মৃত্যুঘণ্টা – ১৮

আঠারো

বৈরুত এয়ারপোর্টে পৌছে ধূসর এক গাড়িতে চেপে আমেরিকান এম্বেসিতে হাজির হলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান ও এজেণ্ট এলেনা রবার্টসন।

সিকিয়োর কমিউনিকেশন রুমে পৌঁছেই বসকে বলল এলেনা, ‘আমার মনে হচ্ছে না এই মিশনের জন্যে রানা উপযুক্ত লোক।

‘জানতাম, এই কথাই বলবে,’ বললেন ব্রায়ান, ‘যুক্তি দিয়ে বোঝাও। …তার আগে শুনে নাও, বাংলাদেশি ওই যুবক পৃথিবীর সেরা গুপ্তচরদের একজন। সিআইএ থেকে অনেকে চেয়েছে ওর মৃত্যু হোক। তার ভেতর ছিল সিআইএ ডেপুটি চিফও। আলাস্কায় ভয়ঙ্কর এক দানব তৈরি করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। নিজেই ফেঁসে যায়। দোষ প্রমাণিত হওয়ায় আদালতের রায় অনুযায়ী পঞ্চাশ বছর জেল খাটতে হতো। জান হাতে নিয়ে পালিয়ে গেছে। ধরা পড়লে সারাজীবনে বেরোতে পারবে না কারাগার থেকে। এর আগেও অনেকে চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাসুদ রানার টিকিও স্পর্শ করতে পারেনি কেউ, বরং পড়েছে মস্ত সব বিপদে।’

‘কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে এবার জড়িয়ে যেতে পারে বিপদে,’ আপত্তির সুরে বলল এলেনা। বুকে অসুস্থ অনুভূতি। মন বলল, খুবই প্রিয় মানুষটার পিঠে ছোরা বসাচ্ছে। কিন্তু এ-ও ঠিক, ওর অন্তর বলছে, রানার ক্ষতি হওয়ার আগেই ওকে সরিয়ে দেয়া উচিত। ‘বিজ্ঞানীর খুনের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে…’

এলেনার কথাটা উড়িয়ে দিলেন ব্রায়ান, ‘ওর দেশের লোক ডক্টর মোবারক, প্রতিশোধ নিতে চাইলে দোষ দেব না।’

‘প্রিয় যে কারও জন্যে ভয়ঙ্কর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।’

‘যে-কোনও ভাল মানুষ তা-ই করবে। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।

বসের চোখে চোখ রাখল এলেনা। ‘বিসিআই থেকে বলা হয়েছে, এই মিশনে রানা কাজ করবে এক শর্তে। মিশন সফল হলে এরপর ওকে খুনের চেষ্টা করবে না আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স এজেন্টরা।’

‘আপত্তি তোলেননি কোনও ইন্টেলিজেন্স চিফ,’ বললেন ব্রায়ান। ‘কথা হয়েছে প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও। প্রয়োজনে রানার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন তিনি। এই মিশনে ওকে সাহায্য করবে তুমি। নাকি এই মিশন থেকে সরে যেতে চাও?’

‘না, তা নয়। কিন্তু পরিচিত এক মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে ওর। নিজের মনকে সামলে রাখতে পারবে রানা?’

‘ঝুঁকিটা তো রানাকেই নিতে হবে, নাকি?’

চুপ থাকল এলেনা।

ব্রায়ান আবারও বললেন, ‘রানা আর তোমার সম্পর্কে কোনও লুকাছাপা নেই। দু’জনের মাঝে কোনও মেয়ে এলে, সেক্ষেত্রে কী করবে, তা স্থির করবে তোমরাই।’

‘আমি ভাবছি কীভাবে সফল হবে এই মিশন,’ বলল এলেনা। ‘বিপদের সময় ওই মেয়ের জন্যে দ্বিধায় পড়তে পারে রানা।’

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন ব্রায়ান, ‘আশা করি তখন পাশে থাকবে তুমি, ওকে সাহায্য করবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে।’

অস্থির লাগছে এলেনার। রানা আর মোনার পুরনো প্রেম জেগে উঠলে, তখন কী হবে? টের পেল, নিজের ব্যক্তিগত কারণে ও চাইছে এই মিশন থেকে সরে যাক রানা।

চুপ করে থাকল। এ বিষয়ে আর কিছু বললেন না ব্রায়ানও।

একটু পর ভার্জিনিয়ার এনআরআই হেডকোয়ার্টার থেকে যোগাযোগ করল মেডিকেল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ডক্টর লাউ আন। স্ক্রিনে দেখা গেল যুবকের পরনে সাদা ল্যাব কোট, চোখে রিমলেস চশমা। অবাক হলো এলেনা। এখন যুবকের কোমরের হোলস্টারে পিস্তল।

গলা পরিষ্কার করে জানতে চাইলেন ব্রায়ান, ‘তুমি সশস্ত্র কেন, আন?’

‘আপনি বলেছেন, কেউ কোয়ারেন্টাইন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে যেন গুলি করি, তাই এই ব্যবস্থা,’ বলল যুবক!

একবার এলেনাকে দেখলেন ব্রায়ান। আবার স্ক্রিনের দিকে ফিরলেন। ‘বুঝলাম। তো এখন পর্যন্ত কাউকে গুলি করেছ?’

একটু বিমর্ষ সুরে বলল আন, ‘না, স্যর, কেউ তো বেরিয়ে যেতে চাইল না।’

‘ঠিক আছে, পিস্তলটা দিয়ে দিয়ো সিকিউরিটি গার্ডের হাতে। সত্যি গুলি করে দিলে ব্যাপারটা ভাল হবে না। কাজের কথায় এসো। ডেবি ম্যাকেঞ্জির ভাইরাস থেকে নতুন কোনও ডেটা পেলে?’

মাথা নাড়ল লাউ আন, ‘প্রথম কথা, স্যর, ডেটা এখনও অসম্পূৰ্ণ।’

‘এদিকে আপনাদের জন্যেই আটকে আছে আমাদের কাজ,‘ বলল এলেনা।

‘তা ঠিক,’ সায় দিল আন। ‘এখন পর্যন্ত ক্লিনিকালি যা পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে: ওই ভাইরাস সম্পর্কে সব জানতে গেলে সময় লাগবে অন্তত কয়েক বছর। তবে আপনার আনা ডেটা থেকে বুঝতে পারছি, ইউএন ভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে ডক্টর মোবারকের সিরিজ ৯৫২-র রেযাল্টের। অদ্ভুত, যে-কোনও প্রাণীর টেলোমার বা জীবনী-শক্তি কমে যায় ৫১%। ইউএন ভাইরাস একটু এদিক-ওদিক করলে জেনেটিকালি মডিফিকেশন সম্ভব। কাজে আসতে পারে জেনেটিক থেরাপির ক্ষেত্রে।

‘এ থেকে কী বুঝব?’ বাঁকা সুরে বলল এলেনা। মুচকি হাসল লাউ আন।

একটু খুলে বলো তো, বাপু,’ বললেন ব্রায়ান।

‘হয়তো ইউএন-এর ভাইরাস সুস্থ করবে মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত জেনেটিক কোডিং,’ বলল আন, ‘মানুষের শরীরে কমবেশি এক বিলিয়ন সেল থাকে। দুষ্ট ভাইরাস হামলা করলে একটা একটা করে এসব সেল ঠিক করা অসম্ভব হয়। কিন্তু একটা সেল-এ ঠিকভাবে সুস্থ ডিএনএ বসিয়ে দিলে, ওটাই তৈরি করবে নিজের মত ভাল কোটি কোটি সেল। রোগ সারতেও সময় লাগবে না। যুদ্ধে হেরে পালাবে মন্দ ভাইরাস। অবশ্য, সবসময় যে এক শ’ ভাগ সুস্থতা আসবে, এমন না-ও হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনা খুবই বেশি, আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে মানুষটা। অন্তত মরে যেতে হবে না তাকে।

ব্রায়ান ও এলেনা বুঝতে পারছে, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লাউ আন। কিন্তু ডক্টর মোবারক টেলোমার কমিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ট্রায়াল ৯৫২-এর রেযাল্ট বিপজ্জনক। ইচ্ছে করলে কমিয়ে দেয়া যাবে মানুষের আয়ু।

‘ট্রায়াল ৯৫২-এর রেযাল্টকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

মাথা দোলাল বিজ্ঞানী। ‘হোস্টের বাইরেও টিকবে ইউএন ভাইরাসের ভেতর ট্রায়াল ৯৫২। থাকবে বাতাসে, জলে, পাখি, অন্য জন্তু, বা কীট-পতঙ্গের দেহে। অ্যারোসলের মত ছড়িয়ে দেয়া যাবে। মিসাইল অথবা আর্টিলারি শেলের মাধ্যমেও। হ্যাঁ, ওই ভাইরাস হতে পারে মারাত্মক এক বায়োলজিকাল অস্ত্র।’

‘অর্থাৎ, ইউএন ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে ট্রায়াল ৯৫২-র ক্ষতিকর কোডিং?’ জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

‘হ্যাঁ, ফাঁকা জায়গা আছে ইউএন ভাইরাসের ভেতর। ওটা দিয়ে ছড়াতে পারবে ভয়ঙ্কর সব ডিএনএ।

গলা শুকিয়ে গেল এলেনার। ডক্টর মোবারকের ল্যাবে দেখেছে জীর্ণশীর্ণ সব বুড়ো ইঁদুর। ইউএন ভাইরাসের মাধ্যমে মানব সমাজে ছড়িয়ে গেলে বাঙালি বিজ্ঞানীর তৈরি ট্রায়াল ৯৫২? হয়তো দেখা গেল, আগামী কয়েক বছরের ভেতর বুড়ো হয়ে মরতে লাগল কোটি কোটি মানুষ। এলেনা ভাবল, আমার যা বয়স, এক্ষেত্রে আগামী কয়েক বছরের ভেতর বুড়ি হয়ে মরব!

‘আর কিছু বলবে?’ লাউ আনের উদ্দেশে বললেন ব্রায়ান। মাথা নাড়ল আন। ‘আপাতত আর কিছু নয়।

‘ঠিক আছে, অস্ত্র জমা দাও,’ বললেন ব্রায়ান। ‘প্রতি বারো  ঘণ্টা পর পর যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে।’

স্ক্রিন থেকে বিদায় নিল লাউ আন।

এলেনার দিকে ফিরলেন ব্রায়ান। ‘তো, নিজে কিছুই করে না ইউএন ভাইরাস। তা হলে, কেন ওটা পাঠাল ওই অফিসে?’

‘ভয় দেখাতে,’ বলল এলেনা, ‘হয়তো ওই একই কারণে খুন হয়েছে বাঙালি বিজ্ঞানী। ওই কাল্টের নেতা এখনও হামলা করতে তৈরি নয়। কিন্তু আত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমাদের।’

‘অথচ কিছুই দাবি করছে না সে,’ বললেন ব্রায়ান।

‘ভাইরাসে রাখার মত উপযুক্ত জিনিস এখনও হাতে পায়নি,’ মন্তব্য করল এলেনা।

মাথা দোলালেন ব্রায়ান! ‘ডক্টর মোবারক তাদের হাতে তুলে দেন ফাঁকা একটা ভাইরাস।’

‘আর সেজন্যেই তাঁকে হাতের মুঠোয় পেতে চেয়েছিল তারা,’ বলল এলেনা, ‘পরে ধরা পড়লেও মুখ খোলেননি ডক্টর। তখন বাধ্য হয়ে এরা গেছে ওই ল্যাবে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল ব্রায়ানের মুখ। ‘হয়তো পৃথিবীর মস্তবড় বিপদ বুঝে ঠিক সময়ে ওই কাল্টের কাছ থেকে সরে যান তিনি। তাই ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এক পর্যায়ে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিতে বাধ্য হয়েছেন। আগেই বাড়িতে বসিয়ে রেখেছিলেন বোমা। জানতেন, গবেষণার কিছুই হাতে পাবে না ওই কাল্ট।

বস চুপ হয়ে যেতেই বলল এলেনা, ‘কিন্তু এমন একজনকে দরকার ওদের, যে কি না ডক্টর মোবারকের গবেষণা শেষ করবে।’

‘ডক্টর মোবারকের মেয়ে।’

‘ওই মেয়েকেই লাগবে, এমন নয়। আবার এ-ও ঠিক, ডক্টর মোবারকের সঙ্গে বছরের পর বছর কাজ করেছে তাঁর মেয়ে মোনা।’ এলেনার মনে পড়ল, রানা এখন দুবাইয়ে। বসের কাছে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি চোরাই আর্টের নিলামে যাচ্ছি কেন?’

‘কারণ ওখানে বিশেষ কিছু বিক্রি হবে, যেটা চেয়েছিলেন মোবারক ও আবু রশিদ,’ বললেন ব্রায়ান। ‘মাসুদ রানা এসব ভেবেই পরিচিত এক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তোমাকে নিলামে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমরা এ কাজ করতে গেলে সমস্যায় পড়ত এনআরআই।’

‘কিন্তু ভাইরাসের সঙ্গে ওই আর্টের কী সম্পর্ক?’

‘তা খুঁজে বের করা তোমার কাজ,’ বললেন ব্রায়ান। ‘মাসুদ রানার বন্ধু নাসের আল মেহেদি তোমাকে নিয়ে যাবে ওই নিলামে।’

‘আপনি কি জানেন ওটা কোথায় হবে?’

‘শহরের মাঝে,’ বললেন ব্রায়ান।

এলেনার মনে পড়ল, বৈরুত শহরের মাঝের অংশ বোমায়

পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ‘ওটা তো নো-ম্যান’স্-ল্যাণ্ড।

‘ওপরে ভাঙাচোরা সব বাড়ি,’ মাথা দোলালেন ব্রায়ান। ‘কিন্তু তুমি থাকবে শহরের নিচে পাতালে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *