অপয়া ক্যামেরা – ৯

নয়

কোন জবাব নেই।

শিউরে উঠলাম। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথা নুইয়ে নুড়ি বিছানো গাড়িপথটা দিয়ে দৌড় দিলাম।

গ্যারেজের দরজাটা বন্ধ। সামনে কে যেন ইয়াবড় এক লাল ‘X’ এঁকেছে। ঘুরে দাঁড়াতেই জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতে দেখলাম স্টাফ করা বানরটাকে। প্রাণীটার পেছনে, বাড়িটা প্রায়ান্ধকার।

জানালায় বৃষ্টির পানির ছাঁট এসে লাগছে। মৃদু ড্রামের বাজনার মত শোনাচ্ছে শব্দটা।

চকিতে পেছনে চাইলাম। কাউকে দেখলাম না। কিন্তু আমি জানি কেউ আছে ওখানে, লক্ষ্য করছে আমাকে। এটা নিছকই আমার কল্পনা নয়

আবারও কেঁপে উঠে, দোরঘণ্টি বাজালাম। বাড়ির ভেতরে ওটার প্রতিধ্বনি শুনলাম।

ক’মুহূর্ত অপেক্ষার পর আবারও বাজালাম। সাড়া নেই।

ছেঁড়া স্ক্রিন ডোরটা টেনে খুললাম। এবার মুঠো দিয়ে

জোরে-জোরে শব্দ করলাম সদর দরজায়।

হাট হয়ে খুলে গেল দরজাটা।

ভেতরে উঁকি দিলাম।

‘কেউ আছেন? হ্যালো?’

নীরবতা। স্রেফ পেছনে বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছি।

ছোট, চারকোনা লিভিং রুমটিতে ঢুকলাম। আঁধারে চোখ পিটপিট করলাম-এবং আঁতকে উঠলাম।

ঘরটা একদম খালি। কোন আসবাব নেই। স্টাফ্ড্ বানরটা বসা জানালার ধারিতে। কামরায় আর কিছু নেই। এমনকী মেঝেতে গালিচা পর্যন্ত দেখলাম না।

‘হ্যালো?’ চেঁচালাম। ‘কেউ আছেন?’

ফাঁকা কামরায় প্রতিধ্বনিত হলো আমার কণ্ঠ। কিচেনে দৌড়ে গেলাম। ওটাও শূন্য। একটামাত্র পাত্র রাখা স্টোভের ওপর, ভেতরটা ওটার পুড়ে কালো। এমনকী সিঙ্কের কলটাও খুলে নিয়ে গেছে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, দেয়ালে হেলান দিলাম। কপাল বেয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। হাতের চেটো দিয়ে ঝেড়ে ফেললাম ফোঁটাগুলো।

ওরা চলে গেছে, বুঝতে পারছি।

মহিলা আর তার মেয়ে গ্যারেজ সেল দিয়ে বিদায় হয়েছে এখান থেকে।

‘এখন কী করা?’ জোর গলায় নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।

দু’হাতে আঁকড়ে ধরলাম অপয়া ক্যামেরাটা। এটা আর ওদেরকে ফেরত দেয়ার উপায় রইল না।

তাহলে কী করা যায়?

এটা বাসায় নেব না, নিজেকে বললাম।

এখানেই রেখে যাব, সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি হলো না। মনস্থির করতেই স্বস্তি পেলাম।

লিভিং রুমে ফিরে এসে, স্টাফ্ড্ বানরটাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিলাম। এবং ক্যামেরাটা রাখলাম ওটার কোলের ওপর।

পিছিয়ে গেলাম। মুখে হাসি ফুটেছে আমার। অশুভ ক্যামেরার হাত থেকে বাঁচতে পেরে খুব ভাল লাগছে। বানরটার দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে আছে আমার ওপর। এবার ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এলাম দরজা দিয়ে।

সদর দরজা আর স্ক্রিন ডোরটা লাগালাম। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে সূর্য।

পরিস্থিতির উন্নতিটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি! বাসায় ফিরলাম। ডিনারের আগে ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে হাতে। হোমওয়র্ক করার জন্য যে শান্ত হয়ে বসব তার জো নেই-কেমন ছটফট করছে মনটা।

ডিজিটাল ক্যামেরাটা আর বাড়তি লেন্সটা নিয়ে, স্কুলের পথে রওনা হলাম। বর্ষপঞ্জির জন্য কিছু ভাল ছবি নেয়া দরকার। রয়কে প্রতিযোগিতায় জিততে দেব না কিছুতেই!

টিচার্স’ পার্কিং লটে ক’জন ছেলে-মেয়ে চড়া হিপহপ মিউযিকের সঙ্গে রোলাররেডিং করছে। ওদের কটা ছবি তুললাম। ওরা কতটা উপভোগ করছে সেটাই ধরতে চেয়েছি আরকী ক্যামেরায়।

এবার ফুটবল মাঠে সেভেন্থ গ্রেডারদের কিকবল খেলার ছবি নিলাম। বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল ঘাসে বারবার দড়াম করে আছাড় খাচ্ছে ওরা। খেলা তো নয়, যেন পা পিছলে পড়ার প্রতিযোগিতা।

কটা ভাল ছবি পেলাম।

‘রয়, তোমার খবর আছে,’ বাড়ি ফেরার পথে আপন মনে বিড়বিড় করলাম।

কম্পিউটারে ছবিগুলো ডাউনলোড করতে তর সইছে না। কখন ওগুলো প্রিন্ট করব আর সেরাগুলো তুলে দেব মি. লয়েডের হাতে। সেজন্য অবশ্য আগামীকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

বাবা-মা কিচেনে। বাবা সিঙ্কে গাজর ছিলছে। মা চুলোয় কী যেন নাড়ছে।

‘কী রে, কী খবর তোর?’ জিজ্ঞেস করল বাবা। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল। ‘উহ!’ গাজর ছিলতে গিয়ে আঙুল কেটেছে। হাতটা উঁচিয়ে দেখাল। ‘রক্ত!’

বাবাকে কিচেনের কাজে আনাড়ীই বলা যায়। কেন যে গায়ে পড়ে মাকে সাহায্য করতে আসে!

‘দশ মিনিট পর ডিনার,’ মা বলল।

‘সমস্যা নেই,’ বললাম। ‘বাবা, একটা ব্যাণ্ড-এইড নিয়ে আসি?’

‘একটা নয়, দশটা লাগবে আমার!’ চিৎকার করে বলল সে। কিন্তু গাজর ছেলা থামাল না।

তরতর করে উঠে এলাম আমার রুমে। ডিজিটাল ক্যামেরাটা ডেস্কে কম্পিউটারের পাশে রাখলাম।

এসময় কিছু একটা দৃষ্টি কেড়ে নিল আমার। বোঁ করে ঘুরলাম-এবং চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা চিরে।

‘নাআআআআ-!’

সেই স্টাফ করা বানরটা! আমার ড্রেসারের ওপর দিব্যি গ্যাট হয়ে বসে রয়েছে, আর ওটার কোলে ভুতুড়ে ক্যামেরাটা!