মৃত্যুঘণ্টা – ৪৯

ঊনপঞ্চাশ

মিসাইলের ক্রেট পরীক্ষা করার পর চারপাশ সার্চ করছে রানা। সামনেই চার্ট রুম। ভেতরে একগাদা ওয়েল্ডিং ইকুইপমেন্ট। পরের কেবিন গুদাম, সেখানে প্রচুর ময়দা, চাল ও অন্যান্য খাবার। আরও এগিয়ে যেতে সামনে পড়ল সাদা এক দরজা, রাবার দিয়ে সিল করা এয়ারলক। কমার্শিয়াল বিমানের দরজার হ্যাণ্ডেলের মতই হাতল।

হ্যাণ্ডেলের একটু ওপরে ছোট, পুরু কাঁচের চৌকো জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল রানা। ওদিকে ল্যাবোরেটরি। দেখা গেল আধুনিক কিছু ইকুইপমেন্ট। এক দিকের কোণে কী যেন নড়ল।

হ্যাঁ, দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে মোনা মোবারক, কাঁদছে।

যখন-তখন খুন হবে, ভাবল রানা।

খুব সাবধানে হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলল রানা, ঝট করে ঘরে ঢুকেই সরে গেল একপাশে। হাতে তৈরি রাইফেল।

‘না, রানা!’ ফুঁপিয়ে উঠল মোনা।

একই সময়ে বিকট আওয়াজ হলো ঘরের ভেতর। পিঠে প্রচণ্ড এক গুঁতো খেয়ে সামনে বাড়ল রানা। হাত থেকে মেঝেতে খটাং শব্দে পড়ল রাইফেল। তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বিসিআই এজেন্ট। দু’বার গড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখের কোণে দেখল, পেছনের দরজায় এসে থেমেছে এক লোক। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর দেখতে সে। কুড়ালের মত চেহারায় চোয়াল যেন চৌকো বাক্স। খুব কাছাকাছি নাকের পাশে সরু দু’চোখ। ঘাড়ে উলকি।

‘তুমি আমার বাড়িতে আমন্ত্রিত,’ বলল রনি এমসন। কাঁধে তুলেছে চায়নিজদের তৈরি এসকেএস রাইফেল।

হঠাৎ করেই গলা শুকিয়ে গেছে রানার। বিসিআই-এর ফাইলে আছে এ লোকের ছবি। সিআইএ ডেপুটি চিফ ছিল, এখন পলাতক। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চাউর হয়ে গিয়েছিল, রানাকে খুন করবে বলে খুঁজছে সে।

একে-৪৭-এর ৭.৬২ এমএম বুলেটের মতই রানার বুকে লাগল এসকেএসের দ্বিতীয় বুলেট। চিত হয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ল রানা। সামান্য ফুটো হয়ে গেছে ওর বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। দম নিতে গিয়ে টের পেল, আটকে গেছে শ্বাস, খাবি খেল কয়েকবার। কুলকুল করে বুক থেকে নেমে বগল ভিজিয়ে দিচ্ছে রক্ত। ঝনঝন করছে কান, আবছা শুনল মোনার আর্তচিৎকার।

এক দৌড়ে রানার পাশে পৌঁছে গেছে মেয়েটা। কিন্তু তখনই দরজা দিয়ে এল আরেক লোক। গণ্ডারের মত সে। রনি এমসনের পাশে থামল।

রানাকে বসতে সাহায্য করবে বলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মোনা, বিড়বিড় করে বলল, ‘সরি… সরি… রানা…

‘অ্যাই, মেয়ে!’ ধমক দিল প্রাক্তন সিআইএ ডেপুটি চিফ রনি এমসন। ‘সরে যাও!’

চোখের অশ্রু গাল বেয়ে নামছে মোনার। আবারও ফিসফিস করে বলল, ‘সরি… রানা… সরি… আমাকে মাফ করে দিয়ো…’

সামনে বেড়ে মোনার বাহু ধরল রনি এমসনের চেলা মার্ডক,  হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল রানার কাছ থেকে।

উঠে বসতে চাইল রানা, কিন্তু গুলির আঘাতে ফুরিয়ে গেছে ওর দম। ডান বুকে ভীষণ ব্যথা। ধারণা করল, ফুটো হয়ে গেছে ফুসফুস।

‘এখন তোকে দেখে মোটেও বিপজ্জনক লাগছে না; হাসল রনি এমসন। ‘অথচ বাহাদুরি কম করিসনি তুই। তোর জন্যেই নষ্ট হয়েছে আমার জীবন। হারিয়ে বসেছি সব সম্মান।

‘কার কথা বলছেন?’ শ্বাস চালু হতেই আকাশ থেকে পড়ল রানা। ‘আমি তো আপনাকে চিনিই না। কে আপনি?’

