পদচিহ্নের উপাখ্যান – ৮

আট

ছেলেরা বাঙ্কে শুয়ে রয়েছে। সজাগ। এক ঘণ্টা গেল। আরেক ঘণ্টা। কিন্তু ঘুম আর আসে না। বেড়ার খুঁটি গাড়তে গিয়ে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে কিশোরের। লোকাস্ট ডালটার আঁচড়ে মুখ আর বাহুর ক্ষতগুলো জ্বালা করছে।

যে মহিলার ঘোড়া চুরি গেছে, বাটারকাপ নাম, তার কথা মনে পড়ল মুসার। ফ্লায়ারগুলোয় ওর আঁকা ড্রাগনের ছবিটা নিশ্চয়ই ঘোড়াটাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

রবিনের মন এখনও খারাপ। কে চুরি করল ওর প্রিয় ড্রাগনকে? ও ভাল আছে তো?

ঘোড়াদের পানির টাবের গোল্ডফিশগুলোর কথা ভাবছে ডন। পানির ছিটে গায়ে মাখতে ভালবাসে সেই ছোট্ট বাদামি টাট্টু ঘোড়াটার কথা মনে খেলা করছে। হানি আর বানিকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে সেই হাড্ডিচর্মসার লালচুলো লোকটার কথা মনে পড়ছে।

‘ঘোড়ায় চড়া কাউবয়ের ছবিওয়ালা লাইসেন্স প্লেট আছে কার গাড়িতে?’ জিজ্ঞেস করল। ভুলেই গেছে ওর এখন ঘুমিয়ে থাকার কথা।

বাঙ্ক থেকে নিচে উঁকি দিল কিশোর।

‘কোথায় দেখেছ ওটা?’ ফিসফিস করে বলল।

‘হানি-বানিকে যে নীল পিকআপ ট্রাকটা নিয়ে আসে ওটায়।’ চোখ বুজে লাইসেন্স প্লেটটার কথা ভাবল ডন। ‘স্টেটের নামে একটা ডব্লিউ আর একটা ওয়াই ছিল।’

‘ওয়াইয়োমিং, ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।

‘ওয়াইয়োমিং কি কানেক্টিকাটের কাছে?’ ডন জানতে চাইল। গুঙিয়ে উঠল রবিন। ডন আরেকটু ভালভাবে পড়তে পারলেই ওকে ভূগোল শেখাতে হবে।

‘ওয়াইয়োমিং এখান থেকে বহু দূরে,’ জানাল। ‘জ্যাক নানার বাসায় গিয়ে তোমাকে ম্যাপ দেখাব।’

‘সবাই আমরা জেগে, বলল কিশোর, ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল। জ্বলে উঠল আরও তিনটে ফ্ল্যাশলাইট। রবিনের ওপর ফ্ল্যাশলাইট তাক করল কিশোর। এক প্রতিবেশী হানি-বানিকে ফেরত দিয়েছে, তাই বলেছিলে না?’

‘হ্যাঁ, ডেবোরা বলেছে লোকটা তার মাঠে ওদেরকে খুঁজে পায়।’

ফ্ল্যাশলাইটটা বারবার জ্বালছে আর নিভাচ্ছে কিশোর।

‘কানেক্টিকাটে মেলানি নানুর কোন পড়শীর ওয়াইয়োমিঙের লাইসেন্স প্লেট থাকবে কেন?’

ছেলেরা কামরার ছাদে একে অপরের আলোকে ধাওয়া করল।

‘মেলানি নানু লোকটাকে চেনেন না বলেছেন,’ বলল মুসা। ‘তারমানে মাত্রই এসেছে।’

‘ওয়াইয়োমিং প্লেটের ব্যাখ্যা মিলল, বলল কিশোর। চিন্তামগ্ন। চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। ভেবে দেখো, শর্টি বলেছে সে এই লোকটাকে আগে কখনও দেখেনি।’

দেয়ালে আলো বুলিয়ে চক্র কাটছে রবিন।

‘শর্টির সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি? ড্রাগনের খোঁজে যখন গেলাম, দেখি এক পাল ঘোড়া নিয়ে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াগুলোকে বেড়ার কাছে টানতে ও যদি জই ফেলে থাকে? তারের বেড়ায় ইচ্ছেমত খোলা-বন্ধের ওই কারসাজিটা তো ও-ও করে থাকতে পারে?’ গা কেঁপে উঠল ওর। ‘ড্রাগন হয়তো জই খেতে গিয়েছিল আর শর্টির কোন দোসর এসে ওকে চুরি করে নিয়ে গেছে।’

‘শর্টি বলেছে সে এখানেই বড় হয়েছে, জানাল গোয়েন্দাপ্রধান। ‘আট বছর বয়সে চলে যায়, কিছুদিন হয় ফিরেছে।’

চিবুকের নিচে ফ্ল্যাশলাইট ধরল ডন। কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে এখন ওকে।

‘শর্টি হয়তো মেলানি নানুর ঘোড়াগুলো চুরি করতেই ফিরে এসেছে,’ বলল।

ছাদ বরাবর ফ্ল্যাশলাইটের আলো বোলাল মুসা। আচমকা তড়াক করে উঠে বসল, হাঁফাচ্ছে।

‘খাইছে, একটা কথা মনে পড়ল।’

‘কী, কী?’ সমস্বরে প্রশ্ন এল।

‘ধরো, আমরা কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে এখানে একটা অচেনা কুকুর দেখলাম। আমরা জানব কীভাবে ওটা কার?’

