বিপদসঙ্কেত – ৫

পাঁচ

সামান্য বিরতি নিয়ে ঘোষণাটা পুনরাবৃত্তি করা হলো, তবে এবার এক দোকানের নাম সহ: কোড রেড, ফুল ফ্যাদম ডাউন

‘জায়গাটা কাছেই,’ বলল টিনা, দ্রুত চোখ বোলাল ওর ম্যাপে। ‘চলো, যাই!’ জরুরী কণ্ঠে বলল।

মল ভেদ করে ওদেরকে প্রাণপণে দৌড়তে দেখল লোকজন, জানে না সর্বোচ্চ বিপদসঙ্কেতের গোপন বার্তাই ওদের এমন ঊর্ধ্বগতিতে ছোটার কারণ। ফুল ফ্যাদম ডাউন-এর উদ্দেশে ধেয়ে যাচ্ছে ওরা। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একই মুহূর্তে ওখানে পৌঁছে রীতিমত অবাক হয়ে গেল কিশোর আর টিনা, ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগল ইতোমধ্যেই দোকানের ভেতরে।

‘আরেকটা বোমা পাওয়া গেছে,’ বললেন তিনি। ‘তোমার বাবা ব্যাপারটা দেখছেন।’ শেষের কথাগুলো টিনাকে উদ্দেশ্য করে।

‘আমরা থাকতে পারি?’ সিকিউরিটি গার্ডদেরকে এলাকাটা খালি করতে দেখে বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন ইন্সপেক্টর।

‘আমরা এখানে লোকজনের ভিড় চাই না, তবে মিস্টার টার্নার বলেছেন এই বোমাটাও ফাটাবার জন্যে পাতা হয়নি।’

‘তারমানে প্রথমটার মত এটার তারও খোলা ছিল?’

ওপরে-নিচে মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর।

‘এটা মল-এর জন্যে নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ, তবে এখনও পর্যন্ত কেউ আহত হয়নি এটাই আশার কথা।’

‘আপনি আর বাবা এত জলদি এখানে পৌঁছলেন কীভাবে?’ টিনা শুধাল।

‘আমরা এই করিডরের দোকানদারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম, ঠিক তখনই চেঁচামেচির শব্দ পাই।’ দোকানের পেছনে, চেয়ারে হতভম্বের মতন বসে থাকা লোকটির দিকে চকিতে চাইলেন। ত্রিশের আশপাশে বয়স মানুষটির, মোটা নাক আর মাথায় পাতলা হয়ে আসা বাদামি চুল। ঘটনার আকস্মিকতায় মুখের চেহারা রং হারিয়েছে। ওনার নাম লুইস প্যাটেন, দোকানের সেল্স্ অ্যাসিস্টেন্ট। উনি বোমাটা দেখে দৌড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যান, তারপর চিৎকার করে মানুষকে সাবধান করতে থাকেন।

দোকানের চারপাশের দেয়াল জুড়ে ফেস মাস্ক, ফ্লিপার্স, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক আর অন্যান্য স্কুবা গিয়ারের ডিসপ্লে। এক পোস্টারে ইয়ট থেকে ডাইভারদের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অপরূপ সুন্দর কোন সাগরে ঝাঁপানোর দৃশ্য, আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে মল-এর নিজস্ব ইনডোর সাগরের ডকে বসে রয়েছে কয়েকজন মানুষ। কিশোর আর টিনা ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দোকানে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তিনি ওদেরকে বললেন, ‘লুইস প্যাটেন পেছনের স্টোরেজ এরিয়ায় বোমাটা খুঁজে পান। অপরাধী হয় রাতেই প্ল্যান্ট করেছে ওটা আর নয়তো আজ সকালে দোকান খোলার কিছুক্ষণ পরে।’

‘তাহলে ওঁর দেখার কথা না?’

‘কোন কিছুর ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে এলে দেখবে কীভাবে?’

বিশৃঙ্খল স্টোরেজ রুমটিতে দেয়ালের এক ভেণ্ট গলে শীতের বাতাস বইছে, এবং বিশাল বিশাল তাকগুলো সব কার্টন আর স্কুবা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। মি. টার্নার একরত্তি ওয়াশরুমটার কাছে দাঁড়িয়ে, ওখানে সিঙ্কের নিচে একটা প্যাকেজ দেখা যাচ্ছে।

‘লাল তারটাই যা বলার বলে দিচ্ছে,’ বললেন তিনি। ‘এক্সপ্লোসিভগুলো ওই অ্যালার্ম ঘড়িটার সাথে কানেক্টেড, ঠিক দুপুরে চালু হয়ে ওগুলোকে বিস্ফোরিত করার কথা ওটার। তবে এবারও ইচ্ছে করেই জোড়া হয়নি লাল তারটা, যার ফলে বোমা ফাটারও সুযোগ নেই। ‘

‘আঙ্কেল, বোমাবাজ কি ভুলে গেছিল তারটা জুড়তে?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘না, না। এ লোক এক্সপার্ট।’

একপাশে স্টাফদের বিশ্রামের জায়গা; সেদিকে চাইল কিশোর, ত্রিশ-বত্রিশ বছরের সুদর্শন এক লোক এক চেয়ারে বসা, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং আর মাথায় সোনালী চুল তার।

‘আমার নাম গর্ডন ব্যাগলি,’ কিশোরকে বলল সে। ‘আমি ফুল ফ্যাদম ডাউন-এর ম্যানেজার। তোমার আঙ্কেলের কাছে শুনলাম তুমি নাকি অনেক রহস্যের সমাধান করেছ। এবারও করবে আশা করি।’

ধন্যবাদ, মিস্টার ব্যাগলি। আমরা…’

‘আমাকে গর্ডন বলে ডেকো।’

‘আপনার দোকানে বোমা এল কীভাবে কোন ধারণা আছে?’

‘সম্ভবত পেছন দরজা দিয়ে। ডেলিভারি নেয়া হয় যে সার্ভিস করিডরটাতে সেটার লাগোয়া ওটা। কিন্তু গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত তালা মারা ছিল দরজাটা।’

টিনার দিকে চট করে চাইতেই কিশোর দেখল রূপবান লোকটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ও। মাথা নেড়ে, প্রশ্ন করল কিশোর, ‘আর সিলিঙের টালি? বোমাবাজ ওখান থেকে দোকানে নামেনি তো?’

গর্ডন জবাব দেয়ার আগেই দোরগোড়ায় উদয় হলো এক মহিলা। বয়স চব্বিশের মত; কালো চোখজোড়া আর সিল্কের পোশাকটার সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে ঘন কালো চুল। আঙুলগুলোয় শোভা পাচ্ছে সোনার অলঙ্কার, গলা আর কানজোড়াও বাদ যায়নি। ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগলের উদ্দেশে ডান হাত বাড়াল সে।

‘আমি এলিস কুপার, এই দোকানের মালিক।’ এবার গর্ডনের দিকে চেয়ে শুধাল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু মনটা খারাপ। এধরনের ঘটনা মল-এর জন্যে ক্ষতিকর। লোকজন এখানে আসা বন্ধ করে দিলে এতগুলো মানুষ আমরা চলব কী করে?’

‘বাবা এ অবস্থা চলতে দেবে না-রহস্যটার সমাধান যাতে হয় অবশ্যই সে ব্যবস্থা করবে।’ ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগলের উদ্দেশে চাইল এলিস। ‘এই মল-এ আমার বাবার অনেকগুলো দোকান আছে।’

‘আমি জানি। এডমনটনে সবার মুখে একই কথা-তিনি দোকানগুলো কিনতে আর সাজাতে কী পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন।’

‘ওগুলো তার টাকা নয়।’

‘মানে?’

