বিপদসঙ্কেত – ৮

আট

কিশোর ওর হোটেলরুমের মেঝেতে শুয়ে বই পড়ছে। রাজন টিভি দেখছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়া ও, এক ফোর্ড পিকআপ ট্রাকের পেছনদিক ওটা। ক্যাবে এরচেয়ে ছোট এক বিছানাও রয়েছে, এবং এক ট্রাফিক পুলিস দাঁড়িয়ে জাকুযির ওপরে। দেয়ালগুলো আর ছাদে ট্রাফিক সাইন আর বাতি

টিভি অফ করল রাজন।

‘তুই ইউরোপা বুলভার চিনিস?’

‘চিনি তো। ঘণ্টাখানেক আগেই তো ছিলাম ওখানে।

‘ও, হ্যাঁ, ভুলেই গেছি। যাকগে, আমি…’

‘ওই বুলভারটা প্যারিসের মত।’

‘ব্যালকনিগুলোর জন্যে? ওগুলোর কথাই ভাবছিলাম আমি ওখান থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়?’

‘হঠাৎ একথা কেন?’

বিছানা থেকে এক লাফে মেঝেতে নামল রাজন।

‘এই, পেল্‌ বিচ খেলবি? টাকা আমি দেব।’

‘ব্যাপারটা কী বল তো? তুই তো গল্‌ফ্ দু’চোখে দেখতে পারিস না! এমনকী কখনও আমার জন্যে পকেটের পয়সাও খরচ করিস না।’

‘কথাটা ঠিক নয়। যাকগে, যাবি?’

‘চল,’ বইটা বন্ধ করল কিশোর।

‘আমার রেডি হতে একটু সময় লাগবে। এই ধর আধঘণ্টা।’

‘কেন?’

‘যে মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে তাকে ইনভাইট করতে চাই। ওর মার দোকানে যাব জিজ্ঞেস করতে।’

‘ফোন কর।’

মাথা নাড়ল রাজন।

‘হাঁটব। আমার ব্যায়াম দরকার।’ নিজের ঘরে গেল ও, ওটা কিশোরেরটার লাগোয়া, এবং দরজা বন্ধ করল। পরের ক’মিনিট শুধু ওর পায়চারীর শব্দ শুনল কিশোর। তারপর সব চুপচাপ। রাজন যে মেয়েটিকে দাওয়াত দিতে চায় তার কথা ভাবল ও, এবার টিভি অন করল।

কিশোর গেম শো দেখছে, এমনিসময় ফোন বাজল।

‘কিশোর,’ চেঁচিয়ে উঠল রাজন। ‘আমি।’

তড়াক করে সিধে হয়ে বসল কিশোর।

‘কী হলো তোর?’

‘আমি ইউরোপা বুলভারে! মনে হয় জেনে গেছি বোমাবাজটা কে! তুই জলদি চলে আয়…’

‘কে ওটা, রাজন?’

‘ফোনে বলা যাবে না! এক্ষুণি চলে আয়।’

‘কোথায় থাকবি তুই?’

‘ঠিক জানি না, তবে লালচুলো এক মহিলাকে খুঁজবি। সে আমার কন্ট্যাক্ট আর…’

লাইন কেটে গেল।

রিসিভারের দিকে দু’মুহূর্ত একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিশোর, তারপর চট করে রেখে দিল। কামরার চাবির গোছাটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে, হলওয়ে ধরে এক ছুটে এলিভেটরের কাছে চলে এল।

অধীর অপেক্ষা করছে, হাতে নাড়াচাড়া করছে গোছাটা এবং অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছে কার্পেটের ওপর, বয়স্ক এক দম্পতি যোগ দিলেন ওর সঙ্গে।

‘কানাডা একদম অন্যরকমের এক দেশ, কিশোরকে বললেন ভদ্রমহিলা। ‘আমাদের ওখানে এরকম হোটেল নেই।’

‘তুমি কোত্থেকে এসেছ, বাছা?’ ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন ওকে।

‘লস এঞ্জেলেস,’ জানাল কিশোর।

সঙ্গে-সঙ্গে ভদ্রলোক করমর্দনের উদ্দেশে হাত বাড়ালেন।

‘ওটা আমার দাদার দেশ। হাত মেলাও।’

অবশেষে লবিতে নামল এলিভেটর। কিশোর দৌড়ে গেল ইনডোর সি-র কাছে, সান্তা মারিয়া-র পাশ দিয়ে রীতিমত উড়ে, এসকেলেটরে চড়ে উঠে এল ইউরোপা বুলভারে।

কিন্তু রাজনের ছায়ামাত্র নেই। বুলভারের ওমাথায়, এক ভিক্টোরিয়ান ল্যাম্প-স্ট্যাণ্ডের ঝুলন্ত ফুলের ঝুড়ির নিচে একজন বসে রয়েছে, আশপাশে আর কেউ নেই। ডেনিম জ্যাকেট সাজিয়ে রেখেছে জানালায়, এমন এক দোকান পেরোল কিশোর, এবার পিছু ফিরে চাইল সান্তা মারিয়া-র উদ্দেশে। রাজন কোথায়?

