পদচিহ্নের উপাখ্যান – ৩

তিন

নাস্তার পর, মেলানি নানু আর ডেবোরা ছেলেদেরকে হাঁটিয়ে করালে নিয়ে গেল। ডন দেখল ফুটকি শর্টির সঙ্গে ছায়াময় এক কোনায় দাঁড়িয়ে।

‘এদিকে আয়,’ ডাকল ও। নাস্তা থেকে বাঁচানো এক বিস্কিট বাড়িয়ে দিল। ফুটকি দুলকিচালে ছুটে এসে গপ করে গিলে নিল ওটা।

শর্টি লেংচাতে-লেংচাতে এল জইয়ের খালি বালতি দুটো নিয়ে।

‘বলেছিলাম না ও এখানেই থাকবে, বলল সে। বেড়া টপকাতে যাবে, কমলা পালকওয়ালা হ্যাটটা টুক করে খসে পড়ল মাথা থেকে। বড়-বড় দাঁতে ওটা তুলে নিল ফুটকি। সবাই হেসে ফেলল দৃশ্যটা দেখে। শর্টি হ্যাটটা নিয়ে মাথায় চাপানোর সময় চকিতে লাজুক চাউনি দিল মেলানি নানুর উদ্দেশে। নানু মুচকি হাসলেন, নাচছে তাঁর চোখের তারা দুটো।

‘আমরা কি এখন রাইড করব?’ ডন প্রশ্ন করল।

‘এখনই না,’ বললেন মেলানি নানু। ‘র‍্যাঞ্চে আগে কাজ সারতে হয়।’

‘আমরা কাউবয়রা বলি: ‘আলু ভর্তা খাওয়ার পরে তবে ডেজার্ট, ‘‘ বলল শর্টি।

‘আমি সবসময়ই আলু ভর্তা খাই!’ উৎফুল্ল কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ডন।

হাসলেন মেলানি নানু।

‘শর্টি বুঝিয়েছে, খেলা পরে যেমন ঘোড়ায় চড়া আগে কাজ।’

‘আমাকে কী করতে হবে বলুন,’ খোশমেজাজে বলল মুসা।

‘জ্যাক বলেছে তুমি খুব ভাল ছবি আঁকো,’ বললেন মেলানি নানু। ‘আমি তোমাকে বার্নের প্রজেক্টের দায়িত্বটা দিচ্ছি। ওদিকের বড় বার্নটা বড়রাস্তামুখী। রোজ বহু লোক ওপথে চলাচল করে। ওটার একপাশে একটা মুরাল আঁকতে হবে।’

‘মুরাল কী?’ ডন জানতে চাইল।

‘কোন বাড়ির পাশে কিংবা দেয়ালে যে বিশাল ছবি আঁকা হয়,’ জানাল মুসা। ‘ফেবার’স ফাইনার ফুস্-এর দেয়ালে ফলমূল আর নানারকমের সব্জির নাচানাচির ছবি আছে না, অমনই আরকী।’

‘ঠিক,’ বললেন মেলানি নানু। বড়সড় একটা মুরাল মানুষের দৃষ্টি কাড়বে। মানুষ বুঝবে ডেয়ার টু ড্রিম র‍্যাঞ্চে ঘোড়া চালানো আর পালক নেয়ার ব্যবস্থা আছে।’

প্রকাণ্ড বার্নটার দিকে চাইল মুসা।

‘খাইছে, আমি একা পারব?’

‘তুমি শুধু ড্রয়িংটা করবে,’ বললেন মেলানি নানু। ‘শর্টি স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে ছবিটা আঁকাবে।’

এসময় ঘোড়া দাবড়ে এল হ্যারি রেডন্যাপ। র‍্যাঞ্চ ম্যানেজারের সোনালী গোঁফজোড়া তার ঘোড়াটার মতই ধুলোমাখা।

‘হানি আর বানির কী হয়েছে অনুমান করতে পারছি। দূরের তৃণভূমিতে বেড়ার ওপর মস্তবড় এক গাছের ডাল পড়েছে,’ বলল সে। ‘গোটা একটা অংশ ভেঙে গেছে। হানি আর বানি সম্ভবত ফাঁকটা দেখতে পেয়ে স্রেফ হেঁটে বেরিয়ে গেছে। আমার দু’জন লোক পাঠিয়েছি ওদেরকে খুঁজতে। অযথা আপনার পুলিস ডাকার কোন প্রয়োজন ছিল না, ডেবোরা।’

‘আ-আমি ভেবেছিলাম ঘোড়া দুটো চুরি গেছে বুঝি,’ আমতা-আমতা করে বলল ডেবোরা।

‘অভিজ্ঞতার অভাব। নইলে এতটা আতঙ্কগ্রস্ত হতেন না আপনি।’ করালের ঘোড়াগুলোর দিকে চাইল হ্যারি। ‘ড্রাগন এখনও এখানে কেন?’ জ্বলন্ত চোখে তাকাল ডেবোরার উদ্দেশে। ‘পশ্চিমের চারণভূমিতে, পুরনো করালে থাকার কথা ওর।’

চোয়াল দৃঢ় হলো ডেবোরার।

‘ওর পা তো সেরে গেছে।’

‘আপনি চিকিৎসক নন, বলল হ্যারি। ‘না বলা পর্যন্ত ড্রাগন পুরনো করালেই থাকবে।’

‘আমি একবার দেখি তো,’ বলল শর্টি। বেড়া টপকে করালে ঢুকে ড্রাগনের পেছনের পা-টা তুলে পরখ করল।

রবিনের চোখ ঘোড়াটার নালের দিকে। বেশিরভাগ নাল ‘ইউ’ আকৃতির, কিন্তু ড্রাগনের পায়ের পাতা চৌকো।

‘ওর পায়ে কি কোন সমস্যা আছে?’ প্রশ্ন করল ও।

‘তেমন কিছু না,’ জানাল শর্টি। ‘ও বিশেষ এক ভঙ্গিতে দৌড়ায়। ভেতরের দিকে পা ছোঁড়ে ছোটার সময়। চারকোনা নালের কারণে স্বচ্ছন্দে, সোজাসুজি ছুটতে পারে।’ ড্রাগনের পা-টা নামিয়ে রাখল সে। দেখে তো মনে হচ্ছে পা সেরে গেছে ওর।’

পাকাচুলো মানুষটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে চাইল হ্যারি।

‘ভেট পরীক্ষা করার আগে কেউ ড্রাগনের পিঠে চড়বে না,’ কঠিন গলায় বলল শটিকে।

‘আপনি বস,’ বলল শর্টি। ড্রাগনের লাগাম চেপে ধরল। ‘আপনার কথাই সই। শার্প দেখুক ওকে, ততক্ষণ ও স্টলেই থাকুক।’

‘তা-ই করুন,’ খোত করে উঠে, রাইড করে চলে গেল হ্যারি।

‘হ্যারি এত খেপে আছে কেন?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।

‘ও আমাকে দেখতে পারে না, জানাল ডেবোরা। ওর ধারণা আমার এখনও হেড র‍্যাংলার হওয়ার বয়স হয়নি। ও চেয়েছিল ওর প্রিয় বন্ধুকে চাকরিটা পাইয়ে দিতে। লোকটা কেনটাকিতে র‍্যাংলারের কাজ করে।

‘ও আসলে ঘোড়াগুলোকে বাপের মত ভালবাসে, আর কিছু নয়,’ পরিবেশটা হালকা করতে চাইলেন মেলানি নানু।

প্যাঁ-প্যাঁ। সবুজ এক ভ্যান সগর্জনে করালের কাছে এসে কিচ করে সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মহিলা লাফিয়ে নামল ওটা থেকে। তার এলোমেলো লম্বা চুল চারদিকে উড়ছে। পরনের কোঁচকানো কাপড়চোপড় দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো পরেই ঘুমিয়েছিল। একগাদা বেগুনী ফ্লায়ার দোলাল সে।

‘আপনারা কেউ কি আমার ঘোড়াটাকে দেখেছেন?’ বলে, ফ্লায়ার বিলি করতে লাগল। ওতে লেখা:

হারানো ঘোড়া-পুরস্কার
আপনারা কি বাটারকাপকে দেখেছেন?

ফোন নম্বর দেয়া কাগজটিতে নাকে সাদা চিহ্ন নিয়ে ধূসর রঙের টগবগে এক ঘোড়ার ছবি। ওটার লেজটা সাদা-কালো।

‘বাটারকাপ দু’দিন ধরে নিখোঁজ, জানাল মহিলা।

‘আমাদেরও দুটো ঘোড়াকে পাওয়া যাচ্ছে না!’ বলল ডন।

শ্বাস চাপল মহিলা।

‘ওগুলোও কি চুরি হয়েছে?’

‘ওরা হয়তো ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে,’ জানাল. কিশোর।

মহিলার জন্য খারাপ লাগল মুসার। বেচারীর চোখজোড়া কান্নাকাটির ফলে লাল টকটকে।

‘খাইছে, আপনার ঘোড়াটাও হয়তো কোন্ ফাঁকে পালিয়েছে, বলল ও।

‘না,’ মহিলার চোখে অশ্রু টলমল করছে।

‘আমাদের গেটের তালা কাটা। বাটারকাপ চুরি গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তোমাদের নিখোঁজ ঘোড়া দুটোকেও হয়তো চুরি করেছে।’ একটা ফ্লায়ার বাড়িয়ে দেয়ার সময় হাত কাঁপতে লাগল তার। ‘তোমরা এধরনের ফ্লায়ার বানিয়ে চারদিকে বিলি করো।’

‘আমার ঘোড়াগুলোর তো কোন ছবি নেই,’ জানালেন মেলানি নানু।

‘তাহলে শীঘ্রি তোলার ব্যবস্থা করুন,’ তাঁকে পরামর্শ দিয়ে ভ্যানে গিয়ে উঠল মহিলা। ‘একদম দেরি করবেন না।’ এবার গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।

ফ্লায়ারটা মনোযোগ দিয়ে দেখল রবিন।

‘আমি এখানে ক্যামেরা নিয়ে এসেছি,’ জানাল। ‘র‍্যাঞ্চের সব কটা ঘোড়ার ছবি তুলতে পারব।’

‘ভেবে দেখো, কাজটা কিন্তু খুব কঠিন,’ বললেন মেলানি নানু।

‘খাইছে, আমিও আছি,’ বলল মুসা। ফ্লায়ারটা তুলে ধরল। ‘এই ছবিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বাটারকাপ দেখতে কেমন।’

শর্টি পাশ দিয়ে চলে গেল, লাগাম ধরে হাঁটিয়ে নিচ্ছে ড্রাগনকে। ফ্লায়ারটা দেখে মাথা ঝাঁকাল।

‘হানি আর বানির ছবি থাকলে আমরাও সবাইকে দেখাতে পারতাম।’ মেলানি নানুর উদ্দেশে চোখ টিপল। ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’

মেলানি নানুর গালজোড়া লাল হয়ে গেল।

‘হুঁ, আসলেই,’ বললেন। ঘোড়াগুলো করালে থাকতে থাকতেই কাজ শুরু করো তোমরা। একবার মাঠে নিয়ে গেলে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।’ ওরা দু’জন ছুটল রবিনের ক্যামেরা আনতে।

‘আমি কী করব?’ প্রশ্ন করল কিশোর, কাজ শুরু করতে ব্যাকুল।

‘জ্যাক বলেছে তুমি যন্ত্রপাতি ভাল বোঝো,’ বললেন মেলানি নানু। ‘তুমি স্যাডল্ আপ করে হ্যারিকে ভাঙা বেড়াটা মেরামতে সাহায্য করো।’ বিজলীকে স্যাল্ পরাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল কিশোর।

‘আর আমি?’ ডনের প্রশ্ন।

‘তুমি ঘোড়াদের পানি দেবে,’ বললেন মেলানি নানু। ‘মানে র্যাঞ্চ জুড়ে পানির বালতি, ট্যাঙ্ক, পিপেগুলো ভরবে। শর্টির কাছে ম্যাপ আছে, ওতে দেখানো আছে ওগুলো সব কোথায়।’

‘ড্রাগনকে স্টলে রেখে আসি, ডনকে বলল শর্টি, তারপর তোমাকে কাজ দিচ্ছি। এখুনি ফিরব।’

করালে অপেক্ষা করছে ডন। কিশোরকে বিজলীর পিঠে ব্ল্যাঙ্কেট ছুঁড়তে দেখল, এবার স্যাডলের দড়িদড়া।

‘এটা ঠিক নয়, শর্টি ফিরলে গজগজ করে বলল ডন। ‘কিশোরভাই ঘোড়ায় চড়বে কিন্তু আমি পারব না।’

‘একটা গোপন কথা বলি,’ বলল শর্টি। ‘র‍্যাঞ্চের সব কাজের মধ্যে তোমারটাই কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

‘সত্যি?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

বুড়োমানুষটি পেছনে হ্যাট ঠেলে দিল।

‘ডন, শোনো, আমি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে র্যাঞ্চার। ঘোড়ারা টাটকা পানি ছাড়া বাঁচে না। প্রতিটা ঘোড়া দিনে প্রায় দশ থেকে পঁচিশ গ্যালন পানি খায়।’

ডন বাসার ফ্রিজে রাখা দুধের মস্ত গ্যালন বোতলটার কথা ভাবল। পঁচিশ গ্যালন কত হতে পারে ভেবে রীতিমত চমকে গেল। ওরে, বাপরে!

‘তাছাড়া, মুচকি হাসল শর্টি, ‘ঘোড়াদের পানি দেয়া সবচেয়ে মজার কাজ…আর এটাই সেরা। পকেট থেকে এক ম্যাপ বের করল। ‘এই যে এটা র‍্যাঞ্চের ম্যাপ।’ মাঝখানের বিশাল এক চক্রে আঙুল রাখল। ‘এটা করাল, আমরা এখন যেখানে। আর এগুলো,’ ম্যাপময় ছোট-ছোট লাল ‘X’ চিহ্ন ছড়ানো, পানির কন্টেইনার, ভরতে হবে।’

‘এতগুলো!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডন। ‘আমি একা পারব না।’

‘কেন পারবে না! কৌশলটা হচ্ছে প্রথমটা দিয়ে আরম্ভ করতে হবে,’ ম্যাপে আঙুল বুলিয়ে সবচাইতে দূরের ‘X’ দাগটা দেখাল শর্টি, ‘তারপর পরেরটা, তারপর তার পরেরটা। একটা- একটা করে। টেরও পাবে না লাঞ্চের আগেই কখন কাজ সেরে ফেলেছ।’

ডন কিশোরকে বিজলীর পিঠে সওয়ার হয়ে তৃণভূমি অভিমুখে যেতে দেখল।

‘ইস, আমিও যদি এখন রাইড করতে পারতাম!’ আফসোস করে বলল ও।

‘পারবে,’ সান্ত্বনা দিয়ে বলল শর্টি। ‘কিন্তু তার আগে…..

‘জানি, জানি,’ বলে উঠল ডন, ম্যাপের সব কটা ‘X’ চিহ্ন দেখল। ‘আগে আলু ভর্তা খেতে হবে।’