মুহূর্তের দ্বিধার পর শ্রাগ করল এলিস।

‘ব্যাপারটা গোপন কিছু নয়। বছর দুয়েক আগে বাবা ছুটি কাটাতে স্যান ডিয়েগোতে যায়। ওখানে এক ধনী মহিলার সাথে পরিচয় হয় তার। স্থানীয় আরেক লোকের সাথে সম্পর্ক ছিল মহিলার, কিন্তু লোকটা ছিল গির্জার ইঁদুরের মতই হদ্দ গরীব। বাবার দামি-দামি উপহারের সাথে পেরে ওঠেনি বেচারা। মহিলা শীঘ্রিই ওই লোককে ছ্যাঁক দেয় আর আমার কপালে আচমকাই জুটে যায় এক সा।’

‘মহিলা আপনার বাবাকে বিয়ে করেছেন বলছেন?’

‘হ্যাঁ।’ শ্রাগ করল এলিস। কিন্তু মহিলাকে আমি বলতে গেলে চিনিই না। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। উনি প্লেনে চড়তে ভয় পান, তাই এডমনটনে কখনও আসেননি। বাবা মাঝেমধ্যে দেখা করতে যায়, তবে এটাকে তো আর সুখের সংসার বলা যায় না, তাই না?’

‘আপনার বাবা স্ত্রীর টাকায় মল-এ এতগুলো দোকান দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। বাবার চিরকালই স্বপ্ন ছিল সুপারমলে ব্যবসা করবে।’ চারধারে নজর বুলিয়ে স্কুবা গিয়ারগুলো দেখল ও। ‘বাবাই আমাকে এ দোকানটা করে দিয়েছে। আমাকে খুশি করার জন্যেই, আমার ধারণা। ক্ষতে মলম দেয়া আরকী।’

মি. টার্নার চাইলেন এলিসের দিকে।

‘এধরনের জিনিসপত্র চলে এখানে? ক্রেতা আছে এসবের?’

‘আছে তো। দোকান খোলার আগে আমাদের স্কুবা ক্লাব রোজ সকালে ইনডোর সাগরে ডাইভ দেয়। তাছাড়া, আলবার্টায় তেলের টাকার ছড়াছড়ি। স্থানীয় অনেক বড়লোকই দুনিয়ার স্কুবা ক্যাপিটালগুলোতে ছুটি কাটাতে যায়। তারা আমার কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কেনে। গর্ডনের দিকে চাইল ও। ‘এই লোকের কল্যাণেই ব্যবসা জমে উঠেছে আমার। এই খেলার আগাগোড়া জানা আছে তার।‘

ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগল তাকালেন গর্ডনের দিকে।

‘এখানে কতদিন কাজ করছেন আপনি?’

‘এই… এলিস দোকান খোলার পর থেকেই, তা প্রায় মাস চারেক। এডমনটনে এসেছিলাম ইনডোর সি-তে ডাইভ দিতে, তারপর সিদ্ধান্ত নিই থেকে যাব এখানেই। মল-এ আসা ভিজিটরদের গাইডের কাজ পাই আমি, পরে এলিসের সাথে পরিচয় হলে আমাকে ওর দোকানের ম্যানেজারের চাকরি দেয়।’ ইন্সপেক্টরের দিকে চাইল সে। ‘বোমাবাজটাকে যেভাবে হোক ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। ওকে একবার বাগে পেলে হয়!’