হঠাৎই এক আর্তচিৎকার শুনল।

কোত্থেকে এল ওটা? ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর, চেয়ে রয়েছে, লোকজনকে বিভিন্ন দোকান থেকে ছুটে বেরোতে দেখল। এবার এক বিক্রয় সহকারী ওপরদিকে তর্জনী তাক করল।

‘ওই যে! ওই ব্যালকনিটায়!’

কিশোর চোখ তুলে এক নয়নাভিরাম প্রাচীন বাড়ির ওপরতলায় চাইল। কিছু একটা বা কেউ একজন রয়েছে ওখানে।

লালচুলে ভরা একটা মাথা দেখল ও।

‘লাফ দেবেন না,’ চেঁচাল ও। ‘আমি আসছি! আপনাকে হেল্প করতে।’

কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবয়বটি আরও ঝুঁকেছে এবং সবাই ক্যাটকেটে নানা রঙের চওড়া স্ট্রাইপের টি-শার্টটা দেখতে পেল। জনতা আর্তনাদ ছেড়ে ছড়িয়ে গেল, দেহটা যখনই ব্যালকনি টপকে নিচে পড়তে লাগল। একটু পরে বাতাস ভেদ করে মর্মরের করিডরে দড়াম করে আছড়ে পড়ল ওটা।

দৌড়ে কাছে গেল কিশোর, অপঘাতের শিকার মৃত মানুষটির দিকে তাকাল।

চোখের জায়গায় নীল বোতাম। নাকটা তৈরি কালো বোতামে। মাথার চুল মপ দিয়ে বানানো।

সবার দৃষ্টি ওর ওপর স্থির।

‘আমি কিছু করিনি।’ আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দু’হাত তুলল কিশোর। ‘আমার কোন দোষ নেই। সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না।’

ক্রুদ্ধ বিড়বিড়ানির শব্দ উঠল, শেষমেশ এক বিক্রয়কর্মী হেসে ফেলল।

‘আপনারা সবাই শান্ত হোন! এতে অন্তত একঘেয়েমি তো কেটেছে! আমি দারোয়ানকে ফোন করে বলছি এখুনি এটাকে সরিয়ে নিতে।

কিশোর অনন্ত রহমানকে কপট আত্মহত্যার খবরটা জানাবে ঠিক করল। কাজটা কার ধারণা করতে পারছে ও। হনহন করে মল ভেদ করে লাগেজ আনলিমিটেড অভিমুখে চলল।

রাজনের কীর্তিকলাপের কথা শুনে খুব হাসল ওর বন্ধু।

‘নিখুঁত সময় বেছেছে ও, মল এসময় ফাঁকা থাকে। স্বাভাবিক কোন রাত হলে কেউ আহত হতে পারত।’

‘দোকান বন্ধ করছ?’

হাতঘড়ি দেখল অনন্ত। ‘আর পাঁচ মিনিট।’

‘ওকে। মাইগুবেণ্ডারে চড়বে? আমরা…’

জানালা দিয়ে চাইল অনন্ত।

‘আর নয়!’ কাউন্টারে দুম করে এক কিল বসাল। ‘এর শেষ কোথায়?’

লেদার জ্যাকেট পরা ছেলেগুলো ফিরে এসেছে। দু’জন করিডরে দাঁড়িয়ে, স্কাল ঢুকল দোকানে। মুখে কথা নেই, দৃষ্টি

ধরে রাখল ওদের ওপরে।

‘কিছু চাই আপনার?’ অনন্ত জিজ্ঞেস করল।

মাথা ঝাঁকাল স্কাল। অ্যাটাশি কেসের এক ডিসপ্লের কাছে গিয়ে একটা কেস পরখ করল, তারপর ফেলে দিল মেঝেতে। লাথি মেরে ওটাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে, আরেকটা কেস ফেলল।

‘চলে যান, প্লিজ,’ বলল অনন্ত।

এসময় নয় বছরের এক ছেলে এসে দরজায় দাঁড়াল। ওর হাতে সামান্য কটা টাকা।

‘হাই,’ খোশমেজাজী কণ্ঠে বলল। ‘আমি আমার মার জন্মদিনের জন্যে একটা উপহার কিনতে চাই।’

কিশোর চাইল স্কালের দিকে, তার দৃষ্টি ছেলেটির ওপর স্থির। অনন্ত বলল, ‘সরি, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।’

হাতঘড়ি দেখল ছেলেটি।

‘সাইনে তো লেখা দোকান নটায় বন্ধ হয়। এখনও তো দু’মিনিট বাকি।’

‘আমার কিছু করার নেই,’ পরিতাপের হাসি অনন্তর মুখে। ‘আজকের মত বেচা-বিক্রি বন্ধ।’

‘ভুয়া বিজ্ঞাপন! আমাদের টিচার ঠিকই বলেছেন।’

মুখে আড়ষ্ট হাসি নিয়ে, ছেলেটিকে নিয়ে দোকান থেকে বেরোল অনন্ত। ও নিরাপদে করিডর ধরে হেঁটে চলে গেলে, ফিরে এসে স্কালের মুখোমুখি হলো।

‘আবার বলছি, চলে যান। দোকান বন্ধ করব।’

স্কাল তার লেদার জ্যাকেটের ভেতরে হাত ভরে স্প্রে পেইন্টের এক ক্যান বের করল। অনন্ত ঝটিতি ফোনের কাছে গেল, কিন্তু স্কাল এক লাফে সামনে বেড়ে দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নিল তারটা। মুহূর্তখানেক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে, এবার অনন্ত চকিতে চাইল কিশোরের দিকে।

‘এসো, হট লাইন থেকে সিকিউরিটিকে ফোন করি।’

ওর বন্ধু দোকান ছাড়তেই কিশোর দেখল স্কাল দেয়ালে টাঙানো এক ছবির দিকে চেয়ে রয়েছে। অনন্তর ছবি, বাবা-মার সঙ্গে। এবার হাত উঁচিয়ে ছবিটায় আড়াআড়ি লাল রঙ স্প্রে করল স্কাল।

কিশোর ঝাঁপিয়ে পড়ল স্কালের উদ্দেশে, কারাতের আঘাত হানল ওর কবজিতে। পেইন্টের ক্যানটা মেঝেতে পড়ে কয়েক লাফে সরে গেল।

‘গাধা কোথাকার…এত বড় সাহস….’

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল স্কাল। করিডরে এক নিরাপত্তাকর্মীকে থামিয়েছে অনন্ত, ইশারা করছে দোকানের দিকে। গার্ডটি তার টু-ওয়ে রেডিয়োতে কথা বলতেই স্কালের বন্ধুরা এক কোনা ঘুরে সটকে পড়ল।

স্কাল দৌড়ে গেল দোকানের পেছনদিকে। কিশোর মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করল, তারপর বুঝল গার্ড যথাসময়ে দোকানে এসে ওকে পাকড়াতে পারবে না। আপার ডিসপ্লে এরিয়া ভেদ করে হরিণ পায়ে ছুটে, স্টোরেজ রুমে ঢুকে পড়ল দ্রুতগতিতে স্কালের চিহ্ন নেই কোথাও।

বাতির সুইচ খুঁজে পেল না কিশোর। আঁধারে নিচু স্বরে গুঞ্জন করে চলেছে একটা যন্ত্র, এক কল থেকে টপ-টপ করে পানি পড়ছে এবং কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কিশোর এগিয়ে গেল, সুইচটা খুঁজে পেতেই মাথার পেছনে বাড়ি খেল। আর্তনাদ ছেড়ে মেঝেতে ঢলে পড়ল ও, মাথা ঝাড়া দিয়ে ভোঁতা যন্ত্রণাটার সঙ্গে যুঝতে চাইছে।

চোখ তুলতেই, স্কালকে দেখল ওপরে। শেলফের মাথায় চড়ে ছাদের টালি সরাচ্ছে। স্কাল আঁধারে মিশে যেতেই, কিশোর টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে শেলফ বেয়ে সিলিঙে উঠতে লাগল। ক্রলস্পেসের বাতাস গুমট। নিচে দোকানপাটের ক্ষীণ আলো দেখতে পাচ্ছে, গার্ডের টু-ওয়ে রেডিয়োর কড়কড় শব্দ পেল লোকটা যেই লাগেজ স্টোরে দৌড়ে এসে ঢুকল।

‘ওপরে,’ চেঁচাল কিশোর। ‘ক্রলম্পেসে।’

এবার স্কালকে হাঁচড়েপাঁচড়ে আঁধারে গা ঢাকা দিতে শুনল। গুড়ি মেরে সাবধানে এগোচ্ছে, শব্দ লক্ষ্য করে চাইতেই সামনে এক আবছা অবয়ব চোখে পড়ল কিশোরের।

‘ভাগো, সাপের মতন হিসিয়ে উঠল স্কাল। ‘ছুরি মারব।’

‘মিথ্যে কথা। ছুরি থাকলে তো আগেই মারতেন।’

‘দূর হও!’

‘আপনি ধরা খেয়েছেন। আপনার হাতে স্প্রে পেইন্ট, সেই বাচ্চাটা সহ তিনজন সাক্ষী। আপনি হয়তো…’

আঁধার ফুঁড়ে ওর উদ্দেশে তেড়ে আসছে স্কাল, দু’হাত বাড়ানো, হিংস্র পশুর মত দাঁত খিঁচোচ্ছে। জড়ামড়ি করে পড়ে গেল দু’জনে, লড়ছে-শেষমেশ এক ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় আঁধার কেটে গেল।

‘এখানে,’ কিশোর গার্ডের উদ্দেশে চিৎকার ছেড়ে মেঝেতে গেঁথে ফেলল স্কালকে। ‘জালিম কোথাকার! আপনার সব জারিজুরি খতম!’