অপয়া ক্যামেরা – ৪

চার

‘খা-খাইছে,’ তুতলে বললাম।

দু’হাত নেড়ে আমাকে তাড়াতে চাইছে মহিলা। মুখখানা তার রক্তবর্ণ।

ঘুরেই দুলকিচালে দৌড়ে গ্যারেজে ঢুকলাম, হাতে তখনও ক্যামেরাটা ধরা। এই ক্যামেরার সমস্যাটা কী? ভাবলাম।

নিচু তাকটায় ওটা রাখার জন্য ঝুঁকতেই কাঁধে টোকা পড়ল আমার।

‘খাইছে!’ চাপা আর্তনাদ ছাড়লাম। উল্টো ঘুরতেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম এক মেয়েকে। আমার বয়েসীই হবে, বাইরের ওই মহিলার মতই বড় আর লাল মুখ ওর।

চোখের ওপর এলোমেলো বাদামি চুল এসে পড়েছে। পরনে ওর ব্যাগি জিন্স আর গোলাপী সোয়েটশার্ট, ঝলমলে অক্ষরে সেটার বুকে লেখা-মামি’স প্রিন্সেস।

‘তুমি ক্যামেরাটা নেবে?’ ফিসফিসিয়ে বলল।

‘খাইছে, ঠিক জানি না, বিড়বিড় করলাম। ‘ওটায় যদি কোন সমস্যা থাকে…’

আমার বুকে ঠেসে ধরল ও ক্যামেরাটা।

‘নিয়ে যাও।’

‘দাম কত?’ প্রশ্ন করলাম।

মাথা নাড়ল ও।

‘পয়সা লাগবে না। আমার মা দেখার আগেই এটা নিয়ে যাও।’ গাড়িপথের দিকে আমাকে ঠেলে দিল মেয়েটি।

বাইকটা তুলে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে গুঁজলাম পুরানো ক্যামেরাটা। মহিলা দেখেনি। প্লাস্টিকের এক পিচার থেকে গ্লাসে জুস জাতীয় কিছু একটা তখন ঢালছে সে।

কিশোর আর রবিন এসময় এসে যোগ দিল আমার সঙ্গে। গাড়িপথ থেকে বাইক তুলে নিল ওরা।

‘এখানে ভাল কিছু নেই,’ রবিন বলল ফিসফিস করে। ‘যাই চলো।’

আমরা মহিলাকে ‘বাই’ বলে পেডাল মেরে দূরে চলে এলাম। রাস্তায় পৌঁছে, পেছন ফিরে গ্যারেজটার দিকে চাইলাম। মহিলার মেয়েটা কাঠপুতুলের মত দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছে আমাদের।

হাত নাড়লাম ওর উদ্দেশে। কিন্তু সাড়া দিল না ও।

.

আমরা বাসায় ঢুকলে মা স্বাগত জানাল। মা সাঙ্ঘাতিক কর্মঠ। দু’মিনিট বসে থাকতে পারে না।

‘কিশোর, রবিন, তোমরা ডিনার করে যাবে কিন্তু,’ বলল মা।

‘আচ্ছা, আণ্টি,’ বলল ওরা।

‘কী রেঁধেছ আজ?’ প্রশ্ন করলাম।

শ্রাগ করল মা।

‘শুধু পিৎযা। সারাদিন ধরে চিলেকোঠাটা পরিষ্কার করেছি। বেশি কিছু রাঁধার সময় পাইনি।’

মা প্রায়ই এমন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামে। তার মত কর্মী পেলে যে কোন সিটি কর্পোরেশন বর্তে যেত।

‘আণ্টি, এবার গোলমরিচ দিয়ো না!’ দুদ্দাড় করে ঘরে এসে ঢুকল ফারিহা, যথারীতি ঘ্যানঘ্যান করছে। ‘গোলমরিচ আমার ভাল্লাগে না! ওগুলো তুলে ফেললেও বিশ্রী স্বাদটা যায় না।’

‘আচ্ছা, দেব না,’ কথা দিল মা।

ব্যাকপ্যাক থেকে প্রাচীন ক্যামেরাটা বের করলাম। ওটা পরখ করতে ব্যাকুল আমি।

‘ওটা পেলে কোথায়?’ ফারিহা জানতে চাইল। হাত বাড়িয়েছিল কিন্তু আমি ঝট করে সরিয়ে ফেললাম।

‘আমার ছবি তোলো!’ দাবি জানাল ও। ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিল, জিভ বের করে, চোখ ট্যারা বানিয়ে ‘জলদি! জলদি তোলো।’

‘ফিল্ম নেই,’ বললাম। ‘মাত্র পেয়েছি ক্যামেরাটা। আর ফিল্ম ভরলে তোমার নয়, কিশোর আর রবিনের ছবি নেব।’

কিশোরকে দাঁড় করিয়ে লেন্স তাক করলাম ওর দিকে। এবার ছবি তোলার ভান করে শাটার বাটনটা টিপলাম।

আশ্চর্য! জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ-উজ্জ্বল সাদা। ধাতব গুঞ্জন শুনলাম-এবং ক্যামেরাটার সামনে থেকে হড়কে বেরোল চারকোনা এক কাগজ।

‘কী ওটা?’ চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা। ‘ভেঙে গেছে! হা-হা! নতুন ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেছে!’ আমাকে আর কিশোরকে ঘিরে এক পাক নেচে নিল।

কাগজটা টেনে বের করলাম। ওটা কার্ডবোর্ড, সামনেটা মোলায়েম আর চকচকে।

‘নষ্ট হয়নি,’ বলল মা। ‘এরকম ক্যামেরা আগে দেখিসনি? এটা সেলফ-ডেভেলপিং ক্যামেরা।’

‘দেখিনি তো,’ বলল ফারিহা।

‘দেখ, ছবি কেমন হড়কে বেরিয়ে এল। তারপর আস্তে- আস্তে ডেভেলপ করবে, মা বলল। ‘ডিজিটাল ক্যামেরা আসার আগে খুব জনপ্রিয় ছিল এগুলো।’

চারকোনা কাগজটার দিকে কৌতূহলী চোখে চেয়ে আমরা সবাই। ওটা কালচে হতে লাগল। রঙ ফুটছে। ধীরে-ধীরে ছবিটা ডেভেলপ করছে, এবং আমরা কিশোরকে দেখতে পাচ্ছি।

‘খাইছে, সুন্দর রং,’ বললাম। ‘খুব কোমল। দারুণ তো!’

‘হ্যাঁ,’ গুঙিয়ে উঠল কিশোর। ‘ছবিটা ভাল, এসেছে- আমার চোখ দুটো কেমন লাল দেখাচ্ছে।’

ফটোটা দেখলাম। হ্যাঁ, সুন্দর দেখাচ্ছে কিশোরকে। কিন্তু ছবিতে ওর চোখজোড়া লাল টকটকে কেন?

কিশোরের উদ্দেশে হাসল ফারিহা।

‘তোমাকে ভূতের মত লাগছে!’ আবারও ছোঁ মারল ক্যামেরা লক্ষ্য করে। ‘আমি ছবি তুলব!’

পাঁই করে ঘুরে সরে গেলাম ওর কাছ থেকে।

‘এটা খেলনা নয়, ফারিহা।’ কিশোরকে হাত ধরে সিঁড়ির দিকে টানলাম। ‘রবিন, এসো আমার রুমে যাই। লাল চোখের চিকিৎসা আমি জানি।’

‘কম্পিউটারে সারাবে?’ প্রশ্ন করল রবিন।

মাথা ঝাঁকালাম।

‘হ্যাঁ। কম্পিউটারে ছবিটা স্ক্যান করে লাল চোখ ঠিক করে ফেলব।’

আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম, ফারিহা যাতে পেছন পেছন আসতে না পারে।

কম্পিউটারে ছবিটা স্ক্যান করলাম আমি। ফটোমাস্টার প্লাস নামে এক প্রফেশনাল প্রোগ্রাম রয়েছে আমার, শিখছি ওটা।

পর্দার ছবিটার দিকে চেয়ে অ্যাডজাস্ট করতে শুরু করলাম।

‘খাইছে,’ আওড়ালাম।

‘কী হয়েছে?’ প্রশ্ন করল কিশোর। আমার কাঁধে দু’হাত রেখে সামনে ঝুঁকল।

‘তোমার চোখ তো কালো করতে পারছি না, বললাম। ‘লাল রঙটা মুছতে পারার কথা। কিন্তু হচ্ছে না।’

‘ওহ, বাঁচাও! আউউউ! আমার চোখ গেল!’ আচমকা কিশোরের আর্তচিৎকার।

আঁতকে উঠে চরকির মত ঘুরলাম।

দু’হাতে চোখজোড়া ঢেকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে কিশোর।

‘আমার চোখ! আমার চোখ!’