অপয়া ক্যামেরা – ১১

এগারো

শোবার সময় হয়ে এল, কিন্তু এতটুকু ক্লান্তি নেই আমার। ক্লজিটের ভেতরে রাখা ক্যামেরাটার ছবি বারবার ভেসে উঠছে মনে। কিশোর আর সারার কথা অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে মগজে। ক্যামেরাটা ওদেরকে যে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে তা সারাক্ষণই খোঁচাচ্ছে আমাকে।

আমি জানি বাসা থেকে ওটাকে সরানো না পর্যন্ত ঘুমোতে পারব না। ক্লজিটের কাছে পা টিপে টিপে গেলাম। চাই না বাবা- মা কোন শব্দ পাক।

পায়ের নিচে ককিয়ে উঠল মেঝে। খোলা জানালায় পর্দার পত-পত শব্দ ছাড়া একমাত্র এটাই অটুট নীরবতা ভাঙছে।

চাঁদ-তারাহীন বেগুনী আকাশটা উঁকি মেরে এক ঝলক দেখে নিলাম। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় দুলছে গাছের কালচে ডাল- পালাগুলো। ব্লকের ওমাথায়, কোনওখান থেকে ডেকে উঠল একটা বিড়াল। শব্দটা কেমন বিলাপের মতন শোনাল আমার কানে। বেচারী বিড়ালটা বোধহয় ঘরে ঢুকতে চায়।

আমিও বাইরে যেতে চাই না। কিন্তু উপায় নেই। পরিকল্পনাটাকে মাঠে মারা যেতে দিতে পারি না।

আঁধারে কামরাটা পেরিয়ে, ক্লজিটের ভেতর হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে, অপয়া ক্যামেরাটা আঁকড়ে ধরলাম। হাতজোড়া কাঁপছে থরথর করে, হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না। একটু পরে, আলগোছে নিচে নামতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে।

ক’মুহূর্ত বাদে, কিচেনের দরজাটা নিঃশব্দে পেছনে লাগালাম। আঁধারে চোখ সইয়ে নিতে দু’মুহূর্ত দাঁড়ালাম। মুখে ঠাণ্ডা, ভেজা বাতাসের পরশ পেয়ে ভাল লাগল।

পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো অন্ধকার। ব্লকের ওপ্রান্ত থেকে বেড়ালটার আহাজারি ভেসে আসছে এখনও। আবারও চাঁদটাকে খুঁজলাম আকাশে। কিন্তু মেঘের ভারী চাদরে ঢাকা পড়েছে মামা।

পেছনের উঠনটা পেরিয়ে, বাড়িগুলোর পেছনের সরু মেটে অলিপথটা ধরে পা বাড়ালাম। বৃষ্টির পানি আর কাদায় মাটি নরম হয়ে রয়েছে। ছোট-ছোট কাদার গর্তে পা পড়তেই ছলাৎ করে উঠছে।

ক্যামেরাটাকে বুকের সঙ্গে পাকড়ে হেঁটে চলেছি। ক’মিনিট পরেই, গলি পুকুরের সামনে থামলাম আমি।

সবাই এটাকে এ নামেই ডাকে। এটার সত্যিকারের কোন নাম নেই। অলিপথের শেষপ্রান্তে ছোট্ট, গোল এক পুকুর এটি।

কেউ-কেউ বলে পুকুরটায় নাকি এককালে মাছ ছিল। এখন আর নেই। স্রেফ থিকথিকে কাদাময় পানিতে ভরা এক গর্ত ওটা।

ক্যামেরাটা শূন্যে তুলে ধরে ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু থমকালাম এক শব্দ কানে আসতেই।

খসখসে একটা আওয়াজ। অলিপথের পাশের কাঁটা ঝোপটার আড়াল থেকে আসছে।

চোখের পলকে উল্টো ঘুরলাম।

ঝোপটার ওপাশে কি কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পেলাম?

আচমকা আমার ঘাড় চেপে ধরল শীতল ভয়। আবারও মনে হচ্ছে কেউ আছে ওখানে। নজর রাখছে আমার ওপর।

‘কে?’ ফিসফিসে স্বরে বললাম। ‘কে ওখানে?’

উত্তর নেই।

সারা দেহ শিউরে উঠল আতঙ্কে। শরীরের সব কটা মাংসপেশীতে খিল ধরে গেছে।

কেউ কি দেখছে আড়াল থেকে? সত্যিই ভীষণ ভয় করছে আমার এমুহূর্তে। কিন্তু কাজটা তো শেষ করতে হবে।

আবারও হাত উঁচালাম এবং এঁদো পুকুরে ছুঁড়ে ফেললাম প্রাচীন ক্যামেরাটা।

ছলাৎ করে জোর শব্দ উঠল। তারপর নিমেষে তলিয়ে গেল কাদার পুকুরে।

ক’মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম মজা পুকুরটার দিকে। ক্যামেরাটা আর ভেসে উঠল না।

নিচু ঝোপটা ঝটিতি দেখে নিলাম। কেউ নেই ওখানে। নিস্তব্ধ চারপাশ।

ওটা কি নিছকই আমার কল্পনা ছিল?

বাড়ির পথে ছুটে চললাম, স্পিকারের তলায় চলকাচ্ছে কাদা। চুপিসারে কিচেনে ঢুকলাম। তারপর সন্তর্পণে ওপরতলায় চললাম।

হল-এর মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়ালাম। বেডরুমের আধখোলা দরজার নিচ দিয়ে চুইয়ে বেরোচ্ছে হলদেটে আলো।

আমার ঘরে কে যেন আছে!