‘ডগ ট্যাগ?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

‘ট্যাগ নেই,’ বলল মুসা। ‘শুধু কুকুর।

‘তাহলে জানার কথা নয় কুকুরটা কার,’ বলল নথি, ‘কারণ আমরা তো এখানে থাকি না।’

‘ঠিক তাই!’

‘মানে?’ ডন শুধাল।

‘মানে হলো এই, যে লোক হানি-বানিকে দিয়ে গেছে সে বলেছে ওদেরকে তার তৃণভূমিতে পেয়েছে। কিন্তু সে আগে কখনও ডেয়ার টু ড্রিম র‍্যাঞ্চে আসেনি। তাহলে জানল কীভাবে ও দুটো এই র‍্যাঞ্চেরই ঘোড়া?’

‘হর্স ট্যাগ,’ বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ডন।

‘আমি সিরিয়াস,’ বলল মুসা।

‘জানার কথা নয় কোনমতেই,’ বলল রবিন। ‘আচ্ছা, ও যদি আদৌ প্রতিবেশী না হয়? যদি চোর হয়?’

‘তা কী করে হয়?’ হাই তুলল কিশোর। ‘চোরে জিনিস চুরি করে।’ হাই তুলল আবারও, ওর দেখাদেখি অন্যরাও। ‘চোরাই মাল ফিরিয়ে দেয় না।’

‘আমার ক্যামেরাটা যে হাপিস করেছে তার মত,’ বলল নথি।

‘আমি শিয়োর এটা পুরনো বার্নের সেই লোকটার কাজ, ‘ দৃঢ়কণ্ঠে বলল ডন। ‘যে রেসকিউ হর্সদের ছবি নিতে বাধা দিচ্ছিল তোমাকে।’

‘নাহ্,’ বলল মুসা। মেলানি নানু বলেছেন শার্পের ভলান্টিয়াররা পুরনো বার্নটায় থাকে। ওরা কখনওই মেইন হাউসে আসে না। ক্যামেরা চোর এমন কেউ যে নানুর অফিসে ঢুকলে কারও সন্দেহ হবে না।’

‘নানুর মত?’ প্রশ্ন ডনের। গুঙিয়ে উঠল সবাই। ‘কিংবা আমাদের?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা।

‘ওটা এমন কেউ যে যখন খুশি ওখানে ঢোকে- বেরোয়-শার্প, ডেবোরা, হ্যারি কিংবা শর্টির মতন।’

আবারও হাই উঠল কিশোরের।

‘আমি শাপকে গাড়ি চালিয়ে ঘোড়ার ওষুধ কিনতে যেতে দেখেছি,’ জানাল। কাজেই ও চোর নয়। কিন্তু আমরা বেড়া মেরামতের পর হ্যারি কোথায় গিয়েছিল জানি না। এবং আমাদেরকে ট্রেইল রাইডে নেয়ার আগে ডেবোরা কোথায় ছিল তা-ও জানা নেই। আর শর্টি তো সবখানেই অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

ছেলেরা বিষণ্ন হয়ে গেল। পরিচিত কাউকে ক্যামেরা চোর ভাবতে চায় না ওরা। কিন্তু এরা ছাড়া আর কে চুরি করতে পারে মাথায় এল না ওদের।

পরিশ্রান্ত ছেলেরা ওদের ফ্ল্যাশলাইটের আলো নিভিয়ে, ব্ল্যাঙ্কেট টেনে নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। একে-একে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। ডন জেগে থাকতে প্রাণপণ যুঝল। কিন্তু শেষমেশ ওর চোখের পাতাও ভারী হয়ে এল।

.

ধোঁয়া! ভোরবেলায় ছেলেদের ঘুম ভাঙল ধোঁয়ার গন্ধে। বিছানা থেকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নেমে ছুটল ওরা জানালার কাছে।

‘ওই যে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা, দূরে এক কমলা আভা দেখাল তর্জনী দিয়ে। র‍্যাঞ্চহাউসে দৌড়ে গেল মেলানি নানুকে জানাতে। তিনি ইতোমধ্যেই কিচেনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নাস্তার জন্য বিস্কিট বেক করতে।

‘নো চিন্তা,’ তিনি ওদেরকে বললেন। ‘হ্যারি লোকজন নিয়ে ফায়ার পিটে গেছে। ক’দিন পরপরই ভোরে ঝোপঝাড় পোড়ায় ওরা, বাতাস যখন স্থির থাকে। এতে আগুন ছড়ানোর ভয় থাকে না। তোমরা চাইলে নাস্তার আগে ঘোড়া নিয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারো।’

ছেলেরা দ্রুতই পোশাক পরে স্যাল্ আপ করল, এবার র‍্যাঞ্চ থেকে রাইড করে বড়সড়, খোলামেলা এক মাঠে পৌঁছল। ওটার মাঝখানে গনগনে এক অগ্নিকুণ্ড গর্জাচ্ছে। আগুনে মরা ডাল-পাতা, ঝোপঝাড় ছুঁড়ে দিচ্ছে র‍্যাঞ্চকর্মীরা। রুমালে নাক- মুখ ঢাকা তাদের। আগুনটাকে ঘিরে ট্রাক্টর নিয়ে বারবার বড় করে চক্কর দিচ্ছে হ্যারি। তার ট্রাক্টরের পেছনে অতিকায় এক আঁকশি হুক দিয়ে জোড়া। মাটিতে আঁচড় কেটে আগুন ছড়াতে বাধা দিচ্ছে ওটা। ছেলেদের ঘোড়াগুলো খোঁত-খোঁত শব্দ করে নার্ভাস ভঙ্গিতে পিছিয়ে গেল।

‘হ্যারি মনে হয় বেড়া-ভাঙা লোকাস্ট ডালটাকে এখানেই এনেছিল,’ বলল কিশোর।

মুসা ওর স্কেচের কথা ভাবল।

‘কিশোর,’ বলল ও, বেড়ার কাছে মাত্র তিনটে বড় গাছ। আর সব কটাই ম্যাল্। ওখানকার আশপাশে কোন লোকাস্ট গাছ নেই। কেউ ডালটা ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর ইচ্ছে করে বেড়ার ওপর ফেলেছে।’

হ্যারিকে ট্রাক্টর চালাতে দেখছে ওরা। র‍্যাঞ্চ ম্যানেজার ওদেরকে দেখে ট্রাক্টর চালিয়ে এদিকে এল। রুমাল টেনে নামাল সে। ধোঁয়ায় মুখে কালিঝুলি লেগে রয়েছে। আগুনের তাপে লোকটার সোনালী গোঁফজোড়ার দু’প্রান্ত নুয়ে পড়েছে।

‘ঘোড়াগুলোকে সরাও এখান থেকে,’ বলল ভ্রূ কুঁচকে। ‘ডেবোরা পাঠিয়েছে বুঝি তোমাদেরকে?’

‘ডেবোরা?’ প্রশ্ন করল রবিন।

নাক দিয়ে বিরক্তির শব্দ করল হ্যারি।

‘বেয়াক্কেলে মেয়েটা এমনকী এটাও জানে না ঘোড়ারা ধোঁয়া দেখে ভয় পেতে পারে। এত বাজে র‍্যাংলার আগে আর দেখিনি, বাপু। মেলানি আমার বন্ধুকে কাজটা দিলে ঠিকঠাকমত চলত র‍্যাঞ্চটা! এখন ঘোড়াগুলোকে সরাও এখান থেকে।’ নাকে রুমাল টেনে তুলে ট্রাক্টর নিয়ে আগুনের কাছে ফিরল ও।

ছেলেরা ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে র‍্যাঞ্চহাউসে ফিরে চলল।

‘আচ্ছা, হ্যারি হানি-বানিকে ছেড়ে দেয়নি তো?’ জিজ্ঞেস করল রবিন। যাতে সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে ডেবোরা ঘোড়াদের যত্ন নিতে জানে না?’

‘খাইছে, ওরা পালানোয় সব দোষ অবশ্য সে ডেবোরাকেই দিয়েছিল,’ বলল মুসা।

বাহুর ক্ষতগুলো দেখল কিশোর।

‘হানি আর বানির গায়ে আঁচড়টাও লাগেনি। এর অর্থ ডালটা বেড়ার ওপর পড়ার আগেই পালায় ওরা। হ্যারি বেড়ার তার কেটে, ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়ে, তারপর বেড়ার ওপর ডালটা ফেলে থাকতে পারে।’

‘এবং পরে হয়তো ড্রাগনকে চুরি করে সবার কাছে ডেবোরাকে আরও অপদস্থ করতে চেয়েছে, বলল নথি। ‘বোঝাতে চেয়েছে ও অযোগ্য।’

‘খাইছে, মেলানি নানুকে বলা উচিত না আমাদের?’ মুসা জানতে চাইল।

‘কোন প্রমাণ তো নেই আমাদের হাতে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ‘ভাবতে হবে কীভাবে প্রমাণ জোগাড় করা যায়।’