পদচিহ্নের উপাখ্যান – ১০

দশ

ছেলেরা ঘোড়ায় চেপে করালে ঢুকতেই গাড়ি চালিয়ে এলেন মেলানি নানু। ঘোড়াচোরদের কথা তখুনি তাঁকে জানাল ওরা এবং সবাই ভেতরে ছুটল পুলিসে ফোন করতে। শার্প বসে ছিল অফিস কম্পিউটারে। ওদেরকে দেখে চমকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল লোকটা।

‘কম্পিউটারটা একটু খুলেছিলাম আরকী, হেঁ-হেঁ, বলল, চট করে অফ করল ওটা। এবার সবার গম্ভীর মুখের দিকে চাইল। ‘কিছু হয়েছে নাকি?’

কিশোর রিসিভার তুলে ডায়াল করল।

‘আমি পুলিসে ফোন করছি আপনার ঘোড়াচোর ভাই আর আপনার দোস্তকে গ্রেপ্তার করার জন্যে।’

নিমেষে মুখের চেহারা পাংশু হয়ে গেল শার্পের।

‘তা-তার মানে?’ তুতলে বলল।

‘আপনারা সঙ্ঘবদ্ধ ঘোড়াচোর চক্র,’ বলল রবিন। ‘এবং আপনি আমার ক্যামেরা চুরি করেছেন।’

‘আ-আমি, চু-চুরি করতে যাব কেন?’ কণ্ঠা রীতিমত লাফাচ্ছে ভয়ার্ত লোকটার।

‘কারণ,’ বলল মুসা, ‘আপনার পুরনো বার্নের বন্ধু আপনার ঘোড়াদের ছবি নিতে দেখেছিল আমাদের। আমাদের ছবিগুলো প্রমাণ দেবে আপনার উদ্ধার করা ঘোড়াগুলো আসলে চোরাই মাল। আপনি রবিনের ক্যামেরা চুরি করে প্রমাণ লোপাট করতে চেয়েছেন।’

‘ক্ব-কী যা তা কথা বলছ,’ বলল শার্প।

‘ক্যামেরা চোরকে কেউ এ অফিসে ঢুকতে দেখেনি,’ জানাল মুসা। ‘মেলানি নানু বলেছেন আপনি সারাক্ষণ এখানে বসে কম্পিউটার চালিয়েছেন, কাজেই কেউ আপনাকে চোর বলে সন্দেহ করেনি।’

রিসিভার রাখল কিশোর।

‘পুলিস রওনা দিয়েছে।’

কথাটা শুনেই দরজার দিকে দৌড় দিল শার্প। আচমকা দোরগোড়ায় উদয় হলো শর্টি। তার খাট, চওড়া দেহ পথ আগলে দাঁড়াল শার্পের।

‘আপনি যে একটা ফোর্থ ক্লাস ভেট আমি আগেই জানতাম, ‘ বলল শর্টি। ‘যে কোন ভাল চিকিৎসকের বোঝার কথা ড্রাগনের জন্যে বিশেষ একটা চারকোনা নাল দরকার। ব্যাপারটা আমিই প্রথম খেয়াল করি। জানাইও আপনাকে। কিন্তু তারপরও আপনি আমার কথা বোঝেননি।’

‘আপনি ডেবোরাকে বলেছিলেন পা না সারা অবধি ড্রাগনকে পশ্চিমের মাঠে রাখতে।’ বলল রবিন। ‘অথচ ওর পা ঠিকই ছিল। আপনি ওকে চুরির ফন্দি এঁটেছিলেন। ওর পিঠের সাদা ড্রাগনের ছাপটা কালো জুতোর কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। বেড়ার কাছে জই ফেলার অপকীর্তিটাও আপনারই। ড্রাগন আর অন্য ঘোড়াগুলো জইয়ের লোভে বেরিয়ে এলে, আপনি ড্রাগনকে চুরি করে ওই পুরনো বার্নটায় নিয়ে যান।’

দূরে সাইরেনের বিলাপধ্বনি শোনা গেল। শীঘ্রিই শার্প আর তার দুষ্কর্মের সহযোগীরা জেলহাজতের পথে রওনা হলো।

.

ক্যাম্পফায়ারে হট ডগ সেঁকা হচ্ছে। র‍্যাঞ্চকর্মীদের সঙ্গে ওখানে বসেছে ছেলেরা। হ্যারি ছোট্ট আগুনটাকে জ্বেলে রাখতে এক গাদা কাঠ জড় করেছে। ডন আগুনে দুটো হট ডগ ফেলল, তবে ওর কাঠিতে টিকল মাত্র একটা।

‘আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল,’ বলল হ্যারি, ‘শার্প যে একটা ঠগ।’

‘আপনি তো ডেবোরাকে খেদাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন, ‘ বললেন মেলানি নানু। ‘কাজে তো কোন মনই ছিল না আপনার।’

ডেবোরার দিকে ঘুরে বসল হ্যারি।

‘আমি সত্যিই দুঃখিত,’ বলল আন্তরিক কণ্ঠে। ‘আমি আমার বন্ধুকে কাজটা পাইয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’

‘আপনি হানি-বানিকে ছেড়ে দেন, তাই না?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘তারপর বেড়া ছিঁড়ে, গাছের ডালটা এমনভাবে ফেলেন যেন লোকে ভাবে ওটা একটা দুর্ঘটনা।’

মাথা নুয়ে গেল কাউবয়ের, চরম লজ্জিত।

‘ভেবেছিলাম গোটা দুই ঘোড়া হারালে ডেবোরা হেনস্তা হবে। তাই এমন ব্যবস্থা করি যাতে মনে হয় ওর ভুলেই মাঠ থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে ঘোড়া দুটো।’

স্মিত হাসল শর্টি।

‘আলসের ধাড়ি দুটো বেশিদূর যায়নি। শার্পের ভাই স্বীকার করেছে ওদেরকে বেড়ার কাছে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। ও ভয় পাচ্ছিল র‍্যাঞ্চের ঘোড়া চুরি গেছে জানলে পুলিস আসবে। এবং ও কখনওই চায়নি পুলিস র‍্যাঞ্চে এসে তল্লাশী করুক। কারণ তাহলে পুরনো বার্নে লুকানো চোরাই ঘোড়াগুলোর কথাও জানাজানি হয়ে যাবে। তাই লোকটা হানি-বানিকে ট্রেইলারে তুলে ভালমানুষের মত দিয়ে যায়।’

হ্যারির দিকে চোখ সরু করে চাইলেন মেলানি নানু।

‘আপনাকে আমার এখুনি বিদেয় করে দেয়া উচিত,’ বললেন। ‘আপনি ডেবোরা এবং আমাদের সবাইকে যেরকম ঝামেলায় ফেলেছেন।’

‘বাদ দিন,’ বলল ডেবোরা। চাইল হ্যারির দিকে। ‘আমি যথেষ্ট শক্ত ধাতের মেয়ে, আপনি যা-ই ভাবুন না কেন। মাথায় বুদ্ধিও রাখি। গত রাতে লাইব্রেরিতে গেছিলাম, শার্প যে বইটা লিখেছে বলেছিল ওটা খুঁজতে হাউ টু রেইয ডট্‌স্। আজ ছুটির দিনে বইটা পড়ব ভেবেছিলাম। কিন্তু লাইব্রেরিয়ান কোথাও ওটা খুঁজে পেল না। তাই এখানে গাড়ি নিয়ে আসি শার্পের কাছে জানতে বইয়ের নামটা ঠিক বলেছি কিনা। তখনই দেখি বড় হর্স ট্রেইলারটা পশ্চিমের মাঠে দাঁড়িয়ে। শার্প ঘোড়া আসবে কিংবা যাবে এমন কোন কথা আমাকে বলেনি। তাই ব্যাপারটা দেখতে যাই।’ ছেলেদের দিকে চাইল ও। খড়ের মাঠে তোমাদের স্যাল্ পরানো ঘোড়াগুলোকে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে দেখেই খটকা লাগে, বুঝি নিশ্চয়ই কোথাও কোন গড়বড় আছে।’

হ্যারি হ্যাট খুলে বুকের ওপর ধরল।

‘মেলানি, ডেবোরা, আমি ক্ষমা চাই,’ বলল অনুতপ্ত কণ্ঠে। ‘আমাকে আরেকটা সুযোগ দিন, প্লিজ।’

‘তা কী করে হয়…’ শুরু করেছিলেন নানু।

‘এবারের মত ওকে মাফ করে দিন,’ বলল শর্টি। ‘ভুল তো সবারই হয়। ও নাহয় বন্ধুর স্বার্থেই ভুলটা করেছে।’

নিজের হট ডগে সরষে ছেটাল ডন।

‘শর্টি, আপনি বললেন ভুল সবারই হয়। আপনি কি আমার বয়সে কোন ভুল করেছেন?’ জবাব চাইল।

‘অবশ্যই, জানাল শর্টি।

‘কী ভুল?’ আবারও প্রশ্ন ডনের।

ক্যাম্পফায়ারের আলোতেও এমনকী ছেলেরা শর্টির মুখের চেহারা গাঢ় লাল হতে দেখল।

‘উম,’ বলল সে, ‘আমার বয়স যখন তোমার চেয়ে একটু বেশি, তখন আমি আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুকে ছেড়ে চলে যাই। এবং কখনওই তাকে আর কোন চিঠিপত্র লিখিনি। একবারও জানাইনি…ওকে কতটা মিস করি।’

মেলানি নানু সামনে ঝুঁকলেন, স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন শর্টির মুখের দিকে।

‘টিম?’ বললেন। ‘টিম অস্টিন? আপনি কি সত্যিই সে?’ বৃদ্ধ মাথা ঝাঁকাল। মেলানি নানু কিশোরী মেয়ের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘তাহলে এতদিন চুপ ছিলে কেন?’

‘ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে মনে রাখনি। তাই ভাবলাম এখানে এসে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ নিলে তুমি হয়তো আমাকে পছন্দ করতে শুরু করবে। সেই ষাট বছর আগের কথা। আমি যেহেতু কোন যোগাযোগ রাখিনি, ভয় পাচ্ছিলাম তুমি যদি রাগ করে আমার মুখ দেখতে না চাও?’

‘কী যে বলো!’ সামনে এগিয়ে লোকটিকে আলিঙ্গন করলেন মেলানি নানু। ‘গত ষাট বছর ধরে ভেবে চলেছি তোমার কী হলো, কেন তুমি দেখা কর না! তুমি আমার প্রিয় বন্ধু, সবসময়ের এবং চিরকালের।’ পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা।

.

পরে, আগুন যখন নিভু নিভু, তখনও শর্টির পাশে বসা মেলানি নানু। দু’জনেই তাঁরা ক্যাম্পফায়ারের আলোয় আলোকিত। কিশোর শেষ গ্রাহাম ক্র্যাকারটিতে চকোলেটের শেষ টুকরোটা রেখে ওটার মাথায় শেষ মার্শম্যালোটা দিল।

‘ম্যাপ্‌ল্‌ গাছ আর, ড্রাগনের স্টলে খোদাই করা হার্টগুলোর রহস্য ভেদ হলো এবার, বলল কিশোর, ‘যেগুলোর ভেতরে টি এ আর এস এল লেখা… টিম হচ্ছেন আপনি, শর্টি-টিম অস্টিন।’

লাজুক হাসি ফুটল শর্টির ঠোঁটে।

কিশোর বলে চলল, ‘আর, মেলানি নানু, আমি জানি আপনার নামের শেষে লার্নার আছে। কিন্তু আপনার সত্যিকারের নাম কোনটা?’

ঘাড় কাত করলেন নানু, অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসি তাঁর মুখে।

‘দাদু আমাকে ছোটবেলায় আদর করে মেলানি বলে ডাকতেন। কিন্তু আমার আসল নাম অন্য। সেটা নাহয় রহস্যই থাকুক।’

ছেলেরা আপত্তি করল না।

***