অপয়া ক্যামেরা – ৮

আট

না। ছবিটা খসে পড়ল আমার হাত থেকে। কোমরের দু’পাশ চেপে ধরে নুয়ে পড়লাম। ব্যথাটা অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। মনে হচ্ছে যেন চামড়ার ভেতর গরম তার পুড়ছে।

এবং তারপর…চলে গেল তীব্র যন্ত্রণাটা।

ধীরে-ধীরে কমেছে এমন নয়। এতটাই আচমকা উধাও হলো, শ্বাস টেনে সটান সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, চোখ পিটপিট করছি পরম বিস্ময়ে।

বুক ভরে দম নিলাম, একবার, দু’বার। কোমর ঘিরে এক হাত বোলালাম। সব ঠিকঠাক।

‘তুমি ঠিক আছ তো?’ রয় প্রশ্ন করল। এতটাই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল ও, চামড়ায় মিশে গেছে ফুটকিগুলো। ‘মুসা?’

জবাব দিলাম না। বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরলাম ক্যামেরাটা। তারপর চরকির মতন ঘুরেই দৌড় দিলাম।

‘অ্যাই!’ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল রয়। ‘তোমার সমস্যাটা কী?’

টু শব্দটিও করলাম না। পার্কিং লটে বেরিয়ে না আসা অবধি ছোটা থামালাম না, শ্বাস নিচ্ছি রাতের শীতল, সতেজ বাতাসে।

আমার সমস্যাটা কী জানি আমি। এই অলক্ষুণে ক্যামেরা।

প্রথমে কিশোর, তারপর সারা…এখন আমি।

ক্যামেরাটা অভিশপ্ত। মানুষের ক্ষতি করে।

এটার কবল থেকে নিস্তার পেতে হবে আমাকে। অদ্ভুত সেই মহিলার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ক্যামেরাটা এক হাতে, এক হাতে হ্যাণ্ডেল ধরে বাইক চালিয়ে বাসার পথে চললাম। খোলা জানালা দিয়ে জোরাল, গমগমে গান বাজিয়ে একটা গাড়ি পাশ কাটাল। প্যাসেঞ্জার সিট থেকে এক মেয়ে হাত নাড়ল আমার উদ্দেশে। কিন্তু আমি পাল্টা নাড়তে পারলাম না।

গ্যারেজের একপাশে ফেলে রাখলাম বাইকটা। জোরে- জোরে হাঁফাচ্ছি, কিচেনের দরজা দিয়ে এক ছুটে বাসায় ঢুকলাম।

চটজলদি নিজের ঘরে উঠে গিয়ে, কেউ আমাকে দেখে ফেলার আগেই ক্যামেরাটা লুকোতে চাই। কিন্তু লিভিং রুমে পা রাখতেই এক লাফে বেরিয়ে এল ফারিহা। রবারের এক কঙ্কালের মুখোশ পরেছে ও

‘আমার ছবি, নাও-নইলে মরো!’ খসখসে কণ্ঠে বলল। দু’হাত তুলেছে থাবা মারার ভঙ্গিতে।

‘ফারিহা, আজ হ্যালোইন নাকি?’ প্রশ্ন করলাম। ‘জানতাম না তো!’

‘আমি ফারিহা নই। আমি সিলভার স্কাল। আমার ছবি তোলো। নইলে রুপোলী দৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করে দেব।’

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বেচারী ফারিহা। এই অপয়া ক্যামেরা দিয়ে আমি ওর ছবি তুললে, ও হয়তো আসলেই কঙ্কাল হয়ে যাবে!

‘সরো।’ ওকে এতটা জোরে ঠেলা দিতে চাইনি। কিন্তু ক্যামেরাটা ঘরে লুকিয়ে রাখতে মরিয়া আমি।

‘অ্যাই-স্কেলিটন মিট!’ গর্জাল ফারিহা, মুঠো নাড়ছে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। ‘দাঁড়াও না, সিলভার স্কালের রাগ কাকে বলে টের পাবে!’

ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম। মাঝে-মাঝে মজার মজার সব কথা বলে ফারিহা।

নিজের কামরায় গিয়ে এক টানে ক্লজিটের দরজা খুললাম। পেছনদিকে, এক গাদা ময়লা কাপড় রেখেছি ভুলেই গিয়েছিলাম।

জিন্স আর শার্টের স্তূপের নিচে কবর দিলাম ভুতুড়ে ক্যামেরাটাকে। এখন আর ফারিহা কোনভাবেই ওটাকে এখানে খুঁজে পাবে না।

বুকের ভেতর যেন ড্রাম বাজছে। অশুভ ক্যামেরাটা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারব না আমি। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, একগাদা দুর্গন্ধযুক্ত, নোংরা কাপড়ের নিচে পড়ে থেকে আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না ওটা।

ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসলাম। সেল ফোনটা বের করে, অন করে কিশোরকে ফোন করলাম।

‘তোমার চোখের কী অবস্থা?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘ঠিক হয়েছে?’

‘না, হয়নি,’ শাণিত কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। ‘তোমার কল্যাণে।’

‘খাইছে, মানে?’

‘বোঝনি?’ কাটখোট্টা গলায় বলল কিশোর। ‘আমার চোখ দুটো এখনও লাল হয়ে আছে। জ্বালা-পোড়া করছে।’

‘খাইছে, আমি সত্যিই দুঃখিত,’ প্রায় গুঙিয়ে উঠলাম।

‘আমি পড়তে পারছি না। টিভি দেখতে পারছি না। হোমওয়র্ক বন্ধ!’ গর্জাল কিশোর। ‘এভাবে আমার পক্ষে স্কুলে যাওয়াও সম্ভব নয়। আমি চাই না কেউ আমার এ দশা দেখুক!’

‘কিশোর, আমি ভয়ানক দুঃখিত’ আবারও বললাম।

‘দুঃখিত?’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘দুঃখিত? মুসা, ওই মহিলা তোমাকে ক্যামেরাটা নিতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু তোমার তো ধারণা তুমি সবজান্তা। যা খুশি তাই করতে পার। দেখো এখন…আমার কী হাল করে ছেড়েছ!’

‘কিশোর, প্লিজ’ মিনতি করলাম।

‘ডাক্তার কখনও এমন রোগ দেখেনি!’ আর্তনাদ ছাড়ল কিশোর। ‘তুমি-তুমি আমার জীবনটা বরবাদ করে দিলে, মুসা!’

‘কিন্তু তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন?’ বললাম। ‘আমরা বন্ধু, তাছাড়া-’

‘না, বন্ধু না,’ জবাব দিল কিশোর। ‘আমরা আর বন্ধু নই। কিছুতেই নয়।

নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না কিশোর এমন কথা বলতে পারে। টের পেলাম থরথর করে কাঁপছে আমার সারা দেহ। কানে ধরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ফোনটা।

ওপ্রান্তে কিশোরের ফোঁপানির শব্দ পাচ্ছি।

‘কিশোর, শোনো, অনুনয় করলাম। আমি কালই ক্যামেরাটা ও বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি যাবে আমার সাথে? আমরা ওই মহিলাকে তোমার চোখের ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করব।’

‘না, যাব না!’ নিচু, ঠাণ্ডা গলায় বলল কিশোর। এবার ফোন কেটে দিল।

.

পরদিন, স্কুল যেন আর ফুরোয় না। ক্লজিটে লুকিয়ে রাখা ক্যামেরাটার কথাই ভাবছি সারাক্ষণ। আর কিশোরকে সাঙ্ঘা মিস করছি। কালকের কথোপকথনের কথা যতবারই মনে পড়ছে গলার কাছে একটা দলা অনুভব করছি।

আজ কী কারণে যেন রবিনও আসেনি স্কুলে। কাল কিশোরের সঙ্গে কথা বলার পর ওকে ফোন করেছিলাম। ও আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। হতেই হবে, কেননা আমি কোন কিছুর বিনিময়েই ওদের দু’জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাই না।

ছুটির পরে, পুরোটা রাস্তা দৌড়ে বাসায় ফিরলাম। ফারিহার আগে পৌঁছতে চাই।

ক্লজিটের ভেতরে ঝাঁপিয়ে ময়লা কাপড়চোপড়গুলো একপাশে ছুঁড়ে ফেললাম। তারপর ক্যামেরাটা নিয়ে বাইকের জন্য গ্যারেজে গেলাম।

জানা থাকা উচিত ছিল এমনটাই হবে। চাকা ফেঁসে গেছে!

কে পরোয়া করে? গুড়ি মেরে হলেও অপয়া এই ক্যামেরাটা ফেরত দিতে যাব আমি!

ওটাকে ব্যাকপ্যাকে ভরে হাঁটা ধরলাম। শীতল বাতাসের ঝাপ্টা লাগছে মুখে। বিভিন্ন বাড়ির সামনের আঙিনার গাছগুলো দুলছে, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করছে। কালো মেঘের আড়ালে হারাতে বসেছে সূর্য।

মনে আছে কীভাবে ওখানে যেতে হবে। স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটছি। আমার ক্লাসের কটা ছেলে সামনের লনে ফ্রিসবি খেলছে।

স্কুল পেরিয়ে, কোনা ঘুরে খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম রকি বিচ পার্কের উদ্দেশে। অচেনা ক’জন ছেলে-মেয়ে পালা করে স্কেটবোর্ডে চেপে গড়গড়িয়ে নামছে পাহাড় বেয়ে।

আহা, আমিও যদি এখন ওদের মত ফুর্তিতে থাকতাম!

পার্কে ঢুকতেই দু’ফোঁটা বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানি টপ-টপ করে কপালে পড়ল আমার। আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে কালচে মেঘপুঞ্জ। বাতাস ক্রমেই আরও শীতল হচ্ছে।

ফিরে যাও, আমার মাথার ভেতর একটা ফিসফিসে কণ্ঠস্বর বলল। মুসা, বাড়ি ফিরে যাও।

‘না!’ জোর গলায় বলে উঠে, হেঁটে চললাম।

পার্কের ভেতর দিয়ে চলেছি, গাছগাছালি দুলছে, কানাকানি করছে। বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে, তবে বৃষ্টি নামেনি।

পার্কের বুক চিরে হনহন করে পা চালাচ্ছি। এবার ছোট- ছোট, চারকোনা বাড়ি নিয়ে সাজানো ছিমছাম এক পাড়ার ভেতর দিয়ে চললাম।

আমি ঠিক রাস্তায় আছি তো? হ্যাঁ। ওই তো, পরের ব্লকে মহিলার লাল বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি।

একটু দাঁড়িয়ে এক হলদে স্কুল বাসকে পেরোতে দিলাম। এবার রাস্তা পার হতে লাগলাম।

ক’পা যেতে না যেতেই পেছনে কাশির শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম।

বোঁ করে ঘুরলাম। কেউ নেই।

খাইছে, আজব তো!

বাকি পথটুকুও পেরোলাম। বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি, ফলে হাঁটার গতি দ্রুততর হয়েছে আমার। এই তো, পৌঁছে গেছি প্রায়।

কিন্তু আবারও থেমে পড়লাম পা ঘষটানির শব্দে। সাইডওয়কে মৃদু ধুপধাপ আওয়াজ।

ঘুরে দাঁড়ালাম এবারও। সরু, নবীন গাছপালাশোভিত এই রাস্তাটা।

কেউ কি কোন গাছের পেছনে ঘাপটি মেরে আছে?

ঘুরে ক’কদম এগোলাম। মহিলার গাড়িপথের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। পেছনে আলতো পদশব্দ পেলাম আবার।

গায়ে কাঁটা দিল আমার।

আমাকে অনুসরণ করছে কেউ।

বৃষ্টি হয়েছে। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম। গাছ থেকে গাছে দৃষ্টি বোলাচ্ছি।

‘কে ওখানে?’ গলা চড়ালাম। বৃষ্টির শব্দে চাপা পড়ল আমার কণ্ঠস্বর।

সাড়া নেই।

‘আমি জানি তুমি এখানেই আছ!’ চিৎকার ছাড়লাম। ‘কে তুমি?’