‘শালা, চিনিস না?’

রানার মাথার তিন ইঞ্চি দূরের দেয়ালে গর্ত করল বুলেট। ওর গালে চড়াৎ করে লাগল দেয়ালের একটা অংশ। ব্যথায় গাল কুঁচকে ফেলল রানা। সরিয়ে নিল মাথা।

‘চিনিস না, শালা?’ চিৎকার করল এমসন। ‘ভুলে গেছিস কী সর্বনাশ করেছিস আমার?’

সময় আদায় করতে হবে, ভাবল রানা। ফিরছে শ্রবণশক্তি। গায়ের জোরও ফিরবে। কিছুক্ষণ পর হাজির হতে পারে এলেনা। সেক্ষেত্রে হয়তো জটিল হয়ে উঠবে পরিস্থিতি।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা।

‘আলাস্কায় তোর কাজ ছিল মরে যাওয়া,’ রাগী গলায় বলল এমসন। ‘ওই দানবের হাতে তুই মরলে সব সামলে নিতাম আমি। কিন্তু তুই মরলি না। আর তাই সব দোষ এসে চাপল আমার ঘাড়ে।’

‘এসব কী বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝছি না,’ অবাক সুরে বলল রানা। আস্তে আস্তে সরছে প্রায়-অবশ ডানহাত।

‘তোর জন্যে সিআইএ থেকে বের করে দিল!’ বুনো শুয়োরের মত চিৎকার করল এমসন। ‘সমাজ থেকে পালিয়ে যেতে হলো! সবাই বলতে লাগল, দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি! আততায়ী লেগে গেল পেছনে! কেন? কারণ মরার কথা থাকলেও তুই আলাস্কায় মরলি না!’

কথাটা শেষ হতেই বিকট এক বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো। থরথর করে কেঁপে উঠেছে গোটা জাহাজ। দেয়ালে হাত রেখে তাল সামলে নিল রানা। বুঝে গেছে, টমাহক মিসাইলের আঘাত নয়, নইলে এতক্ষণে ছাই হয়ে যেত ওরা। চাপা গুড়গুড় আওয়াজ থেমে গেছে। ঘরে এসে ঢুকছে কালচে ধোঁয়া।

‘মেঝেতে শুয়ে সেজদা কর আমাকে,’ কর্কশ হাসল এমসন। ‘ট্রিপওয়্যারের ফাঁদে পড়ে খুন হয়েছে তোর প্রেমিকা এলেনা। মরবি তুই। এবার পারলে বাঁচতে চেষ্টা কর দেখি, বাঙালি গুপ্তচর!’ পায়ে পায়ে সামনে বাড়ছে সে। রানার গলা লক্ষ্য করে তাক করছে রাইফেলের নল। কিন্তু তখনই পিঠ কুঁজো হয়ে গেল তার। ব্যথায় কুঁচকে ফেলেছে চেহারা। ঘরে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলেছে রাইফেলের গুলি।

পৌঁছে গেছে এলেনা।

এদিকে দু’লাফে সামনে বেড়ে সিআইএর প্রাক্তন ডেপুটি চিফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানা। সরাসরি ধাক্কা খেল দু’জন। তাল সামলাতে না পেরে পড়ল পাশের ঘরের কাঁচের দরজায়। ঝনঝন করে ভাঙল পুরু কাঁচ। ধারালো কাঁচ ভরা মেঝেতে পড়েই পরক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, খপ্ করে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলল এমসনের শার্টের কলার। পরক্ষণে আরেক টানে খুলে ফেলল লোকটার বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। গলা খামচে ধরে প্রায় দাঁড় করিয়ে দিল তাকে।

ওদিকে স্ট্র্যাপ দিয়ে গার্নিতে বেঁধে রাখা হয়েছে মিনতিকে। রানার প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পেছনের দেয়ালে পিঠ দিয়ে পড়ল এমসন। সে সামলে নেয়ার আগেই সামনে বেড়ে হাঁটু তুলে বেদম  গুঁতো দিল রানা তার পেটে। পরক্ষণে ওর কপাল নামল এমসনের নাকের ওপর। চুরচুর হলো হাড়, তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠল লোকটা। মাথার পেছন দিক ঠুকে গেছে দেয়ালে। এখনও হাত থেকে ফেলেনি রাইফেল। ওটা ঘুরিয়েই গুলি করতে চাইল রানাকে।

কিন্তু ডানহাতে তার ঘাড় পেঁচিয়ে ধরেছে রানা, বামহাতে কেড়ে নিতে চাইল রাইফেল।

বিপদ বুঝে ট্রিগার টিপে দিয়েছে এমসন। ম্যাগাযিন থেকে অন্তত বারোটা গুলি বেরিয়ে গেল রানার পাশ দিয়ে। পরের সেকেণ্ডে আরেক পশলা গুলি খালি করল অস্ত্রটা।

কাল্টের নেতার চেলা লুকিয়ে পড়েছে একটু দূরের দেয়ালের কোণে।

রানা টের পেল, আগুনের মত উত্তপ্ত নল ধরেছে বলে পুড়ছে ওর হাতের তালু। হ্যাঁচকা টানে রাইফেল কেড়ে নিল ও, পরক্ষণে কুঁদোটা নামিয়ে দিল এমসনের মুখের ওপর। হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে প্রাক্তন সিআইএ ডেপুটি চিফ, কিন্তু সামনে বেড়ে গলা টিপে ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখল রানা। বামহাতের পুরো শক্তি ব্যবহার করে ঘুষি বসাল লোকটার চোয়ালে।

ভীষণ ঝাঁকি খেল এমসন, ধরে রাখা হয়নি বলেই ধড়াস করে পড়ল সে। মেঝেতে স্রোতের মত বইছে তার নাকের রক্ত।

তখনই পেছন থেকে এসে চোক হোল্ডে রানার গলা পেঁচিয়ে ধরল মার্ডক। অন্য হাতে রানার মুখে বসাতে চাইল ঘুষি।

ঝট্ করে বামে ঘুরল রানা, পিছনের লোকটার কনুইয়ের দিকে। চাপ কমল গলার ওপর। এবার দুই হাতে তার দুটো আঙুল ধরে মড়াৎ করে ভেঙে দিল। ‘আউহ্!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, কিন্তু রানার গলা থেকে হাত সরাল না। পায়ে পা বাধিয়ে ওকে পিছনে আছড়ে ফেলতে গেল রানা, কিন্তু তার দরকার পড়ল না। গণ্ডারের মত লোকটার মাথায় কী যেন নামাল মোনা।

খটাং আওয়াজ হলো হাতুড়ির। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা, কিন্তু তখনই কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তল নিয়েই গুলি চালাল সে মোনাকে লক্ষ্য করে।

পেট ধরে পেছনের দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোনা, ওখান থেকে মেঝেতে। দু’হাতে চেপে ধরেছে রক্তাক্ত ক্ষত।

ওই একই সময়ে ল্যাবের মাঝখান থেকে এল গুলি।

এলেনা!

ওর গুলি বিঁধল এইমাত্র উঠে বসা মার্ডকের গলায়। পেছনের দেয়ালে ছিটকে লাগল রক্ত। চিত হলো লোকটা, আর নড়ছে না।

এদিকে উঠে মিনতির কাছে পৌঁছে গেছে এমসন, তাকে তাড়া করল এলেনার দুটো বুলেট। কিন্তু সরে গিয়ে মিনতির পেছনে লুকিয়ে পড়েছে লোকটা। ডানহাতে ধরেছে অসুস্থ মেয়েটার আইভি লাইনের ইঞ্জেকটর,

ইঞ্জেকটর, বামহাত ওয়াই কানেকশনে। টুথপেস্টের মত বড় দুই টিউব আসলে সিরিঞ্জ, ওপরে বুড়ো আঙুল রাখার মত প্লাঞ্জার। একটা লাল, অন্যটা সাদা।

‘আমাকে চিনেছ, মিস রবার্টসন?’ কর্কশ হাসল এমসন। ‘এবার মরবে তোমরা। গুলি করলে ডাবিয়ে দেব প্লাঞ্জার।’

অসহায় বাচ্চা মেয়েটাকে বর্মের মত ব্যবহার করছে কাপুরুষ লোকটা।

মেঝেতে পড়ে আছে মোনা। শার্টের পেট ভেসে যাচ্ছে রক্তে। মাত্র কয়েক ফুট দূরেই এমসন।

একবার মোনার পাশে পৌঁছুলে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব, ভাবল রানা। পায়ে পায়ে রওনা হয়ে গেল ওদিকে।

মোনার চোখে-মুখে তীব্র ব্যথার ছাপ।

এমসন লুকিয়ে আছে মিনতির আড়ালে।

রাইফেল তাক করে চাপা স্বরে বলল এলেনা, ‘কী চাও, এমসন? এসব করছ কেন?’

‘সবসময় রাজা হতে চেয়েছি,’ ফাঁকা হাসল এমসন। ‘তা যখন পারিনি, ঠিক করেছি পুরো দুনিয়ার মানুষ দয়া প্রার্থনা করুক আমার কাছে। হাজার বিলিয়ন ডলার দিতে হবে আমাকে।’

‘তো এসব করছ কেন? ভাইরাস নিয়ে চলে গেলেই…’

‘একটু আগে পৌঁছে গেছ.’ এলেনাকে বলল এমসন, ‘অবশ্য অপেক্ষা করে বুঝিয়ে দিতাম, তোমরা হেরে গেছ।’ মাথার ইশারায় রানাকে দেখাল। ‘ওকে শেষ না করে স্বস্তি নেই আমার।’

‘বদ্ধ-উন্মাদ তুমি,’ বলল এলেনা।

গরম তেলে মশলামাখা পটোল পড়ার মত ছ্যাঁৎ করে উঠল এমসন। ‘জানো, এই হারামজাদার জন্যে শেষ হয়ে গেছে আমার ক্যারিয়ার? একদল এজেন্ট কুকুরের মত তাড়া করছে আমাকে! আমেরিকা থেকে বেরিয়ে কয়েকবার খুন করতে চেয়েছি বাঙালি কুত্তাটাকে, কিন্তু প্রতিবার কপালজোরে বেঁচে গেছে। এবার সেই সুযোগ নেই! সুযোগ নেই এই দুনিয়ারও! মাফ নেই কারও!’

‘তাই বলে নিজের লোকও মেরে ফেললে?’ টিটকারির সুরে বলল রানা। ইঞ্চি ইঞ্চি করে গার্নির দিকে এগোচ্ছে।

দাঁতে দাঁত পিষে রানাকে দেখল লোকটা। ‘ওদেরকে আর দরকার নেই। কখনও বাড়তি লোক রাখি না।’

‘তার মানে কাল্ট, হুমকি— সব ভুয়া?’ জানতে চাইল রানা। বুঝতে পারছে, অত্যন্ত চতুর এই লোক নাকের কাছে মুলো ধরে ওকে এনেছে এই জাহাজে মনের সুখে খুন করবে বলে। তার হাতে রেযাল্ট ৯৫২ আর জীবন-বৃক্ষের ফলের বীজ। মরণ ভাইরাস ব্যবহার করলে মরবে হাজার কোটি মানুষ, বা জীবন- বৃক্ষের বীজ থেকে নেয়া ভাইরাস দিয়ে বাড়িয়ে দেবে আয়ু। যা খুশি করবে সে। ফলাফল ভয়ঙ্কর। কিন্তু এমসন সব গুছিয়ে নেয়ার আগেই পৌঁছে গেছে ওরা। এখন পালাতে পারবে না লোকটা। আর বড়জোর দশ মিনিট পর উড়ে যাবে এই দ্বীপ

‘তুমি না নতুন ধর্ম তৈরি করছিলে?’ জানতে চাইল রানা।

‘ধর্ম বোকাদের জন্যে,’ বলল এমসন, ‘মন থেকে স্রষ্টাকে বিদায় করলে সে-জায়গায় আর কাউকে রাখতে হবে, গাধাগুলোর জন্যে সে ব্যবস্থা রেখেছিলাম।’ এমনভাবে সিরিঞ্জ ধরেছে, যেন ভাল করে দেখতে পায় রানা ও এলেনা। ‘এবার দুই পথের মে কোনওটা বেছে নিবি তোরা। লাল প্লাঞ্জার টিপলে মরবে এই মেয়েটা।’

রানা তিলতিল করে সরছে লোকটার দিকে। গুলি করার জন্যে চাই ভাল অ্যাংগেল। দেখল গার্নির ওপর নড়ে উঠল মিনতি, ভাঙছে ঘুম।

‘তোমার মিসাইল নষ্ট করে দিয়েছি আমি,’ বলল এলেনা।

‘মিসাইল নষ্ট হলেও সমস্যা নেই,’ বলল এমসন, ‘একটা মাত্র অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না ভাল সেনাপতি। মিসাইল হলে চট্ করে ছড়িয়ে যেত ভাইরাস। আরও রাস্তা আছে। এখনও ছড়িয়ে পড়বে, তবে ধীরে। ফলাফল একই।

ঝড়ের বেগে ভাবছে রানা। অন্য উপায়ে ভাইরাস ছিটারে। এমসনের দিকের দেয়ালে চোখ পড়ল ওর। ওখানে ঝুলছে তরল ভরা কয়েকটা বিকার, সঙ্গে ইলেকট্রিকাল পাম্প ও সরু পাইপ। পাইপ গেছে ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও।

হঠাৎ করেই রানার মনে পড়ল পানকৌড়ি পাখি আর ড্রিপ লাইনের কথা। নিচু স্বরে বলল, ‘পাখি!’

মিনতির পেছনে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমসন, খলখল করে হাসল। ‘তুই সত্যিই চালাক মানুষ, মাসুদ রানা। ছয় মাস ধরে ওসব পাখিকে চিনি দেয়া মাছের ঝোল খাইয়েছি। ট্রেনিং শেষ। এবার পাম্প চালু করলেই টিউব থেকে যাবে ভাইরাস ভরা  খাবার। পাখিগুলো খুব ভাল ক্যারিয়ার। প্রথম কয়েক দিনে কাতার, দুবাই, কুয়েত জুড়ে শুরু হবে মহামারী। ওরা বলবে বার্ড ফ্লু।’

বিকারগুলো দু’ধরনের, খেয়াল করেছে রানা। মৃত্যুর জন্যে লাল দাগ। দীর্ঘ জীবন দেবে সাদা।

খুব ধীরে বিকারের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে রনি এমসন।

‘নড়বে না!’ ধমক দিল এলেনা। তাক করেছে রাইফেল।

হাসল সিআইএর প্রাক্তন ডেপুটি চিফ। ‘সাহস হবে না যে গুলি করবে, নইলে এখনই মরবে ছোট মেয়েটা।’

ঘুম ভেঙে গেছে মিনতির। চোখ খুলেই দেখল ঘরের আরেক পাশে রক্তের পুকুরে পড়ে আছে ওর বোন। ‘মোনা আপু! মিনা ফুফু কই?’ ঘুমের ওষুধের কারণে মাথা কাজ করছে না ওর। তার ওপর চোখে চশমা নেই।

রানা বুঝে গেল, পুরো সচেতন নয় মেয়েটা।

হাঁ করল মোনা, কিছুই বলতে পারল না। তীব্র ব্যথায় বিকৃত হলো চোখ-মুখ। শুয়ে আছে নিজ রক্তের ভেতর। কয়েক সেকেণ্ড পর ফিসফিস করল, ‘রানা, সরি।’ প্রায় শোনাই গেল না ওর কণ্ঠ।

ইঞ্চি ইঞ্চি করে বিকার ও পাম্পের দিকে চলেছে রনি এমসন প্লাঞ্জার হাতে নিয়ে। ল্যাবের মাঝ থেকে তাকে গুলি করে ফেলতে পারবে না এলেনা। চট্ করে একবার হাতঘড়ি দেখল রানা। বড়জোর সাত মিনিট, তারপর টমাহক মিসাইলের আঘাতে ছাই হবে ওরা।

ডানহাত তুলল মোনা। মনে হলো অন্ধ। খুঁজছে রানাকে। ফিসফিস করে বাংলায় বলল, ‘রানা, আমি বদলে দিয়েছি।’

মোনার দুর্বল কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে রানা। ‘কী বদলে দিয়েছ?’

‘লাল… মানেই জীবন। মিনতি সুস্থ হবে, কিন্তু… শত শত বছর… বাঁচবে না। শরীরের বাইরে… বাঁচবে না ওই ভাইরাস। চোখ বুজে পড়ে থাকল মোনা।

একইসময়ে শোল্ডার হোলস্টার থেকে ঝটকা দিয়ে ওয়ালথার বের করেই গুলি করল রানা। লাল প্লাঞ্জার থেকে সরে গেছে এমসনের আঙুল। নিখুঁত একটা গোল গর্ত তৈরি হয়েছে তার মাঝ বুকে। রানার দ্বিতীয় গুলি ছিঁড়ে দিয়েছে মিনতির বাহু থেকে আট ইঞ্চি ওপরের আইভি।

অবিশ্বাস্য লক্ষ্যভেদ! এমসন প্লাঞ্জারে চাপ দিলেও বাচ্চা মেয়েটার দেহে এখন ঢুকবে না ভাইরাস।

গুলিবিদ্ধ এমসনও বুঝেছে, বড্ড দেরি করে ফেলেছে। আহত শরীরে পাম্প সুইচের দিকে ঝাঁপ দিল সে।

কিন্তু ঝড়ের বেগে সামনে বেড়ে গার্নিতে ধাক্কা দিল রানা। ওটাকে ঠেলে চাপিয়ে দিল নিষ্ঠুর পিশাচটার ওপর। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বেকায়দাভাবে আটকা পড়ল লোকটা। হাত বাড়িয়ে দিল সুইচের দিকে। কিন্তু বুকে ভীষণ দুটো ঝাঁকি লাগতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল গার্নির ওপর। এলেনার রাইফেলের গুলি নতুন দুটো গর্ত করল তার বুকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গার্নি। পেছনের দেয়ালে ছোপ ছোপ লাল দাগ।

গার্নি পিছিয়ে নিল রানা। এক সেকেণ্ড পর ধুপ্ করে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল রনি এমসন।

দুই সিরিঞ্জ দেখল রানা, চেপে দেয়া হয়নি প্লাঞ্জার।

আরেকবার ঘড়ি দেখল ও।

সাড়ে পাঁচ মিনিট পর আসছে মিসাইল!

‘চলো, বেরিয়ে যেতে হবে!’ তাড়া দিল রানা। দ্রুত হাতে

খুলছে মিনতিকে আটকে রাখা স্ট্র্যাপ।

‘আমি ওকে নিচ্ছি,’ রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে সামনে বাড়ল এলেনা, বুকে তুলে নিল বাচ্চা মেয়েটাকে।

মোনার পাশে বসল রানা। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা, মুখে প্রশান্তি। কবজি ধরে পাল্স্ খুঁজল ও, নেই। মুঠো করা হাতে কী যেন।

মোনার ওই মুঠো খুলল রানা। হাতে একটা সিরিঞ্জ। স্ট্রিপে লেখা: লাল। মিনতির জীবনের জন্যে।

তরল ভরা সিরিঞ্জটা বুক পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল রানা। আগেই মিনতিকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে এলেনা।

এক দৌড়ে বেরিয়ে এসে ঝড়ের গতি তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। মাত্র আধ মিনিটে উঠে এল ওপরের ডেকে। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে এলেনা।

রানা হাত বাড়িয়ে নিল মিনতিকে।

পরস্পরকে দেখল এলেনা ও রানা, তারপর জাহাজের রেলিং টপকে ঝাঁপ দিল সাগরে।

খুব কাছেই থাকবে গ্রাহাম। ওদেরকে বোটে তুলে নিয়ে ফুল স্পিডে সরে যাবে।

.

ল্যাবোরেটরির ভেতর জ্ঞান ফিরল রনি এমসনের। ভয়ঙ্কর ব্যথায় মুচড়ে উঠল তার শরীর। কাত হয়ে দেখল, মেঝেতে শুয়ে আছে নিজের রক্তের ভেতর। গার্নির পায়া ধরে দাঁড়াতে চাইল, পারল না। হাঁটুর ওপর ভর করে এগোতে লাগল। বুঝতে পারছে, বাঁচার উপায় নেই। ঘৃণা চালিত করছে তাকে। না, বাঁচতে দেবে না কাউকে! ধ্বংস হোক পৃথিবী! ঘৃণা করে সে সবাইকে!

বিকারগুলোর সামনে পৌঁছে ছোট একটা টেবিলে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। টিপে দেবে পাম্পের সুইচ। এতই ব্যথা, যেন ভেঙে পড়ছে বুক। যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল একবার। ঝটকা দিয়ে অন করল লাল সুইচ, পরক্ষণে চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। শুনল, গুনগুন আওয়াজে চালু হয়েছে পাম্প। গুড! ভাইরাল সাসপেনশন চলেছে ড্রিপ লাইনের মাঝ দিয়ে।

বুজে আসছে এমসনের চোখ, জোর করে মেলে রাখল, প্রতিটি বিকার থেকে কমছে তরল। যাক, মরে গেলেও পৃথিবী জুড়ে তৈরি করেছে সত্যিকারের নরক!

তীব্র ব্যথা সহ্য করে চুপ করে মেঝেতে পড়ে থাকল মৃতপ্রায় নরপিশাচ!

.

ডানহাতে রেখেছে মিনতিকে, বামহাতে ডুব সাঁতার কেটে উঠতে চাইছে রানা সাগর সমতলে। পানিতে ভিজে ভীষণ ভারী হয়েছে বডি আর্মার, মনে হচ্ছে তলিয়ে যাবে।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর ভুস করে ভেসে উঠল রানা। কানের কাছে শুনল গ্রাহামের কণ্ঠ: ‘বড় মাছ ধরেছি!’

টেনে তোলা হচ্ছে রানাকে।

বাধা দিয়ে আগে মিনতিকে বোটে তুলে দিল রানা, তারপর উঠে পড়ল সরু ডেকে। আগেই থ্রটলের সামনে বসে পড়েছে এলেনা। মস্ত এক লাফে দক্ষিণের সাগরের দিকে ছুটল পাওয়ার বোট।

চুপ করে শুয়ে আছে রানা, প্রায় বিধ্বস্ত। ফুরিয়ে গেছে দম। চোখ রেখেছে কালো আকাশে। মাথার অনেক ওপরে ঘুরছে বেশ কিছু পানকৌড়ি। হঠাৎই সবগুলো নামতে লাগল দ্বীপের দিকে।

সর্বনাশ! ভাবল রানা, এ হতে পারে না! ড্রিপ লাইন থেকে ভাইরাস ভরা খাবার পাবে, তাই খুব খুশি উড়ন্ত পানকৌড়ির দল!

দ্বীপ পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে দ্রুতগামী বোট। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর দক্ষিণ থেকে হুইসলের মত শব্দ তুলে দ্বীপের আকাশে হাজির হলো মিসাইল— প্রথম দুটোর পর এল আরও দুই টমাহক। এরপর এল নানান দিক থেকে।

.

গামলার মত পাত্রে পড়ছে খাবার। ধাক্কাধাক্কি করে কালো রঙের ড্রিপ লাইনের সামনে হাজির হয়েছে পাখিগুলো। নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কর্কশ আওয়াজ তুলছে ওরা। ঠোকর দিচ্ছে একে অপরকে।

কিন্তু হঠাৎ করেই মুখ তুলে দক্ষিণ আকাশ দেখল ওরা। অদ্ভুত এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ আসছে তাদের দিকে। মাত্র এক সেকেণ্ড পর বজ্রের মত পাথুরে দ্বীপে নামল সাক্ষাৎ মৃত্যু! হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস আগুনের তাপে মুহূর্তে ছাই হলো সব পাখি।

পাওয়ার বোটের ডেকে উঠে বসল রানা। এক মাইল দূরের দ্বীপে পড়ছে একের পর এক টমাহক মিসাইল। বিস্ফোরণের আওয়াজে মনে হলো বধির হয়ে যাবে ওরা। জ্বলন্ত সব পাথরের মস্ত সব টুকরো লাফিয়ে উঠে গেল আকাশের অনেক ওপরে। নিচে পড়তে লাগল আগুন ভরা উল্কার মত।

চোখের সামনে দেখল রানা, একই সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো তিনটে মিসাইল। যেন লাফ দিল আস্ত দ্বীপ। ওটাকে ঘিরে ফেলল ব্যাঙের ছাতার মত আগুনের এক প্রকাণ্ড কমলা বল। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর হয়ে উঠল কালচে মেঘের মত।

পিচ্চি মিনতিকে কোলে রেখেছে গ্রাহাম।

এখনও পুরো সচেতন নয় মেয়েটা। অবাক সুরে বলল, ‘আপু? আপু কোথায়?’

বুকের ভেতর তীব্র কষ্ট টের পেল রানা। চুপ করে চেয়ে রইল বিধ্বস্ত দ্বীপের দিকে। আরও কয়েকটা টমাহক মিসাইল পড়ল ওখানে। নতুন করে আবারও লাফ দিল দ্বীপ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ সরিয়ে ফেলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *