মৃত্যুঘণ্টা – ৩২

বত্রিশ

একতলা, গোলাকার ছোট্ট বাড়িটার উঠানে চেয়ারে বসে আছে রানা। চারদিকে নানান জাতের ফল ও ফুলের বাগান। বারো কাঠা জমি নিয়ে বিসিআই-এর সেফ হাউস। চারপাশে উঁচু দেয়াল, ইলেকট্রিফায়েড। চারদিকে চোখ রাখছে গোপন ক্যামেরা। গত কয়েক মাস ধরে এখানে বাস করছে রেসিডেন্ট এজেণ্ট আফরোজ আলী ও তার স্ত্রী নিনা আলী। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের নির্দেশে মিনা মোবারক, মিনতি ও মোনাকে নিয়ে এখানেই উঠেছে রানা।

ধূসর হয়ে এসেছে বিকেল। একটু পর নামবে সন্ধ্যা। 

আকাশের দিকে তাকাল রানা।

গতকাল পুরো রাত ও আজ দুপুর পর্যন্ত বোটে চেপে পারস্য উপসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে ওরা কুয়েতে। নামহীন এক ছোট্ট জেটিতে থেমেছে বোট। ওখান থেকে গাড়িতে করে ওদেরকে তুলে নিয়েছে আফরোজ, নিয়ে এসেছে এই বাড়িতে।

আশ্রয় পাওয়ার পর আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মোনা। গত দু’ঘণ্টা ধরে ফোনে আলাপ করেছে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে, বোঝাতে চাইছে দুবাইয়ে যা ঘটে গেছে, সেটা খুব বড় কিছু নয়। এসব সমস্যা কাটিয়ে বহু পথ হাঁটবে মার্ভেল ড্রাগ্‌স্‌ কর্পোরেশন, আবিষ্কার করবে অমৃতের মত ওষুধ। হ্যাঁ, আপাতত বাধ্য হয়ে ওকে সরে যেতে হয়েছে, কিন্তু কয়েক দিনের ভেতর নতুন করে গবেষণা এগিয়ে নেবে ও।

কিছুক্ষণ মোনার কথা শুনে উঠানে এসেছে রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, প্যারিসে যারা হামলা করেছিল বিজ্ঞানী বা ওদের ওপর, তাদের চেয়ে অনেক পেশাদার ছিল দুবাইয়ের ওই সন্ত্রাসী দল। স্থানীয় ছিল না, সবাই আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান লোক। অস্ত্রের অভাব ছিল না। নিয়ে এসেছিল চোরাই হেলিকপ্টার। সম্ভাবনা আছে যে ওই হামলা কান্টের নয়, অন্য কোনও দলের।

নানান প্রশ্ন জাগছে মনে, কিন্তু একটারও জবাব নেই রানার কাছে। ওদিকে কোনওদিকে এগোতে পারেনি এলেনাও। মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে: হারিয়ে ফেলেছি তামার লিপি।

ওর কাছে কিছু ফোটো ছিল ওটার, সেগুলো দিয়েছে প্রফেসর বার্ডম্যানের কাছে। তিনি খুঁজবেন ফোটোর ভেতর জরুরি তথ্য।

যেইমাত্র এলেনার কথা ভেবেছে রানা, এমন সময় টিং শব্দ তুলল ওর ফোন। মেসেজ দিয়েছে এলেনা। ওটা পড়ল রানা: ‘নতুন কিছু জানলে? বুঝতে পারলে হামলা করেছে কারা?’

না, নতুন কিছুই জানা নেই, ভাবল রানা। মনে হচ্ছে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে পাযলের অসংখ্য টুকরো। এসবই পাযলের কয়েকটা টুকরো, একটার সঙ্গে অন্যটা মেলে না। কোনও ছবি বা দৃশ্য তৈরি করা যাচ্ছে না।

মোনা ফোনে কথা শেষ করলে ওর সঙ্গে আলাপ করবে, ঠিক করেছে রানা। চেয়ার ছেড়ে আবারও বাড়িতে ঢুকতেই ডাইনিং রুমে দেখা হলো মিনা ফুফু ও মিনতির সঙ্গে।

টলমলে পায়ে ওর জন্যেই চা নিয়ে চলেছিল মিনতি, ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। পিচ্চি মেয়েটার হাত থেকে চা নিয়ে ধন্যবাদ দিল রানা। টেবিলে বসে নাস্তার সময়ে কিছুক্ষণ গল্প করল ওরা। তাতে রানা বুঝল, বাপের মতই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রাখে মিনতি।

সন্ধ্যার পর সেফ হাউসের লাইব্রেরিতে ঢুকল রানা। ছোট্ট টেবিলে দেখল পরিচিত একটা বই। ওটা পড়ছিল বোধহয় মোনা। দুবাই থেকে নিয়ে এসেছে।

প্যারাডাইস লস্ট বইটার মলাট উল্টে দেখল রানা। প্রথম পাতায় সই করেছেন ডক্টর আহসান মোবারক। কিছু পাতা দেখা হয়েছে অনেক বেশিবার। প্রায় ছিঁড়ে এসেছে। এসব পাতার প্রথমটা খুলল রানা। মহাকাব্যের একটা স্তবকের নিচে লাল কালিতে দাগ দেয়া। পড়ল

The first sort by their own suggestions fell,
Self-tempted, self-depraved.

শয়তানের পতন বিষয়ে লেখা। সে সময়ে স্রষ্টার বিরোধিতা করতে গিয়েছিল সে।

রানা ভাবল, যে-কোনও কারণেই হোক, নিজেকে শয়তানের মত পরিত্যক্ত বোধ করেছেন ডক্টর মোবারক।

একেবারেই বিশ্বাস করতেন না স্রষ্টা আছে, তা হলে বারবার কেন ভাবতেন ওই বিষয়ে? তাঁর ধারণা ছিল, পাল্টে দিতে পারবেন যে-কোনও প্রাণীর জীবন। তা-ই করতে গিয়ে পতন হয় তাঁর?

পাতা উল্টে আরেক জায়গায় লাল কালির দাগ দেখল রানা। ওই চরণ পড়তে শুরু করার আগেই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল:

“‘ The more I see pleasures about me,
So much more I feel torment within me.’”

ঘুরে তাকাল রানা।

দরজা পেরিয়ে থেমে গেছে মোনা। নিচু স্বরে বলল, ‘তুমি মিল্টনের ভক্ত?’

ডক্টর মোবারক আর তুমি এই কবির ভক্ত কি না, সেটা বড় কথা, ভাবল রানা। মৃদু মাথা নাড়ল। ‘একবার পড়তে চেয়েছি। এমন সব বিষয় মনে এল, বাধ্য হয়ে সরিয়ে রাখি বইটা।’

‘অদ্ভুত সাহিত্য,’ বলল মোনা, ‘কেন মানুষের এই বর্তমান অবস্থা, চমৎকার করে বর্ণনা দিয়েছেন মিল্টন।’

‘যে চরণ বললে, ওটার নিচে কালি দিয়ে দাগ দিয়েছ তুমি?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল মোনা। ‘বাবার দেয়া আণ্ডারলাইন। তবে এটাই আমার সেরা মনে হয়। বুঝতে পারোনি কী বলেছে?’

‘রূঢ় বাস্তবতার কঠিন কষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন,’ বলল রানা। ‘নিশ্চয়ই জানো, তোমার বাবা যাদের সঙ্গে মিশেছিলেন, তারাও মিল্টনের ভক্ত।’

‘জানি।’

একটু কঠোর শোনাল রানার কণ্ঠ: ‘আরও অনেক কিছুই জানো, যা বলবে না।’ হঠাৎ করেই অশ্রু জমল মোনার চোখে। ঘুরে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ডাকল রানা, ‘মোনা।’

থমকে গেছে মেয়েটা। গাল বেয়ে নামছে লবণ জল। হাত দিয়ে মুছে ফেলল। ‘কতটুকু পড়েছ প্যারাডাইস লস্ট, রানা?’

‘যথেষ্ট নয় যে পরীক্ষার খাতায় লিখে পাশ করব।’

‘জানো, কে আসলে ইউরিয়াল?’

মাথা নাড়ল রানা।

‘ইউরিয়াল ছিল স্রষ্টার সবচেয়ে প্রিয় ফেরেস্তা। সূর্যদেবতাও বলতে পারো। কিন্তু স্রষ্টা ইডেন বাগান তৈরি করলে একটু বেশিক্ষণ ওদিকে চেয়েছিল সে। কোনও ক্ষতি করতে চায়নি, কিন্তু ওই যে একটু বেশিক্ষণ দেখল, সেজন্যে ওই বাগান দেখে ফেলল শয়তান। আর সেজন্যেই শুরু হলো ওই কাহিনি।’

‘তার মানে, তুমিই নিয়ে গিয়েছিলে ডক্টর মোবারককে ওই লোকগুলোর কাছে?’ আন্দাজ করল রানা।

‘তার উল্টো,’ বলল মোনা, ‘তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবার কাছে।’

চমকে গেছে রানা।

‘কী করে, তা জানতে চাও?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোনা। ‘আমি মার্ভেল ড্রাগ্‌স্‌ কর্পোরেশনে যোগ দেয়ার আগে একদম অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। কোথাও চাকরি পেতেন না বাবা। আর তখনই এল এক লোক। সে আগ্রহী ছিল জেনেটিক বিষয়ে। অদ্ভুত এক লোক। টাকার অভাব ছিল না। বলেছিল, বিজ্ঞানীরা যেসব দিকে দেখছে না, তেমনই এক ‘জেনেটিক সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চায়। খুশি হয়ে উঠলাম। বললাম আমার বাবার কথা। খুব গর্বিত ছিলাম। জেনেটিকস নিয়ে গবেষণার কোনও উপায়ও ছিল না আমাদের। টাকা ছাড়া কিছুই করতে পারব না। যোগাযোগ করিয়ে দিলাম বাবার সঙ্গে তার। যখন বুঝলাম, মস্ত বিপদে পড়বেন, ততক্ষণে জালের ভেতর আটকা পড়ে গেছেন বাবা।’

‘ওদের দরকার বায়োলজিকাল অস্ত্র,’ বলল রানা, ‘কঙ্গোর  জেনারেলদের মতই।’

মাথা দোলাল মোনা। ‘আগের মতই, চাইলেও সরিয়ে নিতে পারলাম না বাবাকে। এবার বড় বেশি দেরি হয়ে গেল।’

অপরাধের কাঁটা বিধছে মেয়েটার বুকে, টের পেল রানা। নরম সুরে বলল, ‘বুঝতে পারছি, কত কষ্ট চেপে রেখেছ মনে। আর এসব করতে হয়েছে খুব জরুরি একটা কারণে।’

‘হ্যাঁ, ওষুধ আবিষ্কার করতে না পারলে মরে যাবে মিনতি,’ বলল মোনা, ‘ওটাই ভেবেছি তখন। এখন জানি, যেভাবে হোক খুঁজে বের করতে হবে ওই প্রাচীন বাগান। ওটার সেই গাছ বা বীজ না পেলে কিছুই সম্ভব নয়। তাই তোমার কাছে সাহায্য চাই, রানা।’

‘ব্যাপারটা আরও জটিল,’ বলল রানা। ‘ওই কাল্টের লোকও খুঁজছে ওই বাগান। ভয়ঙ্কর কিছু করতে চাইছে। বাহন ভাইরাস এখন তাদের হাতে। এরই ভেতর ইউএন অফিসে এক মহিলার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওটার ভেতর রসদ ছিল না। তোমার বাবা তাঁর ল্যাবে বোমা রেখে দিয়েছিলেন। ৯৫২ টেস্ট রেযাল্ট আর জীবাণু আনতে গিয়ে খুন হয়ে গেছে তাদের লোক। তার আগেই খুন করে ফেলেছে তোমার বাবাকে। ডক্টর ভাল করেই জানতেন, পৃথিবীর কী অবস্থা হবে ওরা জীবাণু ছড়িয়ে দিলে। নিজের জীবন দিলেন, আর নষ্ট করলেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

‘অনেকে বলবে, ওটাই বাবার সবচেয়ে খারাপ কাজ,’ বলল মোনা।

মেয়েটা আসলে কী বোঝাতে চাইছে, বুঝল না রানা।

‘আমার বাবা খুন হয়ে যাওয়ার পর, এখন যদি নিজ চোখে আমাকে দেখতে হয়, মরে গেল আমার বোন; তো বাঁচার কোনও কারণ খুঁজে পাব না। তার চেয়েও বড় কথা, মিনতির মত কোটি কোটি বাচ্চা যদি কষ্টে পড়ে, তার চেয়ে খারাপ আর কী হবে?’

‘অর্থাৎ, মিনতি সুস্থ হবে সেজন্যে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছিলে,’ বলল রানা।

‘এখন নিজেকে মনে হচ্ছে নরকের কীট,’ বলল মোনা, ‘আমার কি উচিত এরপরও বেঁচে থাকা? তবুও বেঁচে আছি শুধু একটা কারণে, যদি আবিষ্কার করতে পারি মিনতির জন্যে দরকারী ওষুধটা।’

বুক ভেঙে যাচ্ছে মেয়েটার, বুঝল রানা। দশ বছর বুকের কষ্ট নিয়ে ওষুধ খুঁজেছেন ডক্টর মোবারকও।

বিড়বিড় করল রানা: ‘The more I see pleasures about me, so much more I feel torment within me.’

ওর চোখে তাকাল মোনা। ‘৯৫২ রেযাল্ট নষ্ট করে দেননি বাবা। ওটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমার কাছে।’

‘আর সেটা জানে ওই কাল্ট, বা সন্দেহ করছে,’ বলল রানা।

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ মাথা দোলাল মোনা।

‘জরুরি কোনও কারণে তোমাকে তুলে নিতে চেয়েছিল, কাজেই নিরাপদ জায়গায় থাকতে হবে, বলল রানা। ‘কিন্তু এই কুয়েতও নিরাপদ নয়।’

‘তা ঠিক, ইউএন অফিসেও যখন হামলা করেছে,’ সায় দিল মোনা।

এখন পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি কীভাবে ভাইরাস ঢুকল ওই অফিসে। কাজটা এমন কারও, যে জানে সরকারি ব্যবস্থা। উন্মাদ একদল লোক এসব পারবে, তা অকল্পনীয়। রানার বাক্সে ওটা আরেক টুকরো পাযল।

‘ডক্টর মারা যাওয়ার পর উড়ে গেছে ল্যাব, কাজেই ৯৫২ টেস্ট নাগালে পেতে হলে একমাত্র উপায় তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া,’ বলল রানা। ‘এবার এমন কোথাও তোমাকে সরিয়ে  দিতে হবে, যেখানে হামলা করবে না তারা। নইলে হয়তো ওই ভাইরাস দিয়ে খুন করবে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ।’

ঢোক গিলল মোনা। ‘তা হলে একটা কাজ করতে পারো। খুন করে ফেলো আমাকে।’

‘তা সম্ভব নয়, অত বড় পশু আমি নই,’ বলল রানা। ‘কিন্তু যারা তোমার মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি চায়, তাদেরকে খুন করতে দেরি করব না।’

থমথম করছে রানার মুখ।

পাশের চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল মোনা। বুঝল রানা, কত বড় চাপ সহ্য করছে মেয়েটা। একবার ভেবেছিল, বিসিআই-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মোনাকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে। ততক্ষণ পাহারা দিতে হবে ওকে। হয়তো কয়েক মাস লাগবে ওই কাল্টের গোড়া উপড়ে ফেলতে। কিন্তু তত দিনে মরে যাবে মিনতি। ডক্টর মোবারক আর মোনার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।

‘তুমি জানো না,’ ফিসফিস করল মোনা, ‘ওদের টেস্ট ৯৫২ চাই না। দরকারই তো নেই! ওদের দরকার ওই বাগানের সেই গাছের ফল। বা জীবন-বৃক্ষের বীজ!’

অবাক হয়ে জানতে চাইল রানা, ‘ওটা দিয়ে কী করবে? জীবন-বৃক্ষের মাধ্যমে মানুষ খুন করবে কী করে?’

বিষণ্ণ চোখে ওকে দেখল মোনা। ‘ওরা ইবলিশ, রানা। ওরা খুন করবে না কাউকে। কিছুই ধ্বংস করবে না। ইডেন গার্ডেনে শয়তানও কিন্তু আদম বা হাওয়াকে খুন করেনি। চালাকি করেছে, ওই ফল খেলে যাতে ভবিষ্যতে মরতে হয় ওদেরকে।’

‘একটু খুলে বলো কী ভাবছ,’ বলল রানা।

মোনার দু’কাঁধে যেন চেপে বসেছে ভারী পাথর। অন্তত এক মিনিট ভেবে নিয়ে তারপর মুখ খুলল, ‘ভাইরাস দিয়ে দশ লাখ বা দু’ শ’ কোটি মানুষ খুন করেও পৃথিবী ধ্বংস করতে পারবে না

ওরা। তাতে হয়তো এক শ’ বছরের জন্যে বাধা পড়বে মানব- সভ্যতার উন্নতি। হয়তো উপকারই হবে এ গ্রহের। তা ছাড়া, যত রোগের বিরুদ্ধে লড়ছে বিজ্ঞানীরা, তাতে বেশি দিন লাগবে না ঠিক চিকিৎসা পন্থা আবিষ্কার করতে। আসলে থিয়োরেটিকালি কাউন্টার ভাইরাস তৈরি করতে পারব আমরা। বা জিন থেরাপি ব্যবহার করে মেরামত করতে পারব ডিএনএ। তখন কোনও কাজেই আসবে না প্লেগ। আর তাই এসব করবে না তারা।’

‘তা হলে কী করবে?’

‘ওরা চায় জীবন-বৃক্ষের ভেতরের ভাইরাসটা, ওটার সঙ্গে মিশিয়ে দেবে বাহক ভাইরাস; তারপর দুটোর মিশ্রণ ছড়িয়ে দেবে পুরো পৃথিবী জুড়ে।’

‘তার মানে রোগের ভয় নেই, আমরা হব প্রায় অমর, বিড়বিড় করল রানা, ‘তো ক্ষতি কোথায়? …কিন্তু জনসংখ্যা…’

‘প্রথমে ক্ষতি বুঝবে না কেউ,’ বলল মোনা, ‘কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে গেলে প্রথমে দ্বিগুণ হবে মানুষের আয়ু… বা চার-পাঁচ গুণ। তখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মৃত্যু হবে না। বড় হবে না তরুণ- তরুণী। এক শ’ বছর ধরে বাচ্চা নেবে। তার মানে, দু’দশকে জনসংখ্যা হবে বর্তমান পৃথিবীর কয়েক গুণ। মাত্র কয়েক বছরে মানুষের চাহিদার চাপে মৃত্যু হবে এই গ্রহের।’

এটাই ভাবতে শুরু করেছিল রানা। সমস্যার গভীর দিকটা বুঝে গলা শুকিয়ে গেছে ওর।

‘এখন আমরা সাত বিলিয়ন,’ বলল মোনা, ‘আগামী বিশ বছরে হব পনেরো বিলিয়ন। শতাব্দীর মাঝে পৌঁছে তিরিশ বিলিয়ন মানুষ থাকব। তার মানে, নিজেদের ভেতর যুদ্ধ ও কষ্ট ছাড়া কিছুই থাকবে না। না খেয়ে মরবে কোটি কোটি মানুষ। স্বর্গ আছে কি নেই, তা বড় কথা হবে না; এ পৃথিবীই হবে সবচেয়ে  ভয়ঙ্কর নরক। সেখানে প্রায় অমর হাজার হাজার কোটি মানুষ খিদের ভেতর বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। ক্ষুধার্ত কুকুরের মত কামড়া-কামড়ি করব সবাই। ধর্মের বোল উধাও হবে সবার মুখ থেকে।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘বিজ্ঞানীরাই অ্যান্টি-ডোট আবিষ্কার করবে,’ বলল মোনা। ‘কিন্তু কাকে দেবে আগে? কে বেছে নেবে মৃত্যু? মানুষ চাইবে না মরণ-ওষুধ দেহে নিতে। কে চাইবে পৃথিবীর জন্যে মরতে?’

