অপয়া ক্যামেরা – ২

দুই

না, ওটা বিস্ফোরণ নয়।

ক’মুহূর্ত পরে, আবারও চোখে দেখতে পেলাম। এবং ধীরে- ধীরে ফোকাসে এল রয় রেস।

মি. লয়েডের পাশে দাঁড়িয়ে ও। ক্যামেরা তাক করে। এবং ওর গাজরমার্কা মুখে চওড়া হাসি।

‘তোমার জন্যে এটা একটা শিক্ষা, মুসা,’ বলল ও। ‘এভাবেই মানুষকে চমকে দিতে হয়। দারুণ এক প্রাণবন্ত শট যা-ই বলো।’

‘রয়-আরেকটু হলেই আমি অন্ধ হয়ে যেতাম!’ চিৎকার ছাড়লাম। চোখে এখনও সাদা ঝলকানি দেখছি।

ক্যামেরার পেছনের ভিউ স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখল রয়।

‘তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে,’ মহা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠে মি. লয়েডের সঙ্গে ওটা শেয়ার করল, ‘হরর মুভির জিন্দালাশ একটা।’

‘তুমি জিন্দালাশ!’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে পাল্টা চেঁচালাম।

রয়কে ওখানে দেখে সাঙ্ঘাতিক হতাশ হয়ে পড়েছি। ওকে কনুইয়ের গুঁতোয় একপাশে সরিয়ে দিয়ে মি. লয়েডের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম।

‘তুমি তো এখুনি চলে যাচ্ছ-তাই না?’ রয়কে বললাম।

শ্রাগ করল ও।

‘কথা বলছিলাম স্যরের সঙ্গে,’ জানাল। ‘বর্ষপঞ্জিটা কীভাবে সাজানো যায় তাই নিয়ে আলাপ করছিলাম আমরা।’

মি. লয়েড চশমা খুলে চোখ কচলালেন। তিনি লম্বা, লিকলিকে মানুষ। এতটাই শুকনো-পাতলা, কব্জির হাড় অবধি গোণা যায়। মুখটা সরু, কালো চুল খুবই ছোট করে ছাঁটা তাঁর। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ-কেউ তাঁকে আড়ালে সুঁই বলে ডাকে। তাকালেই তাঁকে ঠিক সুঁইয়ের মতই দেখায়।

কণ্ঠস্বর কোমল, মোলায়েম মি. লয়েডের। যে কোন প্রশ্নের জবাব বেশ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে তারপর দেন। এবং বারবার চশমা খোলা আর পরা তাঁর স্বভাব। আমার ধারণা, এটা নার্ভাস প্রকৃতির মানুষের লক্ষণ।

মি. লয়েডকে আমি কখনও শিক্ষক হিসেবে পাইনি। তবে তাঁকে আমি বর্ষপঞ্জির একজন যোগ্য উপদেষ্টা মনে করি। তিনি কোন অন্যায্য কাজ করেন না কখনও। যে কোন নতুন আইডিয়াকে স্বাগত জানান।

‘বাবা আমার পেনট্যাক্সের জন্যে নতুন লেন্স কিনে দিয়েছে,’ জানাল রয়। ‘এই ক্যামেরায় দশগুণ বেশি জুম করা যায়। আর অন্য ক্যামেরায় বিশগুণ।’

‘এত ফুটানি দেখিয়ো না,’ রাগতস্বরে বললাম।

রয়ের ধারণা ও বিশেষ কেউ, কেননা ওর বাবা ‘ক্যামেরা ওয়ার্ল্ড’-এর ম্যানেজার কিনা। মল-এর ক্যামেরার দোকান ওটা।

মি. লয়েড নাকের ওপর চশমা ঠেলে তুলে আমার দিকে ফিরলেন।

‘মুসা, গত সপ্তাহে তুমি রেসলিং টিমের কয়েকটা চমৎকার ছবি তুলেছ,’ বললেন। এবার যোগ করলেন, ‘রয়ও।

খাইছে! ঠোঁট কামড়ালাম।

‘রেসলিং টিমটা তো আমার অ্যাসাইনমেণ্ট ছিল,’ বললাম।

দাঁত কেলিয়ে হাসল রয়।

‘তোমাকে ব্যাক আপ দিতে চেয়েছিলাম,’ বলল। ‘তোমার ছোট্ট ক্যামেরাটা যদি কোন কারণে ভেঙে টেঙে যেত সেজন্যে আরকী।

এই ছেলেটার মুখ বন্ধ করবে কে? পিঠে কি দু’ঘা লাগাতে হবে নাকি?’

‘তোমার কী আইডিয়ার কথা যেন বলছিলে?’ মি. লয়েড প্রশ্ন করলেন।

ব্যাকপ্যাকে হাত ভরে আমার আঁকা নকশাগুলো বের করলাম। আহা, রয়কে যদি এখন সাদা আলোর ঝলকে উধাও করে দেয়া যেত!

‘এটা গোটা স্টুডেন্ট বডির ছবির জন্যে,’ মিস্টার লয়েডকে বললাম। ‘নতুন সুইমিং পুলটাকে ব্যবহার করতে চাই।’

হেসে উঠল রয়।

‘তুমি পানির তলা থেকে ছবি নিতে চাও নাকি? আজব!’

‘আল্লার ওয়াস্তে একটু চুপ করবে?’ গুঙিয়ে উঠলাম। ‘পুলে এখনও পানি ভরেনি জানোই তো। তাহলে এত ফটর ফটর কীসের?!’

টেবিলে নকশা বিছিয়ে দিলাম এবং মি. লয়েড ওটা নি করতে ঝুঁকলেন। মাথা চুলকে চোখ পিটপিট করছেন।

‘হাই ডাইভিং বোর্ডে ওটা কি তুমি?’ প্রশ্ন করলেন আমাকে।

মাথা ঝাঁকালাম।

‘জি, সবাই পুলে দাঁড়াবে। ফিফ্থ্ গ্রেড সবার সামনে। তারপর সিক্সথ। পেছনে সেভেন্থ। উঁচু বোর্ডটা থেকে ওয়াইল্ড অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করে সবার ছবি নেব।’

খিলখিল করে হেসে ফেলল রয়।

‘তারপর তুমি ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? আজব!’

ওকে পাত্তা দিলাম না।

মি. লয়েড দীর্ঘ দু’মুহূর্ত আমার নকশাটা পরখ করলেন।

‘ওটা বিপজ্জনক হতে পারে,’ শেষমেশ বললেন তিনি। ‘হাই ডাইভিং বোর্ডটা-’

‘অনেক চওড়া এক পাটাতন ওটা,’ বললাম। ‘দু’পাশে রেইলিং আছে। আমার পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’

নকশাটার ওপর ঝুঁকল রয়, ফলে মি. লয়েডের দৃষ্টি বাধা পেল।

‘মুসা আর আমি দু’জনেই ওখানে উঠে শুট করতে পারি,’ বলল। ও নাহয় ওর মান্ধাতা আমলের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ইউয করল, আর আমি আমার কনিকা স্কয়্যার শুটার।’

এক ঘুষিতে ওকে কুপোকাত করতে মন চাইল।

আস্ত শয়তান একটা!

‘পাটাতনটা অতটা চওড়া নয়,’ মি. লয়েডকে বললাম। ‘একজন মাত্র দাঁড়াতে পারবে ওখানে। এবং এটা যেহেতু আমার আইডিয়া…

‘হুম!’ বলে উঠল রয়। ‘তাহলে একটা প্রতিযোগিতা হয়ে যাক। তোমার আর আমার মধ্যে।’

ঢোক গিললাম।

‘খাইছে, প্রতিযোগিতা?’

‘বর্ষপঞ্জির জন্যে যার ছবি বাছাইয়ে বেশি টিকবে-সে-ই জিতবে। বিজয়ী হাই বোর্ড থেকে বড় ছবিটা তুলবে,’ বলল রয়।

মি. লয়েড কথাটা ভেবে দেখলেন। এবার ক্ষীণ হাসি ফুটল তাঁর কাঁটার মত মুখে।

‘প্রস্তাবটা ভাল,’ বললেন। ‘আমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। বেশ, এক সপ্তাহ পাচ্ছ তোমরা।’

এটা ভাল প্রস্তাব?! মোটেই না!! পুলের আইডিয়াটা তো আমার ছিল। কিন্তু এখন তো আর আমার পেছানোর সুযোগ নেই।

রয়ের মুখে হাসি ধরে না। ওর হাসিটা মুছে দিতে চাইলাম। কিন্তু ওকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না আমি মুষড়ে পড়েছি। তার বদলে বরং বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। প্রতিযোগিতাই সই।’

আমার প্ল্যানটা ভাঁজ করে ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে রাখলাম। এবার দু’জনের উদ্দেশে হাত নেড়ে কামরা ছাড়লাম।

বাসার পথে হাঁটছি, অন্য কোন কিছুর কথা ভাবতে পারলাম না।

সত্যিই আমি জিততে চাই। হাই বোর্ডে দাঁড়াতে চাই, চাই সবাই আমাকে চোখ তুলে দেখুক।

কে জানত শীঘ্রিই আমার স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে?