মৃত্যুঘণ্টা – ৩৪

চৌত্রিশ

একটু পিছিয়ে পড়েছে এলেনা, কিছুক্ষণ পর হাজারো নক্ষত্র ভরা রাতে সামনের গাড়ির পেছনে থামল ও। পাঁচতলা গভীর, খাড়া এক খাদের পাড়ে মোনা ও রানা। জায়গাটা খোলা খনির মুখের মত। অন্তত আধ মাইল দূরে ওদিকের দেয়াল। নিচে বালির মেঝে উঠে গেছে চার দেয়ালের দিকে। মাঝের অংশের উচ্চতা মরুভূমি সমতলের মতই, আকারে অন্তত বারোটা ফুটবল মাঠের সমান।

‘এসো,’ এলেনাকে ডাকল রানা।

এটিভি থেকে নেমে মোনা ও রানার পাশে দাঁড়াল এলেনা।

প্রাচীন দ্বীপের এদিকে পাথুরে বাড়ি দেখছে ওরা। বহু আগেই ধসে গেছে ছাত। গাড়ি থেকে নেমে নাইট ভিশন গগল্স্ খুলে ফেলেছিল এলেনা, রানার মতই আবারও পরে নিল।

‘সত্যিই ওটা সেই দ্বীপ?’ আনমনে বলল মোনা।

‘তা-ই তো মনে হয়,’ বলল এলেনা। ‘চারপাশে খাদ, মাঝে দ্বীপ। বলতে পারো এক ধরনের দুর্গ।’

‘আমরা দেখছি হাভিলা, বালির প্রান্তর,’ বলল মোনা, ‘পিশন নদীর মাঝে সে এলাকা, শেষ বাগান, যেখানে ছিল জীবন-বৃক্ষ।’

‘কিন্তু সবুজের ছোঁয়া নেই।’ চারপাশ দেখছে রানা। বড় রুক্ষ, পরিত্যক্ত এলাকা। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। মাথার ওপরের আকাশে জ্বলজ্বল করছে কোটি তারা।

‘অবাক লাগছে, এই এলাকা পেলেন না কেন আবু রশিদ?’ বলল মোনা। ‘শুনেছি, বহু বছর ধরে খুঁজেছেন।’

‘পাননি, কারণ এদিকটা শুকিয়ে ফেলেছিলেন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন,’ বলল এলেনা, ‘আগে পানির নিচে ছিল, জলাভূমির অংশ। তখন এখানে চলছিল ইরাক-ইরানের যুদ্ধ।’

স্কার্টের পকেট থেকে কাগজ বের করে ভাঁজ খুলল মোনা। কাগজে আঁকা এক সবুজ এলাকা। চারপাশে পানি, দূরে দেয়াল।

‘সুমেরিয়ান বর্ণনা অনুযায়ী,’ বলল মোনা, ‘এখানেই ছিল জীবন-বৃক্ষ।’

বাঁকাভাবে কাগজ ধরেছে, কিন্তু সামনের ওই দ্বীপের সঙ্গে অনেক কিছুই মিলছে, ভাবল রানা। জানতে চাইল, ‘এবার?’

‘নিচে নেমে দ্বীপে গিয়ে উঠব,’ বলল মোনা, ‘সত্যি বীজ রয়ে গিয়ে থাকলে, ওসব থাকবে সবচেয়ে বড় দালানের ভেতর।

রানার এটিভির হ্যাণ্ডেলে দড়ি বেঁধে সেটা ধরে নেমে গেল ওরা খাদের নিচে। কূপের মত জায়গাটা পেরিয়ে উঠতে লাগল দ্বীপের দিকে। কিন্তু যত সহজ মনে হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কঠিন ওপরে ওঠা। প্রথম ধাপে উঠতে গিয়েই হাঁফ ধরে গেল ওদের। বালি-মাটিতে অসংখ্য পাথরের চাপড়া। হাজার হাজার বছর পানির ঘষায় মসৃণ। পিছলে যেতে যায় পা।

