মৃত্যুঘণ্টা – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

পারস্য উপসাগরে আঁধারে ছুটে চলেছে ছোট্ট পাওয়ার বোট, লক্ষ্য দ্বীপের উত্তর তীর। ভাগ্যের সহায়তা পাচ্ছে রানা, এলেনা ও গ্রাহাম। দক্ষিণ থেকে আসছে হাওয়া। পিছিয়ে পড়ছে ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ। তার ওপর, আজ রাত নিকষ কালো। যদিও একটু পর উঠবে চাঁদ।

আপাতত অন্ধকারে নিচু বোট দেখা খুব কঠিন। সরাসরি তীরের মত চলেছে ছোট্ট জলযান।

কালো ওয়েট সুট পরে অপেক্ষা করছে রানা ও এলেনা। একবার থারমাল স্কোপ দেখে নিল রানা। আশপাশে কেউ নেই। ওদের বোটের ইঞ্জিন ছাড়া চলছে না কোনও যন্ত্র। তীরে ছোট ছোট চিহ্ন। ওগুলো বোধহয় পানকৌড়ির নীড়। বছরের এ সময়ে এই দ্বীপ ভরে যায় ওদের ভিড়ে।

থারমাল স্কোপ রেখে এলেনার পাশে হাত লাগাল রানা, গুছিয়ে নিল অস্ত্র। স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে দিল পরস্পরের বডি আর্মার।

‘ঠিক কতটা কাছে যাব?’ প্রায় ফিসফিস করে বলল গ্রাহাম।

ধীর গতি তুলে বোট চলেছে, প্রায় কোনও ঢেউ উঠছে না।

রানার দিকে তাকাল এলেনা। বুঝতে পারছে, খুব গম্ভীর হয়ে গেছে বিসিআই এজেন্ট। তুমুল লড়াইয়ের জন্যে তৈরি। কে জানে, এখন হয়তো ভাবছে মোনার কথা। ওই মেয়ে কাল্টের বিরুদ্ধে গেলে, এতক্ষণে তার সর্বনাশ করে দিয়েছে তারা। বেঁচে আছে কি না, কে জানে! হয়তো ওর সামনেই পেটাচ্ছে ওর ফুফু আর বাচ্চা মেয়েটাকে। আর কাল্টের হাতে গবেষণার ফসল তুলে দিয়ে থাকলে হয়তো খুন হয়ে গেছে এতক্ষণে!

সচেতন হলো এলেনা। ‘কোনও গার্ড দেখছ, রানা?’

মাথা নাড়ল রানা। ঘুরে দেখল গ্রাহামকে। ‘একটু পর ইঞ্জিন বন্ধ করবে। যতটা পারো তীরের কাছে গিয়ে থামবে।’

‘আমিও যেতাম?’ নিচু স্বরে বলল প্রাক্তন ব্রিটিশ এজেণ্ট।

‘না, বোটে কারও থাকা দরকার। মিসাইল পড়ার পাঁচ মিনিট আগে সরে যাবে।’

‘তীরের ওরা গুলি শুরু করলে?’

‘সেক্ষেত্রে তীরে ওঠার আগেই লড়তে হবে। তখন বাড়তি সময় পাব না।’

থ্রটল ঠেলে সামান্য গতি তুলল গ্রাহাম। দ্বীপের বন্দরের দিকে চলেছে। শান্ত পানি। পালকের মত ভেসে চলেছে সরু বোট। সামনে, দূরে কটা রঙের পাথুরে জেটি।

আবারও থারমাল স্কোপ ব্যবহার করল রানা। এরপর দেখল রাইফেলের ব্যারেলের ওপরের নাইট ভিশন স্কোপ দিয়ে। জেটির অনেক কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। এখনও ওদিক থেকে এল না গুলি। চিৎকার করল না কেউ। ইঞ্জিনের মৃদু বিটবিট ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই।

আরও কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল গ্রাহাম।

‘কপাল এত ভাল হওয়ার কথা নয়,’ নিচু স্বরে বলল রানা।

জেটি থেকে এক শ’ গজ দূরে বোট থেকে নেমে পড়ল ওরা, জেটির দিকে না গিয়ে সাঁতরে চলল সৈকত লক্ষ্য করে। রানা খেয়াল করেছে, বৈঠা মেরে আবারও সাগরে ফিরছে জন গ্রাহাম। দূরে গিয়ে অপেক্ষা করবে। রেডিয়ো করলেই তুমুল গতি তুলে হাজির হবে বিধ্বস্ত ফ্রেইটারের কাছে।

দু’মিনিট পর সৈকতে উঠল রানা ও এলেনা। সামনেই নাক- বোঁচা ফোক্সভাগেন গাড়ির মত এক বোল্ডার, ওখানে আড়াল নিল ওরা।

‘অস্বাভাবিক কিছু দেখছ?’ ফিসফিস করল এলেনা।

‘এখনও না,’ বলল রানা।

ফ্ল্যাক জ্যাকেট পরে নিয়ে খাড়া এক রিজে উঠল ওরা। থেমে গেল ওখানেই। আবারও স্ক্যান করার পর বোঝা গেল, ওরা ছাড়া আশপাশে কেউ নেই।

ডানদিকে উঁচু এক খোঁড়লের ভেতর বাসা করেছে দু’জোড়া পানকৌড়ি। তাদের মলে ভরে গেছে নিচের পাথর।

‘ভুলেও ওদেরকে বিরক্ত কোরো না,’ ফিসফিস করল রানা।

মাথা দোলাল এলেনা। হঠাৎ করেই এক শ’টা পানকৌড়ি আকাশে উড়াল দিলে সর্বনাশ হতে বাকি থাকবে না।

রানা রওনা হতেই পেছন থেকে কাভার করল এলেনা।

পরিত্যক্ত, পাথুরে দ্বীপের মেঝে এবড়োখেবড়ো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ করেই থেমে গেল রানা। বসে পড়ল। আগের জায়গায় থাকার জন্যে ইশারা করল এলেনাকে।

প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ডানে সরে বড় এক বোল্ডারের আড়ালে থামল রানা। হাতে তৈরি রাইফেল। কয়েক সেকেণ্ড পর সামনে বাড়ল। থেমে গেল আবারও। ঝুঁকে পড়ে খোঁচা দিল মাটিতে কিছুর গায়ে। এলেনা যেদিকে আছে, ওদিকে তাকাল। অন্ধকারে কালো পোশাকে আস্ত এক ভূত। সরে গিয়ে বসে পড়ে হাতের  ইশারায় ডাকল।

এক ছুটে রানার পাশে পৌছল এলেনা। চাপা স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে, রানা?’

‘কোথাও মস্ত গণ্ডগোল আছে,’ নিচু স্বরে বলল রানা। ‘কী ধরনের?’

বোল্ডারের ওদিকে হাত তাক করল রানা।

সামনে বাড়ল এলেনা। অবাক হওয়ার মত কিছু দেখছে না। দ্বীপ জুড়ে নানান দিকে গেছে পাইপ। যেন একগাদা শেকড়। এবার বুঝল। কয়েকটা পাইপের পাশে পড়ে আছে দু’জন সশস্ত্র লোক। মারা গেছে গুলি বিদ্ধ হয়ে।

‘খেয়াল করো,’ বলল রানা। রাইফেলের নল দিয়ে সরিয়ে দিল একজনের শার্টের ওপরের অংশ। লাশের বুকে ব্র্যাণ্ডিং। GEN 2:17. ডক্টর মোবারক বা জুবায়েরের বুকে এভাবেই আগুনে পুড়িয়ে লেখা হয়েছে অক্ষর ও সংখ্যা।

‘কাল্টের সদস্য এরা,’ বিড়বিড় করে বলল এলেনা।

‘গুলি খেয়েছে মাথায়,’ জানাল রানা।

ঝুঁকে ক্ষত দেখল এলেনা। ছোট ক্যালিবারের গুলি। একই অস্ত্র দিয়ে হয়তো খুন করা হয়েছে ফ্রান্সের পুলিশদেরকে। লাশ স্পর্শ করল এলেনা। ‘শরীর এখনও গরম।’

‘বেশিক্ষণ হয়নি খুন হয়েছে,’ বলল রানা।

‘আসলে হচ্ছে কী এখানে?’ ওর দিকে তাকাল এলেনা।

‘খেলা শেষ করছে,’ মন্তব্য করল রানা। ‘আর সব জায়গার মতই। জোন্সটাউন, ওয়াকো, আইয়ুআম শিনরিকয়ো।’

‘কিন্তু নিজেদের লোককে খুন করছে কেন?’

‘অন্যসব কাল্টের সদস্যরাও কিন্তু নিজেদের লোক খুন করেনি,’ বলল রানা, ‘দলের বড় পদের লোকরা কাজটা করেছে।’

‘কিন্তু… ওরা বিজয়ী হবে, এমন সময় এ কাজ করবে কেন?’

‘এদের কাল্ট অ্যাপোক্যালিপটিক, যা খুশি করতে পারে,’ বলল রানা। ‘আরও বড় কোনও গোলমাল আছে। আমরা ওটা বুঝতে পারছি না।’

‘শেষ করছে খেলা?’ আনমনে বলল এলেনা।

‘এদিকে মিসাইল আসতে বড়জোর বিশ মিনিট,’ বলল রানা।

.

এইমাত্র নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন গাল্ফ ফোর্সের কমাণ্ডার। গাইডেড মিসাইল ক্রুযার ইউএসএস লিংকনের ব্রিজে দাঁড়িয়ে ওটা পড়ছেন ক্যাপ্টেন লরি ক্যাণ্ডেল। তাঁর আদেশের জন্যে অ্যাটেনশন হয়ে অপেক্ষা করছে কমিউনিকেশন অফিসার ও ডেক অফিসার।

নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র একটা টার্গেটে পাঠাতে হবে পুরো আটটি টমাহক মিসাইল। সত্যিই অদ্ভুত কাণ্ড! প্রচণ্ড শক্তিশালী এসব মিসাইল বহন করবে এক হাজার পাউণ্ড হাই-এক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড, অথবা নেভির ব্যবহৃত কমবাইন্ড বম। শেষের ওটার ভেতর থাকবে অন্তত এক শ’টা ছোট ওয়ারহেড। সেক্ষেত্রে একই সময়ে বিশাল এলাকা জুড়ে হবে বোমাবর্ষণ। চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে লক্ষ এ্যাপনেল। মারাত্মক এক্সপ্লোসিভ কনকাশন ওয়েভ তো আছেই, তার সঙ্গে কোরের চার্জ ছাই করবে নির্দিষ্ট এলাকা। তখন তাপ হবে কমপক্ষে এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস।

মাত্র একটা টার্গেটে এত মিসাইল ফেলতে হবে, তাই অবাক হয়েছেন ক্যাপ্টেন ক্যাণ্ডেল। ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ায় তাঁরা এসব ক্ষেপণাস্ত্র ফেলেছেন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, শক্তপোক্ত কমাণ্ড স্টেশন বা কন্ট্রোল বাঙ্কারে। প্রতিটি মিসাইলের ছিল একেকটা করে টার্গেট। কাজেই ক্যাপ্টেনের মনে হচ্ছে, একটা মশা মারতে গিয়ে হাঁকা হচ্ছে আট কোটি হাতুড়ি।

আরও কথা আছে, টার্গেট পরিত্যক্ত ছোট্ট এক দ্বীপ।

অদ্ভুত নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁকে!

‘অর্ডার কনফার্ম করেছ, লেফটেন্যান্ট?’

‘ইয়েস, স্যর,’ জানাল কমিউনিকেশন অফিসার, ‘প্রতিটি কমিউনিকেশন প্রোটোকল ব্যবহার করার পর ভেরিফাই করা হয়েছে, স্যর। অথেনটিক অর্ডার।’

‘অথেনটিসিটি নিয়ে মাথা-ব্যথা নেই,’ বললেন ক্যাপ্টেন, ‘মনেও করি না কেউ হ্যাক করেছে আমাদেরকে। আমি আসলে জানতে চাই, টার্গেট ঠিক আছে কি না। একবার আটখানা মিসাইল পাঠিয়ে দেয়ার পর যদি জানতে পারি, ভুল জায়গায় ফেলেছি, তখন কী হবে? একেকটা মিসাইলের দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার!’

ডেক অফিসার বলল, ‘স্যর, অর্ডার থেকে জেনেছি, . এটা জয়েন্ট অপারেশন। স্যান ফ্রান্সিসকো আর ক্যালিফোর্নিয়া থেকেও একই পরিমাণের মিসাইল ফেলবে ওই দ্বীপে। ওদিকে স্ট্যাণ্ডবাই করা হয়েছে গাইডেড মিসাইল জুয়ার ওয়াশিংটনকেও। এদিকে আমাদেরকে বলা হয়েছে, সঠিক সময়ে মিসাইল ফেলতে।’

অর্ডার ফর্মে আবারও চোখ নামালেন ক্যাপ্টেন।

‘চব্বিশটি মিসাইল ফেলা হবে নির্দিষ্ট টার্গেটে!’

আগে কখনও এমন নির্দেশ পাননি তিনি।

‘ওই দ্বীপে যা-ই থাকুক, কমাণ্ড চাইছে ওটা বাতাসে মিলিয়ে যাক,’ বলল ডেক অফিসার।

নীরবে মাথা দোলালেন ক্যাপ্টেন ক্যাণ্ডেল, অর্ডার শিট মুড়িয়ে অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘ঠিক আছে, মিসাইল লঞ্চ করার জন্যে তৈরি হও।’

‘জী, স্যর,’ সায় দিল ডেক অফিসার।

একটু পর বিকট শব্দে বাজবে জেনারেল কোয়ার্টারে অ্যালার্ম, বারবার প্রচার করা হবে: এটা কোনও ড্রিল নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *