বিপদসঙ্কেত – ১০

দশ

সন্ধেবেলায় কিশোর আর টিনা সুবিশাল এক আর্কেডে গেল, ওখানে বিভিন্ন দেশের খাবার পরিবেশন করা হয় খদ্দেরদের ঘিরে রাখা বুথগুলো থেকে। গ্রীসের সালাদ, মেক্সিকোর টরটিয়া, জাপানের টেরি ইয়াকি, কী নেই এখানে! তবে ওরা ম্যাকডোনাল্ডের বার্গার বেছে নিয়েছে।

‘তো, বলল টিনা, ‘কী মনে হয় তোমার, ঠিক কাজ করেছি আমি?’

‘অবশ্যই! ব্যাটা যে এমন জুলুমবাজ, মেয়েদের ওপর জোরজবরদস্তি করে কে জানত! লরেলি কী বলে?’

‘ঘণ্টাখানেক আগে আমাকে ফোন করেছিল ও। ঘটনাটার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করল, তবে ওর ধারণা আমি ভুল করিনি।’

হাতঘড়ি দেখল কিশোর।

‘অ্যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভাল সিট পাব না।’

‘রাজন বেচারার জন্যে মায়া লাগছে। ও তো এখনও গৃহবন্দি। নিশ্চয়ই মনমরা হয়ে বসে আছে।’

অন্যান্যদের সঙ্গে মি. কুপারকেও মল ভেদ করে আইস প্যালেস অভিমুখে তড়িঘড়ি হেঁটে যেতে দেখল ওরা।

‘তুখোড় ব্যাপারস্যাপার,’ কিশোর আর টিনার উদ্দেশে বসলেন। ‘খেলাটা দারুণ জমজমাট হবে এবং বোমার ঘটনার পর এত মানুষ আর জড় হয়নি এখানে।’

‘কার্ল মিলার নাকি খেলছে আজ,’ বলল কিশোর। ‘সত্যি?’

‘আলবত। সামার এক্সিবিশন হিসেবে আমি খেলাটার আয়োজন করি এবং কার্ল কথা দেয় ও খেলবে। অয়েলারের আরও কয়েকজনও রাজি হয়, সঙ্গে ক্যালগ্যারি ফ্লেমসেরও জনা কয়েক প্লেয়ার। বোমার আতঙ্ক উপেক্ষা করেও খেলছে ওরা।’

‘আমাকে কার্ল মিলারের অটোগ্রাফ জোগাড় করে দেবেন?’ কিশোর অনুরোধ করল।

‘শুধু অটোগ্রাফ কেন, চাইলে দেখাও করাতে পারি।’

‘তবে তো কথাই নেই!’

আয়নাঘেরা এক প্রস্থ সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে বেসমেন্টে, দেয়ালে সারবাঁধা কোক আর ভিডিয়ো মেশিন, এক স্কেটের দোকান, এবং নানান ড্রেসিং রুমের দিকে চলে যাওয়া দরজা। একটিতে অয়েলারদের লোগো দেখতে পেল ওরা; মি. কুপার ভেতরে ঢুকলেন এবং মিনিটখানেকের মধ্যেই ফিরলেন কার্ল মিলারকে নিয়ে। দীর্ঘদেহী যুবকটির মাথায় সোনালী চুল, চোখজোড়া সবুজ।

‘কেমন আছ তোমরা,’ উষ্ণ করমর্দন করে বলল সে। ‘মিস্টার কুপার বললেন তোমরা নাকি গোয়েন্দা।’

‘এই একটু-আধটু চেষ্টা করি আরকী, বলল কিশোর, আর টিনা লাজুক হাসল।

‘সবচেয়ে বড় রহস্য কোটা সভ্ করেছ তোমরা?’

কিছুক্ষণ আলাপ করার পর, কার্ল অটোগ্রাফ দিয়ে খেলার প্রস্তুতি নিতে ড্রেসিং রুমে ফিরল। মি. কুপারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে, কিশোর আর টিনা বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল অয়েলারদের বেঞ্চির কাছে, রিঙ্কের পাশে।

‘কত দর্শক এসেছে দেখো!’

