বিপদসঙ্কেত – ৪

চার

মুহূর্তের দ্বিধার পর, হেঁটে গেল কিশোর।

‘হ্যাঁ?’

‘তুমি স্কালের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

ছেলেটির কুটিল চোখের দিকে চাইল কিশোর।

‘আপনি চেনেন তাকে?’

‘চিনি হয়তো। এত জরুরী কেন ব্যাপারটা?’

‘স্কালকে কোথায় পাওয়া যাবে?’

‘ও আশপাশেই আছে।’ জ্বলন্ত সিগারেটটা তরুণের আঙুলের টোকায় বরফের ওপর পড়ল। ‘কেন?’

‘স্রেফ কৌতূহল।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে, হাঁটা দিল কিশোর। ‘আয়,’ বলল রাজনকে, ‘যাওয়া যাক।

‘চল, চল!’ রাজনের কণ্ঠে জরুরী তাগিদ।

আইস প্যালেস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, এক দোকানের জানালায় চকিতে চাইল কিশোর। কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই দুই ষণ্ডার প্রতিচ্ছবি, ওরা অনুসরণ করছে পায়ে-পায়ে।

‘ওদের মতলবটা কী?’ বলল কিশোর।

‘কে জানে! তোর প্রশ্নের কারণে আমরা এখন ঝামেলায় পড়লাম।’

‘মোটেই না, আমরা পুরোপুরি নিরাপদ। ছদ্মবেশে সিকিউরিটি গার্ডরা ঘুরে বেড়ায় এই মল-এ। তাছাড়া, আমরা ঠিক জায়গায় খোঁচা দিয়েছি। ওদুটো স্কালকে চেনে।’

‘সে আর বলতে, ওরা কিন্তু আমাদের পিছু নিয়েছে। কারণটা কী?

‘কে জানে, ওরা হয়তো স্কালের কাছে যাবে এবং ওদের কল্যাণে আমরাও তাকে দেখতে পাব।’

‘সকালটা দারুণ জমে উঠেছে কিন্তু, যা-ই বলিস,’ বিরসকণ্ঠে বলল রাজন।

‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। তোর ওই পচা নাটকগুলো যদি রিপিট করত?’

‘তা আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?’

‘লাগেজ আনলিমিটেডে। রহমানদেরকে জানাব এখন অবধি যা-যা জেনেছি।’

দোকানটায় যাওয়ার পথে, একগুচ্ছ ঝরনার কাছে আরেকটি ব্যাণ্ডকে পারফর্ম করতে দেখল ছেলেরা। এক মর্মরের জলাধার থেকে ছিটকে ওপরদিকে উঠছে পানির ফোয়ারা-কমলা, নীল আর লাল স্পটলাইটের আলোয় উজ্জ্বল রঙ ছড়াচ্ছে।

‘এখানে তেতাল্লিশটা আলাদা ঝরনা আছে,’ গুনে বলল রাজন। ‘তোর লিস্টে যোগ করে নে।’ কিশোরকে তথ্যটা টুকতে দেখে আরও বলল, ‘এর জন্যে অবশ্য কিছু খরচাপাতি আছে তোর। মাগনা মাগনা ট্রিভিয়া নিয়ে রিসার্চ করি না আমি।’

‘গেলি!’

‘কালকের মধ্যে চেক চাই আমি।’

একটু পরে, লাগেজ আনলিমিটেড নামের দোকানটিতে ঢুকল ওরা। কাউন্টারের পেছনে ওদের বয়সী এক ছেলে দাঁড়িয়ে। মুখে আন্তরিক হাসি।

‘হাই,’ বলল। ‘আমার নাম অনন্ত রহমান। কী লাগবে তোমাদের?’

