মৃত্যুঘণ্টা – ৩৯

ঊনচল্লিশ

ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে এল পরিশ্রান্ত এলেনা। আরব তরুণকে পালা করে চার ঘণ্টা করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে রানা আর ও। এবার আবারও রানার পালা। এদিকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে জন গ্রাহাম। তাকে দায়িত্ব দিয়েছে রানা, পরিচিতদের কাছ থেকে জরুরি তথ্য জোগাড় করতে। এমন কোনও খবর, যেটা এখনও জানে না বিসিআই বা এনআরআই।

মুখ খোলাবার জন্যে বন্দির মাথার একটু ওপরে শক্তিশালী, জ্বলন্ত বা রেখেছে ওরা। দু’হাত পেছনে বেঁধে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে তরুণকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। তার ফাঁকে কামানের গোলার মত ছোঁড়া হচ্ছে নতুন সব প্রশ্ন। রানা বা এলেনা যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে না, বন্দির কানে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে ভারী হেডফোন। তুমুল জোরে চলছে পশ্চিমা রক মিউয়িক। কিন্তু এত চেষ্টা করেও তরুণের মুখ থেকে বের করা যায়নি নতুন কোনও তথ্য। শুধু বারবার বলেছে একটাই নাম: মাউক। সে কাল্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা।

ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে দরজা না ভিড়িয়ে, তরুণকে দেখা যাবে এমন এক জায়গায় চেয়ারে বসল এলেনা। যে কাল্টের সঙ্গে জড়িত, সুযোগ পেলে আত্মহত্যা করবে এই ছেলে। হাত-পা বেঁধে রেখেও উচিত হবে না ঝুঁকি নেয়া।

এলেনার জিজ্ঞাসাবাদের সময় কথা ছিল ঘুমিয়ে নেবে রানা। কিন্তু এদিকের ঘরে এসে এলেনা দেখেছে, কিচেন টেবিলের ওপর ওয়ালথার পি.পি.কে. পিস্তল রেখে চুপ করে বসে আছে রানা। এইমাত্র তুলে নিয়ে পিস্তলে ম্যাগাযিন ভরল। স্লাইড টেনে কক করল অস্ত্র। থমথম করছে বাঙালি গুপ্তচরের মুখ।

‘আর দেরি করব না, টর্চার না করে উপায় নেই,’ এলেনাকে বলল রানা।

পেরিয়ে গেছে পুরো ষোলো ঘণ্টা। কোনও কাজে আসেনি চার দফা জিজ্ঞাসাবাদ। পারতপক্ষে এলেনার সঙ্গে কথা বলছে না রানা। নিজেও ঘুমাতে যায়নি, ঘুমাতেও দেয়নি আরব বন্দিকে নিজে দু’দফা ঘুমিয়ে নিয়েছে এলেনা। তবে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ভয় লাগছিল, যখন-তখন নির্যাতন করবে রানা ওই ছেলেকে।

এরপর কী করবে, তা নিয়ে আলাপ করেছে ওরা। শেষবার আলাপের পর থেকে প্রায় নীরব হয়ে গেছে বিসিআই এজেন্ট।

‘আমি তো আর তোমার শত্রু নই,’ বলল এলেনা।

মুখ তুলে ওকে দেখল রানা। ‘তা জানি।’ আরেকবার দেখে নিল ওয়ালথার।

একাকী বোধ করছে রানা, ভাবল এলেনা। মস্ত ঝুঁকি নিয়ে যে-মেয়েকে উদ্ধার করল, সে-ই করেছে চরম বিশ্বাসঘাতকতা।

‘ফ্রেঞ্চ পুলিশ-অফিসারের কাছে মেসেজ দিয়েছিলে,’ বলল এলেনা।

‘ও, তার মানে আমার ফোনে আড়ি পেতেছে এনআরআই?’

‘এনআরআই চিফের উপায় ছিল না।’

বিরক্ত হলো রানা। ‘জানতে চেয়েছি, কী ক্যালিবারের বুলেট ব্যবহার হয়েছে রুই দে জাখদান্সে। পুলিশ অফিসার বলেছিল, ছোট ক্যালিবারের। হতে পারে .২৫ বুলেট।’

‘তাতে কী?’

‘পার্শিয়ান উপসাগরে মিনা মোবারকের কেবিন ক্রুয়ারে মোনা বলেছিল, যেদিন কিডন্যাপ হলেন ওর বাবা, সেদিন ও প্যারিসেই ছিল। বাবাকে খুঁজছিল। কিন্তু তা না-ও হতে পারে।’

অবাক হয়ে রানাকে দেখল এলেনা। ‘ভাবছ, ওই কাল্টের সঙ্গে মোনা জড়িত?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘কে জানে? হয়তো আইফেল টাওয়ারে যে চারজন পুলিশের ডিউটি ছিল তাদের খুন করার জন্যে এই পিস্তলটাই ব্যবহার করা হয়েছিল। তোমার মনে নেই, থানা থেকে কী বলেছিল? খুব ছোট ক্যালিবারের পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছিল ওদের।’

‘কিন্তু…’

‘বাপ-মেয়ের ঝগড়া চলছিল,’ বলল রানা। ‘মোনা বলেছিল, ওই কাল্টের লোকগুলোকে পথ দেখিয়ে ও-ই নেয় ওর বাবার কাছে। এসব করেছিল মিনতিকে সুস্থ করতে। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হবে ভেবেই হয়তো ভাইরাস বা রেযাল্ট ৯৫২ দিতে আপত্তি তোলেন ডক্টর মোবারক। তাঁর মেসেজে লিখেছিলেন: ভুলেও কাউকে বিশ্বাস করবেন না।

‘কিন্তু দুবাইয়ে মোনার ওপর ওই হামলা, ওটা তো সেক্ষেত্রে মিলছে না,’ বলল এলেনা।

ইন্টারনেট বাটন টিপে টেবিলের ওদিকে মোবাইল ফোন ঠেলে দিল রানা। ঝুঁকে ডিসপ্লে স্ক্রিন দেখল এলেনা।

ড্রাগস্ কর্পোরেশনের এমডি খুন হয়ে গেছেন। তাঁর খুনের সঙ্গে দুবাইয়ের গোলাগুলির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে কর্তৃপক্ষ।

পোড়া এক গাড়ির ছবি দেখল এলেনা। ইনসেটে এমডির হাসিমুখ। ওই ছবি এসেছে মুর কর্পোরেশনের ফাইল থেকে।

‘তো কী বুঝব?’ বলল এলেনা, ‘মোনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল ওই লোক। আর তাই তাকে মেরে ফেলেছে কাল্ট?’

‘দুবাইয়ের লোকগুলো স্থানীয় ছিল না, ইকুইপমেন্ট অনেক আধুনিক, এসেছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলারের হেলিকপ্টারে করে,‘ মন্তব্য করল রানা।

‘কামান ছিল না বটে, কিন্তু আউমেরও হেলিকপ্টার ছিল ‘ বলল এলেনা, ‘রাশান গানশিপ। কাল্টের লোক বড়লোকও হতে পারে।’

‘ফ্রান্সের কথা মনে আছে? লোকগুলোর একজনের কাছে ছিল ছোরা। আর দুবাইয়ের ওদের কাছে অটোমেটিক অস্ত্র।’

পোড়া গাড়ি দেখা শেষ, ওকে ফোন ফিরিয়ে দিল এলেনা। ‘আমাদের কাছে মাটির ট্যাবলেটের পঁচাত্তর ভাগ রয়ে গেছে,’ বলল রানা। ‘আমাদের অংশে সোনার বল পেয়েছ?’

দু’টুকরো শুকিয়ে যাওয়া মাটি আবারও দেখল এলেনা।

ডানের ঢেলায় গোলাকার একটা অংশ। একসময় কিছু ছিল ওখানে। ওর মনে পড়ল মোনার কথা: ‘এতই দামি ছিল, সরিয়ে ফেলে মোম দিয়ে মুড়িয়ে সোনার বলের ভেতর রাখত।’ এলেনার অন্তর বলল, মাটির ট্যাবলেটের আসল অংশ সরিয়ে ফেলেছিল মোনা। মুখে বলল, ‘তাড়া ছিল বলে চট্ করে একটা টুকরো তুলে নেয় মেয়েটা।’

‘প্রথম সুযোগ নিয়েছে,’ বলল রানা, ‘পরে আমরা দু’জন।‘

‘তাতে প্রমাণ হবে না যে জেনেবুঝে সরিয়ে নিয়েছে।

‘তর্ক করে লাভ কী, আসল কথা ওটা এখন ওর কাছে,’ বলল রানা, ‘মাটির ট্যাবলেট ভালভাবেই দেখার সুযোগ পেয়েছিল।’

এলেনার মনে পড়ল, ট্যাবলেট ভাঙার পর এক মুহূর্ত অবাক হয়ে ভাঙা তিন টুকরোর একটি দেখেছিল মোনা। ‘অন্ধকারে অত বুঝতে পারার কথা নয় মেয়েটার,’ বলল এলেনা।

‘এটিভির দিকে যাওয়ার সময় ধীর পায়ে হেঁটেছে,’ বলল রানা, ‘মরুভূমিতে ওঠার পর পা দিয়ে ফেলে দিয়েছে খাদের নিচে নুড়ি পাথরের স্তূপ।’

এলেনার মনে হলো, ঘুমের অভাবে রেগে গিয়ে এসব বলছে রানা। অবশ্য, চুপ করে থাকল ও।

‘আমি ওকে বিশ্বাস করেছিলাম,’ তিক্ত সুরে বলল রানা। ‘ফ্রেঞ্চ পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী বুলেট .২৫ হলেও প্রমাণ হবে না যে মোনাই খুন করেছে,’ বলল এলেনা।

আনমনে এক এক করে ওয়ালথারের ম্যাগাযিন খালি করেছে রানা, আবারও ক্লিপে বুলেট ভরল। সরাসরি ওর চোখ স্থির হলো এলেনার চোখে। ‘বুঝতে পারছ কী করতে হবে? ওই আরব তরুণের কাছ থেকে বের করতে হবে, মোনা এখন কোথায় এবং কী করছে। সে আছে এখন ওই কাল্টের সঙ্গেই।’

‘ওই মেয়ে এখনও ভালবাসে তোমাকে,’ বলল এলেনা, ‘তুমি নিজেও জীবনের ঝুঁকি নিতে দেরি করোনি।’

‘ও জানত, ওকে ভুলেও গুলি করবে না কাল্টের লোক,’ বলল রানা। আলোকিত হয়ে উঠেছে ওর মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। কল নয়, টেক্সট্ মেসেজ।

‘ফ্রেঞ্চ পুলিশ অফিসার?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘হুঁ।’ মেসেজ পড়ল রানা। আরও গম্ভীর হয়ে গেল। ‘.২২ ক্যালিবারের। খুন করেনি মোনা। তার মানে, চাপের মুখে কাল্টের হাতে নিজেকে তুলে দিয়েছে।’ পাশের ঘরের দরজা দেখাল রানা।

ওই ছোকরা জানে কোথায় আছে মোনা!’

এলেনা কিছু বলার আগেই পিস্তল তুলে নিল রানা, চেয়ার ছেড়ে চলল ইন্টারোগেশন রুমে।

এতক্ষণ সরাসরি রানাকে দেখতে পেয়েছে চেয়ারে বসা আরব তরুণ। বাঙালি যুবকের অগ্নিদৃষ্টি ভীষণ আতঙ্কিত করল তাকে। হয়তো এভাবেই মরণ হাতে এগিয়ে আসে যম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *