অপয়া ক্যামেরা – ৩

তিন

শনিবার বিকেল। স্বচ্ছ নীলাকাশ থেকে অকাতরে আলো বিলাচ্ছে সূর্য। বসন্তের প্রথম উষ্ণ দিন আজ। কিশোর, রবিন আর আমি বাইক চালিয়ে সারা শহর ঘুরব ঠিক করেছি।

স্কুলের পাশ কাটালাম আমরা, তারপর ডানে ঘুরে রকি বিচ পার্কের দিকে উতরাই বেয়ে নেমে গেলাম। তিনজনের পরনেই শর্টস্ আর টি-শার্ট। আজ গরমের দিন ভাবতে ভাল লাগছে।

খাড়া পাহাড়ের নিচে ব্রেক কষে গতিমন্থর করতে হলো আমাদের।

‘ফারিহার কী খবর?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘সকালে জ্বালায়নি তো?’

‘জ্বালায়নি আবার! ওটা তো ওর রক্তে!’

শুনে হেসে উঠল রবিন।

‘ও লাই পেয়ে মাথায় উঠেছে। ভীষণ আদুরে।’

‘সেরকম নাকি স্বভাবের,’ বললাম। ‘ভয়ানক বিরক্তিকর। মা বলে ও অমনই। তারমানে ওর সাত খুন মাফ, কোন দোষ ধরা যাবে না।’

‘আদুরি কইন্যা!’ মজা করে বলল কিশোর

পার্কের ভেতর দিয়ে চললাম আমরা, রাস্তার ওপর জট পাকিয়ে ঝুলে থাকা প্রাচীন গাছপালার ছায়াতলে ঢুকছি আর বেরোচ্ছি। এবার ক’জন বন্ধুবান্ধবের বাড়ির পাশ কাটালাম।

রাস্তার এক কোনায় গার্ডেন হোস দিয়ে গাড়ি ধুচ্ছে এক দল ছেলে-মেয়ে। আমরা বাঁক নিতেই এক লাল এসইউভি আমাদের পাশে এসে থামল।

পেছনের জানালার কাঁচ নেমে গেল। এবং কারা মাথা বের করল? আর কারা, আমার প্রিয় দুই বান্ধবী ববি আর এমা!

‘মু-মু!’ তারস্বরে চেঁচাল ওরা। ‘মু-মু!’

‘আহা রে, কী হয়েছে তোমার? মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?’ বলল ববি কপট মমতা মাখানো গলায়।

এমা ওর বাবল গামটা থুক করে ছুঁড়ল আমার উদ্দেশে। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

‘চলি, মু-মু!’ এসইউভিটা সগর্জনে চলে গেল বুনো হাসিতে মত্ত মেয়ে দুটিকে নিয়ে।

চোখ ঘুরিয়ে জোরে পেডাল মারতে লাগলাম। কিশোর আর রবিন আমার নাগাল ধরল ঊর্ধ্বগতিতে সাইকেল চালিয়ে এসে।

‘তোমার সাথে ওরা সবসময় এমন করে কেন? তুমি ওদের সাথে কী করেছ?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

‘খাইছে, আমার বার্থডে পার্টির কথা মনে আছে? ওই যে, বোলিং পার্টি?’

‘মনে থাকবে না কেন?’ বলল কিশোর। ‘বলটা আমি আমার পায়ের ওপর ফেলেছিলাম।’

‘খাইছে, মা বলেছিল আমি মাত্র পাঁচজন বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পারব,’ বললাম। ‘তোমরা তো জানো ববি আর এমা আমার প্রিয় পাঁচের মধ্যে নেই। অপ্রিয় পাঁচের মধ্যে অবশ্য আছে।’

হেসে উঠল রবিন।

‘তাই ওদেরকে জন্মদিনে ডাকনি।’

মাথা ঝাঁকালাম।

‘হ্যাঁ, ওটাই কাল হয়েছে। তারপর থেকে ওরা আমার পেছনে লেগেছে। আমাকে দেখলেই অমন করে।’

একটু পরে, গতি কমিয়ে থেমে পড়লাম এক কোণে। স্ট্রিট সাইনটা একপাশে কাত হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে।

‘আমরা এখন কোথায়?’ প্রশ্ন করলাম।

বিকেলের তেজী রোদে চোখ পিটপিট করছি তিনজনই। ব্লকের দু’ধারেই ছোট-ছোট বাড়ি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। চারকোনা আঙিনাগুলোয় লম্বা-লম্বা আগাছার বাড়-বাড়ন্ত।

এক বাড়ির সব কটা জানালায় কার্ডবোর্ড লাগানো। উঠনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে টিনের ক্যান আর ময়লা-আবর্জনা।

ধুলোমলিন এক গাড়িপথ থেকে এক বেয়াড়া ধরনের বড়সড়, হাড্ডিসার কুকুর গর্জাচ্ছে আমাদের উদ্দেশে, মরিয়ার মত শিকলের বাঁধন ছিঁড়তে চাইছে। অমসৃণ নুড়িপাথরে তৈরি ছোটখাট এক বাড়ির একটাপাশ লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে দুটো ছোট ছেলে।

‘খাইছে, এখানে তো আগে কখনও আসিনি,’ বললাম। ‘আসলে কোনবারই এত দূরে আসা হয়নি আমাদের।’

‘কেমন গা ছমছম করছে,’ বলল ররিন। এবার চোখ বিস্ফারিত হলো ওর। ‘অ্যাই-দেখো, দেখো! গ্যারেজ সেল!’

আমাদের জন্য অপেক্ষা না করেই নুড়ি বিছানো গাড়িপথটা ধরে পেডাল মারতে লাগল ও। ওখানে বাতাসে লাল-নীল বেলুন উড়ছে।

ট্যাগ সেল দেখলে প্রায়ই নিজেকে আর সামলাতে পারে না রবিন। পুরানো জুতো, হ্যাট, কাপড়চোপড়ে ওর সাঙ্ঘাতিক আকর্ষণ। এত জিনিস কিনে কী লাভ ওর জানি না। ভাগ্যিস ওর ঘরে বড়-বড় ক্লজিট আছে।

লাল ইটের বাড়িটা ছোট আর চারকোনা। স্ক্রিন ডোরটা ছিঁড়ে অর্ধেকখানি ঝুলছে। ধুলোটে সামনের জানালা দিয়ে এক স্টাফ করা বানর উঁকি দিচ্ছে।

গ্যারেজের সামনে বিচ চেয়ারে বসা লালমুখো মোটাসোটা এক মহিলা। তার পরনে আঁটোসাঁটো পোশাক। আমরা বাইক থেকে নামতেই সে হাতছানি দিয়ে ডাকল, তবে উঠে দাঁড়ায়নি।

ভাঁজ করা এক খবরের কাগজ নেড়ে বাতাস করছে নিজেকে। এবার ওটা দিয়ে টেবিলটা দেখাল।

‘সব কিছুর অর্ধেক দাম, কর্কশ স্বরে বলল। ‘ট্যাগ করার সময় পাইনি। আমাকে শুধু দাম জিজ্ঞেস করো।’

নুড়ি বিছানো গাড়িপথে বাইক তিনটে শুইয়ে রাখলাম আমরা। আশপাশে আর কেউ নেই। ব্লকের ওপাশ থেকে ঘেউ- ঘেউ করেই চলেছে রাগী কুকুরটা।

রবিন পুরানো কাপড় আর কোর্ট রাখা এক র‍্যাকের কাছে হেঁটে গেল। আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ জন্মাল না। কিশোরও চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু রবিন ওগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল।

আমি গ্যারেজের খোলা দরজার সামনে এক টেবিলের কাছে থামলাম। হলদেটে, পুরানো টাইম ম্যাগাজিন আর শিট মিউযিক ডাঁই করে রাখা ওটার ওপরে।

কটা শিট মিউযিক, তুলে নিয়ে দেখছি। বাবা মাঝেমধ্যে পিয়ানো বাজায়, পুরানো গান সংগ্রহের বাতিক আছে তার। কিন্তু কাগজগুলো থেকে কেমন এক বাজে গন্ধ আসছে আর খসে খসে পড়ছে। ওয়্যাক।

টেবিলে ধুপ করে রেখে দিলাম ওগুলো, কিন্তু হাত দুটোয় বিশ্রী গন্ধ মেখে গেছে।

ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম রবিন স্ট্র হ্যাটগুলো পরে দেখছে। ভাল মানাচ্ছে ওকে। আমাকে হ্যাট পরলে হাস্যকর দেখায়।

কিছু সেকেলে বোর্ড গেম আর অ্যাকশন ফিগারও রয়েছে গ্যারেজে। ‘বাইট মাই ফেস!’ নামে এক মান্ধাতা আমলের ওয়্যারউলফ কার্ড গেম নেড়েচেড়ে দেখলাম। ফালতু।

এবার গ্যারেজের পেছনের রুপোলী আলোয়, নিচু এক তাকে রাখা জিনিসটা আমার দৃষ্টি কাড়ল। একটা ক্যামেরা।

ঝুঁকে তুলে নিলাম ওটা।

‘খাইছে, অদ্ভুত তো,’ বিড়বিড় করে আওড়ালাম।

ক্যামেরাটা নিঃসন্দেহে প্রাচীন। চারকোনা যন্ত্রটা পুরানো বক্স ক্যামেরার মতন দেখতে। আমার ডিজিটাল ক্যামেরার চাইতে অনেক বড় আর ভারী। ধাতব জিনিসটা কালো চামড়ায় মোড়া। ওটাকে উল্টে দিতেই মাথায় এক বিল্ট-ইন ফ্ল্যাশ দেখলাম।

‘খাইছে, কোন্ ধরনের ফিল্ম ভরে এতে কে জানে, বাবা,’ আওড়ালাম নিচু স্বরে। এমন ক্যামেরা আগে কখনও দেখিনি।

আমার ব্যাকপ্যাকে পাঁচ কিংবা দশ ডলার আছে। এতে কি এই প্রাচীন ক্যামেরাটা কেনা যাবে?

বিচ চেয়ারে বসা মহিলার কাছে নিয়ে গেলাম ওটা।

‘এটা বেচবেন?’ প্রশ্ন করলাম।

নিমেষে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। কেঁপে উঠল চিবুক।

‘না!’ প্রায় আর্তনাদ ছাড়ল। ওটা রেখে দাও! নিয়ো না-এক্ষুণি রেখে দাও!’