বিপদসঙ্কেত – ৬

ছয়

সার্ফেসে উঠে, কিশোর আর টিনা মুখোশ খুলল।

‘ওই ডাইভারটা বিপদে পড়েছে,’ চিৎকার করে বলল কিশোর। ‘কোথায় সে?’

‘ওই যে ওখানে, সাবমেরিন ডকের দিকে সাঁতরাচ্ছে। দেখে তো মনে হচ্ছে এখন আর কোন সমস্যা নেই।’

‘ওটা গর্ডন! কী হয়েছিল তার?’

ক’মুহূর্ত পরে কিশোর আর টিনা মিলিত হলো গর্ডনের সঙ্গে। অন্য ডাইভাররা ডকে পৌঁছলে গর্ডন তার এয়ার হোসের কাটা জায়গাটা দেখাল।

‘ইচ্ছে করে কেউ চিরে দিয়েছে! আমি ডুবে মরতে পারতাম।’

‘কী হয়েছিল বলবেন?’

লুইস প্যাটেনের দিকে চকিতে চাইল গর্ডন, বিষণ্ন চোখে ডকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।

‘সাব টানেলে ঢুকি আমরা, তারপর লুইসকে সঙ্কেত দিয়ে জানাই আমি পানির তলার ভাঙা জাহাজটা এক্সপ্লোর করতে চাই। দু’জন ডাইভারের জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা নেই ওখানে, তাই ভগ্নস্তূপের কাছে আমি একাই যাই। গভীর ছায়ার ভেতরে ঢুকতেই আমার এয়ার হোস চিরে যায়।’

‘কিন্তু কীভাবে?’

‘আমি নিশ্চিত নই-খুব দ্রুত ঘটে যায় ব্যাপারটা। আমি একটা হাত আর এক টুকরো প্রবাল দেখি, তারপর বুদ্বুদ উঠতে থাকে আমার মাস্ক ঘিরে।’

‘হামলাকারী হোস কেটেছে প্রবাল দিয়ে?’

‘মনে হয়। ক্লাবের কেউ সাথে ছোরা রাখে না।’

একটু পরে, লিডিয়া সার্ফেসে উঠল। খবরটা শুনে গুম হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরল গর্ডনকে।

‘এডমনটন থেকে চলে যাও, প্লিজ! কোথাও ছুটি কাটাও, সব খরচা আমি দেব, স্রেফ পালাও এখান থেকে। প্লিজ!’

হেসে উঠল গর্ডন।

‘আমাকে ভীতু পেয়েছ? অত ভেবো না তো, লিডিয়া। আমি ঠিকই নিজের খেয়াল রাখতে পারব।’

অল্প সময় পরেই, এলিস আর ওর বাবা পানি থেকে উঠে এলেন এবং ঝটপট তাঁদেরকে জানানো হলো কী ঘটেছে। মি. কুপার সর্বশেষ এই দুঃসংবাদটা শুনে প্রচণ্ড খেপে গেলেন এবং শশব্যস্তে এলাকা ছাড়লেন। তিনি চলে যেতেই, অন্যান্য ডাইভারদের উদ্দেশে ঘুরে চাইল এলিস।

‘আমি জানি আপনাদেরই কেউ একাজগুলো করছেন, বলল। ‘তবে আপনাদের মতলব যা-ই হোক না কেন, এসবে কাজ হবে না। শপথ করে বলছি: কাজ হবে না।’

.

অনন্তর সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ওয়াটারপার্কে টিকিট কিনতে গিয়েও এয়ার হোসটা নিয়ে কথা বলল কিশোর।

‘কাজটা কে করতে পারে?’

এক নিরাপত্তাকর্মীকে ওদের স্পোর্টস ব্যাগের ভেতরটা পরীক্ষা করতে দেখল অনন্ত, এবার হাত নেড়ে ঢুকতে বলা হলো দু’জনকে।

‘জানি না,’ বিশাল লকার রুমটায় ঢোকার সময় বলল অনন্ত। ‘তুমি বললে সাগরে ডাইভারের অভাব ছিল না। সবারই সুযোগ ছিল কাজটা করার।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু অন্য কেউও হতে পারে। আজ ভোরে নির্জন মল-এ অচেনা কোন মানুষ গোপনে ঢুকে থাকে যদি? স্কুবা গিয়ার পরে পানির নিচে ভগ্নস্তূপে লুকানো তো দুই মিনিটের কাজ।’

‘তা ঠিক, কিন্তু কেন?’

‘সেটাই জানতে হবে আমার।’

ওয়াটারপার্কের ভেতরে বাতাস গুমট। চারধারে গজিয়েছে পাম গাছ এবং কৃত্রিম সৈকতে ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দ। অনেকগুলো বদ্ধ ওয়াটারফ্লাইডের স্বচ্ছ চামড়ার নিচে ঘুরপাক খেয়ে নিচে নামছে বাচ্চারা এবং অন্যরা কাছেই গাছের সারি নিয়ে তৈরি এক ভলিবল কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে। দর্শকদের মধ্যে এক তরুণকে চিনল ওরা।

‘স্কাল,’ বলে উঠল কিশোর। ‘আমাদের দেখে ফেলেছে।’

‘তাতে কী?’ দূরে জোরাল এক ভেঁপু বেজে উঠলে বলল অনন্ত। ‘অ্যাই, সার্ফ উঠছে। এসো!’

এক ছুটে সৈকতে গিয়ে এক ব্রেকারের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা, তারপর পানিতে হুটোপুটি করে উঠে পড়ল হাসতে- হাসতে, এবার পুলের গভীর প্রান্তে এক জলপ্রপাতের নিচে লুকানো মেশিনে তৈরি ফেনায় সাঁতরাতে লাগল। খানিকক্ষণ বডি-সার্ফ করল ওরা, তারপর তীরের উদ্দেশে পা বাড়াল। এসময় কিশোর দেখল স্কাল আর তার দুই বন্ধু অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।

‘ওদেরকে দেখেছ?’

‘স্রেফ উপেক্ষা করো,’ পানি ভেঙে পারে ওঠার সময় বলল অনন্ত।

‘তা না হয় করলাম, তবে কাজটা অত সোজা নয়।’

নিজেদের তোয়ালে তুলে নিয়ে, এক পাম গাছের তলায় পেতে রাখা দুটো খালি বিচ চেয়ারে গিয়ে বসল ওরা। তিন ঝামেলাবাজ ওদেরকে অনুসরণ করে, এসে হাজির হলো। ওদের পেশীবহুল বুকে ফেনা মেখে রয়েছে।

‘তো!’ অনন্তর দিকে অগ্নিদৃষ্টি ধরে রেখেছে স্কাল। ‘কয়েক মাস পরে এখানে এসে তোমার কুৎসিত মুখটা দেখতে হচ্ছে আমার। মুখের নকশা পাল্টে দেয়ার আগেই মানে-মানে কেটে পড়ো, পাকি।’

পানির উদ্দেশে চাইল কিশোর। এক লাইফগার্ড দাঁড়িয়ে মঞ্চের ওপর। চিৎকার করলে শুনতে পাবে, যদি সাহায্যের দরকার পড়ে আরকী।

‘আপনারা আমাদের পেছনে লেগেছেন কেন?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

স্কাল হিমদৃষ্টি ফেরাল ওর দিকে।

‘চুপ থাকো। ঠোলা আর ঠোলার বাচ্চাদের ঘৃণা করি আমি।’

‘মিস্টার টার্নার আমার আঙ্কেল তা আপনি জানলেন কীভাবে….

সতর্ক করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল অনন্ত।

‘এদেরকে পাত্তা দিয়ো না। এরা এখুনি বিদায় হয়ে যাবে।’ চেয়ারে আরেকটু আয়েশ করে বসল ও। ‘ছাদটা দারুণ না? আর্চগুলো দেখেছ? কী বিশাল!’

স্কাল কাছিয়ে এল।

‘দূর হও এখান থেকে, পাকি।’

স্থিরদৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে অনন্ত।

‘প্রশ্নই…ওঠে…না,’ টেনে-টেনে বলল। ‘বোঝা গেছে?’

স্কাল চেয়ারের একপাশে পা রেখে, উল্টে দিল ওটা। অনন্ত মাটিতে পড়ে গেল, এবার কনুই ঘষতে ঘষতে উঠে দাঁড়াল।

‘আপনি একটা ফালতু লোক,’ স্কালকে বলল। ‘এসো, কিশোর, আমরা স্লাইডে চড়ি।’

ওরা পিছু নিল না, তবে গায়ে জ্বালা ধরানো আওয়াজ দিল। অনন্ত আর কিশোর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

‘থার্ড ক্লাস লোক,’ অনন্ত রহমান বিড়বিড়িয়ে বলল।

‘স্কালকে ভালভাবে সামলেছ তুমি। তোমাকে খেপানোর জন্যে সবধরনের চেষ্টা করেছে ও।’

‘হুঁ, কিন্তু মারামারি করে কোন কিছুর সমাধান হয় না, এবং আমি মাথা গরম করে ওকে কখনওই সে সুযোগ দেব না।’

‘আমি কারাতে শিখছি, বলল কিশোর, ‘কিন্তু ওদের সাথে পেরে উঠব কিনা জানি না।

‘ওরা ডেঞ্জারাস টাইপের,’ স্বীকার করল অনন্ত।

ব্লু বুলেট স্লাইডের মাথায় বসে ‘গো’ সঙ্কেতের অপেক্ষায় রয়েছে অনন্ত।

‘জেরোনিমো,’ চিৎকার ছেড়ে, টিউব গলে নামার সময় উধাও হয়ে গেল ও। কিশোর সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষা করল এবং তারপর নেমে চলল দ্রুতগতিতে, ওর কানের কাছে জলপ্রপাতের গর্জন। এবার এক সুড়ঙ্গ গিলে নিল ওকে, এখানে আরও দ্রুত পতন হলো; ক্রমাগত পাক খাচ্ছে শরীর, মাথার ওপরে ছোট-ছোট নীল বাতি মিটমিট করছে, শেষমেশ অনন্ত রহমান অপেক্ষা করছে সেই জলাধারটিতে দিনের আলো ভেদ করে পড়ে গেল ও।

‘তুলনাহীন!’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

পরমুহূর্তে, স্কাল আর তার বন্ধুদের দেখল। ওয়াটারপার্ক ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তবে কিশোর নিশ্চিত আবার দেখা হবে ওদের সঙ্গে।

.

লরেলি আর টিনা এসকেলেটরে চেপে মল-এর আপার লেভেলে উঠছে, দেখল পঞ্চাশটার বেশি আয়না ঘিরে রেখেছে ওদেরকে।

‘স্কুবা ডাইভারের কথাটা শুনেছ?’ টিনা প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ। আমি গর্ডনকে চিনি তো।’

‘তাই? কীভাবে?’

‘ওর স্কুবা স্টোরে গেছিলাম একবার, তখন আমার সাথে দুষ্টুমি করছিল।’ মুচকি হাসল লরেলি। ‘আমি বলেছি ওর বয়সী কাউকে খুঁজে নিতে।’

‘ও কি রেগে গিয়েছিল?’

‘না, শুধু হেসেছে। তারপর আলাপ জমল। এরপর কয়েকবারই কফি খেয়েছি একসাথে। আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ওর অনেক আগ্রহ। ওর ধারণা আমি একদিন মেগাস্টার হব, সে যোগ্যতা আমার আছে।’ লাজুক হাসল মেয়েটি। ওটা আমার স্বপ্ন, কিন্তু মিস্টার হাটন এব্যাপারে আমার সাথে একমত নন।’

‘মিস্টার হাটনটা কে?’

‘আমার ম্যানেজার। ওই যে, গতকাল পরিচয় হয় তোমাদের।’

‘ও, হ্যাঁ।’

‘মিস্টার হাটন সবসময় পা-পা করে এগনোর কথা বলেন। উনি চাননি আমি রক দ্য মল কনটেস্টে অংশ নিই।’

‘কেন?’

‘তিনি চান না আমি এখনই রেকর্ডিং করি, তাঁর ধারণা আমার আরও এক বছর অন্তত গলা সাধা উচিত।’

‘সে তো লম্বা সময়!’

‘হুম। গর্ডনও একই কথা বলে। মিস্টার হাটনকে আমার ম্যানেজার হিসেবে পছন্দ নয় ওর।’

‘আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়, এলিস কি গর্ডনকে ভালবাসে?’

‘কোন সন্দেহ নেই।’

গর্ডনকে ও পাবে মনে কর?’

‘পাবে, যদি লিডিয়া ডি ভেগা কোন দুর্ভাগ্যজনক অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হয়। ওদেরকে ঘেরাও করে রাখা দোকানপাটগুলোর উদ্দেশে চোখ বুলিয়ে আনল লরেলি। করিডরে টাক্সেডো পরা এক লোক গ্র্যাণ্ড পিয়ানো নিয়ে বসেছে, ধীর গতির মেলোডি বাজাচ্ছে সে। ‘জানো, এই মল-এ না পঞ্চান্নটা জুতোর দোকান। অনেক না?’

‘জুতোর ব্যাপারে আমি তেমন খুঁতখুঁতে নই।’

‘একটা আইডিয়া এসেছে! আমাদের বিয়ের জন্যে উইণ্ডো শপিং করি চলো।’

বিয়ের গাউন আর অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে তেমন এক দোকানে ঢুকল দু’জনে। কাঁচের দেয়ালগুলোর সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে ম্যানিকিন, তাদের পরনে জমকালো বিয়ের পোশাক; তবে আফসোস সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে কখনওই পৌঁছতে পারবে না পুতুলগুলো। উষ্ণ হেসে এক মহিলা স্বাগত জানাল লরেলি আর টিনাকে, তারপর ওদেরকে ঘোমটাসহ হ্যাট আর লম্বা সাদা দস্তানা পরখের সুযোগ দিয়ে সরে গেল।

‘মুক্তোগুলো কী সুন্দর!’ বলে উঠল লরেলি।

‘আর লেসটাও।’

‘আমি একজনকে চিনি যে বিয়ের সময় আটজন নিতকনে রাখবে।’

‘আটজন?!’

মাথা ঝাঁকাল লরেলি।

‘ক্লিফের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম মনে আছে?’

‘নেই আবার! কাল তো আমাদের ডেট। তুমিই যেহেতু আয়োজন করেছ, আসতে ভুলো না যেন!’

‘আসব, চিন্তা কোরো না। যাকগে, ক্লিফের সাথে আমার কিন্তু একবারই দেখা হয়েছে, তবে ওকে আমার যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়েছে। আমি ওর বোনকে চিনি। তার বিয়েতেই আটজন নিতকনে থাকবে।’

‘বিয়ে বটে একখান! যাকে বলে এলাহী কারবার।’

ওরা ঠিক করল লাঞ্চ সারবে এবং আইস প্যালেসের এক আউটডোর ক্যাফেতে হেঁটে গেল। ওখানে টেবিলগুলো এমনভাবে সাজানো ওপর থেকে বরফ দেখা যায়। লরেলি আর টিনা কুইশে লরেইন আর স্প্রিঙ ওয়াটার অর্ডার করল, তারপর রিঙ্কের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল।

‘অ্যাই, হঠাৎই বলে উঠল টিনা। ‘ওই যে, ক্লিফ।’

কালো কোঁকড়াচুলো ছেলেটির পরনে আইস ড্যান্সিং কস্টিউম। বরফের ওপরে ওর সঙ্গে এক নর্তকী আর এক ধূসরচুলো মহিলাকে দেখা যাচ্ছে

‘মহিলা নিশ্চয়ই ওদের কোচ, বলল টিনা। ক্লিফ আর মেয়েটিকে মহিলার সঙ্গে অনুশীলন করতে দেখল, বরফের ওপর ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। ‘ও আইস ড্যান্সার জানতাম না তো, ও তো দেখছি দারুণ এক্সপার্ট।’

‘কার কাছে যেন শুনেছি মেয়েটা ওর কাজিন।’

‘ওর পার্টনারটা? ভাল তো!’

রিহার্সাল শেষ হলে ওরা যার-যার কুইশে আর সুস্বাদু সালাদ নাড়াচাড়া করে টুকটাক খেল আর ইনডোর সি-র হামলাটা নিয়ে কথা বলল।

‘উপায়, উদ্দেশ্য আর সুযোগ তিনটাই মাথায় রাখতে হবে,’ বলল টিনা। ‘এবং ভিলেনের তিনটাই থাকতে হবে।’

‘তাহলে স্কুবা ক্লাবের কে হতে পারে এই ক্রিমিনালটা?’

এক মুহূর্ত ভাবল টিনা।

‘ওদের যে কেউই এক টুকরো প্রবাল ভেঙে নিতে পারে। উপায় তারমানে সবারই ছিল, সে সঙ্গে সুযোগ।’

‘জোড়া বেঁধে সাঁতরায় না ওরা?’

‘হ্যাঁ, তবে দু’জন মানুষ জড়িত থাকতে পারে এর সাথে।’

‘তারপরও তো মোটিভ থাকতে হবে।’

মাথা ঝাঁকাল টিনা।

‘আমি ভাবছি ওটা নিয়ে। আণ্ডারওয়াটার অ্যাটাক এবং গর্ডনের দোকানে বোমা পেতে রাখার ঘটনা ঘটেছে। দুটোই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। কেন?’

‘গর্ডনের বিরুদ্ধে লোকটার ক্ষোভ আছে।’

‘সে মহিলাও হতে পারে। ক্লাবে তো অনেক মহিলা।’ এক মিনিট নিবিষ্ট মনে ভাবল টিনা। এমন কেউ যদি হয় যে ক্লাবের সাথে জড়িত নয়? পানির তলায় যে কেউই গর্ডনের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে থাকতে পারে, ভাঙা জাহাজের মধ্যে।’

‘তারমানে আগেই কেউ হাজির ছিল ওখানে?’

‘অবশ্যই, ক্লাব সদস্যরা পৌঁছনোর আগেই। ঝটপট স্কুবা গিয়ার পরে নিয়ে ডুব দিয়েছে পানিতে। নিখুঁত ছক, কেননা পুলিস হয়তো ক্লাবের সদস্যদেরকেই শুধু সন্দেহ করবে।’

এক লোককে ওদের দিকে হেঁটে আসতে দেখল টিনা। তার গায়ে মান্ধাতা আমলের সুট। টিনার চোখে কেমন বেখাপ্পা লাগল বিষয়টা। ভদ্রলোক টেবিলে বসার পর চিনল তিনি মি. হাটন, লরেলির ম্যানেজার।

ভদ্রলোক সোজা কাজের কথা পাড়লেন। লরেলি ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে মৃদু হাসল টিনার উদ্দেশে, এবার স্পোকেন আর সিয়াটলে এক রোড ট্রিপের বিষয়ে মি. হাটনের পরিকল্পনার কথা শুনল। ওরা কথা বলছে, এই ফাঁকে কাছের পিরানহা ট্যাঙ্কটার দিকে চাইল টিনা, দেখল গর্ডন ব্যাগলি মাছ দেখছে। এবার ওকে দেখে স্মিত হাসল লোকটি। তাকে হেঁটে আসতে দেখে মি. হাটন উঠে দাঁড়ালেন।

‘ওই যে, তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে যার মহা-মহা আইডিয়া সে লোক আসছে। এবার আর আমি তার প্যাচাল শুনতে চাই না, লরেলি।’

‘কিন্তু আপনি না এইমাত্র স্ট্রবেরি আর হুইপড্ ক্রিমের অর্ডার দিলেন!’

‘ওগুলো তোমার বন্ধুকে নিয়ে খাও।’ দলামোচা পাকানো কটা টাকা বের করে একটা নোট টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলেন তিনি। ‘রাতে রিহার্সালে দেখা হবে। সময়মত চলে এসো কিন্তু।’

তিনি বিদায় নিলে, গর্ডন বসে পড়ল, মুচকি হাসছে।

‘দুটো সুন্দর মুখ! সুন্দর মুখের জয় সবখানে! দোকানে যাব, তার আগে একটু বসি?’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল লরেলি। ‘আপনি ভাল আছেন তো সেই অ্যাটাকের পর?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ব্যাপারটা এমনি-এমনি ছেড়ে দেব না।’

‘মানে?’ টিনা শুধাল।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল লোকটা।

‘আমি মাথা গরম করব না, প্রতিশোধ নেব। যে আমার এয়ার হোস কেটে দিয়েছে তাকে খুঁজে বের করব। এটা আমার প্রতিজ্ঞা।’ এবার লরেলির উদ্দেশে স্মিত হাসল। ‘গতকালের পারফর্মেন্সটা নাকি অসাধারণ ছিল! একজনের কাছে শুনলাম। মূল কথা হচ্ছে কনটেস্ট তুমিই জিতছ।’

‘তাই?’

‘তুমি স্টার হতে চলেছ, লরেলি। একমাত্র প্রশ্ন হলো, কখন। আগামীকাল নাকি আরও পাঁচ বছর পরে?’

‘আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, তবে মিস্টার হাটন বলেন আমার শক্ত ভিত্তি দরকার; নয়তো শীঘ্রিই নাকি ফুরিয়ে যাব। অনেকটা উল্কার মতন।’

‘কে জানে! মিস্টার হাটন যে আমাকে আর আমার উপদেশ পছন্দ করেন না তা তো গোপন করেননি। তিনি হয়তো মিউযিক বিজনেসে বহু বছর ধরে আছেন, তবে তার মানে এই নয় যে তুমি নতুন কোন ম্যানেজার নিতে পারবে না।’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘আরেকটা কথা। সবসময় বড় চিন্তা করবে।’

‘মানুষের মনোবল চাঙা করতে আপনার জুড়ি নেই।’

‘খাবারটা কেমন?’ মি. হাটনের অর্ডার দেয়া স্ট্রবেরিগুলোর দিকে চাইল গর্ডন। সব কটায় হুইপড্ ক্রিম মাখিয়ে একটা মুখে দিল। ‘বাহ, হেভি টেস্টি তো!’ বলে, মেয়েদের দিকে এগিয়ে দিল ডিশটা। ‘সি ওয়ার্ল্ডের কাছে এক রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ছিলাম আমি। চমৎকার ভিউ ছিল ওটার, কিন্তু খেতে-খেতে আইস ড্যান্সারদের নাচতে দেখার ব্যাপারটাই অন্যরকম।’ রিঙ্ক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টিনার কাঁধের ওপর দিয়ে করিডরে কার দিকে যেন চাইল ও, এবার এক পলকে হাতঘড়ি দেখল। টিনা ঘাড় কাত করে চাইতেই দেখল এলিস ওর বাবাকে নিয়ে এদিকেই আসছে।

‘ও, আপনি এখানে?’ এলিস বলল। ‘আমার চিন্তা না করলেও চলত দেখছি-যেখানে সুন্দরী মেয়ে সেখানেই আপনি। এখন কাজে ফিরুন, গর্ডন।

সটান উঠে দাঁড়াল গর্ডন।

‘পাঁচটা মিনিট দেরির জন্যে এত কথার দরকার ছিল না, এলিস। মনে হচ্ছে মস্ত কোন অপরাধ করে ফেলেছি আমি।’

‘না, না, তা কেন। সরি। আমাকে আসলে নার্ভাসনেসে পেয়েছে।’

গর্ডন, এলিস আর ওর বাবা চলে যেতেই, মুখ খুলল টিনা।

‘কুপারদের ব্যাপারে আমি আরও জানতে চাই। এসো, লরেলি, বিল মিটিয়ে দেখি তারা কোথায় যায়।‘

.

শীঘ্রিই ইনডোর সাগরে পৌঁছল ওরা। লোক সমাগম কম। তাই একটা মাত্র সাব ট্রিপ দিচ্ছে। এলিসকে নিয়ে সাব-এ চাপলে নেভাল ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবক অ্যাটেনডেন্ট মি. কুপারকে স্যালুট ঠুকল।

‘তুমি কখনও সাব-এ উঠেছ?’ লরেলিকে প্রশ্ন করল টিনা।

‘হ্যাঁ, খুব ভাল লাগে।’

‘উঠবে এখন?’

‘ওঠা যায়।’

টিকিট কিনে ডকে অল্প কিছু মানুষের সারিতে দাঁড়াল ওরা। এবার কনিং টাওয়ারের এক হ্যাচ খুলে গেল এবং বাইরে চাইলেন মি. কুপার।

‘স্যর,’ চেঁচাল টিনা, ‘আমরা ওখান দিয়ে উঠি?’

‘সরি, এটা ইমার্জেন্সি এক্সিট। যাত্রীরা স্টার্নের হ্যাচ দিয়ে ঢোকে।’

নিচে, বড়-বড় পোর্টহোলমুখী একজোড়া সিটের সারি, ওখানে নামল মেয়েরা। টিনা আর লরেলি বসলে, মি. কুপার ইমার্জেন্সি এক্সিটটা লাগিয়ে দিয়ে কেবিনে নেমে এলেন। সাব- এর সামনের অংশে এলিসের সঙ্গে যোগ দিলেন, মৃদুস্বরে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন গেইজের দিকে ইশারা করলেন।

‘ওঁরা তো টুরিস্ট নন, বলল টিনা, ‘তাহলে সাব-এ চড়লেন কেন?’

একটু পরে, ফাঁপা দুপ শব্দে লেগে গেল স্টার্নের হ্যাচ। ভাপসা গরমে কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে টিনার। পোর্টহোলের পাশে রুপোলী বুদ্বুদ উঠতে দেখল ও, পরমুহূর্তে এক কৃত্রিম কাঁকড়াকে ডক আঁকড়ে ধরে থাকতে দেখতে পেল। ওটার পাশেই নকল সামুদ্রিক আগাছায় জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকতে দেখল এক জেলের পায়ের এক পাটী বুট জুতোকে।

মি. কুপার চাইলেন যাত্রীদের দিকে।

‘গুড আফটারনুন, ফোস্!’ নিজের আর এলিসের পরিচয় দিলেন, তারপর জানালেন তিনি এই যাত্রার দায়িত্বে আছেন। ‘এটা এক সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক মিশন,’ সতর্ক করলেন, সাবটা যেই ওটার বার্থ থেকে ধীরে-ধীরে সরতে লাগল। ‘আমরা নিখোঁজ রিসার্চ সাব SR2-এর সন্ধানে চলেছি।’

এসময় একটি কণ্ঠস্বর কড়কড় করে উঠল রেডিয়োতে।

‘ব্রাভো বে থেকে আপনাকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হলো, অ্যাডমিরাল কুপার।’

‘আই, আই,’ তিনি জবাব দিলেন। এবার অন্যদের দিকে চাইলেন। ‘এই মিশনে আমরা আটলান্টিসের ধ্বংসস্তূপের পাশ কাটাব, সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্ন বলা হয় যেটিকে। সারা দুনিয়ার নানা জাতের মাছ দেখব আমরা, এমনকী হয়তো কিছু হাঙরও। এখন সবাই সুস্থির হয়ে বসুন এবং চোখ-কান খোলা রাখুন।’

টিনা আর লরেলি সামনে ঝুঁকল। ওরা আরেকটি সাব-এর পোর্টহোল আর পিতলের প্রপেলার দেখতে পাচ্ছে। ওটা বিশাল এবং দেখতে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। গোলাকার কাঁচের এক ট্যাঙ্কের পাশ কাটাল ওরা, ওটার ভেতরে সাঁতরাচ্ছে খুদে খুদে লাল রঙের মাছ, তারপর সান্তা মারিয়া-র নিচে এক ট্যাঙ্কে প্রকাণ্ড এক গ্রুপার দেখল।

মি. কুপার মেয়ের সাথে অনুচ্চ স্বরে কথা বলছেন, তবে ও শুনছে বলে মনে হলো না। তার বদলে, এক পোর্টহোল দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এলিস, কিন্তু কেমন যেন আনমনা দেখাচ্ছে ওকে। টিনা স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু একটা খোঁচাচ্ছে এলিসকে। কিন্তু কী সেটি?

এসময় সাব এক সুড়ঙ্গে ঢুকলে সবাই চুপ হয়ে গেল।

‘বিপজ্জনক জলরাশি,’ হুমকির সুরে বললেন মি. কুপার।

‘পোর্টে ওটা কী? SR2-এর ধ্বংসাবশেষ?’ বাঁয়ের পোর্টহোলগুলোর দিকে ঝুঁকল প্রত্যেকে, দেখল এক দানব স্কুইড অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে কৃত্রিম এক সাবকে।

হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন মি. কুপার।

‘হামলা হয়েছে আমাদের ওপর! হামলা! পাওয়ার চলে গেছে!’

নিমেষে সাব-এর ভেতরটা আঁধারে ডুবে যেতেই কেউ একজন আর্তচিৎকার ছাড়ল। কন্ট্রোল প্যানেলে বাতিগুলো ঝলসে উঠল এবং মি. কুপার উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠে হামলা এড়ানোর বিষয়ে কী সব যেন বলতে লাগলেন, এবার সাবটা স্বচ্ছন্দে সুড়ঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে এল নিস্তরঙ্গ পানিতে। সুড়ঙ্গের ভেতরের অভিযানটির পর দাঁত বের করে হাসছেন মি. কুপার, কিন্তু এলিসের দৃষ্টি পায়ের কাছে ইস্পাতের ডেক-এ স্থির।

টিনা এক পোর্টহোল দিয়ে চাইতেই ডুবো ভগ্নস্তূপটির ভুতুড়ে কাঠামোটি দেখল, গর্ডনের এয়ার হোস যেখানে চিরে দেয়া হয়েছিল। শিউরে উঠে ভাবল, ভাগ্যিস লোকটা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল।

এবার সাব-এর স্টার্নের দিকে চাইল। এক চশমাধারী লোকের হাতে পকেট নোটবই আর কলম দেখল।

সে-ও ভগ্নাবশেষটা নিমগ্নচিত্তে নিরীখ করছে এক পোর্টহোল দিয়ে। কারণটা জানতে বদ্ধপরিকর, টিনা উঠে দাঁড়িয়ে সোজা পা বাড়াল লোকটার উদ্দেশে।