অপয়া ক্যামেরা – ১

এক

‘মুসা, দাঁড়াও!’ কিশোর স্কুলের হলওয়ে ধরে দৌড়ে আসছে। ‘ওটা কি নতুন ক্যামেরা?’

রবিনও রয়েছে ওঁর সঙ্গে।

মাথা নাড়লাম।

‘এটা আমার পুরনো ক্যামেরাগুলোর একটা,’ স্ট্র্যাপে বাঁধা ক্যামেরাটা আমার গলা থেকে ঝুলছে। ‘বাবা বলেছে মিস্টার লয়েডের কাছ থেকে বড় অ্যাসাইনমেন্টটা বাগাতে পারলে নতুন একটা কিনে দেবে।’

চোখ পিটপিট করল রবিন।

‘বড় অ্যাসাইনমেন্ট মানে?’

ওকে মৃদু ধাক্কা দিলাম।

‘কেন, আমি গত ক’মাস ধরে তো শুধু ওটা নিয়েই কথা বলে যাচ্ছি, মনে নেই? টাইগার-এ বড়-বড় দু’পৃষ্ঠা জুড়ে পুরো স্টুডেন্ট বডির ছবি ছাপা হবে।’ ‘টাইগার’ আমাদের বর্ষপঞ্জির নাম।

চোখ-মুখ কোঁচকাল রবিন।

‘আমি তো ভেবেছিলাম মিস্টার লয়েড কাজটার জন্যে এরমধ্যেই রয় রেসকে বাছাই করে ফেলেছেন।’

‘না, ভুল ভেবেছিলে,’ বললাম। ‘তাই টাইগার অফিসে এত হন্তদন্ত হয়ে চলেছি। খাইছে, দারুণ এক আইডিয়া এসেছে মাথায়। মিস্টার লয়েড না করতে পারবেন না। আর রয় হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকে ছবি তুলতে দেখবে!’

হেসে উঠল কিশোর।

‘রয়কে তুমি দেখতে পারো না, তাই না?’

চোখ ঘোরালাম।

‘লেটুস কি ছাগলকে পছন্দ করে?’

ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে চাইল রবিন।

‘ছাগল মানে? বুঝলাম না, মুসা।’

বোঝেনি বলে একটু হতাশই হলাম।

‘বলতে চেয়েছি রয় সব কিছু গিলে খেতে চায়,’ ব্যাখ্যা করলাম। ‘ও চায় একাই স্টার হবে। মিস্টার লয়েড গত সপ্তাহে আমাকে জিমনেশিয়ামের বেক সেল-এর ছবি তুলতে বলেছিলেন। গিয়ে দেখি বান্দা হাজির।’

‘রয়?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘আর কে?’

‘ও লড়াকু স্বভাবের। দেখতেও সুন্দর,’ বলল নথি।

‘সুন্দর?’ গলার নিচে তর্জনী চেপে ধরলাম। ‘কমলা রঙের চুল আর ওই কমলা ফুটকিগুলো থাকার পরেও? ওকে দেখতে আমার গাজরের মত লাগে।’

‘তোমার মাথার মধ্যে সবজি ঢুকে গেছে,’ বলল কিশোর।

‘না। আমার মাথার ভেতর শুধু ছবি,’ বললাম। ‘আমিও রয়ের চাইতে কোন অংশে কম লড়িয়ে নই। আমি ওই বড় কাজটা চাই। আর তাই রয়ের আগে বর্ষপঞ্জির অফিসে হাজির হতে চাই।’

এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হল ধরে দুলকিচালে ছুটলাম। প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে, এবং স্কুল ফাঁকা হয়ে গেছে।

‘মুসা-’ পেছন থেকে চেঁচাল কিশোর। ‘শনিবারের বাইক রাইডিঙে আমরা যাচ্ছি তো?’

‘সকালে আমার ফারিহাকে দেখে রাখতে হবে,’ বললাম। ফারিহা আমার খালাতো বোন। ‘পুরোটা বিকেল বাইক চালাতে পারব।’

এবার কোনাটা ঘুরতেই শিয়ার সিস্টারদের সামনে পড়ে গেলাম।

আসলে, ববি আর এমা বোন নয়। ওরা প্রিয় বান্ধবী। ওদেরকে মানিকজোড় বলা যায়। সবসময় একসঙ্গে দু’জনে।

আমি ওদেরকে ‘স্লিয়ার সিস্টার্স’ বলি কারণ আমাকে দেখলেই নাক সিটকায় ওরা। আমি যেন পচা মাংস কিংবা ডিম। এবং আমার প্রতি ওদের ব্যবহারও যাচ্ছেতাই।

ওরা এমনকী দেখতেও অনেকটা একরকম। দু’জনেই ঢ্যাঙা আর টিঙটিঙে। একই ধরনের লম্বা নাক আর চোখা চিবুক ওদের। অনেকটা ডাইনীর মত দেখায়।

‘হাই, মু-মু,’ বলল ববি, তাচ্ছিল্যভরে।

দাঁতে দাঁত পিষলাম। অসহ্য! মুসাকে বিকৃত করে মু-মু বলে ডাকে শয়তান মেয়ে দুটো।

এমা আমার মুখের দিকে আঙুল দেখাল।

‘মু-মু, তোমার সামনের দাঁতে কী?’ বলল।

তর্জনী দিয়ে দাঁত ঘষলাম আমি।

‘গেছে?’ প্রশ্ন করলাম।

মাথা ঝাঁকাল এমা।

‘হ্যাঁ। ময়লাটা তোমার আঙুলে ছিল!’

পরস্পরকে হাই ফাইভ দিয়ে খনখনে গলায় এমনভাবে হাসতে লাগল দু’জনে, এমন মজার কৌতুক যেন ইতিহাসে নেই।

‘বস্তাপচা কৌতুক,’ বললাম। ‘একবারে রদ্দি মাল।’ ওদেরকে ঠেলে পথ করে নিয়ে হল ধরে হনহন করে পা চালালাম। একটু পরে ছুটতে লাগলাম। ক্যামেরাটা সমানে আমার সামনে ঝাঁকি খাচ্ছে।

বর্ষপঞ্জির অফিসের দরজাটা বাঁয়ের একদম শেষে। নব চেপে ধরে ঘোরালাম, এবার হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

পরক্ষণে, শ্বেত বিস্ফোরণে চোখ ধাঁধিয়ে যেতেই সভয়ে শ্বাস চাপলাম।