দুই লেভেলের রেইলিঙেই ভক্তদের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বেশিরভাগই অয়েলার্স লেখা ব্যানার নাড়ছে, তবে ফ্লেস্‌ সমর্থকরাও কম যায় না, লাল পতাকা দোলাচ্ছে ক্যালগ্যারি থেকে গাড়ি চালিয়ে উত্তরে আসা ভক্তরা। নিচু এক গেট দিয়ে জনতার সঙ্গে মিশল কিশোর আর টিনা এবং কোনমতে পথ করে নিয়ে লরেলির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রেইলিঙের পাশে ওদের জন্য জায়গা রেখেছিল মেয়েটি।

‘সবার উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে স্ট্যানলি কাপের ফাইনালের চেয়েও বেশি জমবে খেলাটা,’ হেসে বলল ও।

দর্শকদের হর্ষধ্বনির মধ্যে বরফে পা রাখল অয়েলাররা। তাদেরকে অনুসরণ করল ফ্লেমরা। কিছু ঘোষণার পর মি. কুপার এক সিরেমোনিয়াল পাক ফেলে বরফ ত্যাগ করলেন, স্টেটসন হ্যাট নাড়লেন দর্শকদের উদ্দেশে।

ক’মুহূর্ত পরেই খেলা শুরু হয়ে গেল। এক কোনায় পাক নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে দুই খেলোয়াড়, এবার ওটা ছিটকে চলে এল কার্লের কাছে। জালের পেছন থেকে ওটাকে নিয়ে, ডান দিকে সরতে লাগল সে। এবার মাঝপথে দিক পাল্টে বাঁয়ে ঘুরল। ক্যালগ্যারি গোলরক্ষক ভারসাম্য হারাল এবং পাকটাকে অসহায়ের মত তার জালে ঢুকতে দেখল।

উল্লাসে ফেটে পড়ল অয়েলার্স সমর্থকরা। রিঙ্কের চারধার থেকে তাদের হৈ-হল্লা শোনা গেল, পা ঠুকে পতাকা দোলাচ্ছে, যতক্ষণ অবধি খেলা আবার শুরু না হলো। এবার, খেলোয়াড়রা সাঁই-সাঁই করে কিশোরের পাশ কাটাতেই ওপরের রেইলিঙে হঠাৎই চোখ গেল ওর এবং টের পেল কেউ নজর রাখছে ওর ওপর।

টিনার দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে কথাটা জানাল ও। ‘সানগ্লাস পরা লোকটা। ও কি পরচুলা পরেছে নাকি?’

‘যার হাতে স্কে? ফোলা কোট পরা ওটা মহিলাও হতে পারে।’

‘আমার ধারণা পুরুষ। খেলা না দেখে আমাদের দেখছে কেন সে?’

‘মহিলা চলে যাচ্ছে।’

সানগ্লাস পরা মানুষটি জনতার ভিড় ঠেলে কাঁচের দেয়াল ঘেরা এলিভেটরের দিকে চলেছে। লোয়ার লেভেলে পৌঁছে, ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

লরেলি চাইল ওদের দিকে।

‘অ্যাই! তোমরা খেলা ছেড়ে কী দেখছ? কী তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে!’

‘তুমি আমাদের জায়গা রেখো, প্লিজ, আমরা এখুনি আসছি।’

‘আচ্ছা, তবে কাজটা খুব সহজ হবে না।’

বেঞ্চির অয়েলাররা সামনে ঝুঁকেছে, প্রতিটা মুভ লক্ষ করছে। শোরগোলে কান পাতা দায়, কিশোর আর টিনা যখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল চেঞ্জিং এরিয়ায়। শূন্য ওটা।

‘ও কি স্কেটের দোকানে?’ টিনা শুধাল।

দরজা খোলার চেষ্টা করল কিশোর।

‘বন্ধ। ড্রেসিং রুমে নয় তো?’

‘এটাও বন্ধ।’ ওপরে মিশেছে সেই আয়নাঘেরা সিঁড়িটার দিকে চকিতে চাইল টিনা। ‘ওই যে ওখানে!’

সানগ্লাস এখন সিঁড়ির মাথায়। এক হাতে স্কেট, অন্য হাতে কালো কোঁকড়াচুল সামলাচ্ছে।

‘ওটা নিঃসন্দেহে পরচুলা, বলল কিশোর। ‘কে লোকটা?’

‘মহিলা এখানে নামল কেন?’

‘দুটো স্কে ছিল! এখন মাত্র একটা ওর হাতে!’

‘তাহলে অন্যটা কই? এখানে কোথাও লুকিয়েছে?’

ঝটপট বেঞ্চিগুলোর তলা আর সব কটা ভিডিয়ো গেমসের ওপরে খুঁজে কিছুই পেল না ওরা। এবার নজরে এল স্কেট শার্পেনারটা। কিশোর ছুটে গেল মেশিনটার কাছে, পকেট হাতড়ে কয়েন বের করল এবং ছোট্ট দরজাটা ধীরে-ধীরে খুলে যেতেই ভেতরে এক স্কেট দেখা গেল। টিকটিক শব্দ হচ্ছে এবং স্কেটটির ভেতরে তার দেখা যাচ্ছে।

‘লাল তারটা কানেক্টেড। এটা নকল অ্যালার্ম নয়!’

‘সবাইকে সাবধান করতে হবে।’

সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে উঠে অয়েলারদের বেঞ্চির কাছে চলে এল দু’জনে, দেখল কার্ল মিলার তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছে।

‘ক্যালগ্যারি এইমাত্র সমতা ফিরিয়েছে,’ জানাল সে। ‘তোমরা নিচে কী করছিলে? এমন জবরদস্ত লড়াই কেউ মিস করে?!’

কিশোর ব্যাখ্যা দিতেই, কার্ল বোর্ড টপকে সোজা বরফের ওপর নামল। রেফারি হুইল বাজাল, পেনাল্টির নির্দেশ দিল, কিন্তু কার্ল ত্বরিত গতিতে ঘোষকের বুথে স্কেট করে গিয়ে মাইক্রোফোন আঁকড়ে ধরল।

‘দুঃখিত, দর্শকবৃন্দ, স্পিকারে বলল, ‘খেলা শেষ।’ কেউ- কেউ আপত্তি তুলল, তারপর নিশ্চুপ হয়ে গেল। ‘আমরা বোমা ফাটার আশঙ্কা করছি। দয়া করে এই মুহূর্তে এই এলাকা ত্যাগ করুন।’

.

কিশোর আর টিনা শীঘ্রিই হোটেল সুইটে ফিরল টিভি কভারেজ দেখতে। টিভি ক্যামেরা দর্শক আর পুলিসের গাড়িগুলোর ওপর ঘুরে এল, সুপারমলের মাখনরঙা বাইরের দেয়ালগুলো দেখাল। অবশেষে ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগলের বহু প্রতীক্ষিত ঘোষণাটি এল।

‘বোমাটা নিরাপদে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, উইনিপেগ পুলিসের ইন্সপেক্টর জোসেফ টার্নারের বদৌলতে।’

‘গ্রেপ্তার করবেন কখন?’ এক রিপোর্টারের প্রশ্ন।

‘আমি এইমাত্র ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছি।’

‘তারমানে কাউকে গ্রেপ্তার করছেন? কাকে?’

‘এখনই বলা যাচ্ছে না।’

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলছে, মি. টার্নার কামরায় এলেন। স্ত্রীকে চুমো খেয়ে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর কিশোর আর টিনার দিকে চাইলেন।

‘ব্যাগ গুছিয়ে নাও। তোমরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছ।’

‘আমি এ ভয়টাই পাচ্ছিলাম,’ বলল কিশোর।

‘ফ্লাইট টাইম দেখছিলাম,’ স্বামীকে বললেন মিসেস টার্নার। ‘কাল দুপুরে প্রথম প্লেন।

মি. টার্নার কিশোর আর টিনাকে বোমা উদ্ধারের জন্য অভিনন্দন জানালেন।

‘একটা আজব কথা শুনবে? বোমাটা ছ’ঘণ্টার মধ্যে ফাটত না।’

‘পালানোর জন্যে কি এত সময় লাগত বোমাবাজদের?’

‘সম্ভবত, কিন্তু স্কেট শার্পেনারে অতক্ষণ ওটা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব ছিল। কেউ না কেউ বোমাটা খুঁজে পেতই।’ টাই ঢিলে করলেন মি. টার্নার। ‘স্কেটটার ভেতরে আমরা আদ্যক্ষর পেয়েছি।’

‘কী ওগুলো?’

‘এল. পি.।’

‘লুইস প্যাটেন।’

মাথা ঝাঁকালেন মি. টার্নার।

সে যে দোকানে কাজ করে সেখানে বোমা মেলে, গর্ডন ব্যাগলির এয়ার হোস যখন চিরে দেয়া হয় তখন সে ছিল ওর স্কুবা পার্টনার, এবং এর আগে কম্পিউটারে ওর নাম সার্চ দিতেই দেখা গেল একসময় জেল খেটেছে লোকটা। পুলিস ওকে অ্যারেস্ট করতে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে।’

এসময় ফোন বাজল। সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার পর মি. টার্নার রিসিভার ঝুলিয়ে রেখে মাথা নাড়লেন।

‘ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগল। পুলিস লুইস প্যাটেনের দোকানে হানা দিয়ে ওকে পায়নি, কেটে পড়েছে লোকটা। ওর অ্যাপার্টমেন্টেও গিয়েছিল।’

‘তারপর?’

‘ওখানেও নেই।’ মি. টার্নার চাইলেন ওদের দিকে। ‘লুইস প্যাটেন হাওয়া হয়ে গেছে।’

.

‘ওয়েস্ট এডমনটন মল-এ আজ আমাদের শেষ সকাল!’ মর্মরের টানা করিডর, গাছপালা আর ফোয়ারাগুলোর দিকে চাইল টিনা। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটারপার্কে আমাদের শেষবারের মত যাওয়া।’

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘ভাল লাগছে, আঙ্কেল-আন্টি রাজনকে মাফ করে দিয়েছেন। নইলে বেচারার আর ওয়াটারফ্লাইডে যাওয়া হত না। আহা, সে কী আকুল আবেদন ওর!’

‘হ্যাঁ, কিশোর,’ দাঁত বের করে হাসল রাজন। সেজন্যে তোদেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। তোরা আমার হয়ে সাফাই গেয়েছিস।’

সাবমেরিন ডকের পাশ দিয়ে চলেছে, মি. কুপারের উদ্দেশে হাত নাড়ল ওরা। কনিং টাওয়ারের হ্যাচ খুলছিলেন ভদ্রলোক। মই বেয়ে নেমে, ইনডোর সাগরে একক সাব যাত্রায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গেলেন তিনি।

‘বেচারার জন্যে খারাপই লাগছে, বলল টিনা। ‘কী একা একজন মানুষ!’

লকার রুমের বাইরে অনন্ত রহমানের দেখা পেল ওরা, ছেলেটি লাগেজ স্টোরের ঘটনায় সাহায্য করার জন্য কিশোরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল এবং ওর বাসায় কারি ডিনারের দাওয়াত দিল।

‘এত ভাল কারি তোমরা আগে খাওনি! আমি নিজে রাঁধব।’

‘দুপুর একটায়,’ ব্যথিত কণ্ঠে জানাল কিশোর, ‘আমাদের ফ্লাইট।’

খবরটা শুনে বিমর্ষ হয়ে গেল অনন্ত, এবার সবাই মিলে ওরা ওয়াটারপার্কের গুমট বাতাসে ঢুকল। বিশাল কোর্টটায় আজ আর কোন ভলিবল খেলোয়াড় নেই; পিং-পং টেবিলের পাশে বসা ভুঁড়িওয়ালা এক লোক ওদের উদ্দেশে হেঁকে বলল, ‘খেলবে?’ কিন্তু ওরা প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়ে সৈকত অভিমুখে হেঁটে চলল।

পাম গাছের নিচে একটি মানুষও নেই, কিংবা রেজিং র‍্যাপিস্-এর ইনার টিউবেও কেউ রাইড করছে না। তিন টিনএজার ওয়েভ লেকে ব্লাস্টিং হর্নের সার্ফস আপ ঘোষণাটির অপেক্ষায়, কিন্তু অপেক্ষমাণ সার্ফারদের চিরাচরিত উৎফুল্ল হৈ- হুল্লোড়ের তুলনায় তা একেবারেই নগণ্য।

‘কী করুণ দৃশ্য!’ টিনা মন্তব্য করল।

‘ওটায় উঠি চলো।’ শূন্যে আঙুল তুলল রাজন। ‘স্কাই স্ক্রিমারে চড়তে আমার তর সইছে না।’

অনন্ত ওদের সবার দিকে চাইল।

‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ফাস্ট কে?’

‘ও,’ বলে রাজনকে দেখাল কিশোর। ‘বিশ্বাস কর কিংবা না কর।’

‘রেস দেবে?’

‘অবশ্যই।’

সবচাইতে উঁচু মঞ্চ, ওয়েভ লেক থেকে যেটি ন’তলা ওপরে, ওটা থেকে নিচে সাঁতারুদেরকে পিঁপড়ের মতন দেখাচ্ছে।

‘কত উঁচু, বাপ রে, বলল টিনা, সোজা নিচ বরাবর নেমে- যাওয়া ডব্লু-ট্র্যাক্ড স্কাই স্ক্রিমারটার দিকে চাইল ও। ‘তোমরা আগে।’

হাসিমুখে সামনে এগোল অনন্ত। রাজন টুইন স্লাইডে চড়তেই, টিনা ওদেরকে কাউন্টডাউন দিল। এবার বুনো চিৎকার ছেড়ে, চোখের সামনে থেকে পড়ে গেল ওরা।

নিচের পুলে ঝপাং করে দু’জনের পতন হতেই, পানি বিস্ফোরিত হয়ে স্ফটিকের লক্ষ-লক্ষ হীরের কণা তৈরি করল। স্লাইডে লাফিয়ে পড়ে, অন্য পথটিতে থাকা টিনার দিকে চাইল কিশোর।

‘চলো!’