দ্বীপের প্রথম ধাপে উঠে সামনে দশ ফুট উঁচু প্রাচীর পেল। জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে পাথর। সাবধানে পা ফেলে দ্বীপে উঠল রানা, মোনা ও এলেনা।

মোনার ভাব দেখে মনে হলো, জানে ঠিক কোথায় কী খুঁজবে। সবচেয়ে বড় দালানের দিকে চলল। পিছু নিল অন্য দু’জন।

‘সেই সুমেরিয়ান আমল থেকে এখানে বাস করেছে মানুষ, ‘ বলল মোনা। ‘একদল স্কলার মনে করেন, এরা ছিল এলামাইট। তবে জানা যায়নি নিজেদেরকে কী নামে ডাকত তারা।’

চারপাশে নজর রেখেছে রানা।

আপাতত বিপদের কোনও সম্ভাবনা দেখছে না।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা পৌঁছল ভাঙা, বড় এক দালানের সামনে। ধসে পড়েছে এদিকের দেয়াল। একবার কাগজ দেখে নিয়ে পাথরের স্তূপ টপকে একটা ঘরে ঢুকে পড়ল মোনা, পেছনে রানা ও এলেনা। পরের ঘরে পাওয়া গেল নিচে যাওয়ার সিঁড়ি।

‘ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে নিই?’ রানার কাছে জানতে চাইল মোনা। এতক্ষণ নক্ষত্রের আলোয় চলেছে ওরা। আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ‘জ্বালতে পারো। কিন্তু ফ্ল্যাশলাইটের সামনের দিক ঘিরে রেখো, চারপাশে যেন আলো না যায়।’

সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে ফ্ল্যাশলাইটের আলো নিচে ফেলল মোনা। ওর পিছু নিল রানা ও এলেনা।

সিঁড়ি শেষ হওয়ার পর সামনে পড়ল ছোট এক ফাঁকা ঘর। একসময় হয়তো গুদাম ছিল। মেঝে ভরে আছে বালিতে। পাশের দেয়ালে হাত রেখে কী যেন খুঁজছে মোনা।

‘কী খুঁজছ?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘দেয়ালে আলগা পাথরের মত ইঁট। সুমেরিয়ান কিংবদন্তী অনুযায়ী, জীবন-বৃক্ষের দুই ধরনের ফল ছিল। একটা বিচি ছাড়া, অন্যটা পাওয়া যেত খুব কম। যেটার ভেতর থাকত বিচি বা বীজ, এতই দামি ছিল, সরিয়ে ফেলে মোম দিয়ে মুড়িয়ে সোনার বলের ভেতর রাখত। জিনিসটা ঠাঁই পেত কাদামাটির ইঁটের ভেতর। স্বল্প তাপ দিয়ে শক্ত করে ফেলা হতো সেসব ট্যাবলেট। বুকে এঁকে দেয়া হতো নির্দিষ্ট চিহ্ন।

‘তার মানে, কাদার ভেতর ছিল না,’ বলল এলেনা।

‘শক্ত কাদার ভেতর’ বলল মোনা। ‘দেখলে মনে হবে ইঁট।’

‘এরকম?’ জানতে চাইল রানা।

ঝট করে ওর দিকে তাকাল মোনা ও এলেনা। ছোরার ডগা দিয়ে পাথরের মাঝ থেকে বের করে এনেছে রানা পাতলা এক ইঁট। ওটার ওপর আলো ফেলল মোনা। ওই ট্যাবলেট দেখতে

অনেকটা পাথরের মতই লাগল।

‘এদিকে আগুন ধরেছিল,’ মন্তব্য করল এলেনা। ‘এত বেশি তাপ, পুড়ে গেছে দেয়াল পাথর চেঁছে নিয়ে রাখল ছোট এক প্লাস্টিকের ব্যাগে। রান কৌতূহলী দেখে ব্যাখ্যা দিল, ‘প্রফেসর বার্তমান স্যাম্পন চেয়েছেন কার্বন ডেট বের করবেন।

‘আরও কিছু বলেছেন? জানতে চাইল রানা।

‘তামার লিপির ছবি অনুযায়ী, এ বাগান ঠিক রাখতে সবসময় দু’জন থাকত, বলল এলেনা। তাদেরকে সবই দিতেন রাজা, কিন্তু নিষেধ ছিল, কখনও এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না তারা। বীজশূন্য ফল খাবে, তাতেই বাঁচবে বহুকাল। জন্মও তাদের এখানেই। বাগানের মালিরা জানত না বাইরের দুনিয়ায় কী হচ্ছে। বলে দেয়া ছিল, এটাই আসলে পুরো পৃথিবী, এর বাইরে কিছুই নেই। মৃত্যুও তাদের এখানেই। ভাল খাবার পানীয় ও অন্যান্য সবকিছুই পেত। কিন্তু দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। রাজা এটা করতেন, যাতে কেউ জানতে না পারে এখানে আছে জীবন-বৃক্ষ।’

‘আর্কিওলজিস্ট আবু রশিদ বাবাকে বলেছিলেন, তিনি পেয়েছিলেন মরুভূমিতে হাজার হাজার বছর আগের এক কবর, ‘ বলল মোনা। ‘ওটার ভেতর ছিল তামার ওই লিপি। যাই হোক, ওই লোক এখান থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল শত শত মাইল দূরে।

‘লিপিতে লেখা আছে. রাজার এক প্রহরী চালাকি করে বাগান থেকে বের করে আনে দুই মালির একজনকে,’ বলল এলেনা। ‘চোখ খুলে যায় মালির। বুঝে ফেলে, ওই বাগান আসলে পুরো পৃথিবী নয়। অনেক দূরে চলে যায় সে। অনেক কিছু জানতে পারে। উপায় ছিল না যে আবার ফিরবে ওই বাগানে বা এই রাজ্যে। দেখলেই তাকে খুন করত রাজার প্রহরীরা। নইলে জানাজানি হবে বাগানের কথা।’ কাঁধ ঝাঁকাল এলেনা। ‘ওই লিপি অনুযায়ী, আবারও ফিরেছিল লোকটা। কিন্তু এসে দেখল, দাউ- দাউ আগুনে পুড়ছে গোটা বাগান। আসলে লড়াই বেধে গিয়েছিল বিশ্বাসঘাতক লোকটার সঙ্গে রাজার। পাথরের পোড়া দেয়াল থেকে আরও ধুলো ও পাথরকুচি সংগ্রহ করে ব্যাগে রাখল ও ‘প্রফেসর বার্ডম্যান পোড়া কাঠের টুকরো জোগাড় করতে বলেছেন। কিন্তু এদিকে কড়িবরগা নেই। পাথর ও কাদা দিয়ে তৈরি দেয়াল, টিকে আছে এত বছর ধরে।’

‘আসলে ওজনের কারণে পাথরের দেয়াল একই জায়গায় রয়ে গেছে,’ বলল রানা, ‘সিমেন্ট বা চুন ব্যবহার করেনি। এই একই কারণে এত বছর পরেও আমরা দেখি পিরামিড।’

এলেনার হাতের পোড়া কাদা দেখছে মোনা। বিরক্ত হয়ে হাত থেকে ফেলে দিল রানার কাছ থেকে পাওয়া ইঁট। ওই জিনিস খুঁজছে না ও। সরে গেল আরেক দিকে, নতুন করে দেখতে লাগল দেয়াল। ওপাশের মেঝেতে বেশ কিছু ইঁট। সেসবের ভেতর ভারী, পোড়া একটা ইঁট সরিয়ে নিল মোনা। মেঝের দিকে ঝুঁকে দেখল।

ভারী, পোড়া ইঁট সরিয়ে ফেলার পর দেখা দিয়েছে আরেকটা ত্রিকোণ ইঁট। দেখতে অনেকটা জুতোর বাক্সের মত। মোনার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ইঁটের ওপর কয়েক রকমের চিহ্ন দেখল রানা।

মেঝে খুঁচিয়ে ওই ইঁট তুলে আনতে চাইল মোনা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর থেমে গেল। হতাশ হয়েছে। ‘এটা ওই জিনিস নয়।’

‘জানবে কী করে আসল জিনিস কোনটা?’ বলল রানা, ‘পড়তে পারবে?’

‘না, কিন্তু কয়েকটা চিহ্ন থাকবে।’

‘চিহ্নগুলো কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘এই জিনিস খুঁজছে মোনা,’ ঘরের আরেক দিক থেকে বলল এলেনা।

ঘুরে ওকে দেখল রানা ও মোনা।

চ্যাপটা, ত্রিকোণ ইঁট দেখাল এলেনা। পাথরের দেয়াল থেকে টেনে বের করেছে ওটা। মাঝের বর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে কমপাসের কাঁটার মত চারটে মোটা দাগ। বর্গের ভেতর ছোট আয়তক্ষেত্র। আবার ওটার ভেতর আরও ছোট একটা বৃত্ত।

এলেনার কাছে পৌঁছে গেছে মোনা ও রানা।

মাথা ঝাঁকাল মোনা। ‘হ্যাঁ, এটাই খুঁজছিলাম।’

ওর দু’হাতে ত্রিকোণ, ভারী ইঁট ধরিয়ে দিল এলেনা। রানাকে বলল, ‘প্রফেসর বার্ডম্যান তামার লিপি পড়ার সময় প্রতিটা কলাম শেষ হওয়ার পর একটা করে সিম্বল পেয়েছেন, ওগুলো ওই তিন ভাষায় একই রকম।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘প্রথম বর্গ এই দ্বীপ। তার বুকে আয়তক্ষেত্র এই দালান। ভেতরের বৃত্ত ওই বীজ। বৃত্ত থেকে বের হয়ে চারদিকে যাওয়া কমপাসের কাঁটার মত ওসব কী?’

‘চারটে নদী,’ বলল এলেনা, ‘বা বলা উচিত চারটে খাল। নিয়ন্ত্রণ করত পানির উচ্চতা ও তাপমাত্রা। প্রফেসরের কথায় আর গিলগামেশের গল্পে আছে, জীবন-বৃক্ষের ফল ধরত মাটিতে নয়, অগভীর পানির ভেতর। …পরে সুযোগ পেলে এখান থেকে একবার ঘুরে যাবেন প্রফেসর।’

‘পোড়া পাথরের কুচি জোগাড় করছ করো, কিন্তু আমার মনে হয় না এই দালানে আগুন ধরেছিল প্রাচীন আমলে,’ বলল রানা, ‘ওই কাজ বেদুঈনদের। কে জানে, হয়তো ছয়মাস আগে আগুনে পুড়েছে চারপাশ।’

মোনার পাশে থামল রানা। ‘তুমি শিয়োর তো, ভেতরে বীজ আছে?’

‘ওপরে তো সিম্বল দেখছি,’ বলল মোনা। স্বস্তির হাসি মুখে।

তখনই রানা ও এলেনার কোমরের বেল্ট থেকে এল কৰ্কশ স্ট্যাটিক। স্ক্যানারে স্থির হলো রানার চোখ। সবুজ আলো বাড়ছে আবার কমছে। সিগনাল ধরছে যন্ত্রটা। এক সেকেণ্ড পর আবারও এল স্ট্যাটিক, তারপর কথা বলে উঠল কে যেন। এতই দুর্বল সিগনাল, পরিষ্কার বোঝা গেল না কিছুই।

‘এলেনা, মোনা, এক্ষুণি ওপরে যেতে হবে!’ সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল রানা। ‘সময় নেই, কাছে চলে আসছে কারা যেন!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *