অপয়া ক্যামেরা – ১২

বারো

বুক ধড়ফড় করছে। আলগোছে দরজার কাছে গেলাম। ধীরে- ধীরে, সাবধানে, সামনে ঘাড় কাত করে উঁকি দিলাম ঘরে।

‘ফারিহা!’ শ্বাসের ফাঁকে বলে উঠলাম।

আমার গলার আওয়াজ শুনে ঝট করে ঘুরে চাইল ফারিহা। পাজামা পরা ও। ড্রেসারের সামনে হাঁটু মুড়ে বসা। নিচের ড্রেসার ড্রয়ারটা টেনে বের করেছে।

কামরায় পা রাখলাম।

‘এখানে কী করছ তুমি?’

‘তুমি বাইরে গেছ টের পেয়ে, বলল ও, ‘তোমার ক্যামেরাটা দেখতে এসেছি।’

ড্রেসার ড্রয়ারটা সশব্দে লাগিয়ে দিলাম। এবার হ্যাঁচকা টানে ওকে দাঁড় করালাম।

‘খালি অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর স্বভাব,’ বিড়বিড় করে বললাম। এবার ঠেলে দিলাম দরজার দিকে।

‘আমি শুধু একটা ছবি তুলতাম,’ নাকি সুরে বলল ও। ‘ছবি তুললে কী হয়?’

‘ওই ক্যামেরার কথা ভুলে যাও,’ বললাম। ‘ওটা আর নেই, ফারিহা। ওটা আর ফিরবে না।’ আরেকটা মৃদু ধাক্কা দিলাম ওকে।

ঘ্যানঘ্যান করেই চলল ও।

‘তোমার লাগবে না তাহলে আমাকে দিয়ে দিলে না কেন?’ প্রশ্ন করল।

‘ওটা ভেঙে গেছিল,’ বললাম। ‘তাই ফেলে দিয়েছি।’

তর্ক জুড়তে যাচ্ছিল ও। কিন্তু আমি ঘরের দরজা ওর মুখের ওপর লাগিয়ে দিলাম।

হাই উঠছে। হঠাৎই ভয়ানক ক্লান্তি লাগছে। শরীরের সমস্ত মাংসপেশী টাটাচ্ছে। মাথাটা যেন ভারী পাথর।

ঘুম আসতে অনেক দেরি হলো। শেষমেশ ঘুমোলাম যখন, দুঃস্বপ্ন দেখলাম।

দেখলাম নতুন সুইমিং পুলের উঁচু ডাইভিং বোর্ডের ওপর আমি। স্কুলের সবাই গাদাগাদি করে পুলের ভেতর দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। বর্ষপঞ্জির বড় ছবিটা নিতে চলেছি আমি।

দু’হাতে তুলে ধরেছি অশুভ ক্যামেরাটা। ওটার স্পর্শ ক্যামেরার মত লাগছে না। কেমন নরম আর গরম এক অনুভূতি।

ওটাকে আঁকড়ে ধরতেই, আমার হাতে নড়াচড়া করতে লাগল… দপদপ করছে… শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে!

খাইছে, ক্যামেরাটা জ্যান্ত!

মুখের সামনে ধরেছি ওটাকে। ভিউফাইণ্ডারে চোখ রাখতে গেলাম। ক্যামেরাটা এখন ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে, নিঃশ্বাস ফেলছে।

আমার স্পিকারে চলকে পড়ল কী যেন। চোখ নামিয়ে চাইলাম। খাইছে, রক্তের ফোঁটা।

ক্যামেরার লেন্সটা থেকে রক্ত পড়ছে। গাঢ় লাল রক্ত। ফোঁটায় ফোঁটায়।

কিন্তু আমি ছবি তুলেই যাচ্ছি।

ক্যামেরাটা তাক করলাম নিচে দাঁড়ানো ছেলে-মেয়েদের দিকে। এবং শাটার ক্লিক করলাম।

ফিল্মটা হাতে নিয়ে ছবিটাকে ডেভেলপড্ হতে দেখছি। বহু, বহুক্ষণ লেগে যাচ্ছে ব্যাপারটায়।

শটটা শেষমেশ ফোকাসে এলে চমকে গেলাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছেলে-মেয়েগুলোর গায়ের চামড়া অদৃশ্য। রোদ পড়ে চকচক করছে ওদের মাথার খুলি। ওরা সবাই কঙ্কাল।

‘খাইছে, এ কী করলাম?’ চিৎকার ছাড়লাম। ‘স্কুলের সবাইকে মেরে ফেললাম আমি?’

ঘামে ভিজে নেয়ে ঘুম ভাঙল। চোখ পিটপিটিয়ে দুঃস্বপ্নটাকে তাড়াতে চাইলাম। কিন্তু দাঁত বের করা, চকচকে কুৎসিত কঙ্কালগুলোর স্মৃতি রয়ে গেল আমার মনে।

‘ধ্যাত, এটা স্রেফ স্বপ্ন,’ আওড়ালাম। ‘লম্বা দম নাও, মুসা। এখুনি স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে।’

চোখ বুজে বালিশে ঠিকঠাক মত মাথা রাখলাম আবারও। শিহরনটা যাচ্ছে না। আর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না।

ছাদের দিকে চেয়ে শুয়ে রইলাম। একটু পরে, জানালার বাইরে সূর্যোদয় দেখলাম। কামরায় ছড়িয়ে পড়ল উষ্ণ, লাল কোমল আভা।

বিছানা থেকে নেমে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভোর হচ্ছে, উষ্ণতা ছড়াচ্ছে আমার শরীরে। আগের চেয়ে ভাল বোধ করছি।

স্কুলের জন্য তৈরি হলাম। এবার নিচে নামলাম নাতা করতে।

কিচেনে আমিই প্রথম। কমলার রস বের করতে ফ্রিজের দিকে এগোলাম।

কিন্তু থেমে পড়তে হলো মাঝপথেই। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছি।

খাইছে, নাশতার টেবিলে, আমার চেয়ারের পাশে বসে রয়েছে সেই ভুতুড়ে ক্যামেরাটা!