অপয়া ক্যামেরা – ১৬

ষোলো

চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল আমার।

‘খাইছে, সত্যি? বলো, মা!’

‘গল্পটা লিখে ফেল, তারপর তোদের ক্রিয়েটিভ রাইটিং টিচারকে দে,’ বলল মা। ‘কাহিনীটা খুবই জমজমাট। দারুণ গল্প ফেঁদেছিস। সত্যি বলছি।’

হাঁ হয়ে গেলাম।

‘না, মা। এটা বানোয়াট গল্প নয়। শোনো-’

‘ভৌতিক অংশটা খুব ভাল লেগেছে,’ বলল মা। ‘তোর বাপেরও লাগবে, তাকেও বলিস। আমি তো সবসময়ই তোর কল্পনাশক্তির প্রশংসা করি। তোর রাইসা ফুফুর সাথে এব্যাপারে তোর অনেক মিল। সে তো আজগুবী কথার ওস্তাদ-’

দাঁতে দাঁত পিষলাম। মনে হচ্ছে ফেটে লক্ষ টুকরো হয়ে যাব।

‘এটা… বানানো…গল্প… না,’ টেনে-টেনে বললাম।

‘কী বললি?’ জবাবে মা বলল। ‘আমার ফোন বিপ করছে। কেউ মনে হয় কল করছে। আজ ডিনার একটু দেরি হতে পারে। পরে কথা হবে। ভাল থাকিস।’

ফোন কেটে দিল মা।

এসময় একাধিক কণ্ঠস্বর শুনলাম। লাল-সোনালী ইউনিফর্ম পরা তিন চিয়ারলিডার লাফাতে লাফাতে গেল আমার পাশ দিয়ে। হল ধরে চলে যাওয়ার সময় এক চিয়ার অনুশীলন করল ওরা।

কী আনন্দ! ওরা পরের হলওয়েতে ঢোকা না অবধি দেয়ালে হেলান দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলাম।

অসম্ভব ভয় পাচ্ছি আমি। আতঙ্ক চেপে বসেছে বুকে। প্রিয় বন্ধুদের একজনকে হারিয়েছি ইতোমধ্যেই। বেচারী সারাকে আহত করেছি, সে এখনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। এবং ববি আর এমা গোটা স্কুলকে খেপিয়ে তুলবে আমার বিরুদ্ধে। শীঘ্রি সবাই বিশ্বাস করবে আমি কালো জাদুকর।

কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ালাম। কাঁদা চলবে না।

দরজা ঠেলে খুলে এক ছুটে বাইরে চলে এলাম। বিকেলটা ঠাণ্ডা, বিষণ্ন। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ।

আবহাওয়া নিয়ে মাথা ঘামালাম না। কোন কিছুরই আর পরোয়া করি না আমি, শুধু যেভাবে হোক এই ভুতুড়ে ক্যামেরার হাত থেকে রেহাই চাই।

ছুটতে ছুটতে বাসায় চললাম। কোথাও থামলাম না। কোন গাড়ি চাপা দিতে আসছে কিনা তা-ও দেখলাম না। ধূসর এক আবছায়ার মত আমার পাশ কাটাচ্ছে বাড়িঘর, আঙিনা আর রাস্তাগুলো। আউট-অভ-ফোকাস এক ফটো যেন।

সদর দরজা খুলতেই চিৎকারের শব্দ পেলাম।

‘অ্যাই!’ ফারিহা দৌড়ে এল আমার কাছে। মুখ ফ্যাকাসে। চোখজোড়া ছানাবড়া আর ভয়ার্ত। ‘বাসায় না একটা মৌমাছি ঢুকেছে! আমাকে কামড়াবে না তো?!’

তিন বছর বয়সে নাকে মৌমাছির কামড় খায় ও। তারপর থেকে মৌমাছিকে ওর বেজায় ভয়।

আমার হাত দুটো চেপে ধরল।

‘মারো! মারো ওটাকে!’

‘তুমি কি বাসায় একা?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘মিসেস সিলভা ছিলেন। তবে কিছুক্ষণের জন্যে তিনি বাসায় গেছেন।’

জোরাল গুঞ্জনধ্বনি কানে এল। শব্দটা ফারিহা করছে না। ওর মাথার ওপরে সাঁ করে নেমে এল এক হলদে, পুরুষ্টু ভ্রমর।

আর্তনাদ ছাড়ল ফারিহা।

‘মারো! মারো এটাকে!’

হাত ঝাপ্টায় তাড়াতে চাইলাম ওটাকে। ক্যামেরাটা আমার হাত ফস্কে পড়ে গেল মেঝেতে।

ভ্রমরটা সাঁই করে ওপরে উঠে গেল, এবার তেড়ে এল সোজা আমার মুখ লক্ষ্য করে।

দু’হাত ঝাড়া দিয়ে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ক্রুদ্ধ গুনগুন শব্দ তুলল ওটা-এবং উড়ে চলে গেল জানালার পর্দার কাছে।

ঘুরে চাইতেই দেখি ফারিহা কুড়িয়ে নিয়েছে ক্যামেরাটা। ‘নাআআআআ-’ চিৎকার ছাড়লাম। ‘ফেলে দাও! ফেলে দাও ওটা!’

পরমুহূর্তে সামনের জানালায় ঠোকর খেতে দেখলাম ভ্রমরটাকে। এবার তেড়ে এল ওটা ফারিহার উদ্দেশে।

ক্যামেরাটা হাতের এক ঝটকায় ফারিহার হাত থেকে সরাতে চাইলাম।

এসময় জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ।