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।’

নাক-মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বললেন জেমস ব্রায়ান, ‘মাই গড! এসব কী করছে ওরা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *