পদচিহ্নের উপাখ্যান – ১

এক

মাঝরাতে ঘুম ভাঙল ডনের। কোথায় আছে ও? তড়াক করে বিছানায় সোজা হয়ে বসল। বুকের ভেতর ড্রাম বাজাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

এটা তো ওর বিছানা নয়!

দূরে কোথায় যেন একটা ঘোড়া চিঁহিহি করে ডেকে উঠল বুক ভরে দম নিল ডন। এবার মনে পড়েছে। কিশোর, মুসা আর রবিনের সঙ্গে ডেয়ার টু ড্রিম র‍্যাঞ্চে ছুটি কাটাতে এসেছে ও। বাঙ্কহাউসে আজই প্রথম রাত কাটাচ্ছে ওরা। কিন্তু ঘুমটা ভাঙল কেন?

বিছানা থেকে হড়কে নামল ডন, ওপরের বাঙ্কে ঘুমন্ত কিশোরের ঘুম যেন না ভেঙে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক। রবিন আর মুসার পাশ দিয়ে পা টিপে-টিপে এগোল। ওপরের এক বাঙ্কের কিনারা দিয়ে একটা হাত পড়ে আছে রবিনের। নিচের বাঙ্কে মুসা গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। ওদের পাশ কাটানোর সময় এক চুল নড়ল না ছেলেরা।

জানালার কাছে পৌঁছে, একপাশে পর্দা সরিয়ে বাইরে চাইল ডন। ম্লান আলো বিলাচ্ছে রুপোলী চাঁদ। দূরের প্রকাণ্ড বার্নটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। ঘোড়ার দূরাগত হেষাধ্বনি কানে এল আবার। কিন্তু কোন ঘোড়ার ছায়াও দেখল না ও। রাতের বিচিত্র সব শব্দ শুনতে পাচ্ছে ডন। ঝিঁঝির ডাক। বাঙ্কহাউসের বারান্দায় রাখা রকিং চেয়ারগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করছে।

আরি! ওগুলো কি মানুষের কণ্ঠস্বর? ফিসফিসানির মত শোনাচ্ছে না? কান খাড়া করল ডন। এসময় দমকা বাতাস নাড়িয়ে দিয়ে গেল গাছপালার ডাল-পাতা। আর কোন কণ্ঠস্বর শুনল না ও। হয়তো স্রেফ বাতাসের শব্দ ছিল ওটা।

তৃতীয়বারের মত ডাকল ঘোড়াটা। খুরের ক্ষীণ খট খট শব্দ শুনল ডন। চালু হলো এক ট্রাকের ইঞ্জিন। ওটা চলে যাচ্ছে শুনল ও। এবার নিরেট নিস্তব্ধতা।

একবার হাই তুলল ডন, তারপর আরেকবার। ওর আরও খানিক ঘুমানো দরকার। কাল এই র‍্যাঞ্চে ছেলেদের প্রথম কাজের দিন, সে সঙ্গে খেলাধুলোরও।

ভোরে জাগল কিশোর। বাঙ্ক থেকে লাফিয়ে নেমে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। র‍্যাঞ্চের দূর প্রান্তে, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার কাউবয়দের দেখল ও।

‘ইইইই-হাআআআ!’ তাদের অস্পষ্ট চিৎকার কানে এল। ‘ইইইই-হাআআআ!’

বাঙ্কগুলোর কাছে দৌড়ে গেল কিশোর।

‘ওঠো ওঠো,’ বলে আলতো ঝাঁকুনি দিতে লাগল ঘুমন্ত ছেলেদের। ‘ঘোড়া চরিয়ে ফিরছে র‍্যাংলাররা।’

উত্তেজিত ছেলেরা চটপট মুখ-টুখ ধুয়ে নিল, বাথরুম সেরে জিন্স আর টি-শার্ট পরল। রোদ থেকে বাঁচতে কাউবয় হ্যাট পরেছে, আর পায়ে গলিয়েছে ঘোড়া চালানোর কাউবয় বুট। এবার দৌড়ে গেল করালে। স্কুলের আঙিনার সমান জায়গাটা গোল করে ঘেরা রেইল ফেন্স দিয়ে। ছেলেরা হাঁচড়ে পাঁচড়ে টপ রেইলে উঠে বসল মজা দেখার জন্য। অশ্বারোহী র‍্যাংলাররা ‘ইইইই-হাআআআ হুঙ্কার ছেড়ে তাড়া দিয়ে ঘোড়াগুলোকে ভেতরে ঢোকাচ্ছে।

টগবগে এক কালো ঘোড়া ঊর্ধ্বগতিতে করালে ঢুকল। পিঠে ড্রাগন আকৃতির বড়সড় সাদা এক চিহ্ন ওটার।

‘ড্রাগন!’ চেঁচাল নথি, হাততালি দিল। ওর প্রিয় ঘোড়াটা চোখ তুলে চেয়ে মাথা ঝাড়া দিল।

অন্যরা নিজেদের পছন্দের ঘোড়াদের খুঁজছে। জ্যাক নানার সঙ্গে কয়েকবারই এ র‍্যাঞ্চে এসেছে ওরা। জ্যাক হিগিন্স রবিনের মা-র আপন চাচা। তিনি র‍্যাঞ্চমালিক মেলানির ছোটবেলার বন্ধু। মেলানি নানু ছেলেদের শিখিয়েছেন কীভাবে ঘোড়া চালাতে হয়, এবং ওরা এটা আয়ত্তে আনতে রীতিমত কঠোর পরিশ্রম করেছে। প্রতিবারই উন্নতি হয়েছে ওদের।

মেলানি নানু যখন জানলেন জ্যাক নানা ব্যবসার কাজে ক’দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছেন, তিনি ছেলেদেরকে তাঁর র‍্যাঞ্চে থাকার আমন্ত্রণ জানান।

‘তোমাদেরকে আর সব র‍্যাঞ্চকর্মীদের মতই কাজ-কর্ম করতে হবে,’ বলেছেন মেলানি নানু। ‘তবে ঘোড়ায় চড়ারও সুযোগ পাবে।’ ছেলেরা কাজ করতে ভালবাসে এবং রাইড করতেও।

‘রাজি!’ সমস্বরে বলেছে চারজন।

কালো ফুটকিওয়ালা ছোট সাদা এক ঘোড়া হেঁটে এসে করালে ঢুকল।

‘ফুটকি!’ ডাকল ডন। ছোট ঘোড়াটা মুখ তুলে চেয়ে খোঁত করে শব্দ করল। এবার দুলকিচালে ছুটে এল ডনের কাছে। ‘আমাকে চিনেছে!’ চেঁচিয়ে উঠল ডন। এক মাস আগে ফুটকিকে র‍্যাঞ্চে আনা হয়েছে। ডন প্রথম অতিথি যে ওটার পিঠে চাপে। ঘোড়াটা নাক ঘষল ডনের পকেটে। ‘কীরে, খিদে পেয়েছে?’ বলল ও। ‘আচ্ছা, তোকে নাস্তার টেবিল থেকে কিছু একটা এনে দেব।’

এসময় শক্তিশালী বাদামি এক ঘোড়া সবেগে প্রবেশ করল করালে। কিশোর মুখে দু’আঙুল পুরে ছোট্ট, তীক্ষ্ণ শিস দিল ঘোড়াটা ডাক ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পেছনের দু’পায়ে ভর করে। থাবা মারল বাতাসে। এবার তিড়িং-তিড়িং করে নাচতে-নাচতে ছুটে এল।

‘কীরে, বিজলী, বলল কিশোর, ওটার দু’কানের পেছনে চুলকে দিল। ‘কেমন আছিস?’

মুসা অপেক্ষা করছে তো করছেই, ওর ঘোড়াটার আর দেখা নেই।

‘খাইছে, তোমরা কেউ ডেইজিকে দেখেছ?’

সব ঘোড়া এখনও ঢোকেনি,’ জানাল রবিন। ডেইজিও শীঘ্রি এসে পড়বে।’

কিন্তু মুসা আশঙ্কা করছে ডেইজি লাপাত্তা হয়ে গেছে। ডেইজি ডেয়ার টু ড্রিম র‍্যাঞ্চের রেসকিউ হর্সগুলোর একটি। গোটা দেশ চষে ওগুলোকে উদ্ধার করা হয়। এদের কোন- কোনটা ঘর পালানো। যখন পাওয়া যায় তখন ওরা বেশির ভাগই ছিল অসুস্থ, ক্ষুধার্ত কিংবা আহত। মেলানি নানু সেবা-যত্ন দিয়ে ওদেরকে সুস্থ করে তোলেন। তারপর ভাল ভাল পরিবার দেখে পুষতে দেন। বছরখানেক আগে, বয় স্কাউটদের একটি দল মন্টানার পাহাড়ে দিশেহারার মতন ঘুরে বেড়াতে দেখে ডেইজিকে। ধূসর ঘোড়াটা তখন খিদেয় কাহিল এবং বব ক্যাটের কামড়ে আহত। দলটি ডেইজিকে ডেয়ার টু ড্রিম র‍্যাঞ্চে পাঠায়। এর আগেরবার মুসা এসে দেখে, ঘোড়াটার ক্ষত শুকিয়ে গেছে এবং বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছে ওটা।

মুসা দেখল ঘোড়াগুলো ধীরে-ধীরে ভরিয়ে তুলছে করালটা। বেশির ভাগই সাধারণ ঘোড়া, র‍্যাংলার আর অতিথিরা যেগুলোয় চাপে। তবে ডেইজির মত অল্প কিছু আছে উদ্ধারপ্রাপ্ত।

‘কই, ওকে তো দেখছি না,’ বলল মুসা। ‘ওকে বোধহয় কেউ পালতে নিয়েছে। ও মনেপ্রাণে চেয়েছে ডেইজি এমন কোন পরিবারে যাবে যেখানে ওর ভালবাসা আর যত্ন-আত্তির অভাব হবে না। কিন্তু শান্ত-শিষ্ট রুপোলী ঘোড়াটার পিঠে আরেকবার চাপতে পারলে খুশি হত ও।

‘ওই যে,’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘ওই যে, ডেইজি।’ রাজকুমারীর মত স্বচ্ছন্দ পায়ে করালে ঢুকল মুসার প্রিয় ঘোড়াটা।

‘এই, ডেইজি, এই যে এখানে।’ মুসা চিৎকার ছাড়লে নাচতে-নাচতে ছুটে এল ঘোড়াটা।

আচমকা এক অশ্বারোহী র‍্যাংলার বার্ন ঘুরে সবেগে ধেয়ে এল। লাল কাউবয় হ্যাটের নিচে গম্ভীর তার মুখের চেহারা। করালের পাশ দিয়ে বজ্রপাতের শব্দ তুলে মেইন হাউসের দিকে ছুটল মহিলার ঘোড়া।

‘কিছু একটা হয়েছে, বলল কিশোর, ফেন্স থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামল। অন্যরা অনুসরণ করল ওকে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। ওরা র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌছে দেখে, র‍্যাংলার সামনের বারান্দায় উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে মেলানি নানুর সঙ্গে।

‘নেই,’ যুবতী মহিলা জানাল। ‘পুলিসে ফোন করতে হবে। হানি আর বানিকে চোরে নিয়ে গেছে!’