বিপদসঙ্কেত – ৩

তিন

পরদিন সকাল। কিশোর আর টিনা নাস্তা করতে গেল মল-এর এক রেস্তোরাঁয়। কালকের ঘটনায় এখনও মন খারাপ ওদের।

‘মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে?’ বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করল টিনা। ‘অন্যকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়, ক্ষতি করতে পারে?’

‘বর্ণবাদীরা ভয়ানক কাপুরুষ হয়, মিসেস টার্নার বললেন। ‘ওরা যে কোন পরিবর্তন, অচেনা মানুষ, কিংবা ওদের ক্ষুদ্র পৃথিবীর জন্যে হুমকি এমন সব কিছুকেই ভয় পায়। মুখের ওপর এসে পড়া এক গোছা চুল সরালেন। ‘উইনিপেগে ফেরার পর এক হেট-মেইল কেস নিয়ে আদালতে যেতে হবে আমাকে। আইন ব্যবসায় নামার পর আর কোন কিছু এতটা খেপিয়ে তোলেনি আমাকে। মানুষ এত মূর্খ হয় কীভাবে বুঝি না।’

‘বেচারাদের জন্যে খুব মায়া লাগছিল, বলল কিশোর ‘লাগেজ স্টোরটার কী দশা করে ছেড়েছে! ওদের জন্যে যদি কিছু করতে পারতাম!’

মি. টার্নার কিশোরের হাতের উল্টো পিঠে মৃদু চাপ দিলেন।

‘তুমি আর টিনা অনেক করেছ। আমরা যখন জেরা করছিলাম তখন তোমরা রহমানদেরকে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছ।’ ঠোঁটের কাছে কফি কাপ তুললেন তিনি। ‘তাছাড়া…উহ্! কী গরম, বাপ রে!’

দাঁত বের করে হাসল কিশোর

‘আঙ্কেল, এত কফি খাওয়া ভাল না,’ বলল ও। ‘ক্যাফেইন আপনার নেশা হয়ে গেছে!’

‘ও ঠিকই বলেছে,’ সায় জানিয়ে বলল টিনা। তাছাড়া তুমি কফিতে যে ক্রিমটা নিচ্ছ ওটা কিন্তু পেটে গিয়ে চামড়া হয়ে যাচ্ছে।’

‘কে বলল?’ মি. টার্নারের প্রশ্ন।

‘হেলথ ক্লাস, আর কে? আমাদেরকে ভিডিয়ো দেখিয়েছে।’

মাথা ঝাঁকাল রাজন।

‘হ্যাঁ, আঙ্কেল। ফুসফুসের আলকাতরা চোয়ানো ক্লোজ-আপ ছবি দেখেছেন? স্কুলের সিগারেটখোরদেরকে দুপুরের ক্লাসে এসব দেখানো হয়।’

‘তোমাদের বয়সী ছেলেপিলেরা স্মোক করে ভাবতেও কষ্ট হয়,’ মাথা নেড়ে বললেন মি. টার্নার। ‘দুনিয়াটা উচ্ছন্নে গেছে।’

‘আরও দুঃসংবাদ শুনবে?’ পুরু টোস্টের এক স্লাইসে জ্যাম মাখিয়ে কামড় দিল টিনা। ‘মমম, দারুণ তো! মন শক্ত করো, বাবা। এরপর আসছে ট্যাটু। তুমি শুনে হাঁ-হাঁ করে উঠো না কিন্তু.‘

‘কী?’

‘মানুষজন গায়ে অদ্ভুত সব উল্কি আঁকে না…’

‘ট্যাটু কী জানি আমি, টিনা। কিন্তু তুই কি বলতে চাইছিস তোরা…

‘তোমরা ছোটরা ট্যাটু করাচ্ছ, তাই না, রাজন?’ মিসেস টার্নার প্রশ্ন করলেন।

‘ওরা হয়তো, আমি না… ‘

‘কী কাণ্ড!’ বাধা দিয়ে বললেন মি. টার্নার। এরপর কী? লোবোটমি?’

স্বামীর হাতে আলতো চাপড় দিলেন মিসেস টার্নার

‘তোমার না আবার ব্লাড প্রেশার চড়ে যায়, ডিয়ার। তুমি বরং এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কফি খাও।’

কিশোর চট করে চোখ তুলে স্কাইলাইটের দিকে চাইল মুহূর্তের জন্য একখণ্ড মেঘে ঢাকা পড়ল সূর্য। চারপাশে সবুজের সমারোহ, বাঁশের পাত্রে চারাগাছ থেকে নিয়ে শুরু করে রক স্টারের মাথার চুলের চাইতেও খাড়া ফার্ন ঘিরে রেখেছে ওদেরকে, এছাড়াও নিচে চোদ্দটা গাছ গুনেছে ও। রেস্তোরাঁটা হর্সশুর আকারে তৈরি, মাঝখানটা ফাঁকা; এক ফ্লোর নিচে টেবিল আর ঝরনাগুলো এবং এক ফাস্ট ফুড আর্কেডের গাছপালা।

‘জায়গাটা দুর্দান্ত!’ বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল টিনা।

‘বাবা, বোমাটার ব্যাপারে আর কিছু জানা গেল?’

‘তেমন কিছু না, তবে পুলিসী তদন্তে জানা গেছে লাগেজ স্টোরে ক্রিমিনালটা কীভাবে ঢুকেছিল। ওরা দোকান মালিককে শো রুমে ইন্টুডার ডিটেক্টর ইনস্টল করতে বলেছে-রহমান দম্পতি বলেছে শীঘ্রি লাগাবে।’

‘বদমাশটা ঢুকল কীভাবে?’

‘সব কটা দোকানের ওপরে বড়সড় খোলামেলা জায়গা আছে। বিশাল, অন্ধকার এক ক্রলস্পেস-দাঁড়ানোর উপায় নেই। টোকাইরা সাধারণত রাতের বেলা গোপনে উঠত ওখানে। সিলিঙের টালি তুলে, দোকানে নেমে চুরি করত, তারপর ক্রলস্পেস দিয়ে পালাত। সিকিউরিটি ভেবেছিল তারা এ সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে কেউ ওখানে ঢোকার নতুন কায়দা বের করে ফেলেছে। ধারণা করা হচ্ছে লাগেজ আনলিমিটেডে ঢুকে সে-ই অপকর্মটা করেছে।’

মিসেস টার্নার নিজের জন্য গ্লাসে পানি ঢাললেন জগ থেকে। ‘যা বুঝছি, বিকেলে দোকান খুলে রহমানরা দেখে সব তছনছ হয়ে আছে। কিন্তু অত দেরি করে তারা দোকান খুলল কেন?’

‘মিসেস রহমানের বোনের ফার্মে দু’জনকেই যেতে হয়েছিল জরুরী এক পারিবারিক কাজে, তাই দোকান সকালে বন্ধ ছিল।’

‘তারমানে,’ বলল কিশোর, ‘বর্ণবাদী লোকটা জানত ওখানে সহজেই ক্ষতি করতে ঢোকা যাবে।’ আরও কফি নিয়ে আসছে যে ওয়েট্রেসটি তার দিকে চাইল কিশোর। ‘কাল লাগেজ আনলিমিটেডে কী ঘটেছে শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ। কী বিশ্রী ব্যাপার!’ মিসেস টার্নারের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল সে। ‘রোজ সকালে আপনাদেরকে দেখি। আরও ক’দিন থাকছেন তো এখানে? আপনাদেরকে পেয়ে সিকিউরিটি গার্ডরা মহা খুশি।’

‘বোমা আবিষ্কার হয়েছে বলে?’ মাথা নাড়লেন মিসেস টার্নার। ‘আমরা এখনই যাচ্ছি না। আমার স্বামীর ধারণা আপাতত কোন বিপদের আশঙ্কা নেই, কাজেই থাকা যায়। বোমা পেতেছে যে তাকে শীঘ্রিই জেলের ভাত খেতে হবে।’

‘তা-ই তো চাই। মল উদ্বোধনের পর থেকে এখানে আছি আমি, আর কাজটা ভালও লাগে। তাছাড়া, হাঙ্গেরী থেকে আমার আত্মীয়রা এখানে বেড়াতে আসছে। আমি চাই না ওরা যে কদিন থাকবে কোন অঘটন ঘটুক, তবে আমি মনে হয় খামোকাই বেশি-বেশি ভয় পাচ্ছি।’

‘তারা হাঙ্গেরী থেকে এই মল দেখতে আসবে?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

‘হ্যাঁ, সারা দুনিয়া এমনকী সাইবেরিয়া থেকেও টুরিস্ট আসে এখানে।’

‘বাবা!’ নোটবইটা বের করল কিশোর। মল নিয়ে আমার ট্রিভিয়ায় দারুণ এক এডিশন এটা।’ কিছু নোট নিয়ে চকিতে চাইল অন্যদের দিকে। ‘আরেকটা পরীক্ষা হয়ে থাক: আমরা মল-এ যেসব ঝাড়বাতি দেখেছি তাতে কটা করে বাতি আছে বলো।’ কেউ যখন জবাব দিতে পারল না তখন বলল ও, ‘দু’হাজার। পরের প্রশ্নঃ এখানে কতজন মানুষ কাজ করে?’

‘এটা তো সোজা,’ বলল ওয়েট্রেস। ‘পনেরো হাজার। কিন্তু কালকের মত ঘটনা আরও ঘটলে মানুষ এখানে কাজ করতে ভয় পাবে। বোমাবাজটাকে আপনি শীঘ্রি গ্রেপ্তার করুন, মিস্টার টার্নার।’

‘চেষ্টা তো করছিই।’ কফিটুকু শেষ করলেন মি. টার্নার। ‘বুরবো স্ট্রিটে পনেরো মিনিটের মধ্যে ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগলের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে আমার!’

‘আমরা যাই তোমার সাথে?’ টিনা জিজ্ঞেস করল।

‘সরি, মা। এই মিটিংটা শুধুমাত্র সিনিয়র পুলিস অফিসারদের। শহর আর প্রাদেশিক সরকারের হর্তাকর্তারাও ওখানে থাকবেন। বোমাবাজটাকে নিয়ে তাঁরা সবাই উদ্বিগ্ন।’

উঠে দাঁড়াল কিশোর।

‘ঠিক আছে, আঙ্কেল, আপনি বোমাবাজটাকে পাকড়ান। আমি বরং জানার চেষ্টা করি রহমান দম্পতির এতবড় ক্ষতিটা করল কে।’

মিসেস টার্নার ওর হাত স্পর্শ করলেন।

‘সাবধানে থেকো, বাছা।’

‘ভাববেন না, আন্টি, আমি মল-এই থাকব।’ নোটবইটা দেখল এক ঝলক। এখানে কতজন নিরাপত্তাকর্মী আছে জানেন?’

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস টার্নার।

‘পঞ্চাশ, তারপরও বলছি: সাবধানে থেকো।’

ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে টিনার দিকে চাইল কিশোর।

‘তুমি যাবে?’

‘পারছি না। গতকাল এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, ওকে কথা দিয়েছি আজ সকালে দেখা করব।’

রাজনের দিকে ফিরল কিশোর।

‘তুই? নাকি আজও ঘরে বসে টিভিতে ন্যাকা ন্যাকা ধারাবাহিক নাটক দেখবি?’

‘না, আমি যাব তোর সাথে।’ বেঁচে যাওয়া একমাত্র মাফিনটা মুখে চালান করে সটান সিধে হলো। এবার পেছনের পকেট থেকে এক পেপারব্যাক বের করল।

‘নাও,’ মাফিন চিবোচ্ছে, আঁউ-আঁউ করে বলল টিনার উদ্দেশে, ‘এটা ফেরত দিতে ভুলে গেছিলাম। সরি, ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝোল লেগে গেছে।’

‘ধন্যবাদ,’ গজগজ করে বলল টিনা, পাতা ওল্টাল। ‘পড়া গেলেই হয়…’ মুহূর্তের জন্য ওর চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো; পরক্ষণে চিল চিৎকারে গোটা রেস্তোরাঁ মাথায় তুলল, বইটা থেকে ওর কোলের ওপর যখন এক কুৎসিত কালো মাকড়সা টুপ করে খসে পড়ল। লোকজন চেয়ে রয়েছে এদিকে, বুথ থেকে লাফিয়ে উঠল টিনা, প্রাণপণে কাপড় ঝাড়ছে। ‘গেল কই? গেল কই?’

‘এই তো এখানে।’ রাজন হাঁটু গেড়ে বসল মাকড়সাটাকে তুলে নিতে। ওটার একরত্তি প্লাস্টিকের মাথাটায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আহা রে, ভয় পেয়েছিস? অবশ্য এমন বিকট চিৎকারে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। জোক শপে যাবি আমার সাথে?’

টিনা পানির জগের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু ওর মা নিরস্ত করলেন।

‘শান্ত হ, মা। ওর কোন ক্ষতি করলে ওর বাবা-মা নির্ঘাত মামলা ঠুকে দেবে।’ এবার রাজনের দিকে চাইলেন। দুষ্টুমিটা একটু থামাও, নইলে কিন্তু যে কোন সময় বিপদে পড়বে।’

‘আচ্ছা, আন্টি।’

একান-ওকান হেসে রেস্তোরাঁ ছাড়ল রাজন।

কিশোর টিনার উদ্দেশে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে শ্রাগ করল, তারপর ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক আর গ্যাটো আউ চকোলেটের ডিসপ্লের দিকে এক পলক লোভাতুর দৃষ্টি বুলিয়ে শশব্যস্তে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করল। লাঞ্চের জন্য বানানো হচ্ছে ওগুলো। রাজনকে নিয়ে এসকেলেটরে চেপে ইনডোর সাগরে নেমে এল ও, দেখল সান্তা মারিয়া-র সাদা পালগুলো উজ্জ্বল সূর্যালোকে ঝলমল করছে।

‘কামানগুলো দেখ, ডেক-এর উদ্দেশে তর্জনী দেখাল কিশোর। ‘জেনে রাখ ওগুলো নকল।’

‘ও জেনে আমার কী লাভ?’

‘লাভ হলো বাসায় ফিরে তোর সাধারণ জ্ঞান দিয়ে সবাইকে চমকে দিবি। সবাই বুঝবে তুই সুপারমল সম্পর্কে কত কিছু জানিস। নইলে তো তুই মামা-মামীকে বলবি সুপারমলটার শেপ টিভি স্ক্রিনের মতন চারকোনা।’

‘আর খেয়ে কাজ নেই! ওকথা বলতে যাব কেন? আমি মলটার অনেক কিছু দেখেছি।’

‘হুম! শুধু তো দ্য ড্রপ অভ ডুম, দ্য মাইণ্ডবেণ্ডার আর দ্য স্কাই স্ক্রিমার।’

‘তাতেই হবে।’

‘আজকে সকালে আমার সাথে ঘুরে বেড়ালে অনেক লাভ হবে তোর। ধরে নে আমি তোর গাইড। তোকে দারুণ দারুণ সব জিনিস দেখাব। তাছাড়া অ্যাটাকটা সম্পর্কেও হয়তো কিছু জানা যাবে-এই মল-এ ছোট ছেলে-মেয়েদের ছড়াছড়ি। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই কোন না কোন গুজব শুনেছে।’

‘কোন বিপদ হবে না তো?’

‘আরে না, রেইলিং বরাবর এগিয়ে সাগরের দূর প্রান্তের ডলফিন পুলটা আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করল কিশোর। ‘তবে ঝুঁকি তো আছেই।’

‘তাহলে বাদ দে না,’ ভীতকণ্ঠে বলল রাজন।

কিশোর ওর বাহু চেপে ধরল।

‘ভয় পাস না! আমি তো আছি, তোকে বাঁচাব।’ হেসে উঠল রাজন।

‘হুঁ, একটা পিটবুল টেরিয়ার দেখলেই বোঝা যাবে। মনে নেই সেবার একটা তেড়ে এসেছিল আমাদের দিকে?’

‘তখন তো জানতাম না ওটা শেকলে বাঁধা।’

‘তুই তো ভয়ে সাদা হয়ে গেছিলি।’

‘ওটা তোর কল্পনা,’ বলল কিশোর। ডলফিন পুলে পাথুরে দেয়ালে বসানো এক দরজা দিয়ে উদয় হলো এক ট্রেইনার। ছোট এক সৈকত আর জলরাশির ওপরে দাঁড়িয়ে দেয়ালটি। __ ভেতর থেকে ভুশ করে ভেসে উঠল ডলফিনগুলোর ডত্তোজত মুখ, এইমাত্র লোকটি যে পাত্রটি নামিয়ে রেখেছে সেটি থেকে খাবার দেয়ার জন্য কী চেঁচামেচিটাই না জুড়ল ওরা! __ হাত দিয়ে সঙ্কেত দিতেই পানির তলায় ডুব মারল ভলাকনের ঝাঁক, এবার পানি থেকে লাফিয়ে উঠল একসঙ্গে। অনন্য একটি মুহূর্তের জন্য শূন্যে চকচক করে উঠল সব কটার দেহ, পরমুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে তলিয়ে গেল ঢেউয়ের তলায়। মুহূর্তখানেক পরে, পুরস্কার বুঝে নিতে মাথা তুলল আবারও। ট্রেইনার প্রাণীগুলোর মুখে একের পর এক মাছ ছুঁড়ে দিচ্ছে, সে সঙ্গে প্রলুব্ধ করছে হড়কে বেলাভূমিতে উঠতে। অবশেষে, ওরা পানিতে পিছলে নেমে গেলে, কিশোর আর রাজন হাঁটা দিল।

‘ইস, আমি যদি ডলফিনের ট্রেইনার হতাম!’ বলল রাজন। ‘কাজটা হেভি!’

এক ভিডিয়ো আর্কেডের ভেতরে ভিনগ্রহের প্রাণীর চোখের মত ঝলসাচ্ছে রঙ-বেরঙের আলো এবং গেমগুলোর ভুতুড়ে, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সবাইকে। চশমা পরা এক ছেলেকে খানিকক্ষণ খেলতে দেখল ওরা, এবার কিশোর জানতে চাইল ও খেলায় যোগ দিতে পারে কিনা।

‘তোমাকে ম্যানিটোবার সেরা খেলাটার মোকাবেলা করতে হবে,’ সাবধান করল ছেলেটি। ‘রিস্কটা নেবে? এই আর্কেড আমার সামার হোম। আর এই খেলাটা আমার গার্লফ্রেন্ড।’ ছেলেটির দাঁতে পুরু ব্রেস লাগানো।

‘লাগেজ স্টোরের জঘন্য ব্যাপারটার কথা, পর্দায় ছবি বনবন করে ঘুরতে শুরু করতেই হাত দুটো সচল হলো কিশোরের, ‘শুনেছ নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ।’

‘এ ব্যাপারে তোমার কী মত?’

শ্রাগ করল ছেলেটা।

‘কাজটা খারাপ, তবে তোমার কী-ই বা করার আছে?’

‘এমন কাজ কে করতে পারে বলে তোমার ধারণা?’

‘স্কাল, আর কে? সবাই তো জানে।’

‘কে?’

‘একজন এই মল-এর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, নিজের নাম বলে স্কাল। ন্যাড়া মাথার এই লোকের মাথায় রাজ্যের শয়তানী বুদ্ধি গিজগিজ করছে। ওর কাছ থেকে দূরে থেকো- খুবই খারাপ লোক, ওর আদর্শ হচ্ছে অ্যাডলফ্ হিটলার। ছবিটা পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’ নিজের স্কোরের দিকে অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিশোর। ‘ওয়াও, রাজন, দেখেছিস? গিনেস বুক অভ রেকর্ডস্ কোয়ালিফায়ার।’

‘এটাকে সহজেই হারানো সম্ভব,’ শ্রাগ করে বলল রাজন। চশমা পরা ছেলেটি মাথা ঝাঁকাল।

‘ও ঠিকই বলেছে। আমার মুভগুলো দেখো।’

ক’মিনিট পরে, কিশোর আর রাজন আর্কেড থেকে বেরিয়ে এল, ছেলেটির স্বছন্দে স্কোর করা দেখে রীতিমত তাজ্জব বনে গেছে ওরা। মল-এর কোথাও থেকে গান-বাজনার জোরাল শব্দ আসছে, করিডর দিয়ে ভেসে আসা আওয়াজে দোকানপাটের জানালা কাঁপছে। শব্দ লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি পা চালাল দু’জনে এবং বিশাল এক বইয়ের দোকানের বাইরে জমে ওঠা ভিড়ে মিশে গেল। উঁচু এক মঞ্চে পারফর্ম করছে এক ব্যাণ্ড, গায়ক টি- শার্ট আর জিন্স পরা এক ছেলে। গিটারে এক হাত আর মাইক্রোফোনে অপরটি রেখে চোখ বুজে গাইছে। বিরহের গান, ছেলেটির সারা মুখ বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে।

‘এটা রক দ্য মল কনটেস্ট!’ কাছিয়ে গেল কিশোর। ‘এরা নিশ্চয়ই ক্রিচার্স অভ দ্য নাইট। শুনেছিলাম এরা নাকি খুব ভাল ব্যাণ্ড, আর এখন তো দেখছি সত্যিই!’

‘রক দ্য মল কনটেস্ট মানে?’ রাজনের প্রশ্ন। ‘কই, আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।’

‘পশ্চিমের সেরা প্রতিভাবানরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এ সপ্তায় গোটা মল জুড়ে মিউজিশিয়ানরা বাছাই পর্বে লড়ছে। বিজয়ী ব্যাণ্ড ভিডিয়ো কন্ট্রাক্ট পাবে, সে সঙ্গে ন্যাশনাল ফাইনালের জন্যে হ্যামিলটনে ট্রিপ।’

‘তাহলে আমাদেরকে দাওয়াত দিল না কেন?’

‘কারণ আমরা গ্যারেজের ব্যাণ্ড, ওখানেই বাজাই। তুই ঠিকমত রিহার্সাল করলে হয়তো চান্স পেতাম।’

‘তাহলে শনিবার সকালটা বাদ দিস। আমার ঘুম নষ্ট হয়।’ শো দেখে, ওটা শেষ হলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যদিকে পা বাড়াল ওরা।

‘আমি রক স্টার হব,’ চেঁচিয়ে উঠল রাজন। ‘রোলিং স্টোন- এর কভারে আমার ছবি ছাপবে।’ কাল্পনিক গিটার বাজাচ্ছে, করিডর বরাবর সাইড-ড্যান্স করতে লাগল ও, আর খদ্দেররা ওর কাণ্ড দেখে মাথা নাড়ল। গভীর মনোযোগে রাজনকে দেখছিল বেলুন হাতে ছোট্ট এক মেয়ে, বুড়ো আঙুল চুষছে, এবার বেলুনটা উপহার দিল ওকে।

‘ধন্যবাদ,’ বলে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কিশোরের দিকে চাইল রাজন। ‘দেখলি, সত্যিকারের সমঝদার প্রতিভার কদর করতে জানে।

‘অ্যাই!’ রাজনকে হাঁটা দিতে দেখে ধমকাল কিশোর। ‘কী হলো?! ওর বেলুনটা দিয়ে দে!’

কাছেই এক বাঁশের খাঁচার পাশে ভিড় জমেছে। ওখানে মিছেমিছি লড়াই করছে দুটো বাঘের ছানা। মুহূর্তের জন্য, বিরতি নিল ছানা দুটি, বড়-বড় শান্ত চোখ মেলে দর্শকদের দেখে নিয়ে আবারও খেলায় মন দিল।

‘আহা রে, বাচ্চাগুলো, বলল রাজন, ‘বেচারীদের খাঁচায় আটকে রেখেছে।’

‘মল-এর একটা গেম ফার্ম আছে। জীব-জন্তুগুলো অনেকটা সময় কাটায় সেখানে।’

‘ছেলেরা, বাঘের ছানা কোলে তোমরা কেউ ছবি তুলতে চাও?’ ক্যামেরার পাশ থেকে বলল এক মহিলা।

‘মহিলার মাথা খারাপ,’ বলল রাজন। ‘অযথা পয়সা নষ্ট করবে কে?’

‘আমি করব।’

ওয়ালেট বের করে, পাতলা হয়ে আসা ভেতরটা স্থিরদৃষ্টিতে দেখতে লাগল কিশোর।

‘টাকাগুলো সব গেল কোথায়?’ এবার ঢোক গিলে বলল। ‘গতকাল মাইওবেণ্ডারে পাঁচটা ট্রিপের কথা ভুলে গেলি? ওখানে তো অনেক খরচা হয়েছে।’

‘তা ঠিক, কিন্তু…’ টাকা গুনল কিশোর। ‘এখানে পকেটমার নেই তো?’ ঠাট্টা করে বলল।

‘পকেটমার কি কিছু টাকা নিয়ে ওয়ালেট রেখে যায়?’ খোঁত করে উঠে বলল রাজন।

শ্রাগ করল কিশোর।

‘হুম। আসলে বেশি খরচ করে ফেলছি আমি।’ একটা নোট বের করে, মহিলাকে বিল মিটিয়ে বসে পড়ল ও। মহিলার সহকারী খাঁচা খুলে একটি ছানাকে তুলে নিল। ‘এইমাত্র গোসল করানো হয়েছে তো, গা এখনও ভালভাবে শুকোয়নি।

‘অসুবিধে নেই, বলল কিশোর। কোলে তুলে নিয়ে ছানাটার কোমল পশমে হাত বোলাচ্ছে, শাটার টিক করে উঠল এবং বাঘশাবক ফিরে গেল খাঁচায়। ছবিটা তৈরি হলে ছানাটার মুখের চেহারা খুঁটিয়ে নিরীখ করল কিশোর, তারপর সযত্নে রেখে দিল ফটোটা।

‘দুর্দান্ত এক স্যুভনিয়ার!’

‘এভাবে টাকা ওড়াতে থাকলে কারও জন্যে আর গিট্ কিনতে হবে না। ভাল কথা, আমার জন্যে কী কিনছিস?’

‘তোর জন্যে কেন কিনব?’

শ্রাগ করল রাজন

‘বারে, আমি না তোর মামাতো ভাই?’ বলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, করুণ করে তুলল মুখের চেহারা।

‘হায়দার মামার জন্যে কাল দারুণ এক গিফ্ট কিনেছি। তাঁর টয়োটার লোগো নিয়ে এক কি চেইন। ওই যে, যে দোকানটায় শুধু গাড়ির জিনিসপত্র বেচে, ওটা থেকে। আর মামীর জন্যে দুটো সুগন্ধী সাবান কিনেছি।’ রাশেদ চাচা, মেরি চাচী, মুসা, রবিন, জিনা আর ডনের জন্যও কিছু না কিছু কিনবে ভেবে রেখেছে ও।

মাথা ঝাঁকাল রাজন।

‘খিদে পেয়েছে।’

‘এইমাত্র না নাস্তা করলি? রাক্ষস কোথাকার!’

‘তাতে কী? পেট গুড়গুড় করছে তো। চল, আইস প্যালেসে যাই।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু আমি এই স্কাল লোকটা সম্পর্কে আরও জানতে চাই।’

ক’মিনিট বাদে, আইস প্যালেসে ঢুকল ওরা। জায়গাটা পুরোদস্তুর এক এনএইচএল রিঙ্কের সমান, গম্বুজাকৃতি উঁচু স্কাইলাইটগুলো থেকে চুইয়ে পড়া সূর্যালোকে ঝিকোচ্ছে ওটা।

‘ওই জানালাগুলো কম্পিউটার কন্ট্রোলড্, বলল কিশোর। ‘বিশেষ কায়দায় ওরা এখানে একইরকম তাপমাত্রা ধরে রাখে।’

.

দুই স্তরে দোকানপাট ঘিরে রেখেছে রিঙ্কটাকে, এবং বহু মানুষ রেইলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে স্কেটারদের দেখছে।

‘অয়েলাররা এখানে প্র্যাকটিস করে। মাঝেমধ্যে সামারে প্রদর্শনী ম্যাচও খেলে, অয়েলারদের কয়েকজন আর অন্যান্য দলের খেলোয়াড়রা মিলে। এই শুক্রবার রাতেও ম্যাচ আছে, তবে তোর কোন আগ্রহ আছে বলে তো মনে হয় না।’

‘এরচেয়ে মানি টক দেখা ভাল।’

‘অর্থনীতির কচকচানি শুনে কী মজা পাস তুই শুনি?’

‘শীঘ্রি আমি স্টক আর বণ্ডের ব্যবসায় নামছি কিনা। জানতে হবে না কীসে মোটা টাকা ঘরে আসবে?’

‘মনে হয় ঠিকই বলেছিস তুই। তা তোর পরামর্শ কী?’

‘কিছু খাওয়া দরকার।

‘আরেকটা মুসা,’ বলল কিশোর মনে-মনে।

কাছের এক স্ট্যাণ্ড থেকে কনি আইল্যাণ্ড হট ডগ কিনল ওরা, তারপর রিঙ্কের পাশ ঘেঁষে এক টেবিলে বসল। নিঃশব্দে চিবোচ্ছে, কিশোর আর রাজন ফিগার স্কেটারদের ঘুরপাক খেয়ে পাশ কাটাতে দেখল, পরনে তাদের বাহারী পোশাক। খাওয়া শেষে, পাশের টেবিলে বসা ওর সমবয়সী এক ছেলের দিকে চাইল কিশোর।

‘এই যে, বন্ধু, স্কাল নামে কারও নাম শুনেছ তুমি?’

ছেলেটি মাথা নাড়ল, তবে কাছেই রেইলিঙে পা তুলে বসে থাকা জনা দুয়েক বড়-বড় ছেলের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। লেদার জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরা, মুখের চেহারায় একরাশ বিরক্তি, কিশোরের উদ্দেশে ঘুরে চাইল ওরা, এবার রাজনের দিকে, তারপর পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল।

‘অ্যাই, ছেলে, ওদের একজন ডাকল কিশোরকে। এদিকে এসো।’