‘নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না, মিস্টার ব্যাগলি, ‘ ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগল যে তথ্যগুলো এতক্ষণ ধরে টুকেছেন, সেগুলোয় এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। ‘লুইস প্যাটেনের ব্যাপারে যা জানেন বলুন।’

‘ সে মাত্র মাসখানেক হয় জয়েন করেছে,’ এলিস জবাব দিল। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে বলতে পারেন। ভবঘুরে কিসিমের লোক, তবে দুর্দান্ত ডাইভার। তার কথাকে যথেষ্ট সম্মান দেয় কাস্টোমাররা।’

‘আচ্ছা, একটা কথা মাথায় এল, এলিসকে বলল কিশোর। ‘বোমাবাজ হয়তো কোন কারণে আপনার বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায়। হয়তো ভাবছে দোকানগুলোকে লস করিয়ে তাঁর ব্যবসা লাটে তুলবে।’

‘না। ব্যাঙ্কে আমার স্যার অনেক টাকা। তাছাড়া, কেউ আমার বাবার ক্ষতি করতে চাইবেই বা কেন?’

‘আমি নিশ্চিত নই। হয়তো…’

এসময় দোরগোড়ায় বিশালদেহী এক লোকের আবির্ভাব হতেই বাধা পড়ল কিশোরের কথায়। তার একমাথা ঘন সাদা চুল, ঝোপাল ভ্রূর নিচে তীব্র একজোড়া চোখ আর তামাটে গায়ের চামড়া দৃষ্টি কেড়ে নিল ওর। দীর্ঘকায় মানুষটির মাথায় দামি কাউবয় হ্যাট এবং পরনে নিখুঁত মাপের, সুদক্ষ দর্জির হাতে তৈরি পরিপাটী থ্রি-পিস সুট। আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট তার পোশাক-আশাকে।

নীরবতা ভাঙলেন ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগল।

‘ইনি এলিসের বাবা, রোনাল্ড কুপার।’

মি. কুপার তাঁর কাউবয় বুটের সোলে ঘষে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে, চুরুট ধরালেন। বোমাটা এক নজর দেখার পর তদন্তের খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন, এবার চুরুটের ধোঁয়ায় অন্যদের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গত বছর এই মল- এ নব্বই লাখ মানুষ ভিজিট করেছে। গতকালের কথা বহু মানুষ জানে, আজকের ঘটনাটাও জানবে আরও অনেকে। জানেনই তো মানুষ কত সহজে ভয় পেয়ে যায়। বোমাবাজটাকে শীঘ্রি পাকড়ান, ইন্সপেক্টর, নইলে আগামী বছর হয়তো নব্বইজনও আসবে না এখানে। এলিসের দিকে ফিরলেন তিনি। ‘তুই কিছু সেল্স্ সাইন ঝোলা। ব্যবসা এখন নির্ঘাত মন্দা যাবে, আমরা যদি কোন চেষ্টা না করি।’

‘ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, বাবা। আমার দোকান আমি বুঝব কী করব না করব।’

‘দোকানটা আমার টাকায় কেনা এবং লাভের মুখও দেখেছে আমার পরামর্শ মেনেই।’

‘তাহলে তুমিই চালাও না দোকান! আমি ক্যারিবিয়ানে ডাইভিঙে ফিরে যাই। কয়েকটা দোকানের মালিক হয়ে তুমি বদলে গেছ, বাবা। তুমি একটা সাম্রাজ্য গড়তে চাইছ, অন্য কোন কিছুকেই আর তোয়াক্কা করছ না।’

বলিষ্ঠ গড়নের লোকটি জবাব না দিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিস। এবার কিশোর আর টিনার দিকে চাইল।

‘তোমরা কখনও স্কুবা ট্রাই করেছ?’

মাথা ঝাঁকাল টিনা

‘হ্যাঁ, আমাদের দু’জনেরই সার্টিফিকেট আছে। আপনার ক্লাবের সাথে ডাইভিং করা যাবে?’

‘হয়তো।’ এক তাক থেকে এক স্পিয়ারগান তুলে নিল ‘ভাবছিলাম এমন কিছুর খোঁজেই বুঝি মার্কেটে এসেছ তোমরা। তোমাদেরকে বিশেষ ছাড় দেব, কিনবে?’

শিউরে উঠল টিনা।

‘আমরা স্পিয়ারগান ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছি, তবে জিনিসটা আমার ভয়ানক অপছন্দ।’

‘কী বল!’ অবাক কণ্ঠে বলে এক কার্টনের দিকে লক্ষ্যস্থির করার ভঙ্গি করল এলিস। ‘আমার তো ভীষণ ভাল লাগে।’ স্পিয়ারগানটা নামিয়ে রেখে, ডিসপ্লে এরিয়ায় গিয়ে ঢুকল ও, সবাইকে পেছনে নিয়ে। ইতোমধ্যে আরও পুলিস অফিসার পৌঁছেছেন এবং তাঁরা লুইস প্যাটেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, লোকটি গোমড়ামুখে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে মেঝের দিকে।

ইন্সপেক্টর উইন্টার ঈগলকে দেখে এক অফিসার বললেন, ‘এই লোক কোন সহযোগিতা করছে না।’

‘কেন করব?’ বিড়বিড় করে আওড়াল লুইস। ‘আমি তো কোন আইন ভাঙিনি।’

গর্ডন এগিয়ে এল।

‘আমাদের দোকানে একটা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। আমি চাই আপনি অফিসারদের হেল্প করুন।

তীব্র ঘৃণার চোখে তার উদ্দেশে এক ঝলক চাইল লুইস।

‘সারাদিন আমাকে আপনার অর্ডার শুনতে হয়, কিন্তু এবার আর নয়।’

লালচে আভা ফুটল গর্ডনের মুখের চেহারায়।

‘ওঁরা যা জানতে চাইছেন তার জবাব দিন।’

‘একবার তো যা বলার বলেছিই তাদেরকে। এক কথা ক’বার বলব?’

গর্ডনের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে চাইল কিশোর, এবার উল্টো ঘুরল দরজার উদ্দেশে, দেখল বছর বিশেকের এক তরুণী এক নিরাপত্তাকর্মীর পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।

‘আমার বয়ফ্রেণ্ড আছে এখানে! ও মারা যেতে পারত!’ ছিপছিপে তরুণীটি এবার দশাসই গার্ডকে ঠেলে সরিয়ে সবাইকে অবাক করে দিল এবং দৌড়ে এল গর্ডনকে আলিঙ্গন করতে।

‘ওহ, গর্ডন,’ ফোঁপাচ্ছে সে, অশ্রুমাখা গাল দু’খানি চিকচিক করছে। ‘কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম! কাজে যাওয়ার পথে গাড়ির রেডিয়োতে খবরটা শুনি। তারপর থেকেই মাথাটা যে কেমন করছিল!’

আলতো করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, মেয়েটির দিকে চোখ নামিয়ে চেয়ে স্মিত হাসল গর্ডন।

‘চিন্তার কিছু নেই, শান্ত হও।’ এবার অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, এ আমার বান্ধবী লিডিয়া ডি ভেগা। মল-এর ডলফিন ট্রেইনারদের একজন।’

এতক্ষণ চোখ সরু করে লিডিয়াকে দেখছিল এলিস। এবার মুখ খুলল, ‘কাজে আবারও লেট? বাবার উচিত তোমাকে ছাড়িয়ে দেয়া।’

মি. কুপার মাথা নাড়লেন।

‘ও এত চমৎকার ডলফিন শো দেখায়, বললেই তো আর হুট করে ছাঁটাই করা যায় না। তবে আমার মেয়ের কথায় যুক্তি আছে, লিডিয়া। দেরি করলে কেন?’

‘ঘুম ভাঙতে দেরি হলো যে।’

মাথা নাড়ল এলিস।

‘আজকালকার দিনে সিনসিয়ার কর্মচারী পাওয়া বড়ই কঠিন। আমি যদি…’

‘শুনুন, ভদ্রমহিলা, ক্রুদ্ধস্বরে বাধা দিল লিডিয়া। ‘এধরনের আরেকটা বাজে মন্তব্য করলে কিন্তু পস্তাবেন বলে দিচ্ছি!’ গর্ডনকে সরে যেতে দিয়ে, দরজা অবধি হেঁটে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মাপছে এলিসকে। ‘আরেকটা কথা: আমার মানুষটার দিকে নজর দিলে কিন্তু ভাল হবে না।’

লিডিয়া দুপদাপ পা ফেলে বেরিয়ে যেতেই, টিনা অনুসরণ করল ওকে। আরও ক’মিনিট দোকানটিতে রইল কিশোর, তারপর মল-এ গেল টিনার খোঁজে। দেখা যখন হলো, টিনা মিটিমিটি হাসছে।

‘বলো তো কী?’

‘গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য পেয়েছ?’

‘না। ডলফিন শো-র ব্যাকস্টেজ দেখার চান্স। লিডিয়া ডি ভেগা ওখানকার ট্রেইনার এবং আমি এইমাত্র স্পেশাল ট্যুরের পারমিশন পেয়েছি। শুধু তা-ই নয়, ও স্কুবা ক্লাবেও আছে আর আমাদেরকে কাল সকালে ডাইভিঙের আমন্ত্রণও জানিয়েছে। আমরা ক্লাবের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারব।’

‘বলো কী! অ্যাই, লিডিয়া আর এলিসের ব্যাপারটা আসলে কী বলো তো? দু’জনেই কি ওরা গর্ডনকে ভালবাসে?’

‘দেখেশুনে তো তা-ই মনে হচ্ছে। দু’জনের মধ্যে মারাত্মক রেষারেষি, তাই না?’

‘হুম। ওদের দেখা হলেই যেন বারুদ জ্বলবে।’

.

পরদিন কাঁটায়-কাঁটায় সকাল সাতটায় ছোট্ট এক ডকে দাঁড়িয়ে তখন কিশোর আর টিনা। অনেক ওপর থেকে কোমল সূর্যকিরণ পড়েছে সান্তা মারিয়া-র পালে এবং সুনীল, শীতল জলরাশি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদেরকে। লিডিয়া ডি ভেগা যখন যন্ত্রপাতি গোছগাছ করে অন্যান্য ক্লাব সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, টিনা সার্ফেসের নিচে প্রবাল আর নকল কাঁকড়াগুলো খুঁটিয়ে দেখল।

‘এই মল-এর ডিজাইনারকে পুরস্কার দেয়া উচিত। সব কিছু এত নিখুঁত, মনে হয় জলজ্যান্ত! ওই মূর্তিগুলো আর মাটির কারুকাজের তুলনা নেই। আটলান্টিস কি সত্যিই ছিল? আপনার কী ধারণা?’

‘সত্যিই যদি থাকতও, দুর্ভাগা মানুষগুলোর কথা ভাবলে খারাপ লাগে, যখন ডুবে যায় ওটা,’ জবাবে বলল লিডিয়া। ‘তবে আমাদের আশপাশের মানুষগুলোও তো ভাল নেই। বোমাবাজটাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করা গেলেই হয়।’

‘এলিসের বাবাকে তো তেমন চিন্তিত মনে হলো না।’

‘হয়তো তা-ই। উনি খুবই আত্মবিশ্বাসী মানুষ কিনা।’ হাতঘড়ি দেখল লিডিয়া। ‘মিস্টার কৃপার আর এলিস ঠিক সোয়া সাতটায় আসবে। উনি খুবই গোছানো স্বভাবের মানুষ আর এলিস বাপের পুরোপুরি কব্জায়।’

যথাসময়ে পৌঁছল বাপ-বেটি। কুশল বিনিময়ের পরে, দু’জনে নিঃশব্দে তৈরি হলো এবং ঝাঁপাল পানির তলায়। এরপর উদয় হলো লুইস প্যাটেন, সঙ্গে গর্ডন। লিডিয়াকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো খেল দোকান ম্যানেজার।

‘আমি নিজেই খানিক তদন্ত করেছি। হয়তো পুলিসের আগেই বোমাবাজটাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।’

‘ওহ, গর্ডন, সাবধানে থেকো, প্লিজ! তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে!’

গর্ডন আর লুইস প্যাটেন টুপ করে সাগরে পড়ার পর পানির ওপাশে চাইল টিনা।

‘হাঙরগুলো ক্ষুধার্ত হয়ে আছে আজ সকালে। টের পাচ্ছি আমি।’

মৃদু হাসল লিডিয়া।

‘ডাইভ দিতে ভয় পাচ্ছ?’

‘তা নয়।’

কিশোর আর টিনা অপেক্ষা করল লিডিয়ার থাম্‌স্-আপ সঙ্কেতের জন্য। এবার ওরা নিস্তব্ধ স্বর্গে প্রবেশ করতে পানিতে ঝাঁপাল, এবড়োখেবড়ো পাথর আঁকড়ে থাকা তারা মাছের পাশে জলরাজ্যে যেখানে দুলছে সবুজ গাছপালা। কিশোর হাত নেড়ে টিনাকে ডাকল, পাথরের মাঝে পড়ে থাকা পোর্সেলিনের এক ভাস দেখাল তর্জনী তাক করে। ওটার কাছেই অতিকায় টেম্পল ডগদের মূর্তি, আটলান্টিসের হারানো ঐশ্বর্য অতন্ত্র পাহারা দিচ্ছে। কিশোর আর টিনা ধীরে-ধীরে সাঁতরাচ্ছে ভগ্নস্তূপের মাঝে, এবার বালুময় তলদেশে পড়ে থাকা গুপ্তধনের এক সিন্দুক পরখ করতে গেল। তন্তুর মত মৃদু দোলায়মান সামুদ্রিক উদ্ভিদ আর ধারাল প্রবালের টুকরোর পাশ দিয়ে সাঁতরে গেল ওরা, পরমুহূর্তে সভয়ে শ্বাস চাপল কিশোর।

সোজা ওর দিকেই তেড়ে আসছে এক হাঙর, আঘাত হানতে প্রস্তুত।

মরিয়া হয়ে, অসহায়ের মত আত্মরক্ষার জন্য হাতজোড়া তুলল কিশোর। কিন্তু হিংস্র প্রাণীটা ট্যাঙ্কের কাঁচের দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে সরে গেল, ওটার গায়ের গাঢ় চামড়ার প্রতিটা দাগ-ভাঁজ কাছ থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল কিশোর। ঘুরে চাইতেই মাস্কের ভেতরে টিনার বিস্ফারিত চোখজোড়া দেখল ও। হাত নেড়ে, সবাইকে পেছনে নিয়ে হাঙরদের ফেলে সান্তা মারিয়া-র উদ্দেশে চলল টিনা। কাঁচের এক দেয়াল ভেদ করে ওরা এক বিরাট গ্রুপার আর ট্যাঙ্কের অন্যান্য মাছ দেখল, এবার সাঁতরে চলল স্টার্ন অভিমুখে। শক্তিশালী এক সামুদ্রিক সাপের সঙ্গে কোন ধরনের এক জলজ সরীসৃপের প্রাগৈতিহাসিক মরণপণ লড়াইয়ের বাস্তবানুগ মডেল ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওখানে।

একটু পরে, কিশোর আর টিনা যখন সাঁতরাচ্ছে এক ডুবো ভগ্নস্তূপের পোলিন্দর উদ্দেশে, ওটার ছায়া ফুঁড়ে বেরিয়ে এল স্কুবা গিয়ার পরা এক মূর্তি এবং সাগরপৃষ্ঠের দিকে দ্রুত উঠে যেতে লাগল, পেছনে রেখে গেল অগুনতি ভুড়ভুড়ি।