পদচিহ্নের উপাখ্যান – ৫

পাঁচ

ঢং-ঢং-ঢং। গোটা র‍্যাঞ্চ জুড়ে শোনা গেল ধাতব কাউবেলের শব্দ।

‘কে কোথায় আছেন চলে আসুন!’ গলা ছেড়ে ডাকলেন মেলানি নানু। ঢং-ঢং-ঢং।

শীঘ্রি ডাইনিং রুম ভরে উঠল ক্ষুধার্ত র‍্যাঞ্চকর্মীদের ভিড়ে। মুসা আর রবিনের মাঝখানে চেয়ার দখল করল ডন।

‘খাইছে, তোমার বুটের এ হাল কেন? শুধাল মুসা। চোখ নামাল ডন। হলদে বুটজোড়া ওর বাদামি দাগে মাখামাখি।

‘জানি না,’ বলল ও। চোখ বোলাল কামরার চারপাশে। ‘কিশোরভাইকে দেখছি না।’

‘এখুনি এসে পড়বে,’ বলল রবিন।

খাবারের পাত্র আর প্লেট নিয়ে এলেন মেলানি নানু। টাটকা কর্ন ব্রেডের সঙ্গে বড়-বড় কাপে চিনি পরিবেশন করা হচ্ছে। ডন নিল ম্যাকারনি আর পনির। রবিন পুরু এক টুকরো মিটলোফ কেটে নিয়ে তাতে কেচাপ ছেটাল। মুসা নিল মেলানি নানুর বাগান থেকে সদ্য তোলা ধোঁয়া ওঠা সবজির তরকারি। এর সঙ্গে মেশাল লবণ আর গোলমরিচ মাখানো এক দলা মিষ্টি মাখন। এবার ভালমত নাড়ল ওটাকে।

টেবিলে টেবিলে ঘুরছে বিশাল এক থালা ভর্তি গাজর, টমেটো আর শসার টুকরো, যুকিনি আর গোলমরিচ। ঝুড়ি ভর্তি টাটকা বিস্কুটের সঙ্গে রয়েছে অ্যাপল বাটার, বাসায় তৈরি জ্যাম আর গ্রেভির পিচার।

আচমকা হুড়মুড় করে ডাইনিং রুমে ঢুকে তীক্ষ্ণ শিস দিল ডেবোরা।

‘দারুণ খবর আছে,’ বলে উঠল। ‘হানি আর বানি ঘরে ফিরেছে। এক নতুন পড়শী এইমাত্র দিয়ে গেল ওদেরকে।’ সবাই হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল।

কটকটে লাল চুল আর আজব কণ্ঠাওয়ালা লোকটার কথা মনে পড়ল ডনের।

‘আমি দেখেছি তাকে,’ বলল। ‘আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল র্যাঞ্চহাউসটা কোনখানে।’ সাহায্য করতে পেরেছে বলে গর্ববোধ করল ও।

‘খাইছে, লোকটা ঘোড়া দুটোকে পেয়েছে কোথায়?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

র‍্যাংলারের মুখে স্মিত হাসি ফুটল।

‘তার তৃণভূমিতে। আজ সকালে দেখে তার ঘোড়াদের সাথে হানি আর বানিও চরে বেড়াচ্ছে।’

‘ওরা ভাল আছে তো?’ রবিনের প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল ডেবোরা।

‘আস্তাবলে শর্টি ওদের গা ধুইয়ে দিচ্ছে, লাঞ্চের পর দেখতে যেয়ো।’

কিচেন থেকে প্লেটে চকোলেট চিপ, পিনাট বাটার, ওটমিল রেইযিন আর স্নিকারডুডল কুকির পাহাড় নিয়ে বেরিয়ে এলেন মেলানি নানু। উত্তেজিত ছেলেরা তাঁকে সুসংবাদটা জানাল। মেলানি নানুকে বিস্মিত দেখাল।

‘নতুন প্রতিবেশী কবে এল জানি না তো!’ বললেন, চোখ- মুখ ঝলমল করছে খুশিতে। মনে হয় ওল্ড সিডার মিডো ফার্মটা কিনেছে। কুকির একটা বাক্স উপহার দিয়ে ধন্যবাদ জানাতে হবে তো।’

ডন এক স্নিকারডুডলের ওপর থেকে সিনামন শুগার চাটার সময় বড় ভাইদেরকে বাথটাবের গোল্ডফিশগুলোর কথা জানাল। মুসা আর রবিন বলল ঘোড়াগুলোকে ঠায় দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে কতটা ঝক্কি পোহাতে হয়েছে ওদের।

এক বাটি তাজা ফল রাখলেন মেলানি নানু।

‘পশ্চিমের তৃণভূমির ঘোড়াগুলোর ছবি তুলতে পেরেছ?’

‘আরও আছে নাকি?’ বলে উঠল রবিন।

‘খাইছে!’ ঢোক গিলল মুসা।

‘বেশি না, অল্প কটা,’ বললেন মেলানি নানু। ‘তোমাদেরকে কখনও ওখানে নিয়ে যাইনি। বড় এক খড়ের মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়, আর দেখার মত তেমন কিছু নেইও। পুরনো এক বার্ন পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। শার্প ওখানে রেসকিউ হর্সগুলো রাখে। একাজে সাহায্য করতে নিজের জনা দুয়েক স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে এসেছে ও। ওর মত ভেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, প্রাণীদের অনেক যত্ন নেয়।’ পাত্র থেকে একটা আঙুর ছিঁড়ে নিয়ে মুখের ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন। ‘কী, আরও ছবি তোলার মত এনার্জি আছে তোমাদের?’

‘আমরা ঘোড়ায় চড়ব কখন?’ রীতিমত গুঙিয়ে উঠল ডন।

‘শীঘ্রিই,’ বললেন মেলানি নানু। ‘আর কয়েকটা কাজ বাকি আছে, সেগুলো সেরে নিই। স্যাডল আপের সময় হলে ঘণ্টি বাজাব।’

ডনের মাথার চুল এলোমেলো করে দিল রবিন।

‘চলো আমাদের সাথে, বলল।

‘তুমি ঘোড়াদের সামনে আপেল আর গাজর ধরবে, তাহলে ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।’

‘আচ্ছা,’ বলল ডন। ওদেরকে অনুগমন করে র‍্যাঞ্চের বড়সড় কিচেনটিতে ঢুকল। মুসা এক পিপে থেকে কটা আপেল নিয়ে কেটে ফালি ফালি করল। ডন গাজরের বাক্স খুঁজে নিয়ে মুঠো মুঠো করে থলেয় ভরল।

‘তুমি জুতো পাল্টে নাও,’ মুসা বলল ডনকে। ও আস্তাবলে দৌড়ে গিয়ে হলদে বুটজোড়া খুলল। ওগুলো রাখল র‍্যাঞ্চকর্মীদের হলদে বুটের সঙ্গে। পানি-কাদায় কাজ করার সময় ওই বুটগুলো পরে তারা। কিন্তু শুধুমাত্র ডনের বুটেই বাদামি ছোপ দেখা যাচ্ছে।

‘জলদি এসো, ডাকল নথি। ডন কাউবয় বুট পরে এক ছুটে বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। এবার তিনজনে পা বাড়াল পশ্চিমের তৃণভূমির উদ্দেশে।

মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই এক ঘোড়সওয়ারকে এদিকে আসতে দেখল ওরা।

‘ওই যে, কিশোরভাই,’ চিৎকার ছেড়ে, হাত নাড়ল ডন।

বিজলীকে দাঁড় করাল কিশোর।

‘হানি আর বানি কোনখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জানতে পেরেছি আমি!’ ঝটপট ওদেরকে ভাঙা বেড়া আর মেটে রাস্তায় ঘোড়ার পদচিহ্ন, এবং চাকার দাগ আবিষ্কারের কথা জানাল কিশোর। ‘আমার ধারণা, হানি আর বানিকে রাস্তায় দেখে কেউ চুরি করে।’

হেসে ফেলল মুসা।

‘না, না। এক পড়শী তার মাঠে ওদেরকে চরতে দেখে ফেরত দিয়ে গেছে।’

ভ্রূ কোঁচকাল কিশোর।

‘কিন্তু… আমি তো ওদের পায়ের ছাপ দেখেছি। চাকার দাগও।’

ওরা চারজন রহস্যটার সমাধান করতে চেষ্টা করল।

‘বেড়ার কাছে এমনিই হয়তো চাকার দাগ ছিল,’ বলল মুসা। ‘ঘোড়া দুটো বেরিয়ে যাওয়ার পর লোকে হয়তো ভাঙা বেড়াটা দেখার জন্যে থেমেছে। তারা সম্ভবত খুরের চিহ্নের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ায় ওগুলো মুছে গেছে। তাই তুমি আর দেখনি আরকী।’

বিজলীর গলা আলতো হাতে চাপড়ে দিল কিশোর।

‘হ্যারিও তা-ই বলেছে। ঘোড়া দুটো রাস্তায় উঠে যাওয়ায় নাকি আর খুরের দাগ দেখা যায়নি।’

বন্ধুর দিকে চাইল রবিন।

‘তুমি তা ভাবছ না, তাই না?’

বাতাসে ফুঁ দিল কিশোর।

‘ভাঙা বেড়া, খুরের ছাপ আর টায়ারের দাগ-সব একখানে। কেমন কাকতালীয় না ব্যাপারটা? এবং কাকতাল আমার পছন্দ নয়। তবে হানি আর বানিকে যখন ফিরে পাওয়া গেছে, তারমানে চুরি হয়নি ওরা।’ রবিনের ক্যামেরা আর ডনের বড় থলেটা দৃষ্টি কাড়ল গোয়েন্দাপ্রধানের। ‘তোমরা যাচ্ছ কোথায়?’

‘পশ্চিমের তৃণভূমির ঘোড়াদের ছবি তুলতে, জানাল মুসা। ‘তুমি তো এখনও খাওনি,’ বলল ডন। ‘শিগগির যাও, নইলে সব ফুরিয়ে যাবে।’

মেলানি নানুর খাবারে টান পড়েছে ভাবতেই মুচকি হাসি ফুটল কিশোরের ঠোঁটে।

‘একটু পরে দেখা হবে।’ এবার বিজলীকে দাবড়াল মাঠ- ময়দান পেরিয়ে।

.

বিজলীকে হাঁটিয়ে আস্তাবলে ঢুকল কিশোর। ইয়াবড় এক স্পঞ্জ দিয়ে এক মোটাসোটা ঘোড়ার গা ঘষছিল শর্টি। কাছেই আরেকটা হোঁতকা ঘোড়া বাঁধা। দেয়ালের এক পেরেক থেকে ঝুলছে শর্টির পালক-হ্যাট, আর কাউবয় বুটজোড়া ওটার নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা। ঘোড়াটাকে গোসল করাচ্ছে হলদে রবারের বুট পরে।

‘বেড়াটা মেরামত করা গেল?’ প্রশ্ন করল শর্টি।

‘হ্যাঁ।’ বিজলীর স্যাডল খুলে স্যাডল স্ট্যাণ্ডে রাখল কিশোর। এবার রাইডিং হেলমেটটা খুলে ঝুলিয়ে দিল দেয়ালে।

কিশোরের মুখ আর বাহুজোড়া দেখে ভ্রূ কোঁচকাল শর্টি।

‘এত কাটাকুটি কীসের?’

‘ভাঙা ডালটায় দড়ি বাঁধতে গিয়ে কেটেছে।’

‘কাটা জায়গাগুলো ভালমত ধুয়ে স্যাভলন লাগাও, নইলে ইনফেকশন হতে পারে,’ বলল শর্টি। ‘আয়,’ বলে সাবান মাখানো ঘোড়াটার গা চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘এটা হানি, আর ওটা বানি।’

হানির মসৃণ চামড়ায় হাত বোলাল কিশোর।

‘ডালটার খোঁচা না খেয়ে ও তৃণভূমি থেকে বেরোল কীভাবে?’

‘হয়তো ওটার পাশ ঘুরে হেঁটে গেছে,’ বলল শর্টি।

‘অসম্ভব,’ বলল কিশোর। দুটো ঘোড়ার কোনওটার শরীরেই সামান্যতম কাটাকুটি কিংবা ছড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই। ‘ডাল আর বেড়ার খুঁটির মাঝখান দিয়ে আমারই শরীর গলে না, আর এই ঘোড়া দুটোর তুলনায় আমাকে তো রীতিমত রোগাই বলতে হবে।

‘এই দুটোর চেয়ে হাতিও চিকন,’ বলে হেসে উঠল শর্টি।

‘কে ফিরিয়ে এনেছে এদেরকে?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘রাস্তার ওপাশের এক প্রতিবেশী।’ একটা চোখ পিটপিট করছে শর্টির। ‘লোকটাকে আগে কখনও দেখিনি। অবশ্য আমি বহু বছর এখানে ছিলাম না। আট বছর বয়সে চলে যাই। যাদের চিনতাম তাদের বেশিরভাগই এখন আর নেই।’

‘কিশোর পাশা!’ এমনিসময় গটগট করে আস্তাবলে এসে ঢুকলেন মেলানি নানু। ‘আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? তোমার জ্যাক নানা জানলে আমাকে আস্ত রাখবে না। শর্টি, আপনি ওকে আটকে রেখেছেন নাকি?’

রক্তবর্ণ হয়ে গেল শর্টির মুখের চেহারা। এমনকী তার সাদা চুলের বিপরীতে কানের ডগা দুটোকেও টকটকে লাল দেখাল। চোখ নামাল মাটিতে, ছুটন্ত পানির হোসের কারণে ওর বুটজোড়া কাদায় মেখে যাচ্ছে।

‘সরি, বলল। ‘ভুল হয়ে গেছে।’

‘এসো, কিশোর,’ ডাকলেন মেলানি নানু, ‘তোমার খাবার গরম করে দিচ্ছি। বিকেলে অনেক কাজ আছে কিন্তু আমাদের।’ ওরা হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে, মেলানি নানু চকিতে কাঁধের ওপর দিয়ে চাইলেন শর্টির দিকে, এবং কিশোরের মনে হলো, নানুর মুখের চেহারাতেও খানিকটা লালচে আভা ফুটেছে।