অপয়া ক্যামেরা – ৫

পাঁচ

শ্বাস চাপলাম। লাফিয়ে উঠে পড়লাম চেয়ার থেকে।

‘কী হয়েছে?’

কিশোর চোখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে।

‘আমার চোখ জ্বলে গেল!’

কিশোরের হাতজোড়া ধরে আস্তে করে নিচে নামালাম। ওর চোখ দুটো দেখে কেঁপে উঠল বুক।

আগুনের মত জ্বলছে।

‘ভীষণ ব্যথা করছে! শীঘ্রি কিছু একটা করো!’

‘ফ্ল্যা-ফ্ল্যাশটা হয়তো বেশি তীব্র ছিল,’ তুতলে বললাম। ‘তুমি ক্যামেরার খুব কাছে দাঁড়িয়ে ছিলে।’

আমি আর রবিন বাথরুমে ধরে-ধরে নিয়ে গেলাম কিশোরকে। ঠাণ্ডা পানিতে এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে ওর চোখে চেপে ধরলাম।

‘কাজ হচ্ছে না!’ ককিয়ে উঠল কিশোর। ‘আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে! ভয়ানক ব্যথা করছে!’

‘ঠিক হয়ে যাবে,’ সান্ত্বনা দিয়ে বলল রবিন।

কাপড়টা সরালাম। ওর চোখজোড়া এখনও যেন জ্বলন্ত অঙ্গার।

কাপড়টা আবারও ভিজিয়ে ওর মুখের ওপর রাখলাম। তারপর দু’জন মিলে ওকে নিচে, মার কাছে নিয়ে গেলাম।

‘মা, ওর চোখ জ্বালা করছে। লাল হয়ে আছে,’ বললাম।

‘দেখি।’ কাপড়টা সরাল মা। লাল আভা দেখে চোখ কপালে উঠল তার। ‘তোমার কি অ্যালার্জি আছে, কিশোর?’

মাথা নাড়ল কিশোর। ওর গোটা দেহ কাঁপছে থরথর করে।

‘না! নেই! প্লিজ কিছু একটা করুন!’

‘ঘরে আই ড্রপ আছে, জলদি নিয়ে আয়,’ জরুরী কণ্ঠে বলল মা। ‘আমার ড্রেসারের ওপর পাবি।’

আই ড্রপেও কোন কাজ হলো না।

‘শিগগির ওর চাচীকে ফোন কর,’ বলল মা। ‘ওকে হয়তো চোখের ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। আশ্চর্য, হঠাৎ করে কী হলো?!’

ক’মিনিট পরেই মেরি চাচী চলে এলেন। আমরা কিশোরকে গাড়িতে তুলে দিলাম। রবিনও যাবে সঙ্গে।

‘চোখ জ্বালাপোড়া সেরে গেলে,’ বললাম ওকে, ‘আমাকে ফোন কোরো।’

গাড়িটা চলে যেতে দেখলাম। পেটের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি টের পাচ্ছি। কিশোরের ভয়ার্ত চিৎকার এখনও কানে বাজছে আমার।

বেডরুমে গিয়ে, স্ন্যাপশটটা তুলে নিলাম। রক্তচক্ষু কিশোরের হাসিমাখা মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

খাইছে, কী আজব ব্যাপার, মনে-মনে বললাম।

.

ডিনারের পর, তখনও কিশোরের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎই মি. লয়েডের দেয়া অ্যাসাইনমেন্টের কথা মনে পড়ল। জিমে গিয়ে মেয়েদের বাস্কেটবল খেলার ছবি নিতে হবে বর্ষপঞ্জির জন্য।

দুটো ক্যামেরা ব্যাগে ভরলাম। তারপর এক লাফে বাইকে চড়ে সোজা জিমে।

কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছেছি। খেলা প্রায় শেষের পথে। আমাদের টাইগাররা হেরে যাচ্ছে প্রবল প্রতিপক্ষ স্টিংরে-দের কাছে।

ওই তো, আমাদের সেরা খেলোয়াড় সারা ম্যাকগ্র। বল কেড়ে নিয়ে ড্রিবল করে এগোল ফ্লোরের ওপর দিয়ে। লাইনের কাছে থেমে সহজ এক থ্রি-পয়েন্টার পাঠাল।

রিচারগুলো অর্ধেক ভর্তি, ছেলে-মেয়েরা খেলা দেখতে এসেছে। বেশিরভাগই পা ঠুকে উৎসাহ জোগাচ্ছে সারাকে।

ঠিক করলাম ব্লিচারের ওপর থেকে কটা ছবি নেব। আমার সেরা ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। সহসা লাল-সাদা এক স্নিকার বেরিয়ে এসে আমাকে ল্যাং মারলে তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়লাম।

‘আউ!’ পড়ে গিয়ে হাঁটুতে জোর ব্যথা পেলাম। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম স্নিকারটা কার পায়ে-ববি। ও আর এমা আমার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

‘আহা রে, ব্যথা পাওনি তো?’ বলল ববি। হেসে উঠল।

‘মু-মু, ইস, তোমার ক্যামেরাটা ভাঙেনি তো?’ দর্শকদের কোলাহল ছাপিয়ে চেঁচাল এমা।

আমার উচিত ছিল ওদেরকে উপেক্ষা করা। তার বদলে বলে বসলাম, ‘খাইছে, মেয়েদের পা এত বড় হয় জানতাম না তো!’

এবার ক্যামেরার দিকে চাইলাম। হায় হায়! সত্যিই তো লেন্সটা ফেটে গেছে।

হতাশায় মাথা নাড়তে নাড়তে ব্লিচারের মাথায় উঠে এলাম। চাইলাম স্কোরবোর্ডের দিকে। টাইগাররা ৩৬-৪৫-এ ইয়ে। সারার শীঘ্রি কিছু ভেলকি দেখানো উচিত। আর তাতে আমিও ভাল ছবি তোলার সুযোগ পাব।

অন্য ক্যামেরাটার জন্য হাত ঢোকালাম ব্যাগে-এবং সভয়ে অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়লাম।

‘খাইছে!’ সেই বিচিত্র, পুরানো ক্যামেরাটা। আমি তো এটা আনতে চাইনি!

কী আর করা… এখন এটাই ব্যবহার করতে হবে।

ডজন-ডজন ছবি তোলা যাবে না এটা দিয়ে। একটা-দুটো সেরা মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাকে।

ফ্লোরের ওপর দিয়ে ছুটছে সারা, এমন এক লং শট নিতে চাই। এই সেকেলে ক্যামেরা দিয়ে কি তা সম্ভব? ওটাকে তুলে ধরলাম মুখের কাছে-তারপর গুঙিয়ে উঠলাম

রয় রেস! ওর লাল চুলের ওপর টেনে নামিয়েছে নীল বেসবল ক্যাপটা। কিন্তু তারপরও সহজেই চেনা যাচ্ছে

ও কী করছে এখানে?

খেলোয়াড়দের বেঞ্চের পাশে, মেঝেতে দাঁড়িয়ে রয়। ওর গলায় স্ট্র্যাপ থেকে ঝুলছে দুটো ক্যামেরা। একের পর এক ছবি নিচ্ছে ও।

‘অ্যাই, হিংসুটে কোথাকার!’ জোরে চিৎকার ছাড়লাম। ও জানে এটা আমার অ্যাসাইনমেন্ট।

প্রতিযোগিতায় জিততে যে কোন কিছু করতে রাজি রয়। কিন্তু এটা ঠিক নয়-অন্যায়।

স্টিংরে দল আবারও স্কোর করল। দর্শকরা সব থম মেরে গেছে। সবাই আশা করছে সারা কিছু একটা করবে।

নিচে তাকালাম, রিচারগুলোর দিকে। ববি সেল ফোনে কথা বলছে। এমা ব্যাগ হাতড়ে কিছু খুঁজছে। খেলায় মন নেই ওদের।

পুরানো ক্যামেরাটা রেডি রাখলাম। ক’মুহূর্ত পরে, ফ্লোরের মাঝ বরাবর সবেগে ড্রিবলিং করে এল সারা।

এই-ই সুযোগ। ও বাস্কেটের দিকে উড়াল দিতেই ভিউ স্ক্রিনে রাখলাম ওকে। উঁচুতে লাফিয়ে উঠে হুপে লেআপ পাঠাল সারা।

ওর পাজোড়া মেঝে ছাড়তেই শাটার বাটন টিপলাম। ঝলসে উঠল ক্যামেরা। হড়কে বেরিয়ে এল চারকোনা কাগজ।

ছবিটার দিকে চেয়ে থেকে ওটাকে ডেভেলপ হতে দেখছি।

‘খাইছে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘এমন হলো কেন?’

ছবিতে শুধু সারার একটা বাহু এসেছে।

ওর বাকি শরীর কোথায়? মুখ?

শুধুমাত্র ওর বাহুর ছবি তুলেছি আমি?

এসময় কোন কিছু ভাঙার জোরাল শব্দে আঁতকে উঠে শ্বাস চাপল ব্লিচারের ছেলে-মেয়েরা।

এবং শব্দটাকে চাপা দিল প্রচণ্ড যন্ত্রণাকাতর এক তীব্র, তীক্ষ্ণ বিলাপধ্বনি।

ঘুরে চাইলাম-এবং দেখলাম বাস্কেট রিম থেকে ঝুলছে সারা।

এক বাহুতে ভর দিয়ে!

ককাচ্ছে ও, আর্তনাদ করছে। গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে দরদর করে।

এমনকী ব্লিচারের ওপর থেকেও দেখতে পাচ্ছি বিশ্রীভাবে ভেঙে গেছে ওর বাহুটা। অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে ওটা ঝুলে রয়েছে ওখানে।

দু’দলের খেলোয়াড়রা ওর নিচে দাঁড়িয়ে হৈ-হল্লা করছে। বাচ্চারা ভয়ে চোখ ঢাকছে। কোচেরা ওকে মেঝেতে নামাতে ছুটে গেলেন।

রেফারি সাইরেনের মত বারবার বাঁশি ফুঁকছেন। ব্যথায় কাতরাচ্ছে, জিম ফ্লোরে চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে সারা, চামড়া ভেদ করে হাড় দেখা যাচ্ছে ওর।

শ্বাসের জন্য আঁকুপাঁকু করছি, উপলব্ধি করলাম ছবিটা এখনও আমার হাতে ধরা। ওটাকে চোখের সামনে তুলে চেয়ে রইলাম একদৃষ্টে।

সারার বাহুটার দিকে তাকিয়ে আছি।

এবং সহসাই অসুস্থ বোধ করলাম