অপয়া ক্যামেরা – ১৩

তেরো

ক্যামেরাটা ভেজা। লেন্সে কাদা মাখা।

আর্তনাদ করতে চাইলাম। ওটাকে দেয়ালে বারবার ঠুকতে ইচ্ছে করছে। পায়ের তলায় পিষতে মন চাইছে। খাইছে, হাতুড়ি দিয়ে যদি ভেঙে চুরমার করতে পারতাম ওটাকে।

কিন্তু জানি এসবে কাজ হবে না।

শহরের ওমাথায় ওই বাড়িটায় রেখে এসেছিলাম এটাকে। মজা পুকুরেও ফেলে এসেছি।

অথচ ওটা এখন এখানে। উপায় নেই। কোন উপায় নেই এটার হাত থেকে বাঁচার।

টেবিল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিলাম ক্যামেরাটা। তারপর ওপরতলায় ছুটলাম ক্লজিটে লুকিয়ে রাখতে, কেউ নাশ্তার জন্য নেমে আসার আগেই কাজটা সারতে হবে।

সারাদিন আর কিছু ভাবতে পারলাম না।

দুপুরে, স্নিয়ার সিস্টার্স-ববি আর এমা আমাকে ধাক্কা মারায় লাঞ্চ ট্রে-টা হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। লাঞ্চরুমে হাসির হুল্লোড় উঠল।

‘চোখে দেখো না?!’ তীব্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল ববি। ‘কানা নাকি?’

মেয়েদেরকে তো কিছু বলা যায় না, নইলে এক হাত দেখে নিতাম ওদেরকে।

কী আর করা, অপমানটা হজম করলাম। এমনকী ওদের দিকে চাইলাম না পর্যন্ত। না খেয়েই বেরিয়ে এলাম লাঞ্চরুম থেকে।

নাশতার টেবিলে দেখা ক্যামেরাটার কথাই মাথায় ঘুরছে কেবল আমার। পেট শক্ত হয়ে রয়েছে, যেন ডজনখানেক গিঁট পড়েছে ওখানে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। খাব কীভাবে?

নিঃসন্দেহে আমার সাহায্য দরকার।

ছুটির পরে, ব্যাকপ্যাকে ভরলাম ক্যামেরাটা। বাইক চালিয়ে পৌছলাম মল-এ। র‍্যাকে বাইক পার্ক করে, দোতলায় ‘ক্যামেরা ওয়ার্ল্ড’ দোকানটির উদ্দেশে দুলকিচালে ছুটলাম।

আমি ভেতরে পা রাখতেই সুরেলা কণ্ঠে বেজে উঠল দোরঘণ্টি। কাঁচের ডিসপ্লে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম রয়ের বাবাকে। নীল-সাদা স্ট্রাইপড্ শার্ট আর খাকি পরনে তাঁর। এক টুকরো নরম, সাদা কাপড় দিয়ে পালিশ করছেন বড় এক ক্যামেরার লেন্স।

আমাকে চিনতে পেরে মুচকি হাসলেন তিনি

‘মুসা? কেমন আছ?’

মি. রেস খাট আর লিকলিকে। কানের কাছে দু’এক গাছি কালো চুল ছাড়া তাঁকে টেকোই বলা যায়। চোখজোড়া বাদামি তাঁর, হাসিটা আন্তরিক এবং কালো গোঁফজোড়া দেখে মনে হয় যেন নাকের নিচে সরু দুটো রেখা টানা হয়েছে।

‘আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই,’ বললাম। ব্যাকপ্যাকে হাত ভরে বের করে আনলাম ক্যামেরাটা। তারপর কাঁচের কাউন্টারে নামিয়ে রাখলাম। ‘এই প্রাচীন, অদ্ভুত ক্যামেরাটা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে পারেন?’

লেন্সটা সযত্নে নামিয়ে রাখলেন তিনি। এবার কাপড়টা ভাঁজ করে ড্রয়ারে রেখে দিলেন

‘দাও, দেখি,’ বললেন।

এক হাতে ওটা তুলে নিয়ে মুখের সামনে ধীরে-ধীরে ঘোরালেন।

‘ক্যামেরাটা প্রাচীন আর অদ্ভুত তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ বিড়বিড় করে বললেন। ‘এটা পেলে কোথায়, মুসা? ই-বেতে?’

‘গ্যারেজ সেল,’ জানালাম।

‘আগে আর কখনও এরকম জিনিস দেখেছি বলে মনে হয় না,’ বললেন। উল্টে দিয়ে তলাটা পরখ করলেন। ‘কোন ব্র্যাণ্ড নেম নেই। কোথাও আইডি নাম্বারও দেখছি না।’

ভিউফাইণ্ডার ভেদ করে চাইলেন। এবার খুঁটিয়ে দেখলেন লেন্সটা।

‘এটা সেল্‌ফ্-ডেভেলপিং,’ বললেন। ‘এত পুরনো ক্যামেরার বেলায় ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক।’

‘ক্যামেরাটা…খুবই উদ্ভট ধরনের,’ বললাম।

গোঁফে তা দিলেন মি. রেস।

‘আমার অফিসে কিছু বই আর পুরনো ক্যাটালগ আছে,’ বললেন। ‘ওগুলো দেখি এসো।’

পেছনের ছোট্ট অফিসটায় তাঁকে অনুসরণ করে ঢুকলাম। ঝাড়ু রাখা ক্লজিটের সমান ঘরটা। কম্পিউটার নিয়ে এক ডেস্ক, একটা চেয়ার এবং গাদা-গাদা ক্যামেরা বিষয়ক বই আর পত্র- পত্রিকা রয়েছে এখানে।

স্তূপের নিচ থেকে কটা পুরানো বই টেনে বের করলেন মি. রেস এবং একে-একে ওগুলোর পাতা উল্টাতে লাগলেন।

‘ক্যামেরাটায় কোন নাম নেই বলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে,’ বললেন।

এবার ফট করে সেকেলে আরেকটি বই খুলে পাতার পর পাতা ঘাঁটতে লাগলেন তিনি।

‘আমি প্রাচীন ক্যামেরার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ,’ বললেন। ‘লোকে বলে আমার নাকি ফটোগ্রাফিক মেমরি! হা-হা। এমনি বলে আরকী। কিন্তু আমি কখনও এমন জিনিস দেখিনি… আরি!’

পুরানো বইটির এক পাতায় চোখ সেঁটে গেছে তাঁর। ‘মনে হয় তুমি হয়তো…. গভীর মনোযোগে খুদে অক্ষরগুলো পড়ছেন।

অবশেষে, চোখ তুললেন।

‘মুসা, তুমি সম্ভবত দুষ্প্রাপ্য কিছু একটা পেয়েছ,’ বললেন। ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে ফটোটার সঙ্গে মেলালেন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…’

‘খাইছে, কী সেটা?’ প্রশ্ন করলাম।

‘এখানে লিখেছে এরকম মাত্র একটা ক্যামেরাই বানানো হয়েছিল,’ মি. রেস বললেন। আসলে পঞ্চাশের দশকের এক হরর মুভির জন্যে তৈরি করা হয় ওটা।’

ঢোক গিললাম।

‘হ-হরর মুভি?’

মাথা ঝাঁকালেন মি. রেস।

‘মুভিটার নাম ছিল ‘ড্রাকুলা’স গেস্ট’!’ ছোট্ট লেখাটা পড়লেন আবারও। ‘কিন্তু সিনেমাটা মুক্তি পায়নি। সেটে নানা ধরনের অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, এবং প্রোডাকশন বন্ধ করতে বাধ্য হয় তারা।’

প্রমাদ গণলাম। শিউরে উঠল সর্বাঙ্গ।

‘খারাপ কিছু?’

শ্রাগ করলেন মি. রেস।

‘তা বলেনি। ছবিটা কখনওই শেষ করা যায়নি। এবং ক্যামেরাটা একসময় হারিয়ে যায়।’ বইটা বন্ধ করলেন। ‘তুমি ভাগ্যবান, ছায়াছবির ইতিহাসের একটা অংশ খুঁজে পেয়েছ।’ ক্যামেরাটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে গেলেন।

‘না। প্লি-প্লিজ,’ তুতলে, পিছিয়ে গেলাম। ‘আপনি রাখবেন ওটা?’

চোখ পিটপিট করলেন তিনি।

‘বলো কী?! ক্যামেরাটার অ্যান্টিক মূল্য আছে। এটা-’

‘খাইছে, এটার বড় ধরনের সমস্যা আছে,’ বললাম। গলা চড়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ শোনাল আমার। ‘আমি ক্যামেরাটা নিয়ে যেতে চাই না। প্লিজ-

‘জিনিসটা মেরামত করা যাবে,’ বললেন তিনি 1

‘দরকার নেই!’ চেঁচিয়ে উঠলাম প্রায়। ‘এটা অভিশপ্ত। অশুভ! প্লিজ, মি. রেস-এটা রাখুন আপনি। এমন কোথাও লুকিয়ে রাখুন যেন কারও হাতে না পড়ে।’

চোখের পাতা পড়ছে তাঁর বারবার।

‘আমি অভিশাপ, জাদু-টোনায় বিশ্বাস করি না,’ বললেন। ‘এগুলো সব কুসংস্কার। ‘

‘প্লিজ-ক্যামেরাটা রেখে দিন,’ বললাম। চলে যেতে ঘুরে দাঁড়ালাম।

‘তোমাকে স্টোর ক্রেডিট দেয়া যায়,’ বললেন। ‘এটার বিনিময়ে তুমি কিছু নিতে পারো।’

‘লাগবে না!’ বললাম। আর এক মুহূর্ত ওখানে নয়। ক্যামেরাটার কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকতে চাই।

সবেগে অফিস থেকে বেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে এলাম। দোরঘণ্টি বাজছে তুমুল শব্দে। মল-এ দৌড়ে গেলাম। ডব্ল্ বেবি স্ট্রলার ঠেলছে এক মহিলা, আরেকটু হলেই আমার সঙ্গে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ত সে।

‘সরি, চিৎকার ছেড়ে, দৌড়ে চললাম।

অপয়া জিনিসটার হাত থেকে কি সত্যিই বেঁচেছি আমি? মনে-মনে বললাম।

মি. রেসের কাছে ওটা নিরাপদে থাকবে তো?

নাকি আবারও ফিরে এসে জ্বালাতন করবে আমাকে?

.

পরদিন। স্কুল ছুটির পরে, লকার থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করলাম। তারপর ছুটলাম অডিটোরিয়ামে। ছেলে-মেয়েরা ‘বাই বাই বার্ডি’ নামে এক নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে, বর্ষপঞ্জির জন্য ওটার ছবি নেব ঠিক করেছি। রবিনের সঙ্গে কথা হয়েছে আজ। ও জানে আমি মহাব্যস্ত, তাই আর দেরি করায়নি। কিশোরের অবস্থা আগের মতই।

পর্দার সামনে সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। মঞ্চের একপাশে পিয়ানোতে বসা মিসেস হুপার, বাজনা বাজাচ্ছেন।

তিনি নতুন গানের টিচার। তাঁর নয়া আইডিয়া নাড়িয়ে দিয়েছে স্কুলের সবাইকে।

‘বাই বাই বার্ডি’-র মত এতবড় গীতিনাট্য আমাদের স্কুলে কখনও হয়নি। শুরুর মহড়া থেকে উদ্বোধনী রাত পর্যন্ত কয়েকশো ছবি তুলব ভেবে রেখেছি।

কিন্তু মঞ্চের দিকে তড়িঘড়ি এগোতেই, অজান্তে গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম এ নাটকে আমার দুই শত্রু ববি আর এমাও রয়েছে।

মঞ্চের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন তর্ক করছিল দুই বান্ধবী। কিন্তু আমাকে দেখেই সব ভুলে ভেংচি কাটল।

আমিও মুখ বাঁকালাম। এসময় পেছনে ভারী পায়ের আওয়াজ পেলাম। অডিটোরিয়ামের কংক্রিটের মেঝেতে জুতোর গটমট শব্দ।

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম।

‘রয়!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘তুমি এখানে কী করছ?’

ওর মুখে হাসি ধরে না। পেছন থেকে হাতজোড়া সামনে আনল-এবং আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওর হাতে সেই অপয়া, অলক্ষুণে ক্যামেরাটা!

ওটা মুখের কাছে ধরে, মঞ্চের দিকে ঘুরে দাঁড়াল এবং তাক করল ববি আর এমার উদ্দেশে।

‘ড্রাকুলার অতিথিরা, খবর কী তোমাদের?’ হেঁকে বলল।

আতঙ্কে জমে গেলাম।

শাটার বাটন টিপতে বুড়ো আঙুল ওঠাল ও।

‘নাআআআআ!’ আর্তচিৎকার ছাড়লাম।