দু’পা একসঙ্গে জোড়া, মাথার পেছনে হাত, শূন্যতায় পতন হলো কিশোরের। শ্বাসরুদ্ধকর কটি মুহূর্ত অবলীলায় নেমে চলল ও, এবার আবার যোগাযোগ হলো স্লাইডের সঙ্গে কানে বাতাসের আর্তনাদ নিয়ে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ও। বাঁকের কাছে পৌছে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল কিশোর, পানিতে যেই আছড়ে পড়ল পাজোড়া এবং প্রথম ঝাঁকের রুপোলী বুলেট আঘাত হানল ওর নাকে-মুখে। এবার জলাধারে খুঁজে পেল নিজেকে, দু’মুহূর্ত পরে, ডেক-এ অপেক্ষারত ওদের দলটির উদ্দেশে সাঁতরে গেল।

‘কে জিতল?’

হেসে উঠল অনন্ত।

‘রাজন আমার রেকর্ড ভেঙেছে। স্কোরবোর্ডে সময় দেখে থ বনে গেছি।’

রাজন দায়সারা ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল।

‘ও কিছু নয়। কিন্তু, কিশোর, তুই তো টিনার কাছে হেরেছিস।’

এক ঝলকে স্কোরবোর্ড দেখে নিল কিশোর। এবার টিনার দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, ‘এরপর কোন স্লাইড?’

‘আগে ভলিবল খেলি, চল। কোর্টে একটা বল পড়ে ছিল দেখেছি।’

ক’মিনিটের মধ্যেই ওদের সঙ্গে যোগ দিল নাদাপেটা সেই লোক এবং আরও কয়েকজন। একটু পরেই টিনার ছুঁড়ে দেয়া বল লাগল রাজনের মাথায়। রাজন টিনাকে লক্ষ্য করে জোরে কিক মারল, তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কাছেই গাছগাছালির জটলার মধ্যে উড়ে গিয়ে পড়ল বলটা।

‘পারলে না!’ সুরেলা কণ্ঠে বলে, টিনা গাছের দঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে ঢুকেই বেরিয়ে এল পরমুহূর্তে। ‘কিশোর, দেখে যাও।’

অন্য ছেলে দুটিও ছুটল ওর সঙ্গে। মাটিতে এক খোলা মুখের কাছে দাঁড়িয়ে টিনা। মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া পেল ওরা।

‘বলটা এই এয়ার-কণ্ডিশনিং ডাক্টের ভেতরে পড়েছে, ‘ জানাল টিনা। ওই প্যাকেজটার পাশে।’

কিশোর আর টিনা লাফিয়ে পড়ল গর্তটার ভেতরে। গ্রাউণ্ড লেভেলের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, এক ধাতব গ্রিল ভেদ করে গর্ভের অন্ধকারে চাইল দু’জনে। এবার কিশোর ঝুঁকল প্যাকেজটা পরখ করতে।

‘এটা বোমা! চট করে চোখ তুলে চাইল অনন্ত আর রাজনের দিকে। ‘হট লাইন ফোনে সিকিউরিটিকে খবর দাও।’ ওরা দৌড়ে চলে যেতেই চাইল টিনার উদ্দেশে। ‘বোমাবাজ প্যাকেজটা এখানে রাখল কীভাবে?’

‘ডাক্টের ভেতর দিয়ে?’ স্ক্রিনটা ঝাঁকাতেই খুলে গেল। ‘দেখো, হ্যাক-স দিয়ে কীভাবে কবজাগুলো কেটেছে। বোমাবাজ এভাবেই মল জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবার অগোচরে।’

আঁধারে দৃষ্টি রাখল কিশোর।

‘তোমার কী ধারণা?’

‘আমি শিয়োর নই। কী অন্ধকার এখানে!’

‘হয়তো…’ টিনার দিকে তাকাল কিশোর। ‘শব্দটা শুনলে?’

‘হ্যাঁ।’

ডাক্টের ভেতরে গুড়ি মেরে ঢুকল ওরা, তারপর অপেক্ষায় রইল। ক’মুহূর্ত পরে শব্দটা শুনল আবারও। আঁধারে, কোথাও থেকে, কারও কণ্ঠস্বর সাহায্যের জন্য করুণ আর্তি জানাচ্ছে।