‘কিছু না।’ কিশোর নিজেদের পরিচয় দিল, জানাল গত সন্ধেয় এখানে এসেছিল ও। ‘তুমি ছিলে না, তবে তোমার বাবা- মার সাথে দেখা হয়েছে। আমি কিছু ইনফর্মেশন জোগাড় করেছি যেগুলো ওঁদের কাজে লাগতে পারে।’

‘তাই? তোমাদের দেশ কোথায়?’ বলল অনন্ত। ‘দেখে তো মনে হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছ।’

‘বাংলাদেশ। আমরা বাঙালি।’

‘তাই?’ উৎফুল্ল হয়ে উঠল অনন্ত। ‘আমিও তো বাংলাদেশী। আমার বাড়ি চট্টগ্রামে।’

‘জানি,’ বলল কিশোর। ‘কাল তোমার বাবা-মার সাথে কথা হয়েছে। তুমি বাংলা বোঝ কিনা শিয়োর হতে পারছিলাম না।’

এবার মাতৃভাষায় আলাপ জমে উঠল তিনজনের। অনন্তর জন্ম কানাডায়। দেশে ওর আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, মাঝে-মাঝেই বাংলাদেশে যায়। কিশোর আর রাজনের কথাও আগ্রহ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল।

‘দাঁড়াও, মাকে ডেকে আনি।’ বলল অনন্ত

মিসেস রহমানের ভ্রূজোড়া কুঁচকে রয়েছে বিস্ময়ে, অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। ভদ্রমহিলা গতকালই জেনেছেন কিশোর বাঙালি। তাই বাংলাতেই কথা বললেন।

‘তুমি কিছু জানতে পেরেছ, বাবা?’

‘তেমন বিশেষ কিছু না,’ জবাবে বলল কিশোর, ‘তবে স্কাল নামে একজন সম্ভবত সে রাতে দোকানে ঢুকেছিল।’

মাথা ঝাঁকাল অনন্ত।

‘আমার সাথেও আগে একবার ঝামেলা করেছে ও।’

‘আমি পুলিসকে ফোন করব,’ বললেন মিসেস রহমান। ‘তুমি কি তাদেরকে কোন প্রমাণ দিতে পারবে, কিশোর?’

‘না, আণ্টি। এগুলো স্রেফ গুজব।’

‘তবুও জানাই।’

মিসেস রহমান কল করছেন, অনন্ত জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। সেই দুই পাঙ্ক দোকানটার ওপর নজর রাখছে, লেদার জ্যাকেটের পকেটে হাত গোঁজা ওদের, ভ্রূ কোঁচকানো।

‘ওই দু’জন স্কালের চামচা। একসাথে ঘোরে,’ বলল অনন্ত।

‘ওরা আমাদের ফলো করছে,’ বলল রাজন। ‘আমার ভয় করছে!’

‘হুম,’ বলে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ‘তোমাদের দোকানে পেছনের দরজা আছে নিশ্চয়ই? ওদেরকে খসাতে চাই।’ বলল অনন্তর উদ্দেশে।

‘হ্যাঁ, এসো।’

দোকানের ভেতর দিয়ে চলেছে, কিশোর দেখল ক্ষয়-ক্ষতির সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সুবিন্যস্ত সারিতে সুটকেসগুলো দাঁড়িয়ে, রঙ করা দেয়ালগুলোতে নতুন ছবি।

‘সারা রাত নিশ্চয়ই বেদম খাটতে হয়েছে তোমাদের,’ বলল কিশোর। খুব তাড়াতাড়িই গুছিয়ে নিয়েছ। কী মনে হয়, এধরনের ঘটনা আবারও ঘটতে পারে?’

‘মনে হয় না। আপার ডিসপ্লে এরিয়ায় থেমে দাঁড়াল অনন্ত, সিলিঙে লাগানো প্লাস্টিকের ছোট্ট এক যন্ত্র থেকে খুদে এক লাল বাতি ঝলসাচ্ছে। ‘ওটা নতুন লাগিয়েছি আমরা, ইনট্রুডার ডিটেক্টর। কেউ রাতের বেলায় এখানে ঘোরাঘুরি করলেই, ব্যস। সাইরেন বেজে উঠবে এবং মেসেজ চলে যাবে সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টার্স আর পুলিসের কাছে। গার্ডরা মাত্র দু’মিনিটের মধ্যে এ জায়গাটা ব্লক করে দিতে পারবে।’

‘তাও তো একশো বিশ সেকেণ্ড’ চিন্তিত কণ্ঠে কিশোর বলল। ‘পালানোর জন্যে যথেষ্ট।’

‘হ্যাঁ, তবে দোকান অন্তত তছনছ করতে পারবে না।’

এসময় মিসেস রহমান যোগ দিলেন ওদের সঙ্গে।

‘পুলিস তথ্যটার জন্যে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, তবে তাদের দরকার জোরাল প্রমাণ।’ কিশোরের উদ্দেশে স্মিত হাসলেন। ‘তোমার আন্তরিকতার জন্যে ধন্যবাদ, বাবা।’

‘আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব, আন্টি, নতুন কোন তথ্য পেলেই জানাব।’

অনন্ত চাইল মার দিকে।

‘মা, আমি এক ঘণ্টার জন্যে ছুটি নিই? লরেলি কনটেস্টে গাইছে, আমি ওখানে গিয়ে ওকে উৎসাহ দিতে চাই।’ অনুমতি পেয়ে কিশোর আর রাজনের দিকে চাইল ও। ‘তোমরা যাবে? তোমাদেরকে লরেলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম।’

‘তোমার গার্লফ্রেণ্ড? শুধাল রাজন।

‘না, ওর বয়স আঠারো। আমার বন্ধুর বড় বোন, ওর ভাইয়ের সাথে স্ট্রিটবল খেলি আমি। ‘

দোকানের পেছনদিকের স্টোরেজ এরিয়ায় ঢুকল ওরা। ছাদ ছোঁয়া তাকগুলোতে কার্টনের স্তূপ, এক কোণে ঝাড়ন আর ভ্যাকিউম ক্লিনার রাখা, এবং দেয়ালের এক ভেণ্ট দিয়ে শীতল বাতাস আসছে।

‘একটা কথা মনে হলো হঠাৎ, বলল কিশোর। পুলিসের ধারণা অনুপ্রবেশকারী ছাদ থেকে নেমেছে, কিন্তু ও তো এয়ার- কণ্ডিশনিং ভেণ্ট দিয়েও ঢুকতে পারে।’

সিলিঙের টালির উদ্দেশে তর্জনী তাক করল অনন্ত।

‘আঁচড় আর ঘষা খাওয়ার দাগগুলো দেখেছ? কাল রাতে ওগুলো এমনই ছিল, তাছাড়া এয়ার-কণ্ডিশনিং গ্রিলও ড্যামেজ হয়নি।’

লম্বা এক করিডরে পা রাখল ছেলেরা। চোখে পড়ল শুধু অন্যান্য দোকানের খিড়কি দরজা।

‘এখান থেকে মল-এর আরেক অংশে যাওয়া যায়,’ অনন্ত বলল। ‘তোমাদের ফলো করা ওই গরিলা দুটো টেরও পাবে না তোমরা কখন পগার পার হয়ে গেছ।’

অ্যালুমিনিয়ামের মস্ত বড় শ্যাফটটার দিকে চোখ তুলে চাইল কিশোর, দোকানগুলোয় যেটি এয়ার-কণ্ডিশনিং সরবরাহ করে।

‘ওই ডাক্টগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ যাচ্ছে না আমার। ওখান দিয়ে সহজেই গুড়ি মেরে মল-এর যে কোন জায়গায় পৌঁছনো সম্ভব। ওটা অপরাধীদের জন্যে আদর্শ গুপ্তপথ।’

রাজন হাসল অনন্তর উদ্দেশে।

‘বহুদিন ধরে এসব কথা শুনে যাচ্ছি, মানে যখন থেকে ও ফ্র্যাঙ্ক আর জো হার্ডিকে আবিষ্কার করেছে আরকী। এখন অবশ্য বাছাধন লে কারে পড়ছে, তবে কাহিনী ওই একই—গোপন সূত্র আর এয়ার-কণ্ডিশনিং ডাক্ট দিয়ে ভিলেনদের ক্রল করা। হা, হা!’

শুনে হেসে উঠল অনন্তও।

‘তোমাদের এত খাতির অথচ মনমানসিকতা একদম আলাদা।’

করিডরের শেষ প্রান্তের দরজাটা দিয়ে আবারও মল-এ ঢুকল ছেলেরা। চারপাশে লোকজন দেখে হাঁফ ছাড়ল রাজন।

‘এতক্ষণ ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। আরি, ওটা কী? আগে তো কখনও দেখিনি।’

কাছেই এক দোতলা যন্ত্র বেয়াড়া শব্দ করছে: বং! বং এবং ব্ল্যাম-ব্ল্যাম-ব্ল্যাম আর টিং! টিং! জনতা চারধারে ভিড় করে বিলিয়ার্ড বলগুলোকে আঁকাবাঁকা পথে নিচে পড়তে দেখছে, দীর্ঘ সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ওগুলো, ঘণ্টায় আঘাত করা হ্যামারগুলোকে চালু করছে, বাড়ি মারছে পিতলের করতালে, এবং অন্যান্য শব্দবহুল কৌশল দেখিয়ে উঁচুতে উঠে আবার নবযাত্রা আরম্ভ করছে।

‘আজব তো, হেসে উঠল রাজন। ‘কার মাথা থেকে বেরিয়েছে এমন খাসা বুদ্ধি?’ হাতঘড়ি দেখল চট করে। ‘ঝটপট একবার মাইওবেণ্ডারে ঢুঁ মেরে গেলে কেমন হয়? তোমার বন্ধুর বোনের গান শুরু হওয়ার আগে?’

‘যাওয়া যায়, বলল অনন্ত।

খানিকদূর হেঁটে আর্চওয়ে ভেদ করে ইনডোর অ্যামিউজমেন্ট পার্ক গ্যালাক্সিল্যাণ্ডে ঢুকল ওরা। জোরাল শব্দে গান বাজছে এখানে, সাইডওয়কগুলোয় মানুষ গিজগিজ করছে এবং মাথার ওপরে ঘুরছে বিশাল এক দোলনা, কিন্তু দৃশ্যপটে প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে সেই আজদাহা মাইগুবেণ্ডার। চোদ্দতলা উঁচু, সামুদ্রিক সাপের মতন কুণ্ডলী পাকানো রোলার কোস্টারটির তিনটি লুপ, ওগুলো এতটাই ওপরে উঠেছে যে ঢালু ছাদের নিচে মাথাগুলো চোখেই পড়ে না প্রায়।

‘চলো!’ টিকিট বুথের দিকে ছুটতেই কিশোর দেখল চিৎকাররত যাত্রীদের নিয়ে সাঁ করে খাড়া নেমে এল এক বগি। ‘আমার আর তর সইছে না। এক্ষুণি চড়তে হবে!’

ক’মিনিট পরে, এক বগিতে বসে রয়েছে তখন ওরা, কিশোর দ্রুত মত পাল্টাল।

‘পারব না, ওটা চলতে শুরু করতেই বলে উঠল কিশোর। ‘নেমে যাব।’

‘তুই তো প্রতিবারই একথা বলিস। তাছাড়া এখন আর নামার উপায় নেই,’ চেঁচিয়ে উঠল রাজন। ‘আল্লার নামে চললাম!’

বগিটা ত্বরিত গতিতে সরাসরি ছাদ বরাবর উঠে গেল। চূড়ায় পৌঁছল যখন, যাত্রীরা তারস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ল, সেফটি রেইলে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কিশোরের আঙুলের গাঁটগুলো। এবার বগিটার পতনের পালা। সাঁ করে খাড়া পড়ে গেল ওটা অতল শূন্যতায়, কানে জোরাল বাতাসের শব্দ পাচ্ছে কিশোর, এবার বগিটা আচমকা নিচে পৌঁছে সগর্জনে উঠে পড়ল এক লুপের ভেতরে। ওপরে উঠে, উল্টো হয়ে, আবারও শিখরে পৌঁছল, তারপর আরেকবার পতন ঘটল। যাত্রীরা সব উত্তেজনায় চেঁচাচ্ছে, আর্তনাদ করছে।

শেষমেশ কিইইচ করে তীক্ষ্ণ শব্দে ব্রেক কষে থামল রাইডটা। প্রত্যেকে ওটা থেকে বেরিয়ে আসছে টলতে টলতে, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে। অনন্ত এক পায়ে দাঁড়িয়ে মাথার একপাশে থাবড়া মারল।

‘মনে হচ্ছে মগজে পানি জমেছে।’

‘তুমি আউট অভ ফোকাস, বলল কিশোর। ‘অন্যরাও তা-ই।’

‘চলো,’ চেঁচিয়ে উঠল রাজন। ‘এরপর দ্য ড্রপ অভ ডুম ‘আগে পেটের ভেতরটা স্বাভাবিক হোক।’

‘আমি কিশোরের দলে,’ বলল অনন্ত। ‘আমরা গেম খেলতে যাব।’

‘ওকে, ওখানে দেখা হবে,’ বলল রাজন।

ওরা দু’জনেই স্পিড শিফটার্সে ভাল করল আর একইসঙ্গে ব্যর্থ হলো চ্যাম্পিয়নশিপ ডার্টস্ অ্যাণ্ড ভেগাস প্রাইয রিঙ-এ। এসময় একজন এগিয়ে এল। বয়সে অনেকটা বড় ওদের চাইতে, চোখজোড়া কুতকুতে আর চাঁদি কামানো তার। মুখের একপাশে লম্বা, আঁকাবাঁকা ক্ষতচিহ্ন।

স্কাল।

ওর ঠিক পেছনেই লেদার জ্যাকেট পরা সেই দুই গরিলা।

‘অ্যাই?’ কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি নাকি খুঁজছ আমাকে?’

অপ্রস্তুত বোধ করল কিশোর।

সেলিন ‘হ্যাঁ…মানে…

‘কেন?’

‘আমি…মানে…একজনের কাছে শুনেছি কাল রাতের ঘটনাটার ব্যাপারে আপনার কিছু জানা আছে।’ কিশোর বিরতি নিল, কিন্তু স্কাল মুখ খুলল না। ‘লাগেজ স্টোরের কথা বলছি আরকী।’

এসময় রাজন এসে কিশোরের পাশে দাঁড়াল।

‘কী হয়েছে রে?’

‘একটু সমস্যা।’

স্কাল অনন্তর দিকে চেয়ে রয়েছে, এবার মাটিতে থুতু ফেলল।

‘শালার পাকি!’

‘কী বলছেন এসব… বলল কিশোর।

কিশোর আর স্কালের মাঝখানে দাঁড়াল অনন্ত। হাতজোড়া মুঠো পাকানো ওর, তবে কণ্ঠস্বর শান্ত-সংযত রেখে বলল, ‘শোনেন, আমি পাকি নই, বাংলাদেশী। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশ বাংলাদেশ। তাছাড়া, আমার জন্ম ভ্যাঙ্কুভারে।’

নীরবতা।

‘আমাদের দোকানের ক্ষতিটা কি আপনি করেছেন?’

‘ভাগো!’

‘আমি জানি কাজটা আপনার। আপনি আমাদের দোকানের আশপাশে আর কখনও আসবেন না।’

‘তুমি আমাকে হুকুম করছ, পাকি?’ বন্ধুদের উদ্দেশে সঙ্কেত দিতেই ওরা কাছিয়ে এল। ‘তোমার সাহস তো কম নয়!’

অনন্তর দিকে চাইল রাজন।

‘চলে এসো।’

‘এক মিনিট।’

ওদের দিকে এগিয়ে আসছে গলফ্ শার্ট আর স্ল্যাপ্স্ পরা এক লোক।

‘গুড ডে, জেন্টলমেন।’ ওদেরকে ফটো আইডি কার্ড দেখাল। আমি এখানকার সিকিউরিটি গার্ড। কী হচ্ছে এখানে? সবাই মনে হয় উত্তেজিত তোমরা।’ কেউ যখন জবাব দিল না তখন কাছের এক্সিটের উদ্দেশে তর্জনী দেখাল লোকটা। ওই যে, বেরনোর রাস্তা।’

অনন্তর দিকে হীন দৃষ্টি হেনে, বন্ধুদের নিয়ে হাঁটা দিল স্কাল। অন্য এক এক্সিট দিয়ে কিশোর আর অন্যরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল রাজন।

‘ব্যাপারটা খারাপ দিকেও যেতে পারত।’ অনন্তর দিকে চাইল কিশোর।

‘আচ্ছা, ক্যাফে অর্লিন্সের বোমা আর তোমাদের দোকানের ব্রেক-ইনের মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই তো?’

‘না। আমি শিয়োর আমাদের দোকানের ক্ষতি করেছে স্কাল, কিন্তু বোমা পাতার মত কুশলী লোক ও নয়। তাছাড়া, ওর মোটিভই বা কী? আমার ধারণা বোমাবাজ এমন কেউ যার মল- এর বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ আছে। আর বোমা বানাতে দক্ষতা লাগে, তারপর সবার চোখে ধুলো দিয়ে পাতার ব্যাপারটা তো আছেই।’

ওরা যে করিডরটা দিয়ে হাঁটছে এক সার পুকুর সেটাকে ভাগ করেছে। পানির তলায় ঝিকমিক করছে পড়ে থাকা কয়েন, সচল ফোয়ারাগুলোয় গরগর শব্দ হচ্ছে আর পাম গাছগুলো ওপরের স্কাইলাইট ছুঁয়েছে। আইস প্যালেসে ওরা কাঁচে ঘেরা এক এলিভেটরে চাপল, বরফে চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে দেখল স্কেটারদের।

খাঁচাটা থেকে বেরোতেই এক মঞ্চ ঘিরে জনতার ভিড় দেখল। স্বর্ণকেশিনী এক তরুণী এইমাত্র গান গাওয়া শেষ করেছে এবং মুগ্ধ শ্রোতারা তুমুল করতালি দিচ্ছে। মেয়েটি হাসল, আয়ত চোখজোড়া চকচক করছে খুশি আর তৃপ্তিতে।

‘বা-বা, মেয়েটা তো দারুণ সুন্দরী!’ প্রশংসার সুরে বলল রাজন।

অনন্তর দিকে চাইল কিশোর।

‘তুমি কি সত্যিই চেন ওকে?’

শ্রাগ করল ছেলেটা। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।

‘হ্যাঁ।’

লরেলির ব্যাণ্ড সদস্যদের পরনে স্টেটসন আর লাল সাটিনের পোশাক; মেয়েটি পরেছে রুপোলী স্কার্ট আর ধবধবে সাদা ব্লাউজ। গিটার তুলে নিয়ে এক কান্ট্রি সং ধরল ও, এবং শ্রোতারা নিমেষে মাতোয়ারা হয়ে গেল। পা ঠুকে তাল দিচ্ছে তারা, সে সঙ্গে হাততালি।

‘আমি ওকে ভোট দেব,’ শ্রোতাদের হর্ষধ্বনির মধ্যে গান শেষ হলে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

এসময় টিনা জনতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হাসিমুখে। ‘ওর কথাই বলেছিলাম। কাল ওর সাথেই পরিচয় হয় আমার। মেয়েটা কী দুর্দান্ত গায়, তাই না?’

অনন্তর সঙ্গে টিনার পরিচয় করানোর পর ওরা শেষ গানটা শুনল। লরেলি মাথা নোয়াল, তারপর মঞ্চ থেকে নেমে এসে ঘিরে রাখা শ্রোতাদের অটোগ্রাফ দিল এবং তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করল। শেষমেশ অনন্ত ওকে নিয়ে এল কিশোর আর রাজনের সঙ্গে পরিচিত করাতে। মেয়েটির নীলচে-সবুজ চোখজোড়া বড়-বড়, মায়াকাড়া আর অপূর্ব সুন্দর।

‘গ্রেট শো, বলল কিশোর। ‘অভিনন্দন।’

‘ধন্যবাদ! কী মনে হয়, আমার ব্যাণ্ড প্রতিযোগিতাটা জিততে পারবে?’

‘জিতে গেছে বলা যায়,’ বলল রাজন। ‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’ কিশোরের নোটবই ধার করে, একটা পাতা ছিঁড়ে এগিয়ে দিল। ‘প্লিজ, সালটাও লিখবেন।

‘লিখব, কিন্তু কেন?

‘এতে অটোগ্রাফটার দাম আরও বাড়বে। একদিন এই কাগজের টুকরোটা বেচে বিএমডব্লিউ কিনতে পারব।’

‘তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক!’ খোশমেজাজে বলে অনন্তর দিকে ঘুরে দাঁড়াল লরেলি। ‘দোকানের ব্যাপারটা শুনেছি, খুবই দুঃখজনক। আঙ্কেল-আন্টিকে আজ ফোন করব।’

‘ধন্যবাদ, লরেলি। তারা খুশি হবে…

এসময় কোঁচকানো সুট পরা এক লোকের আগমনে বাধা পেল অনন্ত।

‘লরেলি,’ বলল সে, ‘জার্নাল পত্রিকার এক ফটোগ্রাফার এসেছেন। তুমি কি তাঁর জন্যে পোজ দিতে পারবে?’

‘নিশ্চয়ই।’ অন্যদের দিকে চাইল লরেলি। ‘ইনি মিস্টার হাটন। আমার ম্যানেজার।’

‘হাই দেয়ার।’ ওদের উদ্দেশে ছোট্ট নড করে, লরেলির দিকে ফিরল লোকটা। ‘এসো, বাছা। আমাদের প্রচার দরকার। প্রচারেই প্রসার। সামাজিকতা পরেও করা যাবে।

ওরা হাঁটা দিতেই হাতঘড়ি দেখল রাজন।

‘হায়, হায়, দুপুর হয়ে গেছে! এখুনি তো নাটক শুরু হবে। সামান্থা আর রবার্ট আজ উকিলের কাছ থেকে চাচার সম্পত্তির ব্যাপারে জানবে। আজকের শো মিস করা যাবে না কিছুতেই।’

কিশোরের সঙ্গে ওয়াটারফ্লাইডে যাওয়ার পরিকল্পনা করার পর দোকানের উদ্দেশে রওনা হলো অনন্ত। টিনা রেইলিঙের ওপর ঝুঁকে ফিগার স্কেটারদের দেখছে, এসময় কিশোর ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল ওর উদ্দেশে।

‘মনের কথাটা কী?’

‘মানে?’

‘তুমি কোন ব্যাপারে উত্তেজিত। পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’

‘ঠিক ধরেছ! শুক্রবারে আমার ডেট আছে। ছেলেটার নাম ক্লিফ। লরেলি পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।’

‘তোমরা কোথায় যাবে ঠিক করেছ?’

‘গ্যালাক্সিল্যাণ্ডে।’

‘ছেলেটা কেমন?’

‘চিন্তা কোরো না, কোন সমস্যা হবে না।’

‘আমি আর রাজন পাহারাদার হিসেবে থাকব?’

‘না!!’

হেসে উঠে, কিশোর পিরানহা দেখার প্রস্তাব করল। খোদাই করা আপার রেইলিঙের পাশ বরাবর হেঁটে অতিকায় অ্যাকুয়ারিয়ামটার কাছে গেল ওরা, সবুজ ফার্নের ভেতরে যেখানে সাঁতরাচ্ছে হিংস্র মাছগুলো। কাঁচে নাক ঠেকাতেই দুঃসাহসী কিশোরের দিকে পাল্টা চাইল ছোট-ছোট, কঠিন মুখগুলো।

‘আমি ভয় পাই না,’ ঘোষণা করল ও।

‘ওখানে কী লিখেছে আগে পড়ো, বলল টিনা। ‘সাবধান! রক্ত দেখলেই খিদেয় উন্মত্ত হয়ে ওঠে পিরানহা।’

‘এবার ভয় পাচ্ছি।’

‘এই কাঁচে ভাল প্রতিফলন হয়। একজন এইমাত্র আমাদের ছবি নিল।’

উল্টো ঘুরতেই, চশমা পরা এক লোককে দ্রুত হেঁটে যেতে দেখল কিশোর। তার বেল্টের সঙ্গে চামড়ার এক থলে ঝুলছে।

‘ওটায় নিশ্চয়ই ক্যামেরা রাখে?’

মাথা ঝাঁকাল টিনা।

‘হ্যাঁ,’ চাইল কিশোরের দিকে। ‘ফলো করবে ওকে? লোকটা আগেও আমাদের ওপর নজর রাখছিল আর কী সব যেন টুকছিল। এবং আমি শিয়োর ওকে এর আগেও কোথাও দেখেছি।’

‘তাহলে…’ কথা শেষ হলো না কিশোরের।

বিরতি নিল ও, হকচকিয়ে গেছে। বাজনা থেমে গেছে আচমকা এবং রিঙ্কের চারপাশের স্পিকারগুলো এখন নিঃশব্দ। এবার এক জরুরী কণ্ঠে ঘোষণা এল: ‘কোড রেড, কোড রেড।’