বিপদসঙ্কেত – ৯

নয়

পুলিসী জেরা শেষে, ফাঁকা করিডর ধরে হোটেলের দিকে ফিরে চলল কিশোর।

দোকানপাট সব বন্ধ। মলটা যেন এখন নিঝুমপুরী। এক পাখির দোকানের কাঁচের দেয়ালের ওপাশে এক ফ্লেমিঙ্গো এক পায়ে দাঁড়িয়ে, খুদে এক চোখ দিয়ে জরিপ করছে ওকে, অন্যগুলো গোলাপী পালকে ঠোঁট ডুবিয়ে ঘুমিয়ে কাদা। ইনডোর সি-র অন্ধকার সার্ফেসের নিচে স্পটলাইটের আভা, ফলে গর্ডনের যেখানে প্রাণ সংশয় হয়েছিল সেখানকার ভাঙা মূর্তিগুলোর আকৃতি আর ধ্বংসস্তূপের নকশা প্রকাশ পাচ্ছে। সাগরের শেষ সীমানা অবধি হেঁটে গিয়ে, ঝোপাল লতাপাতায় ছাওয়া এক পথ অনুসরণ করল কিশোর। একটু পরে, পানির কিনারায় এক রেইলিঙের কাছে পৌঁছল। সাগরপৃষ্ঠের নিচে, হাঙরগুলোকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত ট্যাঙ্কের ভেতরে চক্কর কাটতে দেখল ও নিস্তব্ধ মল-এর গা ছমছমে পরিবেশে কেমন অদ্ভুত আর ভীতিকর লাগল দৃশ্যটা।

কিশোর হোটেলে ফিরে দেখল আঙ্কেল-আন্টি অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছেন ঘরে। দু’জনেই চিন্তিত, ওকে বলছেন সে কথা, এমনিসময় দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে রাজনের প্রবেশ।

‘অ্যাই, কিশোর! ইউরোপায় কী হয়েছিল রে…?’

একটা হাত তুলে ওকে থামালেন মিসেস টার্নার।

‘দাঁড়াও, রাজন। মিস্টার কুপার এইমাত্র ফোন করেছিলেন। তিনি ইউরোপা বুলভারে তোমার সব কাণ্ডকারখানার কথা শুনেছেন। ভদ্রলোক বলেছেন এখনি যেন তোমাকে বাড়িতে ফেরত পাঠাই।’

নিমেষে ফ্যাকাসে হয়ে গেল রাজন। মুছে গেছে হাসি।

‘তাই?’

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস টার্নার।

‘আমার ওকালতির সব কায়দা-কৌশল কাজে লাগাতে হয়েছে তাঁর মন ঘোরাতে।’

এবার দাঁত বেরিয়ে পড়ল রাজনের, মিসেস টার্নারের হাত ঝাঁকিয়ে দিল।

‘সত্যিই আপনার তুলনা নেই, আণ্টি।’

‘কাল হয়তো একথা না-ও ভাবতে পার তুমি।’

.

পরদিন সকালে দোকানগুলো খুলতেই, মিসেস টার্নার এক পিৎযা আকৃতির পাত্র নিয়ে সুইটে ফিরলেন এবং কিশোরকে পাঠালেন রাজনের ঘুম ভাঙাতে। দীর্ঘক্ষণ পরে ফিরল দু’জনে।

‘ওর কুম্ভকর্ণের ঘুম, আন্টি। ওর বিছানার পাশ দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে দমকলের গাড়ি গেলেও টের পাবে না।’

মস্ত হাই তুলল রাজন।

‘ভোর ছটা পর্যন্ত সিনেমা দেখেছি। এখন আর চোখ খোলা রাখতে পারছি না।’

‘তোমার জন্যে একটা গিফ্‌ট্ এনেছি, রাজন।’

‘ধন্যবাদ, আণ্টি। দাম কত?’

খোঁত করে শব্দ করল কিশোর।

‘অ্যাই, তুই সবসময় টাকা দিয়ে সব কিছুর বিচার করিস কেন রে? মাঝে-মাঝে মনে হয় তোর মাথায় ঘিলু বলে কিছু নেই।’

পাত্রটা রাজনের হাতে দিলেন মিসেস টার্নার।

‘মল-এর আরও অনেক কিছুর মত এটাও বিশ্ব রেকর্ডধারী।’

‘আমি এরচেয়েও বড় পিৎযা খেয়েছি, আণ্টি।’

‘খোলোই না।’

রাজন ঢাকনাটা টেনে খুলতেই পেল্লায় এক কুকি বেরোল, ওতে লেখা: তোমার বাইরে যাওয়া নিষেধ।

‘মজা করছেন, তাই না, আণ্টি?’ বলল ও।

‘তোমার তাই ধারণা?’

‘কুকিটা খাই?’

‘খাও, তবে বার্তাটা মনে রেখো।’

‘তা আর বলতে! সকালে আমার প্রিয় গেম শো-টা হবে, এটা খেতে-খেতে শো দেখব।’ চাইল কিশোরের দিকে। ‘অ্যাই, তুই দুটোর দিকে ফোন করিস, একসঙ্গে ওয়াটারপার্কে যাব।’

একটা হাত তুললেন মিসেস টার্নার।

‘রাজন, তুমি কুকির এক পিঠ দেখেছ, অন্যটাও দেখো।’

ওটাকে ঘোরাতেই পেছনের লেখাটা দেখল ও দু’দিনের জন্য।

‘দু’দিনের জন্যে বেরনো বারণ? কিন্তু, আন্টি, আমরা তো ওয়েস্ট এডমনটন মল-এ আছি!’

‘এর পরেরবার তোমাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হবে।’

.

ঘণ্টাখানেক পরে গ্যালাক্সিল্যাণ্ডে পৌঁছল টিনা ড ডেটের জন্য। লরেলি ওর বয়ফ্রেণ্ড রিচার্ড মার্কসের সঙ্গে এসেছে। ছেলেটি সুদর্শন, কিন্তু টিনার ডেট, ক্লিফ রিচার্ডও কারও চেয়ে কম যায় না। চমৎকার পরিপাটী সাজে সেজেছে তরুণ, জ্যাকেটের পিঠে স্কেটিং ক্লাবের নাম লেখা।

বিনোদন পার্কের ভেতরে, ভেতরে, ছোট্ট হ্রদটায় ভাসমান নৌকোগুলোর উদ্দেশে চাইল টিনা, এবং খুদে ট্রেইনটার দিকেও। ‘জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। শপিং মলের ভেতরে আস্ত একটা বিনোদন পার্ক, ভাবা যায়!’

‘আসলেই,’ বলল ক্লিফ। আর ওই মাইগুবেণ্ডারটা আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।’

‘ওই ট্রিপ্‌ল্‌-লুপ রোলার কোস্টারটার কথা বলছ? আমি, বাবা, ওটায় চড়ছি না।’ টিনা বলল।

‘কেন? চড়েই দেখো না, খুব মজা লাগবে।’

‘একবার চড়েছি। আর নয়।

লরেলি আর রিচার্ড অরবিট্রনে চড়তে চাইল, তাই প্রথমে ওটাতেই রাইড নেবে ঠিক করল। শীঘ্রি ওরা টের পেল তুমুল গতি কাকে বলে! ওদের বগিগুলো দ্রুতলয়ে উঠছে, নামছে, ওদেরকে ওপরে-নিচে, সামনে-পেছনে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। মেয়েরা চিল চিৎকার ছাড়ছে, ওদের মুখের ওপর চুল আছড়ে পড়ছে চাবুকের মত।

‘ওয়াও!’ রাইড শেষে শ্বাসের ফাঁকে বলল টিনা। ‘দুর্দান্ত লাগল!’

ওয়াশরুমে ও আর লরেলি চুল আঁচড়ে আয়নায় নিজেদের এক ঝলক দেখে নিল।

‘ক্লিফ তোমাকে পছন্দ করে,’ বলল লরেলি। ‘ভালমতই এগোচ্ছে কিন্তু সব কিছু।

হেসে ফেলল টিনা।

‘আমার ভীষণ নার্ভাস লাগছে।’

‘ টেনশন না করে স্রেফ এনজয় করো।’

বাম্পার কার রাইড করে, গোটা দুয়েক মখমলের প্রাণী জেতার পর, ড্রপ অভ ডুম-এ গেল ওরা। লঞ্চ প্যাডে স্পেস রকেটের পাশে যে ইস্পাতের কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে, সেরকম দেখতে জিনিসটা যেন আকাশছোঁয়া।

ক্লিফ চাইল টিনার উদ্দেশে।

‘ভয় লাগছে?’

‘না, কেন?’

‘না, তুমি তো মাইগুবেণ্ডারকে ভয় পাও।’

‘কে বলল?’

‘ওটায় চড়তে ভয় পাচ্ছিলে না?’

‘আমি তো তা বলিনি।’

‘গুড, তাহলে এই রাইডটার পরেই ওটায় চড়ব।’

ছেলেটির নীল চোখে চোখ রাখল টিনা।

‘সে দেখা যাবে। এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি।’

‘দেখা যাবে না, মন স্থির করে ফেলো।’

ড্রপ অভ ডুম-এর দিকে ঘুরে দাঁড়াল টিনা।

‘এসো, এবারের টিকিট আমি কিনব।‘

‘না, আমি।’ টাকা বের করে, বুথে হেঁটে গেল ক্লিফ এবং শীঘ্রি ওরা ইস্পাতের কাঠামোটার পায়ের কাছে ছোট্ট এক খাঁচায় স্ট্র্যাপবন্দি হলো।

‘গুড লাক,’ অ্যাটেনডেন্ট বলল। ‘মনে হবে ১২০ তলা বাড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছ। এই রাইডের অনুভূতিটা এমনই।’ দাঁত বের করে হেসে, পিছিয়ে গেল লোকটা। ‘এযাত্রা যদি বেঁচে ফেরো তবে ফ্রিতে আরেকবার রাইড দেব তোমাদের।’

আচমকাই খাঁচাটা ওপরে উঠতে লাগল। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল টিনা, এবার নিচের দিকে চাইল। অনেক নিচে, এক টুরিস্ট ভিডিয়ো ক্যামেরায় ধারণ করছে ওদের ছবি। শীঘ্রিই মহিলা ছোট হয়ে গেল, তারপর খাঁচাটা সশব্দে থেমে গেল নীল ইস্পাতের শিখরে।

ছোট-ছোট চাকার ওপর ভর করে গড়িয়ে সামনে এগিয়ে, অনন্তকালের জন্য যেন থমকে দাঁড়াল ওটা। গুঙিয়ে উঠল টিনা, এবার খাঁচাটা পড়ে যেতে লাগল, পতনটা ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, ধাতব চাকাগুলো ট্র্যাকের সঙ্গে ঘষা খেয়ে গর্জাচ্ছে-ওর গলা দিয়ে নিঃশব্দ আর্তচিৎকার বেরোল।

সহসাই দিক পাল্টে দড়াম করে থেমে গেল খাঁচাটা। অ্যাটেনডেন্ট ঝুঁকে পড়ে ওদেরকে খাঁচামুক্ত করার সময় প্রশ্ন করল, ‘কী, হবে নাকি আরেকবার?’

‘না, না,’ রীতিমত গোঙানির শব্দ বেরোল ক্লিফের গলা দিয়ে। ‘আমার তলপেট এখনও ৯৫ তলায় পড়ে আছে।’

‘আমারও একই অবস্থা, বলল টিনা, ওরা টলতে-টলতে রাইডের কাছ থেকে পা বাড়াল লরেলি আর রিচার্ডের উদ্দেশে। ‘মানুষ মারার কল ওটা।’

‘এরপর মাইওবেণ্ডার,’ বলল ক্লিফ।

কাছের রোলার কোস্টারটার দিকে চাইল টিনা। ট্রিপ্‌ল্‌- লুপগুলো এতটাই ওপরে উঠেছে, ওগুলোর মাথা দেখতে কষ্ট হচ্ছে। টিনা তাকিয়ে রয়েছে, এক লুপ থেকে ত্বরিত গতিতে বেরিয়ে এল লালরঙা এক বগি, আনন্দে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ওটার যাত্রীরা, এবার বগিটা সগর্জনে আবার ফিরে গেল আকাশে।

‘ভয়ঙ্কর!’

‘টিকিট কিনে আনি, বলল ক্লিফ।

‘আমি চড়ছি না।’ কাছের এক বেঞ্চি দেখাল টিনা তর্জনী দিয়ে। আমি এখানে অপেক্ষা করব। হাত নাড়ব তোমাদের দিকে!’

‘ফাজলামি পেয়েছ!’ কর্কশ কণ্ঠে বলে একটা হাত তুলল ক্লিফ। ‘তুমি মাইওবেণ্ডারে চড়ছ।’

‘তুমি আমাকে হুকুম করার কে? যদি না চড়ি?’

‘তাহলে আমার সাথে এসেছ কেন?’

‘আমি,’ বলল টিনা, কণ্ঠস্বর কাঁপছে রীতিমত, ‘কোন ঝগড়াঝাঁটি চাই না। আমি এখানে বসে থাকব।’

‘তাহলে পার্টি শেষ, বলল ক্লিফ। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে টিনার দিকে, মুখে রা নেই। অপূর্ব সুন্দর নীল চোখজোড়া ওর, লম্বা-লম্বা পাপড়ি।

‘দেখো, বলল টিনা। এটা পাগলামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমি এই রাইডটায় চড়ছি না, তোমরা চড়ো। পরে তো দেখা হচ্ছেই।’

‘তুমি যাচ্ছ আমাদের সাথে। কঠোর গলায় বলল ক্লিফ।

টিনা তাকাল লরেলি আর রিচার্ডের উদ্দেশে। ওরা লক্ষ করছে, সে সঙ্গে আরও কয়েকজনও।

‘এসো, আমরা তর্কাতর্কি বন্ধ করি, বলল টিনা। ‘ঠিক আছে?’

‘না, ঠিক নেই,’ বলল ক্লিফ। ‘তোমার পেছনে আজ আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে।’

মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল টিনা। চাইল ক্লিফের দিকে, তারপর লরেলি আর রিচার্ডের উদ্দেশে। হঠাৎই রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল ওর গোটা দেহ।

‘এই নাও,’ বলল ও, পকেট থেকে কটা নোট বের করল। ‘তোমার ক্ষতিপূরণ।’

ক্লিফ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে, টু শব্দটি করল না। এবার ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে রোলার কোস্টারের উদ্দেশে চলল। টিনা উল্টো ঘুরে রিচার্ড আর লরেলির মুখোমুখি হলো।

‘যাই। কাল দেখা হবে।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু…’

‘পরে কথা হবে! সরি!’

বিনোদন পার্কের ভিড় ভেদ করে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিল টিনা, মনে হলো ওর পাজোড়া যেন রবারের তৈরি, একরকম চোখ- কান বুজে হনহনিয়ে হাঁটছে ও, গ্যালাক্সিল্যাণ্ড থেকে এইমুহূর্তে বেরিয়ে যেতে চায়। শেষমেশ মল-এ পৌঁছল টিনা, দেখল দোকানগুলোর জানালায় লোকজন নানান ধরনের পণ্য দেখছে। চকচকে মর্মর পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে হাঁটছে, ক্লিফের কথা ঘুরছে মাথায়, সামনে কটা ফোয়ারা দেখল ও। ব্লু দানিয়ুব ওয়ালয়ের সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে নাচছে ওগুলো।

ওয়াও,’ পানির দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল ও। ‘আমি ঠিক কাজই করেছি।’