‘প্রায় কেউ না,’ বিড়বিড় করল রানা।

‘কিন্তু ওই পিল খেলে কমবে আয়ু। ওটাকে কী বলবে সবাই? আত্মহত্যার পিল?’

রানার মনে পড়ল, এ বিষয়ে বলেছিলেন ডক্টর মোবারক। তখন তাঁকে মারতে উঠেছিল প্রায় সবাই। ওই ওষুধ দিতে গেলে সবাই বলবে, আমাকে না, অন্যকে দাও! আমি বাঁচতে চাই!

‘কী, রানা, ভেবেছ, কী হতে চলেছে সামনে?’ মাথা নাড়ল মোনা। ‘বেশ কয়েক বছর আগে বাবা প্রচার করেছিলেন, আমাদের উচিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে একসময়ে পৃথিবী হবে নরক। তখন তাঁকে ফ্যাসিস্ট বা ফ্যানাটিক বলেছিল সবাই। …তা হলে কি ভবিষ্যতে ওষুধ দিয়ে জন্ম ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হবে? লটারি হবে? শ্বেতাঙ্গরা মানবে? বা কৃষ্ণাঙ্গরা? বা আমরা? …কারা রাজি হবে বন্ধ্যা হতে? …তার মানে, যাদের জোর বেশি, তারা যা খুশি করবে। আবারও পৃথিবী জুড়ে হবে মহাযুদ্ধ। বরাবরের মতই সুযোগ-সুবিধা পাবে বড়লোকরা। সাধারণ মানুষ হবে বঞ্চিত। ভাল খাবার পাবে না, পাবে না সুপেয় পানি, মৃত্যু আসবে খুব কষ্ট দিয়ে। সামনে এসবই আসছে, রানা। এখনই ঠেকাতে না পারলে ওই কাল্ট পৃথিবীর বুকে তৈরি করবে নরক। মাফ পাবে না কেউ।’

রানার মনে পড়ল, ওর বন্ধু গ্রাহামকে বলেছিলেন ডক্টর মোবারক, ওরা আনফরগিভেবল।

এখন ও বুঝতে পারছে, কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।

‘ওই দৈত্য একবার বেরিয়ে গেলে, আর কখনও বোতলে ভরতে পারবে না কেউ,’ বলল মোনা, ‘এর চিকিৎসা নেই। দীর্ঘজীবন নিশ্চিত করে নরকের যাতনা দেয়া হবে।

‘এখন বুঝলাম, কতটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন ডক্টর,’ বলল রানা। ‘এত ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভেবেছ তোমরা, কিন্তু তখনও যেমন কিছু করার ছিল না, এখনও নেই। আমরা বড়জোর চেষ্টা করতে পারি, যাতে ঠেকানো যায় ওই কাল্টকে।

‘আমার বাবার মতই. আমিও চাই না আমার কারণে ধ্বংস হোক পৃথিবী,’ বলল মোনা। ‘কিন্তু হাল ছাড়ব না, অবশ্যই চেষ্টা করব মিনতিকে বাঁচাতে। যারা ওর মত রোগে আক্রান্ত, তাদের হাতে তুলে দিতে চাই ওই ওষুধ। অথচ, ওই একই ওষুধ দিয়ে শেষ করে দেবে পৃথিবী। অদ্ভুত এই জগৎ। এই কাল্ট শেষ করে দেবে স্রষ্টার সৃষ্টি, সত্যিই হারিয়ে যাবে প্যারাডাইস।’

ওই কাল্টের আছে ভয়ঙ্কর এক পিস্তল, এখন চাই শুধু বুলেট। গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা, ‘খুঁজে বের করতে হবে ওই বাগান। যদি থাকে, ওই কাল্টের আগেই পৌঁছুতে হবে ওখানে।’

আস্তে করে মাথা দোলাল মোনা!

ডক্টর মোবারক বা মোনা প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী, ওরা যদি মনে করে সত্যিই কোথাও আছে ওই বাগান, সেক্ষেত্রে ওটা খুঁজতে যাওয়াই ভাল। ‘দুই জায়গায় ফোন দেব,’ বলে লাইব্রেরির দরজা পেরিয়ে উঠানে বেরিয়ে এল রানা। ফোন করল বিসিআই চিফের ব্যক্তিগত ল্যাণ্ড ফোনে।

‘হ্যালো, রানা।’

ওদিক থেকে গম্ভীর কণ্ঠ শুনে হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ‘স্যর,  সব এখনও পরিষ্কার নয়।’ পারস্য উপসাগরে বোটে করে আসার সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছে রানা। নতুন তথ্যগুলো জানাল।

জবাবে বিসিআই চিফ বললেন, ‘এবার খুঁজে বের করতে হবে ওই বাগান।’

‘জী, স্যর।’

‘দেরি করার উপায় আছে বলে মনে করি না,’ বললেন রাহাত খান। ‘দলে আরও কয়েকজনকে নেবে ভাবছ?’

‘জী-না, স্যর। একসঙ্গে জড় হওয়ার সময় নেই।’

‘ঠিক আছে, যোগাযোগ রাখবে।’

‘জী।’

ওদিক থেকে রেখে দেয়া হলো রিসিভার।

এবার এলেনাকে ফোন করল রানা। ওদিক থেকে কল রিসিভা হতেই বলল, ‘কী অবস্থা, এলেনা?’

‘কানা গলিতে আটকে গেছি,’ ক্লান্ত স্বরে বলল মেয়েটা, ‘আমার মনে হচ্ছে ওই কাল্টের লোক বদ্ধ-উন্মাদ। দুনিয়া জুড়ে এখানে ওখানে না গিয়ে দেখা দরকার, ঠেকানো যায় কি না ওই ভাইরাস।’

‘তা নয়, আমাদের পরের টার্গেট প্রাচীন একটা বাগান,’ জোর দিয়ে বলল রানা, ‘নইলে ডক্টর মোবারক সেই মিটিঙে যা বলেছিলেন, ঠিক তা-ই হবে— নরক হবে এ পৃথিবী। সবাইকে ওরা অতি দীর্ঘ আয়ু দেবে।’

মোনার কাছ থেকে কী জেনেছে, সংক্ষেপে জানাল রানা।

তিন মিনিট পর কথা ফুরিয়ে গেলে এলেনা বলল, ‘বিশ্বাস করবে না, আমি বোধহয় জানি কোথায় খুঁজতে হবে ওই গাছ। ‘

‘ইরাকে?’ আন্দাজ করল রানা, ‘টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের কাছে কোথাও?’

‘সহজ হবে না পাওয়া,’ বলল এলেনা, ‘প্রফেসর বার্ডম্যান ধারণা করছেন, ওই বাগান ছিল পশ্চিম ইরাকে। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে ওখানে যাওয়া খুব কঠিন কাজ।’

‘সীমান্ত আমরা পেরিয়ে যাব,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘তুমি পৌঁছে যাও বসরার উত্তরে আল কুয়ারনাতে। ওখানে তোমার সঙ্গে যোগ দেব আমি।’

‘তোমার সঙ্গে আসছে মোনা মোবারক?’

‘হ্যাঁ। সঙ্গে ওর ফুফু আর ছোট বোন মিনতি।’

ওদের জন্যে সেফ হাউস লাগবে?

‘পেলে ভাল হয়। ওখানে বিসিআই-এর সেফ হাউস নেই।‘

‘আলাপ করব আমার চিফের সঙ্গে, পরে দেখা হবে আল কুয়ারনাতে।’

‘ঠিক আছে,’ ফোন রেখে দিল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *